আইজিপি’র ক্ষমা প্রার্থনা ও আত্ম-সমীক্ষা by শহীদুল্লাহ ফরায়জী
উপলব্ধি থেকে এবং বিবেকের অন্তর্নিহিত তাড়না থেকে ক্ষমা প্রার্থনা বা আত্ম-সমীক্ষা ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য স্পষ্ট করবে। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন বিষয়টিকে আরও সঙ্গতিপূর্ণ করে তুলবে। ফলে পুলিশ বাহিনীর অমানবিক সংস্কৃতির পরিবর্তে মানবিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে। পুলিশ বাহিনী অগৌরবের কলঙ্ক থেকে গৌরবে ফিরে আসবে। ক্রমাগতই আমাদের আত্ম-সমীক্ষার বিস্তৃতি ঘটাতে হবে। আমরা গত ১৫ বছর দেখেছি সরকার কর্তৃক সকল হত্যাকাণ্ডের বৈধতা দিতে। প্রকাশ্যে মিছিলে বা জনসমাবেশে গুলি করে হত্যা, পুলিশ হেফাজতে হত্যা, বন্দুক যুদ্ধের নামে হত্যা, ক্রস ফায়ারের নামে হত্যা, নির্বিচারে মানুষ হত্যাই ছিল সরকারের মৌলিক কাজ। কারণ হত্যা না করলে, শত্রুকে নিধন না করলে, নির্মূল না করলে রাজত্ব হুমকিতে পড়ে। ফ্যাসিবাদের বিরোধিতাকারীরা সরকারের কাছে ছিল দেশের শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু, সন্ত্রাসী ও নাশকতাকারী। সুতরাং হাসিনার নির্দেশে পুলিশ, র?্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, ডিবি, সিআইডি, বিজেপি- যারাই রাষ্ট্রের সশস্ত্র শক্তি, তারাই মানুষ হত্যাকে পশু হত্যার সমকক্ষ করে ফেলেছিল। শেখ হাসিনা সরকার যে বয়ানের উৎপাদন করেছিল তা হচ্ছে - যারা সরকারের বিরোধিতা করে তারা স্বাধীনতা বিরোধী, চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী, সন্ত্রাসী এবং জঙ্গি। এরা অধম পশুর চেয়েও নিম্নে। ফলে উন্নয়নের জন্য, অগ্রগতির জন্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্য, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিম্নমানের অধমদের হত্যা করা কোনো অন্যায় নয় বরং ন্যায়সঙ্গত। সরকারের এই ভয়ঙ্কর বয়ানে রাষ্ট্রের কয়েকটা শৃঙ্খলা বাহিনী নিষ্ঠুর এবং কসাই বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। ফলে যে যত দ্রুত হত্যা করতে পারতো, হত্যার পর সরকারবিরোধী চক্রান্ত বা নাশকতার নাটক করতে পারতো, সে তত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতো এবং প্রমোশন ও ভালো পদায়ন নিশ্চিত হতো।
মেজর সিনহাকে যে ওসি প্রদীপ খুন করেছিল এর পূর্বে সে আরও শতাধিক হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিল। এই শতাধিক হত্যাকাণ্ডের রেকর্ড পুলিশ সদরদপ্তরে জমা হওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাকে পুলিশ পদকের জন্য কয়েকবার মনোনয়ন করে এবং ওসি প্রদীপের পুলিশ পদক নিশ্চিত হয়। শেখ হাসিনা ‘মানুষ হত্যা’কে পুলিশের গুণ এবং দক্ষতা হিসেবে বিবেচনা করেছে। বিরোধীদলের নেতাকর্মীকে হত্যা এবং নির্বাচনে প্রতারণাপূর্ণ কর্মকাণ্ড দিয়ে নৌকার প্রার্থীকে জয়লাভ করানোর বিষয়ে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (এসিআর) উল্লেখ থাকার রীতি চালু হয়েছিল। এসব বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন দেখে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন পদে পদায়ন করা হতো! রক্তের বিনিময়ে অর্জিত একটি রাষ্ট্রকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল!
ছাত্র-জনতা আবার বুকের রক্ত দিয়ে দেশকে রাহমুক্ত করেছে। বাংলাদেশের একজন আইজিপি এই প্রথম স্বীকার করেছেন- পুলিশের বাড়াবাড়িতে মায়ের বুক খালি হয়েছে, নাগরিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। সত্যকে আড়াল করার, নিষ্ঠুরতাকে বৈধ করার- অতীতের কোনো প্রচেষ্টা কোনো আইজিপি সাহেব গ্রহণ করেননি। রাষ্ট্রের নাগরিক অর্থাৎ রাষ্ট্রের মালিকানার অধিকারী যিনি, তাকে বিনা বিচারে হত্যা করে, হত্যার স্বপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করার ভয়ঙ্কর সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা তিনি অব্যাহত রাখেননি। হত্যার স্বপক্ষে মিথ্যা বা বানোয়াট নাটকের কুশীলবের ভূমিকা গ্রহণ না করে, সত্য এবং নৈতিকতার সুউচ্চ স্তম্ভে একজন আইজিপি’র অবস্থান গ্রহণ করা- নিঃসন্দেহে জাতীয় রাজনীতিতে নতুন পাঠ হিসেবে পর্যালোচনা করতে হবে।
রাষ্ট্র যে মিথ্যার কারখানা নয়, রাষ্ট্র যে কসাইয়ের পাটাতন নয়, রাষ্ট্র যে মিথ্যার মঞ্চ নয়, তা হাসিনা বুঝতে না পারলেও নতুন বাংলাদেশের শাসকদের বা রাষ্ট্রযন্ত্রে জড়িতদের বুঝতে হবে। রাজপথে, রাজনীতির ময়দানে, সমাবেশে, মিছিলে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবি উঠছে, ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা বিলোপের লক্ষ্যে বজ্র-কঠিন স্লোগান হচ্ছে। লাখ লাখ তরুণ-তরুণী ছাত্র-ছাত্রীদের উষ্ণ রক্তে ও শিরায় শিরায় মাতম উঠেছে নিপীড়নমূলক রাষ্ট্র উচ্ছেদের জন্য। আজ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজপথে বিদ্রোহের আগ্নেয়গিরি জ্বলে উঠেছে, আমাদের বিবেকের মশালে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সে মশাল জ্বলতে শুরু করেছে দিগন্ত জোড়া অন্ধকারকে আলোকিত করার প্রক্রিয়া হিসেবে। এখন মানুষ আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে- শোষণ ও নিপীড়নের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য। প্রশ্ন থাকবে, বিতর্ক থাকবে, দ্বিমত থাকবে, থাকবে বিরোধ কিন্তু মানুষের মহিমাকে ক্ষুণ্ন করার কোনো প্রচেষ্টা কারো থাকবে না। প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যকে ক্ষুণ্ন করার, জনগণের মালিকানা কেড়ে নেয়ার কোনো দূরভিসন্ধি থাকবে না, গণতন্ত্রকে হত্যা করে ক্ষমতা দখলের কোনো অভিপ্রায় থাকবে না। রাষ্ট্র পরিচালিত হবে নাগরিকের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও চাওয়া-পাওয়ার উপর।
অতীতের পুলিশ এবং গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী পুলিশ এই দুইয়ের মাঝে বড় পার্থক্য থাকতে হবে, মৌলিক পার্থক্য। আগের পুলিশ মনে করতো জনগণ ক্রীতদাস এখন মনে করবে জনগণের মালিকানায় এই রাষ্ট্র। ফ্যাসিবাদী আমলে সরকার হয়ে উঠতো জনগণের ঊর্ধ্বে ঐশ্বরিক মহিমার সমতুল্য। কিন্তু এখন সরকার হবে জনগণের। আগে সরকার হতো ‘ক্ষমতা’ ও ‘প্রভুত্বের’ কেন্দ্রবিন্দু, এখন সরকার হবে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কেন্দ্র। প্রজাতন্ত্রে প্রভুত্ববাদিতার কোনো স্থান নেই। হাসিনা সরকার রক্ষা করতে গিয়ে প্রভুত্ববাদিতা এবং দখলদারিত্ব প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, জীবন এবং অধিকার, সাম্য সব উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। অতীতের লুণ্ঠনজীবী, অতিরিক্ত বল প্রয়োগকারীর নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটাতে হবে। এতে প্রভুত্ববাদ বা বল প্রয়োগ করে হবে না। সরকার গঠিত হবে জনগণের বিবেক নিঃসৃত সম্মতি প্রদানের মাধ্যমে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার উচ্ছেদ হবে গণতন্ত্রয়ানের মাধ্যমে- ডিটেক্টরশীপ বা জোর জবরদস্তির মাধ্যমে নয়।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতেই আইজিপি সাহেব সত্যকে স্বীকার করেছেন, ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। অন্যায় মিথ্যা লালন করলে মানুষ তার আপনসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং সামগ্রিকভাবে শৃঙ্খলিত দাসে পরিণত হয়, জীবন-যাপনের নৈতিক সক্ষমতা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনো প্রতিষ্ঠানের দুর্বৃত্তপনা এককভাবে বা যৌথভাবে বহু মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। সুতরাং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ন্যায্যতার সূত্রে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। প্রশাসন এবং পুলিশ বাহিনীকে গঠন পুনর্গঠন করা প্রশ্নটি এখন খুব জরুরি।
সামাজিক ব্যবস্থা এবং সামাজিক উপলব্ধিগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো স্থাপন করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের যেমন যথেষ্ট জ্ঞানভিত্তিও দরকার, তেমনি মানবিক ও সহানুভূতিশীল যুক্তি প্রয়োগের দ্বারা পরিচালনা করা নিশ্চিত করতে হবে। নতুন আইজিপি সাহেবের মতো সত্য স্বীকার করে এবং আত্ম-সমালোচনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে সর্বক্ষেত্রে। সমাজের সর্বক্ষেত্রে ন্যায্যতার সমবণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের রাষ্ট্রের মূল দর্শন- সাম্য মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচারকে ধারাবাহিকভাবে এবং অগ্রাধিকারভিত্তিক দৃশ্যপটে নিয়ে আসতে হবে। এই ত্রয়ী আদর্শ যেন সমাজ ও রাষ্ট্রের পরতে পরতে উন্মোচিত হয়। আমাদের অন্যায় আচরণের মিথ্যা অহমিকা, ভাগাড়ম্বর, দুর্নীতি ও চৌর্যবৃত্তির উৎসগুলোর অনুসন্ধান করতে হবে। রাজনৈতিক দর্শনে বা রাষ্ট্র পরিচালনার প্রক্রিয়ায় নৈতিক ও ন্যায্যতার প্রয়োগের জন্য নতুন ডিসকোর্স এবং নতুন পদ্ধতি বা নতুন ব্যবস্থা (পড়সঢ়ষবঃব ড়ৎফবৎরহম) লাগবে। প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার নতুন নকশার উদ্ভাবন করতে হবে। অতীতে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে প্রকট অন্যায়ে আমাদের জর্জরিত করেছিল, রিমান্ড এবং আয়না ঘরে জীবনের মহিমাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল তা থেকে পরিত্রাণের উপায় এখনই শুরু করতে হবে বা শুরু হয়েছে। আইজিপি হিসেবে বাহারুল আলমের সত্যের প্রতি আনুগত্য ও ক্ষমা প্রার্থনায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মহাপরিচালকও ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং আয়না ঘরের অবস্থানের কথা স্বীকার করেছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনারও ভুল-ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। রাজনীতি ও সামাজিক জীবনের সকল ক্ষেত্রেই নৈতিকতার জন্য জায়গা বরাদ্দ রাখতে হবে।
পুলিশ বাহিনীতে এ চর্চা শুরু হয়েছে, সমাপ্তি যেন না হয়। ফ্যাসিবাদের শাসনামলে এসব ছিল কল্পনারও অতীত।
যারা রাষ্ট্রের গোপন বন্দিশালা নির্মাণ করেছিলেন তাদের সবাইকে আইনের আওতায় এনে অনুতাপ এবং জবাবদিহিতার প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করতে হবে। সংস্কৃতিরও রূপান্তর ঘটাতে হবে। সামাজিক ব্যবস্থাপনার সংশোধন প্রক্রিয়াও শুরু করতে হবে। ন্যায্যতার পরিধিকে বিস্তৃত করতে হবে। আমাদের উপলব্ধি, মূল্যবোধ নির্ধারণে ও মূল্যায়নে ন্যায্যতার হাজির রাখা জরুরি। আমরা নিজেদের দ্বারা নিজেদের প্রয়োজনে এবং নিজেদের জন্য ন্যায্যতাকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাবো।
ক্ষমতার মানদণ্ডে বিবেকের দংশন বা আত্মদহন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আইজিপি সাহেবের নৈতিক ভাবনা ও ক্ষমতার কর্তব্য দায় রাষ্ট্রের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হতে পারে।
লেখক : গীতিকবি
faraizees@gmail.com
No comments