মংলা বন্দর সচল করার উদ্যোগ



অনেকটা পিছিয়ে পড়া মংলা বন্দরে নতুনভাবে প্রাণসঞ্চার করতে সরকার নানা প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। সম্প্রতি বন্দরের সামগ্রিক উন্নয়নে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে।
১১ অক্টোবর এই কমিটির বিষয়ে সরকারি গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে গঠন করা এই কমিটি প্রতি তিন মাস অন্তর পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও উন্নয়নের জন্য বৈঠকে বসবে। কমিটি বন্দরের নানা বিষয়ে নিয়মিতভাবে সরকারকে পরামর্শ দেবে।
এই কমিটিতে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, সাংসদ, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা রয়েছেন।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পশুর নদীর গভীরতা বৃদ্ধি এবং মংলা বন্দরের বহির্নোঙর এলাকায় ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভারত, নেপাল ও ভুটান মংলা বন্দর ব্যবহার শুরু করলে এবং পদ্মা সেতু নির্মিত হলে কী কী হতে পারে, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে মংলা বন্দরে একটি মাল্টিপারপাস জেটি নির্মাণের প্রকল্প ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মূলত মংলা বন্দরকে দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে রূপান্তরের ব্যাপারে আগ্রহী সরকার ও প্রতিবেশী দেশগুলো।
মংলা বন্দরে ১৩১ কিলোমিটারের দীর্ঘ চ্যানেলের নাব্যতা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য আট কোটি ৮২ লাখ টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ে ‘টেকনো ইকোনমিক ফিজিবিলিটি স্টাডি ফর ইম্প্রুভমেন্ট অব নেভিগ্যাবিলিটি অব মংলা পোর্ট’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীরা আবারও মংলা বন্দরকে বেছে নিতে শুরু করেছেন।
মংলা বন্দরের সমস্যা: হিরন পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার পশুর নদীর গভীরতা কম ও সরু। এতে নির্বিঘ্নে বড় জাহাজ এখান দিয়ে বন্দরে চলাচলে অসুবিধা হয়।
বন্দর কর্তৃপক্ষের নানা সূত্র থেকে জানা গেছে, ২০০১ সালের পর পশুর নদী খননের জন্য ড্রেজিং বাবদ কোনো বড় অঙ্কের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য মংলা বন্দরে ব্যবহার করা বেশির ভাগ যন্ত্র তার মেয়াদকাল অতিক্রম করেছে। লোডার, হেভি ক্রেন, ফর্ক লিফট, হেভি লিফট, মাঙ্কি ক্রেন, ক্যারিয়ার—এগুলোর বেশির ভাগ প্রচলিত জীবনকাল অতিক্রম করেছে। ফলে বন্দর তার সক্ষমতার ছয় ভাগের মাত্র এক ভাগ ব্যবহার করতে পারে।
হ্রাস পেয়েছে জাহাজের যাতায়াত: ১০ বছর আগে মংলা বন্দরে যে পরিমাণ জাহাজ মালামাল নিয়ে আসত, এখন তা এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। বন্দরের হিসাবে ১৯৯৭-৯৮ সালে ৩৫৫টি জাহাজ এসেছে। এক দশক পর ২০০৭-০৮ সালে তা এসে ঠেকে ৯৫টিতে। তবে পরের বছর এর সংখ্যা কিছুটা বেড়ে ১৩৯টিতে উন্নীত হয়। আর ২০০৯-১০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস অর্থাৎ জুন থেকে ডিসেম্বর সময়ে জাহাজ ভিড়েছে মাত্র ৭৬টি।
বন্দরের মালামাল ওঠানামা করার ক্ষমতা আছে ৬৫ লাখ টন। বর্তমানে তা ১০ লাখ টনে নেমে এসেছে। অথচ এক দশক আগেও এই বন্দর দিয়ে ৩০ লাখ টন মালামাল আমদানি ও রপ্তানি হয়েছে।
বন্দরের আয়-ব্যয়: ১০ বছর আগেও মংলা বন্দর লাভজনক অবস্থায় ছিল। অর্থাৎ বন্দর থেকে যে আয় হয়, তার চেয়ে ব্যয় ছিল কম। সরকারি হিসাবে দেখা গেছে, ২০০০-০১ অর্থবছরে মংলা বন্দরের আয় ছিল ৭৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। পক্ষান্তরে ব্যয় ছিল ৫৫ কোটি চার লাখ টাকা। ফলে ওই অর্থবছরে বন্দরের মুনাফা ছিল ২০ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
বন্দরের উন্নয়নে সরকার কোনো ব্যয় না করায় একসময়ের লাভজনক বন্দর ক্রমশ লোকসানি অবস্থায় চলে যায়। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ সাত কোটি ২৮ লাখ টাকা লোকসান দেয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে আয় ও ব্যয় মোটামুটি সমান। জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালে বন্দরের মোট আয় হয়েছে ৩৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা আর ব্যয় হয়েছে ৩৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
সরকারের উদ্যোগ: মংলা বন্দর উন্নয়নে সম্ভাব্যতা যাচাইসহ নানা কাজে ইতিমধ্যে নেমে পড়েছে সরকার ও বন্দর কর্তৃপক্ষ। মংলা বন্দরের বহির্নোঙরে ড্রেজিংয়ের জন্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রস্তাবিত প্রকল্প বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনে পর্যালোচনার জন্য রয়েছে।
চলতি অর্থবছর থেকে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলে বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে।
চ্যানেলের নাব্যতা রক্ষায় নিয়মিত ড্রেজিংয়ের জন্যও কাটার সাকশন ড্রেজার ক্রয়ের জন্য প্রায় ৮৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি হয়েছে। আগামী দুই বছরে এই কাটার ড্রেজার সংগ্রহ করা হবে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে যে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে, তার ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অচিরেই বন্দরের প্রদত্ত সুবিধাদি পর্যালোচনা ও হালনাগাদ করার জন্য কী কী করা যেতে পারে, সে সম্পর্কে সুপারিশ দিতে।
বন্দরের সামগ্রিক কার্যক্রমের উন্নয়নে সরকারি সার্কুলার, আইন ও বিধি সুপারিশের বিষয় থাকলেও কমিটিকে সে ব্যাপারে মতামত দিতে বলা হয়েছে।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান কিছুদিন আগে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মংলা বন্দরের ক্ষমতার তুলনায় বেশির ভাগ অংশই অব্যবহূত থাকে। বিগত সরকারের আমলে বন্দরের উন্নয়নে কোনো বিনিয়োগ হয়নি। যন্ত্রপাতি পুরোনো হয়ে গেছে। আবার ড্রেজিং না করার কারণে পশুর চ্যানেলের নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুনভাবে মংলা বন্দরকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেগুলো নিয়ে বর্তমান কাজ চলছে। আশা করি, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মংলা দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে রূপান্তর হবে।’

No comments

Powered by Blogger.