এবার বিএনপি নেতাদের দখলে আলোচিত সেই খাল by সুদীপ অধিকারী
সরজমিন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সাদেক এগ্রোর স্থাপনা ভেঙে উদ্ধার করা রামচন্দ্রপুর খালের সেই জায়গা আবার দখলে নেয়া হয়েছে। টিনের ছাউনি ও বেড়া দিয়ে সেখানে বানানো হয়েছে ছোট বড় একাধিক ঘর। রয়েছে রিকশার গ্যারেজ। যেখানে অন্তত ৪০/৫০টা রিকশা সব সময় রেখে দেয়া হয়েছে। আছে চায়ের দোকানও। আর যেখানে সাদেক এগ্রোর ফার্ম ছিল ঠিক সেখানেই নির্মাণ করা হচ্ছে লাল ইটের পাকা ঘর। টিনের ঘরগুলোর মধ্যে আবার একাধিক কেরামবোর্ড খেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রয়েছে পরিত্যক্ত গানের স্কুল। যার জানালা, আসবাবপত্র আগেই লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বর্তমানে ঘরটুকু ব্যবহার করছে ট্রাকচালকরা। আর এর সামনেই গাবতলী-সদরঘাট সড়কের পাশে খালের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল ট্রাকস্ট্যান্ড। ওই স্ট্যান্ডের মধ্যে সারি সারিভাবে পার্ক করা রয়েছে অসংখ্য পণ্য বহনকারী ট্রাক। চলছে ট্রাক মেরামতের কাজও। চারদিকে পাকা দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা ওই ট্রাকস্ট্যান্ডের দেখভালের জন্য রাখা হয়েছে নিরাপত্তা প্রহরী।
মহসিন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, গত কোরবানি ঈদের সময় একটি ছাগল কেনা নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মো. মতিউর রহমানের ছেলের দামি ঘড়ি, গাড়ি, আলিশান জীবনযাপন, মতিউর রহমান ও পরিবারের সদস্যদের নামে রিসোর্ট, শুটিং স্পট, বাংলো বাড়ি, জমিসহ নামে-বেনামে সম্পত্তি থাকার বিষয়ে একের পর এক খবর প্রকাশিত হতে থাকে। এরই একপর্যায়ে ২৭শে জুন রামচন্দ্রপুর খালের বেদখলে থাকা ওই জায়গা উদ্ধারে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ। সেদিনের অভিযানে আলোচিত সাদিক অ্যাগ্রোর অবৈধ অংশ ভেঙে দেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খামারের পেছনে খালের জায়গায় থাকা অবৈধ কিছু টিনের ঘর ও রিকশার গ্যারেজও উচ্ছেদ করা হয়েছিল। ডিএনসিসি’র অঞ্চল-৫-এর তৎকালীন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতাকাব্বীর আহমেদ এবং ডিএনসিসি’র সম্পত্তি কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুব হাসানের নেতৃত্বে উদ্ধার অভিযান শেষে তখন খাল খননের কাজও শুরু করা হয়। কিন্তু গত ৫ই আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই আবারো দখল হতে শুরু করেছে এই খালের জমি। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরের দিন বিকালেই একদল লোক ওই জায়গায় ঘর বানানোর কাজ শুরু করেন। রাতের মধ্যেই বাঁশের অবকাঠামো দিয়ে টিনের দুটি ছাপরা ঘর তৈরি করে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি’র সাতমসজিদ হাউজিং ইউনিটের নামে ব্যানার টাঙিয়ে দেয়া হয়। কয়েকদিনের মধ্যেই পুরো জায়গা দখল করে একাধিক ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। চায়ের দোকান, পাকা ঘর, রিকশার গ্যারেজ, ট্রাকস্ট্যান্ড, স্কুল কী নেই এই খালের জায়গায়। নতুন করে আবার বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে নতুন নতুন জায়গা। মূলত ওয়ার্ড বিএনপি’র নেতারা এই সরকারি জায়গাগুলো নিজেদের দখল করে ঘর তৈরি করে মানুষের কাছে ভাড়া দিচ্ছেন। আর এসব দেখাশোনার জন্য বেশকিছু যুবক রেখে দেয়া হয়েছে। পুরো নিয়ন্ত্রণ তাদেরই হাতে। তারা সার্বক্ষণিক এখানে থেকে পাহারা দেয়। এরা সকলেই ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলামের লোক। তার ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। তিনি ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতিকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি হয়েও বীরদর্পে ঘুরে বেরাচ্ছেন।
মো. ইয়াসিন মোল্ল্যা নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, একসময় এই খালটি অনেক সুন্দর ছিল। গভীর ছিল। প্রচুর পানি ছিল। নদীর সঙ্গে সংযোগ থাকায় মানুষ দৈনন্দিন কাজ এখানেই সারতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন খালটি দখল হতে হতে মৃতপ্রায়। খালের জায়গা দখল করে পাকা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল ট্রাকস্ট্যান্ড। মেইন রোডের সঙ্গে পাকা দেয়াল দিয়ে সরকারি জায়গা ঘিরে রাখলেও যেন দেখার কেউ নেই। সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চুপ। আর এর সুযোগ নিয়ে বিএনপি’র নাম ভাঙিয়ে সব দখল হয়ে যাচ্ছে। যেন দেখার কেউ নেই। আমরা চাই খালটি আবার গভীরভাবে খনন করা হোক।
খালের জায়গা নিজের লোক দিয়ে দখলের বিষয়ে ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম মানবজমিন’কে বলেন, রাজনৈতিক বিরোধিতার জেরেই আমার প্রতিপক্ষ আমার নামে এসব মিথ্যা কথা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আমি কোনো খালের জায়গা দখল করিনি। আমি বরং খালের জায়গা দখলমুক্ত করতে আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দদের নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এই জায়গা মূলত মোহাম্মদপুর থানার ৩৩নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি মান্নান হোসেন শাহীনের লোকজন দখল করে ঘর নির্মাণ ও রিকশার গ্যারেজ তৈরি করেছেন। আর সুরের ধারা স্কুলের পেছনে টিনের ঘর তৈরি করে কেরামবোর্ড ও মাদকের আসর বসিয়েছে ওয়ার্ড যুবদল নেতা জাহিদ মোড়ল। জাহিদ তার লোকদের দিয়ে সেখানে মাদক বিক্রি করছেন। আগে যেখানে সাদেক এগ্রো ছিল সেখানে সাতমসজিদ হাউজিং এর সহ-সভাপতি রশিদ মাস্টার ভুয়া দলিল তৈরি করে তার ভাগ্নে আলিমকে দিয়ে পাকা ঘর নির্মাণ করেছে। ওই পাকা ঘরের পাশে টিনের ঘর তৈরি করেও মাসে ২০ হাজার টাকা ভাড়া আদায় করছেন। তাদের এসব কাজে বাধা দেয়ায় আমার নামে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।
এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ৩৩নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি মান্নান হোসেন শাহীন বলেন, এইসব দখলদারি ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কথা বলায় আমার অফিসে ঢুকে আমাকে কুপিয়ে আহত করা হয়েছে। আহত অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে হাসপাতালে লড়াই করার পর এখন বাড়িতে রেস্টে রয়েছি। এখনো দুটো অপারেশন বাকি। পুরোপুরি সুস্থ হতে পারিনি। সকলে জানে আমার বিষয়ে। আমি খালের জমি দখল করবো কীভাবে? যারা আমার নামে এই অভিযোগ তুলেছে তারা নিজেরাই ওই সরকারি জমি লোক দিয়ে ভোগদখল করে খাচ্ছে। আর অন্যের নামে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।
এদিকে খালের জায়গায় তৈরি কার ট্রাকস্ট্যান্ডের দায়িত্বে থাকা আন্তঃজেলা ট্রাক-মিনি ট্রাকচালক সমিতির সভাপতি নসু মিয়া ও আকবর হোসেন বলেন, আমাদের ট্রাকগুলো রাখার জায়গা নেই বলেই খালের জায়গা ভরাট করে আমরা ট্রাকস্ট্যান্ড তৈরি করেছি। যদি সরকার কখনো আমাদের চলে যেতে বলে আমরা তখন জায়গা ছেড়ে দিবো।
No comments