‘সাংবাদিকদের সেলফ সেন্সরশিপ সাংঘাতিক বেড়ে গেছে’ :-মাহফুজ আনাম
সাংবাদিকদের
সেলফ সেন্সরশিপ সাংঘাতিক বেড়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন সম্পাদক পরিষদের
সভাপতি ও ইংরেজি দৈনিক দ্যা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। বলেছেন,
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা এখন এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ডিজিটাল
নিরাপত্তা আইন আর মানহানির মামলা- এই দুটো জিনিস আমাদের সাংবাদিকতা জগতে
বিরাট ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সেজন্য সাংবাদিকদের সেলফ সেন্সরশিপ
সাংঘাতিক বেড়ে গেছে। এখন বেশির ভাগ সংবাদ আমরা ছাপি না। দৈনিক প্রথম আলোর
কাছে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি এসব কথা বলেন। আগামীকাল পত্রিকাটির ২১তম
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে মাহফুজ আনাম এই সাক্ষাতকার দেন।
সম্পাদক পরিষদের সভাপতি সাক্ষাতকারে বর্তমান সাংবাদিকতার অবস্থা, চ্যালেঞ্জ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, চ্যালেঞ্জ উত্তরণে করনীয়- এসব নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন।
তিনি বলেন, মানহানির মামলা আগে থেকেই ছিল, কিন্তু এত ব্যাপকভাবে এটার প্রয়োগ হতো না।
মানহানির মামলা দুই রকমের হয়- একটা ফৌজদারি মানহানি, অন্যটা দেওয়ানি আদালতে মানহানির মামলা। সাধারণ নাগরিক কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মানহানি মামলা করতে গেলে আদালত হয়তো মামলা গ্রহণ করবেন না; কিন্তু কোনো প্রভাবশালী বা টাকাওয়ালা লোক মামলা করতে যান, তাহলে তার মামলা নেয়া হবে এবং সেটা নেয়া হবে ফৌজদারি আইনে; সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে। তাছাড়া, আইনে স্পষ্ট লেখা আছে, মামলা করতে পারবেন শুধু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি, অন্য কেউ নয়। যার মানহানির অভিযোগ উঠল, শুধু তিনিই মামলা করতে পারবেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তার বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী, সমর্থক, অনুসারীরা মামলা করে এবং সেসব মামলা গ্রহণ করা হয়। তিনি বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটরা কিন্তু এসব মামলা না নিলেও পারেন, আইনে তাদের সেই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা এসব মামলা গ্রহণ করেন। এতে একই অভিযোগে ১০-১৫-২০টা মামলা হয়। নিজের ওপর দায়ের করা মামলার কথা উল্লেখ করে মাহফুজ আনাম বলেন, আমার বিরুদ্ধে হয়েছে ৮৪টা মামলা।
সম্পাদক পরিষদের সভাপতি বলেন, আইনে আরও বলা হয়েছে যে, একটা মানহানির ঘটনায় একের বেশি মামলা হতে পারবে না। সেখানে একাধিক মামলা হয় কীভাবে? কিন্তু আমাদের দেশে সেটাও হয়ে আসছে।
সাংবাদিকতা এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বলেও মন্তব্য করেন ডেইলি স্টার সম্পাদক। স্বাধীনতা চর্চার দিক থেকে সাংবাদিকতা এখন সারা বিশ্বে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আমেরিকার উদাহরণ টেনে মাহফুজ আনাম বলেন, সে দেশে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মতো একটা অনন্য বিধান আছে, যা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। সেই দেশেই এখন প্রেসিডেন্ট কথায় কথায় সাংবাদিকদের বকাঝকা করেন। সংবাদমাধ্যমে যা কিছু তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশিত হয়, তাকেই তিনি ফেক নিউজ বলেন। তিনি প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের নিকৃষ্টতম জীবদের অন্যতম বলছেন। এভাবে সাংবাদিকদের ও সাংবাদিকতা পেশাকে হেয় করা হচ্ছে। শুধু আমেরিকা নয়, পশ্চিমা দেশগুলো ছিলো স্বাধীন সাংবাদিকতার তীর্থস্থান; তাদের সাংবাদিকতার মূল্যবোধ ও স্বাধীনতার চর্চা থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের সাংবাদিকেরা অনুপ্রাণিত হতাম। সেটা এখন সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলেও সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে মনে করেন মাহফুজ আনাম। বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসার ফলে একজন পাঠকের সামনে সংবাদের অনেক পথ উন্মোচিত হয়েছে। সে এখন আর খবরের কাগজ, টেলিভিশন ও রেডিওর ওপর নির্ভরশীল নয়। যেকোনো খবর সে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৎক্ষণাৎ জেনে ফেলছে। শুধু জেনে ফেলছে না, সে তাৎক্ষণিকভাবে নিজের অভিমত দেয়ারও সুযোগ পাচ্ছে। সর্বসাধারণের মতপ্রকাশের এত ব্যাপক স্বাধীনতা পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো ছিল না। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে ব্যাপক স্বাধীনতা ও বিস্তৃতি, সেই তুলনায় এর দায়িত্বশীলতার ঘাটতি বিরাট। সাংবাদিকতায় যেটাকে বলা হয় এডিটোরিয়াল কন্ট্রোল বা সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেটা নেই। ফলে এই মাধ্যমে খবর আদান-প্রদানের অভিজ্ঞতায় লোকজন আস্থার সংকটে ভোগে। ভাবে, আমি যে খবরটা পেলাম, এটা ঠিক না বেঠিক; এটা গুজব বা ফেক নিউজ কি না।
মাহফুজ আনাম বলেন, তবে পেশাদার সাংবাদিকতার জন্য এটা বিরাট সুযোগ। আমরা যদি পাঠক-দর্শকদের আস্থা আরও দৃঢ় করতে সঠিক সাংবাদিকতা করতে থাকি, তাহলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যতই ব্যাপক হোক না কেন, তারা আমাদের কাছেই ফিরে আসবে।
সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ হিসেবে তৃতীয় আরেকটি বৈশ্বিক প্রবণতার কথা তুলে ধরেন তিনি। সেটা হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দায়িত্বহীন তথ্য আদান-প্রদানের সুযোগ নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পদক্ষেপ নিচ্ছে। তিনি বলেন, আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ভোলা ও রামুর মতো ঘটনা যখন ঘটতে পারছে, যা বিদেশেও ঘটছে, তখন তো একটা নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। এটার একটা যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু এটার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার অত্যন্ত কঠোর আইনকানুন তৈরি করছে, কিছু কিছু দেশে প্রয়োগও করছে। তার ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
মাহ্ফুজ আনাম বলেন, যে তিন ধরনের চ্যালেঞ্জের কথা বলা হলো, বাংলাদেশে আমরা এই তিনটারই শিকার। তবে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বা রাষ্ট্রনেতারা এখনো আমাদের ট্রাম্পের ভাষায় আখ্যায়িত করেননি। কিন্তু আমাদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, এ দেশে ডিজিটাল ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেসব আইন করা হয়েছে, সেগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য ভীষণ প্রতিকূল। সবচেয়ে কঠোর আইনটি হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এবং সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে এর প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছি। এ আইনের প্রতিটি ধারা আমরা ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছি, এটা কী সাংঘাতিক আইন। সরকার যদি এ আইন প্রয়োগ নাও করে, এ আইনের অস্তিত্বই সাংবাদিকদের সব উদ্যম নষ্ট করে দিতে পারে। এ আইনে ১৯ ধরনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ আছে, সেগুলোর মধ্যে ১৪টাই জামিনের অযোগ্য। তাহলে একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যদি মামলা হয়, যেহেতু তিনি জামিন পাবেন না, বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর আগেই তাকে ছয় মাস, এক বছর কারাগারে কাটাতে হবে। একজন সাংবাদিকের মাথায় যদি এই দুশ্চিন্তা থাকে, তাহলে তার পক্ষে কীভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতা করা সম্ভব। তাছাড়া, এ আইনে পুলিশকে খুব বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কোনো অপরাধ সংঘটনের প্রয়োজন নেই, কোনো পুলিশ কর্মকর্তার যদি মনে হয় যে কোনো সংবাদ প্রতিষ্ঠানের দ্বারা সে রকম কিছু করার সম্ভাবনা আছে, তাহলেই তিনি সেই সংবাদ প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার ও অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করে নিয়ে যেতে পারবেন।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি বলেন, ডিজিটালাইজেশনের ফলে বিজ্ঞাপনদাতারা এখন বেশি করে ঝুঁকছে ডিজিটাল প্রকাশ মাধ্যমের দিকে। সারা বিশ্বেই এটা ঘটছে। এতে মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের বিজনেস মডেল সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশে নামকরা অনেক সংবাদপত্রের ছাপা সংস্করণ বন্ধ হয়ে গেছে, তারা শুধু অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করছে। টেলিভিশনের দর্শকও ভীষণভাবে কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে সাংবাদিকতা এখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও ব্যবসায়িক- তিন দিক থেকেই একটা ক্রান্তিকাল।
মাহ্ফুজ আনাম বলেন, সাংবাদিকতার সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে, এর মধ্যেই বিরাট সুযোগ লুকিয়ে আছে। এখন আমাদের নৈতিক সাংবাদিকতা সুদৃঢ়ভাবে রক্ষা করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি মানুষ যে অনাস্থা বোধ করছে, সেই অনাস্থা যদি পেশাদার সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয়, তাহলে আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ থাকবে না। তাই আমাদের আস্থা অটুট রাখা, বরং তা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। আমরা হলাম সঠিক সংবাদদাতা- এই অবস্থানে সম্পূর্ণভাবে অটল থাকতে হবে। এটা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে জনগণ সত্য সংবাদের জন্য, সঠিক তথ্যের জন্য আমাদের কাছেই ফিরে আসবে; পেশাদার সাংবাদিকতাই বিকল্পহীন বলে প্রমাণিত হবে।
সম্পাদক পরিষদের সভাপতি সাক্ষাতকারে বর্তমান সাংবাদিকতার অবস্থা, চ্যালেঞ্জ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, চ্যালেঞ্জ উত্তরণে করনীয়- এসব নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন।
তিনি বলেন, মানহানির মামলা আগে থেকেই ছিল, কিন্তু এত ব্যাপকভাবে এটার প্রয়োগ হতো না।
মানহানির মামলা দুই রকমের হয়- একটা ফৌজদারি মানহানি, অন্যটা দেওয়ানি আদালতে মানহানির মামলা। সাধারণ নাগরিক কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মানহানি মামলা করতে গেলে আদালত হয়তো মামলা গ্রহণ করবেন না; কিন্তু কোনো প্রভাবশালী বা টাকাওয়ালা লোক মামলা করতে যান, তাহলে তার মামলা নেয়া হবে এবং সেটা নেয়া হবে ফৌজদারি আইনে; সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে। তাছাড়া, আইনে স্পষ্ট লেখা আছে, মামলা করতে পারবেন শুধু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি, অন্য কেউ নয়। যার মানহানির অভিযোগ উঠল, শুধু তিনিই মামলা করতে পারবেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তার বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী, সমর্থক, অনুসারীরা মামলা করে এবং সেসব মামলা গ্রহণ করা হয়। তিনি বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটরা কিন্তু এসব মামলা না নিলেও পারেন, আইনে তাদের সেই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা এসব মামলা গ্রহণ করেন। এতে একই অভিযোগে ১০-১৫-২০টা মামলা হয়। নিজের ওপর দায়ের করা মামলার কথা উল্লেখ করে মাহফুজ আনাম বলেন, আমার বিরুদ্ধে হয়েছে ৮৪টা মামলা।
সম্পাদক পরিষদের সভাপতি বলেন, আইনে আরও বলা হয়েছে যে, একটা মানহানির ঘটনায় একের বেশি মামলা হতে পারবে না। সেখানে একাধিক মামলা হয় কীভাবে? কিন্তু আমাদের দেশে সেটাও হয়ে আসছে।
সাংবাদিকতা এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বলেও মন্তব্য করেন ডেইলি স্টার সম্পাদক। স্বাধীনতা চর্চার দিক থেকে সাংবাদিকতা এখন সারা বিশ্বে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আমেরিকার উদাহরণ টেনে মাহফুজ আনাম বলেন, সে দেশে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মতো একটা অনন্য বিধান আছে, যা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। সেই দেশেই এখন প্রেসিডেন্ট কথায় কথায় সাংবাদিকদের বকাঝকা করেন। সংবাদমাধ্যমে যা কিছু তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশিত হয়, তাকেই তিনি ফেক নিউজ বলেন। তিনি প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের নিকৃষ্টতম জীবদের অন্যতম বলছেন। এভাবে সাংবাদিকদের ও সাংবাদিকতা পেশাকে হেয় করা হচ্ছে। শুধু আমেরিকা নয়, পশ্চিমা দেশগুলো ছিলো স্বাধীন সাংবাদিকতার তীর্থস্থান; তাদের সাংবাদিকতার মূল্যবোধ ও স্বাধীনতার চর্চা থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের সাংবাদিকেরা অনুপ্রাণিত হতাম। সেটা এখন সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলেও সাংবাদিকতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে মনে করেন মাহফুজ আনাম। বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসার ফলে একজন পাঠকের সামনে সংবাদের অনেক পথ উন্মোচিত হয়েছে। সে এখন আর খবরের কাগজ, টেলিভিশন ও রেডিওর ওপর নির্ভরশীল নয়। যেকোনো খবর সে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৎক্ষণাৎ জেনে ফেলছে। শুধু জেনে ফেলছে না, সে তাৎক্ষণিকভাবে নিজের অভিমত দেয়ারও সুযোগ পাচ্ছে। সর্বসাধারণের মতপ্রকাশের এত ব্যাপক স্বাধীনতা পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো ছিল না। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে ব্যাপক স্বাধীনতা ও বিস্তৃতি, সেই তুলনায় এর দায়িত্বশীলতার ঘাটতি বিরাট। সাংবাদিকতায় যেটাকে বলা হয় এডিটোরিয়াল কন্ট্রোল বা সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেটা নেই। ফলে এই মাধ্যমে খবর আদান-প্রদানের অভিজ্ঞতায় লোকজন আস্থার সংকটে ভোগে। ভাবে, আমি যে খবরটা পেলাম, এটা ঠিক না বেঠিক; এটা গুজব বা ফেক নিউজ কি না।
মাহফুজ আনাম বলেন, তবে পেশাদার সাংবাদিকতার জন্য এটা বিরাট সুযোগ। আমরা যদি পাঠক-দর্শকদের আস্থা আরও দৃঢ় করতে সঠিক সাংবাদিকতা করতে থাকি, তাহলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যতই ব্যাপক হোক না কেন, তারা আমাদের কাছেই ফিরে আসবে।
সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ হিসেবে তৃতীয় আরেকটি বৈশ্বিক প্রবণতার কথা তুলে ধরেন তিনি। সেটা হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দায়িত্বহীন তথ্য আদান-প্রদানের সুযোগ নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পদক্ষেপ নিচ্ছে। তিনি বলেন, আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ভোলা ও রামুর মতো ঘটনা যখন ঘটতে পারছে, যা বিদেশেও ঘটছে, তখন তো একটা নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। এটার একটা যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু এটার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার অত্যন্ত কঠোর আইনকানুন তৈরি করছে, কিছু কিছু দেশে প্রয়োগও করছে। তার ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
মাহ্ফুজ আনাম বলেন, যে তিন ধরনের চ্যালেঞ্জের কথা বলা হলো, বাংলাদেশে আমরা এই তিনটারই শিকার। তবে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বা রাষ্ট্রনেতারা এখনো আমাদের ট্রাম্পের ভাষায় আখ্যায়িত করেননি। কিন্তু আমাদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, এ দেশে ডিজিটাল ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেসব আইন করা হয়েছে, সেগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য ভীষণ প্রতিকূল। সবচেয়ে কঠোর আইনটি হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এবং সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে এর প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছি। এ আইনের প্রতিটি ধারা আমরা ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছি, এটা কী সাংঘাতিক আইন। সরকার যদি এ আইন প্রয়োগ নাও করে, এ আইনের অস্তিত্বই সাংবাদিকদের সব উদ্যম নষ্ট করে দিতে পারে। এ আইনে ১৯ ধরনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ আছে, সেগুলোর মধ্যে ১৪টাই জামিনের অযোগ্য। তাহলে একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যদি মামলা হয়, যেহেতু তিনি জামিন পাবেন না, বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর আগেই তাকে ছয় মাস, এক বছর কারাগারে কাটাতে হবে। একজন সাংবাদিকের মাথায় যদি এই দুশ্চিন্তা থাকে, তাহলে তার পক্ষে কীভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতা করা সম্ভব। তাছাড়া, এ আইনে পুলিশকে খুব বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কোনো অপরাধ সংঘটনের প্রয়োজন নেই, কোনো পুলিশ কর্মকর্তার যদি মনে হয় যে কোনো সংবাদ প্রতিষ্ঠানের দ্বারা সে রকম কিছু করার সম্ভাবনা আছে, তাহলেই তিনি সেই সংবাদ প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার ও অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করে নিয়ে যেতে পারবেন।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি বলেন, ডিজিটালাইজেশনের ফলে বিজ্ঞাপনদাতারা এখন বেশি করে ঝুঁকছে ডিজিটাল প্রকাশ মাধ্যমের দিকে। সারা বিশ্বেই এটা ঘটছে। এতে মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের বিজনেস মডেল সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশে নামকরা অনেক সংবাদপত্রের ছাপা সংস্করণ বন্ধ হয়ে গেছে, তারা শুধু অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করছে। টেলিভিশনের দর্শকও ভীষণভাবে কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে সাংবাদিকতা এখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও ব্যবসায়িক- তিন দিক থেকেই একটা ক্রান্তিকাল।
মাহ্ফুজ আনাম বলেন, সাংবাদিকতার সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে, এর মধ্যেই বিরাট সুযোগ লুকিয়ে আছে। এখন আমাদের নৈতিক সাংবাদিকতা সুদৃঢ়ভাবে রক্ষা করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি মানুষ যে অনাস্থা বোধ করছে, সেই অনাস্থা যদি পেশাদার সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয়, তাহলে আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ থাকবে না। তাই আমাদের আস্থা অটুট রাখা, বরং তা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। আমরা হলাম সঠিক সংবাদদাতা- এই অবস্থানে সম্পূর্ণভাবে অটল থাকতে হবে। এটা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে জনগণ সত্য সংবাদের জন্য, সঠিক তথ্যের জন্য আমাদের কাছেই ফিরে আসবে; পেশাদার সাংবাদিকতাই বিকল্পহীন বলে প্রমাণিত হবে।
No comments