আমি মুদ্রা বলছি by হক মো. ইমদাদুল
পৃথিবীতে
সভ্যতার শিকড় গজাতেই মানুষের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু
বা বস্তুসমূহের। নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক প্রয়োজন মেটানোর সুবিধার্থে তারা
শুরু করেছিল এক বস্তুর বিনিময়ে অন্য বস্তুর আদান-প্রদান। এই আদান-প্রদানকে
বলা হতো বিনিময় প্রথা। কিন্তু এতে দেখা দিয়েছিল হাজারো রকম অসুবিধা।
এই অসুবিধা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিনিময়ের একক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছিল চা–গাছের ডাল, নারকেলের মালা, গ্রেইন ও বিশেষ কতকগুলো প্রাণীকে। পরবর্তী সময়ে মানুষ কালে কালে ভাবতে শুরু করেছিল এই প্রথার কিছুটা পরিবর্তন আনার জন্য। চিন্তাবিদদের ভাবনা সফল হলো আমার জন্মলাভের পর। আমার গায়ের রং বা আকৃতি কেমন ছিল, প্রথম অবস্থায় ঠিক আমার মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, আমার জন্ম হয়েছিল ধাতব পদার্থ দ্বারা। ছোটবেলায় কেউবা মেডেল বলে, আবার কেউবা টোকেন বলে ডাকত।
আমার মাধ্যমে শুরু হলো বিভিন্ন বস্তুর আদান-প্রদান। ফলে আমার কদর বেড়ে গেল এই পৃথিবীর মানুষগুলোর কাছে। কিছুদিন আমাকে আদর করার পর নিজের অজান্তেই মানুষের কাছে হয়ে গেলাম অনেকটা অপ্রিয়। কেন অপ্রিয়, এই প্রশ্ন করার পূর্বেই জানতে পারলাম কবে, কখন ও কোথায় আমার জন্ম। আরও জানতে পারলাম, আমার গায়ের রং বা আকৃতি এসবের মধ্যে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। ফলে মানুষগুলো ব্যর্থ হয় পরস্পর দুই দেশের মধ্যে বিনিময়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে।
মানুষের ব্যবহারের সুবিধার্থে আমাকে করা হলো প্লাস্টিক সার্জারি। আনা হলো আমার রূপের পরিবর্তন। অর্থাৎ আমার গায়ে ব্যবহার করা হলো বিভিন্ন রাজপরিবারের ছবি। চেহারা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোনো এক রাজপরিবারের নামানুসারে পুনরায় আমার নাম রাখা হলো ‘মিন্ট’। বস্তুর আপেক্ষিক চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমার আপেক্ষিক মান কমতে শুরু করে। সে জন্য তৎকালীন গ্রিক ও লাতিন বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে আমার ছোট–বড় পরিমাণগত পরিবর্তনের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ওই সময় গ্রিক দেশের লোকেরা তাদের ভাষায় ‘মিন্ট’ নামের পরিবর্তে ‘নোমিজমা’ ও লাতিনের লোকেরা তাদের ভাষায় ‘নিউমিজমা’ বলে আমাকে ডাকতে শুরু করে। ঠিক একই সময়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ‘নিউমিজম্যাটিক’ বলে ডাকতে লাগল।
যুগের পর যুগ বিভিন্ন ধাতু আমার দেহে প্রবেশ করায়, ধাতুগুলোর ওজন ও মূল্যমানের ওপর ভিত্তি করে আমার অতীতের সব কটি নাম বাদ দিয়ে পুনরায় নাম রাখা হলো ‘কয়েন’। ছোটবেলায় কয়েন শব্দের অর্থটা ঠিক বুঝতাম না। যদি সঠিক অর্থ বুঝতে পারতাম, তাহলে এই নাম রাখার সুযোগ দিতাম না পৃথিবীর মানুষগুলোকে। কেননা যৌবনকালে পদার্পণ করে জানতে পারলাম, কয়েন শব্দটি লাতিন শব্দ কিউনিয়াস থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ ডাই বা মৃত। আসলেই কি আমি মৃত? যদি–বা মৃতই হই, তবে প্রশ্ন জাগে, আমি জীবিত ছিলাম কখন ও কোথায়? জানি, পৃথিবীর মানুষগুলো এই প্রশ্নের জবাবদিহি করতে পারবে না। তাই ভাবছি, মানুষ যদি ‘মৃত’ বা ‘কয়েন’ নাম দিয়ে কিছুটা শান্তি পায় অথবা কিছুটা উপকৃত হয়, তবেই আমার জীবন হবে সার্থক।
শৈশবকালে ধাতব পদার্থের মূল্যমান দ্রুত রূপান্তরিত হওয়ায়, কোনো কোনো দেশে ধাতব পদার্থের প্রচলন বেশি দিন স্থায়ী হতো না। ফলে আমার রূপের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হতো খুবই ঘন ঘন। বোধ করি সে জন্যই হয়তো আমার নাম রাখা হয়েছিল কয়েন বা মৃত।
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে আমার দেহে ধাতব পদার্থের ব্যবহার শুরু করেছিল। ওই সময়ের ধাতব পদার্থগুলো ছিল ইলেক্ট্রাম প্রকৃতিতে প্রাপ্ত স্বর্ণ ও রৌপ্য ইত্যাদি অশোধিত খনিজ পদার্থ। জেনোফেন্স নামের এক ব্যক্তি গ্রিক দেশে ইলেক্ট্রাম প্রকৃতিতে প্রাপ্ত স্বর্ণ ও রৌপ্য আমার দেহে ব্যবহার করেন। তখন আমার দেহের আকৃতি ছিল মণ্ড বা গোল বোতামের মতো।
চীন দেশে আমার আবির্ভাব কীভাবে ঘটে, তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। তবে আমেরিকান ম্যানহাটন ব্যাংক মানি মিউজিয়ামে রক্ষিত আমার শৈশবকালের কিছু ছবি থেকে যা বোঝা যায়, তার পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা হয়, চীনে খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে বড় আকারের একধরনের ‘বেল’ আকৃতিতে আমার রূপ দেওয়া হয়েছিল। পরে বেল আকৃতির পরিবর্তে আমার রূপ দেওয়া হয় একপ্রকারের ‘চাবির’ মতো। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে চাবি আকৃতির অবসান ঘটিয়ে পুনরায় আমার রূপ দেওয়া হয় কড়ির মতো করে।
৫৬৫-৫৮৫ খ্রিষ্টপূর্বে মিসরীয় রাজা ক্রুসাসের আমলে স্বর্ণ ও রৌপ্য আমার দেহে ব্যবহারের জন্য সরকারিভাবে অনুমোদিত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংকিং প্রথা চালু হওয়ার পর আমার দেহে স্বর্ণ থাকায় আমার গুরুত্ব বেড়ে যায় অনেকাংশে এবং আমাকেই বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়। অবশ্য পরে আমার দেহের অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়।
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে রোমান দেশে প্রথম আমার দেহে ব্রোঞ্জ স্থান পায়। ২৬৮ খ্রিষ্টপূর্ব রোমানে রৌপ্য ও স্বর্ণের অনুপ্রবেশ ঘটে আমার দেহে। ওই সময়ে রোমান দেশে আমাকে ‘কনস্যুলার’ নামে অভিহিত করা হয়। ২৯ খ্রিষ্টপূর্ব রোমান সম্রাট আমার দেহে সম্রাজ্ঞী অথবা রাজ কন্যার ছবির ব্যবহার শুরু করে ছিলেন। দশম শতাব্দীতে প্রিন্সনিভ রাশিয়াতে আমার দেহে খণ্ড খণ্ড সিলভার ব্যবহার করে। তখন রাশিয়াতে আমার নাম রাখা হয়েছিল ‘ডেঞ্জি’।
জার্মানে প্রথম ক্যারোলিনজিয়ান নামক পদার্থ আমার দেহে ব্যবহার করে। পরে বারো শতাব্দীর শেষের দিকে পশ্চিম জার্মান ও কেন্দ্রীয় ইউরোপে আমার দেহে রৌপ্যের ব্যবহার শুরু করে। ১৯৩৯ সালে জার্মানে সম্রাট লুইস–চার আমার দেহে জিংক ও অ্যালুমিনিয়ামসহ আরও অন্য ধাতব পদার্থ ব্যবহার শুরু করেন।
আমার দেহে স্বর্ণ ব্যবহারের ফলে স্বর্ণের সৌন্দর্য ও মূল্যমানের আধিক্যের জন্য মানুষগুলো আমাকে তাদের নিজ নিজ ধনভান্ডারে বন্দী করতে শুরু করে এবং বাজারে আমার পদচারণ কমে যায়। ফলে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ বিনিময়–সংকট দেখা দেয়। তাই ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকায় আমার দেহে স্বর্ণ ব্যবহার বাতিল বলে ঘোষণা করে।
আজ আমার নাম ‘মুদ্রা’ বা ‘কয়েন'। আমি যে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কালে কত আদরের ছিলাম জনমনে, তার প্রমাণ বহন করে আমার পূর্বের নামগুলোতে। যেমন টোকেন, মেডেল, মিন্ট, নোমিজমা, নিউমিজমা, নিউমিজম্যাটিক, কনস্যুলার, ডেঞ্জি ও কয়েন প্রভৃতি। তবে এসব নামকরণ করা হতো অধিকাংশই তৎকালীন উচ্চ পরিবার তথা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর নামানুসারে। শেষ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান মিন্ট মাস্টার কেন্দ্রীয় অনুসন্ধান এজেন্সি নামে সর্বজনস্বীকৃত একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে আমার সার্বিক সেবার জন্য। ফলে আমার দেহের রং, রূপ, আকৃতি ইত্যাদি নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের ওপর।
প্রায় চার হাজার বছর আগে থেকেই আমার উন্নতির জন্য অর্থাৎ বিনিময় মাধ্যমের উন্নতির জন্য বিশ্বের সব জ্ঞানী গুণী ও গবেষক যুগের পর যুগ চেষ্টা করে আসছেন। কিন্তু আমার জীবন শুরু হয়েছিল সংগ্রাম দিয়ে, জীবনের অবসানও ঘটবে সংগ্রাম দিয়েই। জন্ম থেকে এ পর্যন্ত যতবার সংগ্রাম করেছি, ততবারই বিজয়পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল আমার। আজও বিজয়পতাকা নিয়ে স্থান থেকে স্থানান্তর সংগ্রাম করছি নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।
কেননা পৃথিবীর মানুষগুলো চায় না, আমি বেঁচে থাকি। যাদের সভ্যতা, জ্ঞান-বুদ্ধি, শিক্ষা, অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান ইত্যাদির ব্যবস্থা হয়েছিল আমাকে দিয়ে, আজ আমিই তাদের চোখের বালি?
আমার মন বলছে, আজকের বাংলাদেশের মতো একসময় পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই থাকবে না আমার অস্তিত্ব, পরিবেশিত হবে না আমার দেহের খাদ্য। সুতরাং, পৃথিবীর মানুষগুলোর কাছে আমি মুদ্রার একটিই প্রশ্ন, কোন অপরাধে আমি ‘মুদ্রা’ ক্রমাগত বিলুপ্তির পথে?
এই অসুবিধা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিনিময়ের একক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছিল চা–গাছের ডাল, নারকেলের মালা, গ্রেইন ও বিশেষ কতকগুলো প্রাণীকে। পরবর্তী সময়ে মানুষ কালে কালে ভাবতে শুরু করেছিল এই প্রথার কিছুটা পরিবর্তন আনার জন্য। চিন্তাবিদদের ভাবনা সফল হলো আমার জন্মলাভের পর। আমার গায়ের রং বা আকৃতি কেমন ছিল, প্রথম অবস্থায় ঠিক আমার মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, আমার জন্ম হয়েছিল ধাতব পদার্থ দ্বারা। ছোটবেলায় কেউবা মেডেল বলে, আবার কেউবা টোকেন বলে ডাকত।
আমার মাধ্যমে শুরু হলো বিভিন্ন বস্তুর আদান-প্রদান। ফলে আমার কদর বেড়ে গেল এই পৃথিবীর মানুষগুলোর কাছে। কিছুদিন আমাকে আদর করার পর নিজের অজান্তেই মানুষের কাছে হয়ে গেলাম অনেকটা অপ্রিয়। কেন অপ্রিয়, এই প্রশ্ন করার পূর্বেই জানতে পারলাম কবে, কখন ও কোথায় আমার জন্ম। আরও জানতে পারলাম, আমার গায়ের রং বা আকৃতি এসবের মধ্যে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। ফলে মানুষগুলো ব্যর্থ হয় পরস্পর দুই দেশের মধ্যে বিনিময়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে।
মানুষের ব্যবহারের সুবিধার্থে আমাকে করা হলো প্লাস্টিক সার্জারি। আনা হলো আমার রূপের পরিবর্তন। অর্থাৎ আমার গায়ে ব্যবহার করা হলো বিভিন্ন রাজপরিবারের ছবি। চেহারা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোনো এক রাজপরিবারের নামানুসারে পুনরায় আমার নাম রাখা হলো ‘মিন্ট’। বস্তুর আপেক্ষিক চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমার আপেক্ষিক মান কমতে শুরু করে। সে জন্য তৎকালীন গ্রিক ও লাতিন বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে আমার ছোট–বড় পরিমাণগত পরিবর্তনের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ওই সময় গ্রিক দেশের লোকেরা তাদের ভাষায় ‘মিন্ট’ নামের পরিবর্তে ‘নোমিজমা’ ও লাতিনের লোকেরা তাদের ভাষায় ‘নিউমিজমা’ বলে আমাকে ডাকতে শুরু করে। ঠিক একই সময়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ‘নিউমিজম্যাটিক’ বলে ডাকতে লাগল।
যুগের পর যুগ বিভিন্ন ধাতু আমার দেহে প্রবেশ করায়, ধাতুগুলোর ওজন ও মূল্যমানের ওপর ভিত্তি করে আমার অতীতের সব কটি নাম বাদ দিয়ে পুনরায় নাম রাখা হলো ‘কয়েন’। ছোটবেলায় কয়েন শব্দের অর্থটা ঠিক বুঝতাম না। যদি সঠিক অর্থ বুঝতে পারতাম, তাহলে এই নাম রাখার সুযোগ দিতাম না পৃথিবীর মানুষগুলোকে। কেননা যৌবনকালে পদার্পণ করে জানতে পারলাম, কয়েন শব্দটি লাতিন শব্দ কিউনিয়াস থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ ডাই বা মৃত। আসলেই কি আমি মৃত? যদি–বা মৃতই হই, তবে প্রশ্ন জাগে, আমি জীবিত ছিলাম কখন ও কোথায়? জানি, পৃথিবীর মানুষগুলো এই প্রশ্নের জবাবদিহি করতে পারবে না। তাই ভাবছি, মানুষ যদি ‘মৃত’ বা ‘কয়েন’ নাম দিয়ে কিছুটা শান্তি পায় অথবা কিছুটা উপকৃত হয়, তবেই আমার জীবন হবে সার্থক।
শৈশবকালে ধাতব পদার্থের মূল্যমান দ্রুত রূপান্তরিত হওয়ায়, কোনো কোনো দেশে ধাতব পদার্থের প্রচলন বেশি দিন স্থায়ী হতো না। ফলে আমার রূপের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হতো খুবই ঘন ঘন। বোধ করি সে জন্যই হয়তো আমার নাম রাখা হয়েছিল কয়েন বা মৃত।
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে আমার দেহে ধাতব পদার্থের ব্যবহার শুরু করেছিল। ওই সময়ের ধাতব পদার্থগুলো ছিল ইলেক্ট্রাম প্রকৃতিতে প্রাপ্ত স্বর্ণ ও রৌপ্য ইত্যাদি অশোধিত খনিজ পদার্থ। জেনোফেন্স নামের এক ব্যক্তি গ্রিক দেশে ইলেক্ট্রাম প্রকৃতিতে প্রাপ্ত স্বর্ণ ও রৌপ্য আমার দেহে ব্যবহার করেন। তখন আমার দেহের আকৃতি ছিল মণ্ড বা গোল বোতামের মতো।
চীন দেশে আমার আবির্ভাব কীভাবে ঘটে, তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। তবে আমেরিকান ম্যানহাটন ব্যাংক মানি মিউজিয়ামে রক্ষিত আমার শৈশবকালের কিছু ছবি থেকে যা বোঝা যায়, তার পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা হয়, চীনে খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে বড় আকারের একধরনের ‘বেল’ আকৃতিতে আমার রূপ দেওয়া হয়েছিল। পরে বেল আকৃতির পরিবর্তে আমার রূপ দেওয়া হয় একপ্রকারের ‘চাবির’ মতো। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে চাবি আকৃতির অবসান ঘটিয়ে পুনরায় আমার রূপ দেওয়া হয় কড়ির মতো করে।
৫৬৫-৫৮৫ খ্রিষ্টপূর্বে মিসরীয় রাজা ক্রুসাসের আমলে স্বর্ণ ও রৌপ্য আমার দেহে ব্যবহারের জন্য সরকারিভাবে অনুমোদিত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংকিং প্রথা চালু হওয়ার পর আমার দেহে স্বর্ণ থাকায় আমার গুরুত্ব বেড়ে যায় অনেকাংশে এবং আমাকেই বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়। অবশ্য পরে আমার দেহের অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়।
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে রোমান দেশে প্রথম আমার দেহে ব্রোঞ্জ স্থান পায়। ২৬৮ খ্রিষ্টপূর্ব রোমানে রৌপ্য ও স্বর্ণের অনুপ্রবেশ ঘটে আমার দেহে। ওই সময়ে রোমান দেশে আমাকে ‘কনস্যুলার’ নামে অভিহিত করা হয়। ২৯ খ্রিষ্টপূর্ব রোমান সম্রাট আমার দেহে সম্রাজ্ঞী অথবা রাজ কন্যার ছবির ব্যবহার শুরু করে ছিলেন। দশম শতাব্দীতে প্রিন্সনিভ রাশিয়াতে আমার দেহে খণ্ড খণ্ড সিলভার ব্যবহার করে। তখন রাশিয়াতে আমার নাম রাখা হয়েছিল ‘ডেঞ্জি’।
জার্মানে প্রথম ক্যারোলিনজিয়ান নামক পদার্থ আমার দেহে ব্যবহার করে। পরে বারো শতাব্দীর শেষের দিকে পশ্চিম জার্মান ও কেন্দ্রীয় ইউরোপে আমার দেহে রৌপ্যের ব্যবহার শুরু করে। ১৯৩৯ সালে জার্মানে সম্রাট লুইস–চার আমার দেহে জিংক ও অ্যালুমিনিয়ামসহ আরও অন্য ধাতব পদার্থ ব্যবহার শুরু করেন।
আমার দেহে স্বর্ণ ব্যবহারের ফলে স্বর্ণের সৌন্দর্য ও মূল্যমানের আধিক্যের জন্য মানুষগুলো আমাকে তাদের নিজ নিজ ধনভান্ডারে বন্দী করতে শুরু করে এবং বাজারে আমার পদচারণ কমে যায়। ফলে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ বিনিময়–সংকট দেখা দেয়। তাই ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকায় আমার দেহে স্বর্ণ ব্যবহার বাতিল বলে ঘোষণা করে।
আজ আমার নাম ‘মুদ্রা’ বা ‘কয়েন'। আমি যে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কালে কত আদরের ছিলাম জনমনে, তার প্রমাণ বহন করে আমার পূর্বের নামগুলোতে। যেমন টোকেন, মেডেল, মিন্ট, নোমিজমা, নিউমিজমা, নিউমিজম্যাটিক, কনস্যুলার, ডেঞ্জি ও কয়েন প্রভৃতি। তবে এসব নামকরণ করা হতো অধিকাংশই তৎকালীন উচ্চ পরিবার তথা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর নামানুসারে। শেষ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান মিন্ট মাস্টার কেন্দ্রীয় অনুসন্ধান এজেন্সি নামে সর্বজনস্বীকৃত একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে আমার সার্বিক সেবার জন্য। ফলে আমার দেহের রং, রূপ, আকৃতি ইত্যাদি নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের ওপর।
প্রায় চার হাজার বছর আগে থেকেই আমার উন্নতির জন্য অর্থাৎ বিনিময় মাধ্যমের উন্নতির জন্য বিশ্বের সব জ্ঞানী গুণী ও গবেষক যুগের পর যুগ চেষ্টা করে আসছেন। কিন্তু আমার জীবন শুরু হয়েছিল সংগ্রাম দিয়ে, জীবনের অবসানও ঘটবে সংগ্রাম দিয়েই। জন্ম থেকে এ পর্যন্ত যতবার সংগ্রাম করেছি, ততবারই বিজয়পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল আমার। আজও বিজয়পতাকা নিয়ে স্থান থেকে স্থানান্তর সংগ্রাম করছি নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।
কেননা পৃথিবীর মানুষগুলো চায় না, আমি বেঁচে থাকি। যাদের সভ্যতা, জ্ঞান-বুদ্ধি, শিক্ষা, অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান ইত্যাদির ব্যবস্থা হয়েছিল আমাকে দিয়ে, আজ আমিই তাদের চোখের বালি?
আমার মন বলছে, আজকের বাংলাদেশের মতো একসময় পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই থাকবে না আমার অস্তিত্ব, পরিবেশিত হবে না আমার দেহের খাদ্য। সুতরাং, পৃথিবীর মানুষগুলোর কাছে আমি মুদ্রার একটিই প্রশ্ন, কোন অপরাধে আমি ‘মুদ্রা’ ক্রমাগত বিলুপ্তির পথে?
No comments