অপহৃত হয়েছিলেন মিসবাহ, মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার by ওয়েছ খছরু

সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে অপহৃত হয়েছিলেন এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। অপহরণকালেই তাকে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। এতে তার পা ও হাত ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। এরপর অজ্ঞাত স্থানে রেখেই মিসবাহ সিরাজের ফোন থেকে স্ত্রী ও কন্যাকে ফোন দিয়ে মুক্তিপণ হিসেবে কোটি টাকা চাওয়া হয়। তিন ঘণ্টা দরকষাকষির পর ভোর রাতে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে জীবিত ছাড়া পান মিসবাহ সিরাজ। ততক্ষণে শরীরে রক্তক্ষরণে তিনি বার বার সংজ্ঞা হারাচ্ছিলেন। তাকে এই অপহরণ, কোপানো এবং মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় সিলেট জুড়ে তোলপাড় চলছে। তবে নিশ্চুপ মিসবাহ পরিবার। রহস্য উদ্‌ঘাটনে পুলিশও তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। তবে পুলিশ ও গোয়েন্দারা ছায়া তদন্তে নেমে অনেক তথ্যই পেয়েছেন। এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ আওয়ামী লীগের তিনবারের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। এ ছাড়া সিলেট জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে একাধিকবার দায়িত্ব পালন করেন। ৫ই আগস্টের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পরপরই গা ঢাকা দেন মিসবাহ। এরমধ্যে তার বিরুদ্ধে সিলেটে হত্যাসহ ৭টি মামলা করা হয়। মিসবাহ সিরাজের পারিবারিক ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন- মামলা হওয়ার পর থেকে তিনি আর নগরের ফাজিলচিস্ত আবাসিক এলাকার নিজের বাসায় থাকতেন না। মাঝে মধ্যে বাসায় এলেও সুবিদবাজার এলাকার একটি বাসায় তিনি নিয়মিত বসবাস করতেন। বৃহস্পতিবার রাতে তিনি জরুরি কাজে তার ফাজিলচিস্তস্থ বাসায় এসেছিলেন। মধ্যরাতে একটি সিএনজি অটোরিকশাযোগে ফেরার পথে তার সঙ্গে ছিলেন মিজান নামের একজন রংমিস্ত্রি। মূল সড়কে আসা মাত্রই ৮-৯টি মোটরসাইকেলে আসা মুখোশধারী দলের সন্ত্রাসীরা তার সিএনজি অটোরিকশার গতিরোধ করে। এ সময় অন্য একটি সিএনজি অটোরিকশাতে তুলতে ধস্তাধস্তি করে। তিনি ওই সিএনজি অটোরিকশাতে উঠতে রাজি না হওয়ায় তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে সন্ত্রাসীরা।

একপর্যায়ে মিসবাহ সিরাজকে জোরপূর্বক অটোরিকশাতে তুলে অপহরণকারীরা অজ্ঞাতস্থানে চলে যায়। সেখান থেকে মিসবাহ সিরাজের ফোনে অপহরণকারীরা স্ত্রী ও কন্যার মোবাইল ফোনে ফোন দেয়। মিসবাহ সিরাজকে ফেরত পেতে মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করে কোটি টাকা। একইসঙ্গে বিষয়টি গোপন রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। রাত ৩টা পর্যন্ত দেন-দরবারের মাধ্যমে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের এক নেতার মধ্যস্থতায় মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের মাধ্যমে মিসবাহকে ছেড়ে দেয়া হয়। পারিবারিক ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন- রাত ৩টার পর নগরের সাগরদিঘীরপাড়ের নির্জন স্থানে অপহরণকারীরা তাকে সড়কে ফেলে চলে যায়। পরে স্ত্রী, কন্যাসহ পরিবারের সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে নগরের সুবহানীঘাটের আল হারমাইন হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেন। তারা জানিয়েছেন- উদ্ধারের সময় মিসবাহ সিরাজের শারীরিক অবস্থা গুরুতর ছিল। হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে তার শরীরে তিন ব্যাগ রক্ত পুশ করা হয়েছে। তবে চিকিৎসার পর তিনি বর্তমানে শঙ্কামুক্ত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন তারা। ঢাকায় অজ্ঞাত স্থানে রেখেই তাকে উন্নত চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় মেয়ে মুনতাহা তার পিতার জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। তবে ঘটনা কী ঘটেছে সে ব্যাপারে তিনি মুখ খুলেননি। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) মো. সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন; ঘটনাটি জানার পর সিলেট নগর পুলিশ ও গোয়েন্দার তরফ থেকে ছায়া তদন্ত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেক তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ঘটনার ভিকটিম কিংবা তার পরিবারের সদস্যদের কারোই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে অভিযোগ না পেলে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশ এলাকার সিসিটিভি’র ফুটেজ সংগ্রহসহ ভার্চ্যুয়ালিও তদন্ত করছে।

মুক্তিপণের টাকা আদান-প্রদান প্রসঙ্গে তিনি জানান- এ ব্যাপারে পুলিশও খোঁজ পেয়েছে। আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তিকে না পেলে এ ব্যাপারে কিছুই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। এরপরও পুলিশ তদন্তকাজ এগিয়ে রাখছে বলে জানান তিনি। এদিকে; মিসবাহ সিরাজের স্বজনদের সূত্র খবর হচ্ছে- মিসবাহ সিরাজকে অপহরণ করেছে সুবিদবাজার কেন্দ্রিক আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটি অপরাধী গ্রুপ। এ গ্রুপে রয়েছে সর্বদলীয় অপরাধী চক্র। ৫ই আগস্টের পর তারা নতুন করে ওই এলাকায় অবস্থান নিয়ে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। ওই গ্রুপ কয়েকদিন রেকি করার পর মিসবাহ সিরাজকে হাতের কাছে পেয়ে ঘটনা ঘটায়। অপহরণকারীদের দাবি ছিল কোটি টাকা। শেষে পরিবারের পক্ষ থেকে ২৫ লাখ টাকা প্রদানের মাধ্যমে তাকে মুক্ত করা হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে উঠে এসেছে স্থানীয় এক নেতা লল্লিক আহমদের নাম। গতকাল বিকালে এ ব্যাপারে লল্লিক আহমদের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন; এ ঘটনা সম্পর্কে তিনি অবগত নয়। পত্রিকা দেখে শুনেছেন। বিষয়টি এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের পরিবারের লোকজনই ভালো বলতে পারবেন বলে জানান তিনি। এদিকে- ঘটনার সত্যতা জানতে মিসবাহ সিরাজের মিয়া ফাজিলচিস্তর বাসায় গেলে বাসাটি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। একই এলাকায় বসবাসরত মিসবাহ সিরাজের স্বজনরা জানিয়েছেন- ঘটনার দিন রাতে অনেক ঘটনাই ঘটেছে। মুক্তিপণ দেয়া হয়েছে। কার মাধ্যমে, কীভাবে ওই টাকা দেয়া হয়েছে আর অপরাধীরা কারা সেটি ভালোই বলতে পারবেন কেবল মিসবাহ’র পরিবারের সদস্যরা। ঘটনার পর থেকে মিসবাহ’র পরিবারের আচরণে মনে করা হচ্ছে তারা আইনি লড়াইয়ে যাবেন না। মামলায় আসামি হওয়ায় উল্টো মিসবাহ সিরাজ এখন কারান্তরীণ হতে পারেন। সেই শঙ্কা থেকে তারা মুখবন্ধ করে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.