নারীর সন্তুষ্টি অর্জিত হতে আরও সময় লাগবে -সরকারের প্রথম বছর by ফরিদা আখতার
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ২০০৯ সালে যে কটি বিষয় খুবই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়েছিল, তার মধ্যে কৃষি, বাজারব্যবস্থা বা দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও স্বাস্থ্য উল্লেখযোগ্য। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় (২০০৭-২০০৮) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষের একেবারে দম বের হওয়ার দশা হয়েছিল। তাই নতুন সরকার আসার পর এসব দিকে স্বাভাবিক কারণেই পরিবর্তন সবাই আশা করছিল। অবস্থার কিছুটা উন্নতিও হয়েছে অবশ্যই। এভাবে দেখতে দেখতে এবং অবস্থা পরিবর্তনের আশা করতে করতে আমাদের দিন কেটেছে।
তবে আমি আজ নারীদের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়েই লিখছি; কারণ, এবারের নির্বাচনের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, সাধারণ আসনে ১৯ জন নারী জয়ী হয়ে এসেছেন। সংরক্ষিত আসন ছাড়াও এবার জাতীয় সংসদে নারীর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু তাহলেও কি আমরা খুব এগিয়েছি? এ প্রশ্ন উঠছে। অবশ্য ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ১৯টি আসনে নারী রয়েছেন, এটাকে আমরা বেশি বলিই বা কী করে। আনুপাতিক হারে তা মাত্র ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তাহলে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে এখনো পথ হাঁটতে হবে। এত তাড়াতাড়ি খুশি হলে এগোতে পারব না, খরগোশের দৌড়ের মতো কাছিমের কাছে হারতে হবে।
নারীদের সার্বিক পরিস্থিতি বর্ণনা করলে দেখা যায়, নির্যাতন কমেনি, বরং কোথাও বেড়েছে—এমন তথ্য তুলে ধরে পত্রিকাগুলো বড় শিরোনাম করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে আমার মন্তব্য হচ্ছে, নারী নির্যাতন সংখ্যায় কমেছে কি বেড়েছে, সরকারের কাজের মূল্যায়নের জন্য এটাই একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না। আমাদের দেখতে হবে, যদি নির্যাতনের ঘটনা একটিও ঘটে থাকে, সে ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে? ক্ষমতাসীন দলের কেউ নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত কি না, থাকলে তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না? দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নারী হওয়া সত্ত্বেও নারী নির্যাতন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তাঁকে আমরা সক্রিয় দেখিনি। হয়তো তিনি উত্কণ্ঠিত হয়েছেন, কিন্তু তাঁকে সক্রিয় না দেখে হতাশ হয়েছি। ক্ষমতাসীন দলের সদস্য; বিশেষ করে, ছাত্রলীগের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতনের যে ঘটনা ঘটেছে, সেখানেও সরকারকে প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। কাজেই নির্যাতন প্রতিরোধের উদ্যোগে সরকার সফল হয়নি, এটা অবশ্যই বলা যায়। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি এবং অন্য দলও উল্লেখযোগ্যভাবে কোনো প্রতিবাদ করেনি। সে ক্ষেত্রে সরকারের মতো তারা বিফল হয়েছে।
মহাজোট সরকারে নারী দৃশ্যমান এবং প্রভাবশালী অবস্থানে আছেন বলে ধারণা করা হয়। এমন কিছু বোঝানোর জন্যই সম্ভবত প্রথম আলোতে একটি কার্টুন প্রকাশ করা হয়েছে বছরের প্রথম দিনের সংখ্যায়। ক্ষমতাসীন দলের তিনজন ‘প্রভাবশালী’ নারী শেখ হাসিনা, সাহারা খাতুন এবং দীপু মনি একই দোলনায় দুলছেন, প্রধানমন্ত্রীর হাতে তিনটা তাসের ‘টেক্কা’। ক্ষমতা বোঝানোর জন্য এই তিনটি কার্ড যথেষ্ট। অন্যদিকে বিরোধী দলে একা বেগম খালেদা জিয়া একটি ছোট টুলে দাঁড়ানো, নড়চড় নেই (দেখুন প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি, ২০১০)। তাঁর দলে নারীদের উল্লেখযোগ্য পদে দেখা গেলেও তাদের খুব আওয়াজ শুনি না। যেমন, সেলিমা রহমান এবং বেগম সারওয়ারী রহমান সব সময় দলের উল্লেখযোগ্য পদে থাকেন। এমনকি দলের দুঃসময়ে শত চাপের মুখেও তাঁরা দলের সঙ্গে থেকেছেন। কিন্তু কার্টুনে খালেদা জিয়াকে একা দেখানো হয়েছে। হাতে কোনো কার্ড নেই। সে যা-ই হোক, এই কার্টুন অনেক কথা বলছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলে যদি নারীরা গুরুত্বপূর্ণ পদে যেমন—স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ে আছেন বলে সব সময় তুলে ধরা হচ্ছে, কিন্তু কার্টুনে মতিয়া চৌধুরী নেই কেন? এটাও চোখে পড়ার বিষয়। একই সঙ্গে ২০০৯ সালে রাজনীতিতে নারীর সাফল্য দেখাতে গিয়ে প্রথম আলোর নারীমঞ্চ, ইত্তেফাক-এর মহিলা অঙ্গনসহ বিভিন্ন পত্রিকায় সাহারা খাতুন ও দীপু মনির কথা আসছে। এখানেও মতিয়া চৌধুরী নেই, মন্নুজান সুফিয়ানের কথাও নেই। মতিয়া চৌধুরী তাঁর কৃষি মন্ত্রণালয়ে সফল হয়েছেন বলে জনমত জরিপেও এসেছে। তবুও তিনি অনুপস্থিত কেন? এদিকে যাঁকে মোটেও তুলে ধরা হচ্ছে না, তিনি হচ্ছেন বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। সত্যি বলতে কি, বেগম মন্নুজান সুফিয়ান শ্রমবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ার পর তিনি যেন নাই হয়ে গেছেন। তাঁকে কদাচিত্ মিডিয়ায় দেখা যায়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মন্ত্রিপরিষদের সভায় এদিক-ওদিক ক্যামেরা ঘুরলে তাঁকে হালকাভাবে দেখা যায়। তখন বুঝতে পারি, তিনি এখনো ওই পদে আছেন। শ্রমিকদের ব্যাপারে এত কথা হয়, কিন্তু মন্নুজান সুফিয়ানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। নতুন সরকারে নতুন মুখ দিয়ে গড়া মন্ত্রিপরিষদে বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের থাকাটাও নিশ্চয়ই একটা ইতিবাচক অর্জন ছিল, কিন্তু কেন যে এটা এখন তুলে ধরা হচ্ছে না, তা বুঝতে পারলাম না। তিনি তো সাধারণ আসনেই নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। নারীদের মধ্যেই কি একটু বৈষম্য হয়ে যায় না? নারী পাতাগুলোও কি তাঁকে ভুলে গেছে?
এদিকে রাজনৈতিকভাবে নারীদের ক্ষমতাহীন করার নজির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০০৯ সালে। যেমন—সংরক্ষিত আসনে ৪৫ জন নারীকে পরোক্ষ নির্বাচনে সংসদ সদস্য করা হয়েছে, কিন্তু তাঁরা আজও কোনো নির্বাচনী এলাকা পাননি। তাঁরা কাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তা-ই তাঁরা জানেন না। নিজেদের কোনো এলাকাও নেই। আবার নারীদের প্রতিনিধিত্ব করার প্রশ্নও আসছে না, কারণ, তাঁরা জনগণের ভোট; বিশেষ করে, নারীদের ভোট নিয়ে সংসদে যাননি। তাঁরা যাঁদের করুণা নিয়ে সংসদে গেছেন, তাঁরাই (সেই পুরুষ সাংসদেরাই) তাঁদের ক্ষমতাহীন করে রেখে দিয়েছেন। সংরক্ষিত আসনে বসে এত ক্ষমতাহীন ও পরিচয়হীন হয়ে থাকতে এর আগে কখনো দেখা যায়নি। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হলো ঘটা করে। অনেক নারী সরাসরি ভোটে জিতে এসেছেন, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন। কিন্তু পুরো উপজেলা পরিষদই এখন ক্ষমতাহীন হয়ে বসে আছে।
সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে যে এত নারী মন্ত্রী রয়েছেন, এত নারী সাধারণ আসনে নির্বাচিত হয়েছেন, নারী হুইপও হয়েছেন; কিন্তু গত এক বছরে নারী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়নি। আজও দেখলাম না, তাঁরা আন্তর্জাতিক নারী দিবস, রোকেয়া দিবস কিংবা নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে দলমত-নির্বিশেষে নারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। হয়তো তাঁরা বলবেন, তাঁরা নারী হিসেবে নন, মানুষ হিসেবে নিজেদের দেখছেন, তাই আলাদা করে নারীদের সঙ্গে বসার প্রয়োজন তাঁদের নেই। তাঁরা এখন ‘মানুষদের সঙ্গে কাজ করেন (অর্থাত্ নারী-পুরুষ উভয়ের সঙ্গে)। মেনে নিলাম, কিন্তু যে নারী আন্দোলন তাঁদের এই ‘মানুষ’ হওয়ার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে, তাকে ভুলে গেলে তো চলবে না। আমরা আগে তাঁদের নারীদের মাঝে দেখেছি, নারী আন্দোলনেও তাঁরা ছিলেন। কিন্তু এখন হঠাত্ মানুষ হয়ে গেলে তো নারীদের প্রতি অবহেলা হয়ে যায়। আশা করি, বিষয়টি তাঁরা অনুধাবন করবেন।
নতুন সরকারের প্রথম বছর গেছে, দ্বিতীয় বছরে আমরা দেখতে চাই অবস্থার গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে কি না। আমাদের চোখ, কান খোলা থাকছে ভালো কিছু দেখা এবং শোনার জন্য।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
তবে আমি আজ নারীদের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়েই লিখছি; কারণ, এবারের নির্বাচনের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, সাধারণ আসনে ১৯ জন নারী জয়ী হয়ে এসেছেন। সংরক্ষিত আসন ছাড়াও এবার জাতীয় সংসদে নারীর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু তাহলেও কি আমরা খুব এগিয়েছি? এ প্রশ্ন উঠছে। অবশ্য ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ১৯টি আসনে নারী রয়েছেন, এটাকে আমরা বেশি বলিই বা কী করে। আনুপাতিক হারে তা মাত্র ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তাহলে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে এখনো পথ হাঁটতে হবে। এত তাড়াতাড়ি খুশি হলে এগোতে পারব না, খরগোশের দৌড়ের মতো কাছিমের কাছে হারতে হবে।
নারীদের সার্বিক পরিস্থিতি বর্ণনা করলে দেখা যায়, নির্যাতন কমেনি, বরং কোথাও বেড়েছে—এমন তথ্য তুলে ধরে পত্রিকাগুলো বড় শিরোনাম করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে আমার মন্তব্য হচ্ছে, নারী নির্যাতন সংখ্যায় কমেছে কি বেড়েছে, সরকারের কাজের মূল্যায়নের জন্য এটাই একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না। আমাদের দেখতে হবে, যদি নির্যাতনের ঘটনা একটিও ঘটে থাকে, সে ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে? ক্ষমতাসীন দলের কেউ নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত কি না, থাকলে তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না? দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নারী হওয়া সত্ত্বেও নারী নির্যাতন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তাঁকে আমরা সক্রিয় দেখিনি। হয়তো তিনি উত্কণ্ঠিত হয়েছেন, কিন্তু তাঁকে সক্রিয় না দেখে হতাশ হয়েছি। ক্ষমতাসীন দলের সদস্য; বিশেষ করে, ছাত্রলীগের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতনের যে ঘটনা ঘটেছে, সেখানেও সরকারকে প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। কাজেই নির্যাতন প্রতিরোধের উদ্যোগে সরকার সফল হয়নি, এটা অবশ্যই বলা যায়। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি এবং অন্য দলও উল্লেখযোগ্যভাবে কোনো প্রতিবাদ করেনি। সে ক্ষেত্রে সরকারের মতো তারা বিফল হয়েছে।
মহাজোট সরকারে নারী দৃশ্যমান এবং প্রভাবশালী অবস্থানে আছেন বলে ধারণা করা হয়। এমন কিছু বোঝানোর জন্যই সম্ভবত প্রথম আলোতে একটি কার্টুন প্রকাশ করা হয়েছে বছরের প্রথম দিনের সংখ্যায়। ক্ষমতাসীন দলের তিনজন ‘প্রভাবশালী’ নারী শেখ হাসিনা, সাহারা খাতুন এবং দীপু মনি একই দোলনায় দুলছেন, প্রধানমন্ত্রীর হাতে তিনটা তাসের ‘টেক্কা’। ক্ষমতা বোঝানোর জন্য এই তিনটি কার্ড যথেষ্ট। অন্যদিকে বিরোধী দলে একা বেগম খালেদা জিয়া একটি ছোট টুলে দাঁড়ানো, নড়চড় নেই (দেখুন প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি, ২০১০)। তাঁর দলে নারীদের উল্লেখযোগ্য পদে দেখা গেলেও তাদের খুব আওয়াজ শুনি না। যেমন, সেলিমা রহমান এবং বেগম সারওয়ারী রহমান সব সময় দলের উল্লেখযোগ্য পদে থাকেন। এমনকি দলের দুঃসময়ে শত চাপের মুখেও তাঁরা দলের সঙ্গে থেকেছেন। কিন্তু কার্টুনে খালেদা জিয়াকে একা দেখানো হয়েছে। হাতে কোনো কার্ড নেই। সে যা-ই হোক, এই কার্টুন অনেক কথা বলছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলে যদি নারীরা গুরুত্বপূর্ণ পদে যেমন—স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ে আছেন বলে সব সময় তুলে ধরা হচ্ছে, কিন্তু কার্টুনে মতিয়া চৌধুরী নেই কেন? এটাও চোখে পড়ার বিষয়। একই সঙ্গে ২০০৯ সালে রাজনীতিতে নারীর সাফল্য দেখাতে গিয়ে প্রথম আলোর নারীমঞ্চ, ইত্তেফাক-এর মহিলা অঙ্গনসহ বিভিন্ন পত্রিকায় সাহারা খাতুন ও দীপু মনির কথা আসছে। এখানেও মতিয়া চৌধুরী নেই, মন্নুজান সুফিয়ানের কথাও নেই। মতিয়া চৌধুরী তাঁর কৃষি মন্ত্রণালয়ে সফল হয়েছেন বলে জনমত জরিপেও এসেছে। তবুও তিনি অনুপস্থিত কেন? এদিকে যাঁকে মোটেও তুলে ধরা হচ্ছে না, তিনি হচ্ছেন বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। সত্যি বলতে কি, বেগম মন্নুজান সুফিয়ান শ্রমবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ার পর তিনি যেন নাই হয়ে গেছেন। তাঁকে কদাচিত্ মিডিয়ায় দেখা যায়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মন্ত্রিপরিষদের সভায় এদিক-ওদিক ক্যামেরা ঘুরলে তাঁকে হালকাভাবে দেখা যায়। তখন বুঝতে পারি, তিনি এখনো ওই পদে আছেন। শ্রমিকদের ব্যাপারে এত কথা হয়, কিন্তু মন্নুজান সুফিয়ানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। নতুন সরকারে নতুন মুখ দিয়ে গড়া মন্ত্রিপরিষদে বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের থাকাটাও নিশ্চয়ই একটা ইতিবাচক অর্জন ছিল, কিন্তু কেন যে এটা এখন তুলে ধরা হচ্ছে না, তা বুঝতে পারলাম না। তিনি তো সাধারণ আসনেই নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। নারীদের মধ্যেই কি একটু বৈষম্য হয়ে যায় না? নারী পাতাগুলোও কি তাঁকে ভুলে গেছে?
এদিকে রাজনৈতিকভাবে নারীদের ক্ষমতাহীন করার নজির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০০৯ সালে। যেমন—সংরক্ষিত আসনে ৪৫ জন নারীকে পরোক্ষ নির্বাচনে সংসদ সদস্য করা হয়েছে, কিন্তু তাঁরা আজও কোনো নির্বাচনী এলাকা পাননি। তাঁরা কাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তা-ই তাঁরা জানেন না। নিজেদের কোনো এলাকাও নেই। আবার নারীদের প্রতিনিধিত্ব করার প্রশ্নও আসছে না, কারণ, তাঁরা জনগণের ভোট; বিশেষ করে, নারীদের ভোট নিয়ে সংসদে যাননি। তাঁরা যাঁদের করুণা নিয়ে সংসদে গেছেন, তাঁরাই (সেই পুরুষ সাংসদেরাই) তাঁদের ক্ষমতাহীন করে রেখে দিয়েছেন। সংরক্ষিত আসনে বসে এত ক্ষমতাহীন ও পরিচয়হীন হয়ে থাকতে এর আগে কখনো দেখা যায়নি। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হলো ঘটা করে। অনেক নারী সরাসরি ভোটে জিতে এসেছেন, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন। কিন্তু পুরো উপজেলা পরিষদই এখন ক্ষমতাহীন হয়ে বসে আছে।
সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে যে এত নারী মন্ত্রী রয়েছেন, এত নারী সাধারণ আসনে নির্বাচিত হয়েছেন, নারী হুইপও হয়েছেন; কিন্তু গত এক বছরে নারী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়নি। আজও দেখলাম না, তাঁরা আন্তর্জাতিক নারী দিবস, রোকেয়া দিবস কিংবা নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে দলমত-নির্বিশেষে নারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। হয়তো তাঁরা বলবেন, তাঁরা নারী হিসেবে নন, মানুষ হিসেবে নিজেদের দেখছেন, তাই আলাদা করে নারীদের সঙ্গে বসার প্রয়োজন তাঁদের নেই। তাঁরা এখন ‘মানুষদের সঙ্গে কাজ করেন (অর্থাত্ নারী-পুরুষ উভয়ের সঙ্গে)। মেনে নিলাম, কিন্তু যে নারী আন্দোলন তাঁদের এই ‘মানুষ’ হওয়ার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে, তাকে ভুলে গেলে তো চলবে না। আমরা আগে তাঁদের নারীদের মাঝে দেখেছি, নারী আন্দোলনেও তাঁরা ছিলেন। কিন্তু এখন হঠাত্ মানুষ হয়ে গেলে তো নারীদের প্রতি অবহেলা হয়ে যায়। আশা করি, বিষয়টি তাঁরা অনুধাবন করবেন।
নতুন সরকারের প্রথম বছর গেছে, দ্বিতীয় বছরে আমরা দেখতে চাই অবস্থার গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে কি না। আমাদের চোখ, কান খোলা থাকছে ভালো কিছু দেখা এবং শোনার জন্য।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
No comments