ভোলা সংঘর্ষ: ৪/৫ হাজার ব্যক্তিকে আসামী করে মামলা করেছে পুলিশ
ঘটনার পর মাদ্রাসা ভবনের অবস্থা |
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় ভোলার বোরহানউদ্দিন থানা পুলিশ বলছে, ইসলামের
নবীকে কটাক্ষ করে দেয়া এক ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে রোববারের এক সংঘর্ষ
এবং পুলিশের গুলিতে চার ব্যক্তি নিহত হবার ঘটনায় অজ্ঞাত ৪/৫ হাজার
ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা হয়েছে।
বোরহানউদ্দিনে এখন থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
পুলিশ
বলেছে, বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য নামে একজনের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে নবী
মোহাম্মদকে নিয়ে মেসেঞ্জারে পোস্ট দেয় হ্যাকাররা এবং এর সাথে জড়িত
দুজনকে তারা আটক করেছে।
আইডি হ্যাক হওয়ার পর বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য নিজেই থানায় উপস্থিত হয়ে জিডি করেছিলেন।
কিন্তু এ ঘটনার জের ধরে রোববার সংঘর্ষে চার জন নিহত হয়।
তবে
উপজেলা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এনামুল হক আজ সকাল বিবিসি বাংলাকে
জানিয়েছেন, রাতে আর কাউকে আটক করা হয়নি বা অপ্রীতিকর কোনো ঘটনাও ঘটেনি।
"পরিস্থিতি এখন শান্ত ও স্বাভাবিক। বিজিবিসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে," বলছিলেন মিস্টার হক।
যদিও স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল মালেক বিবিসিকে বলেন, বোরহানউদ্দিন পৌর এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
"শুধু পৌর এলাকাতেই এমন অবস্থা দেখা যাচ্ছে। তবে আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা বা আটকের খবর আমরা পাইনি"।
ওদিকে ছয় দফা দাবিতে ভোলা সদরে সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদ সোমবার যে সমাবেশ ডেকেছিলো - সেটি স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা তাজউদ্দিন বিবিসিকে বলেন, প্রশাসন তাদের অনুমতি দেয়নি বলে তারা সমাবেশ স্থগিত করেছেন।
তবে পরে তারা সংবাদ সম্মেলনে করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে জানান তিনি।
বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের কারণ কী?
পুলিশ বলছে, ফেসবুকে ইসলামের নবীকে নিয়ে কটূক্তি করে দেয়া কথিত একটি পোস্টকে ঘিরে বোরহানউদ্দিনে গত তিনদিন ধরে বিক্ষোভ চলছে।
বিষয়টি নিয়ে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা গ্রামবাসীর সঙ্গে কয়েক দফায় আলোচনা চালিয়ে আসছেন।
রোববার সকালে এরকম এক বৈঠকের সময় পুলিশের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষ বেধে গেলে, এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়।
বোরহানউদ্দিন থানার সাব ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ জাফর ইকবাল বিবিসিকে মোট চারজন মানুষ নিহত হবার খবর নিশ্চিত করেছিলেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের বক্তব্য:
পুলিশের
এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে ১৮ অক্টোবর রাতে বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য নামের ২৫
বছর বয়সী এক যুবক বোরহানউদ্দিন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তিনি
জানান, তার ফেইসবুক আইডি 'বিপ্লব চন্দ্র শুভ' হ্যাক করা হয়েছে।
জিডি
করার সময় থানায় থাকাকালেই ফোনে তার কাছে চাঁদা দাবি করা হয়। বিষয়টি
তিনি তখনি ওসিকে জানান এবং ওসি জানান ভোলার পুলিশ সুপারকে।
পুলিশ
জানিয়েছে "প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সেদিন রাতের মধ্যেই বিপ্লব চন্দ্র
বৈদ্যর ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাককারী ও তার মোবাইলে কলদাতা শরীফ এবং ইমন
নামে দুই যুবককে যথাক্রমে পটুয়াখালী এবং বোরহানউদ্দিন থেকে আটক করে পুলিশ।
আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদেরকে বোরহানউদ্দিন থানায় নেওয়া হয়।"
তবে মাওলানা তাজউদ্দীনের দাবি পুলিশ ঘটনা 'অন্যদিকে প্রবাহিত করার' চেষ্টা করছে।
বোরহানউদ্দিনের এসপি বললেন এমপিকে - "স্যার আমাদের বাঁচান।"
সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুল জানান, তিনি ঢাকায় থাকলেও বোরহানউদ্দিনে সব পক্ষের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছিলেন।
তিনি বলছিলেন, রোববার পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে তিনি বুঝতে পারেন যে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে।
"জেলার
পুলিশ সুপার - উনি ফোন রেখে দেবার আগে আমাকে শেষ কথাটা বলেন, 'স্যার
আমাদেরকে বাঁচান। আমরা মসজিদের দোতলায় ইমামের রুমে অবরুদ্ধ আছি, আমাদেরকে
বাঁচান,' তার উক্তি ছিল এটাই।"
"তখনই আমার মনে হলো যে এ মুহুর্তেই
আমার ভোলা যাওয়া দরকার। সাথে সাথেই আমি হেলিকপ্টারযোগে ভোলা চলে আসি।
দ্রুত আসার জন্য এ ছাড়া আমার উপায় ছিল না।"
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
বিপ্লব
চন্দ্র শুভ নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির নামে করা একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে
ঘটনার সূত্রপাত - যাতে ইসলামের নবী মোহাম্মদের নামে কটুক্তি করা হয়।
বিবিসি
বাংলাকে সাংসদ আলী আজম বলেন, বিপ্লব চন্দ্র শুভ তাৎক্ষণিকভাবে থানায় এসে
জানান যে তার ফেসবুক আইডি হ্যাকিং করা হয়েছে, এবং তিনি একটি জিডি এন্ট্রি
করেন।
"জিডি করার পর তার মোবাইলে একটা ফোন আসে।"
"ওপাশ থেকে একজন বলে যে 'আমি গাজীপুর থানার ওসি বলছি, তোমার মোবাইল থেকে
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা জিনিস ছড়িয়ে পড়েছে, এটা আমি মুছে দিতে
পারি - তুমি আমাকে ২ হাজার টাকা দাও।"
"ব্যাপারটা আমার নজরে আনা হলে
আমি ভোলার পুলিশ সুপারকে এবং আমার নির্বাচনী এলাকা বোরহানউদ্দিনের
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেই দ্রুত এ ঘটনার নিরসন করার জন্য।"
সাংসদ আলী আজম জানান, কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নেন এবং বিপ্লব চন্দ্র শুভকেও থানায় রাখা হয়।
"পাশাপাশি
যে মোবাইল থেকে ওই কলটি এসেছিল - আমরা মোবাইল ট্র্যাকিং করে জানতে পারি সে
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার একটি ছেলে। তাকেও সেখান থেকে আনা হয়।
"পটুয়াখালীর এ ব্যক্তি আবার মোবাইল সিমটি নিয়েছিলেন বোরহানউদ্দিনের একজনের কাছ থেকে। তাকেও আমরা থানা হেফাজতে এনেছি।"
"রোববারের
গুলিবর্ষণের আগের দিন - অর্থাৎ শনিবার রাতে - এখানে স্থানীয় আলেম-ওলামারা
'তৌহিদি জনতা'-র ব্যানারে একটি সমাবেশ ডাকেন। এতে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন
তাদের সাথে জেলা প্রশাসক, পুলিশ কর্মকর্তা, স্থানীয় গণ্যমান্য লোকদের
নিয়ে একটি মিটিং করা হয়।"
"এতে সবাইকে অবহিত করা হয় যে বিপ্লব
চন্দ্র শুভ এবং পটুয়াখালী থেকে এ্যারেস্ট করে আনা ব্যক্তি - যে আইডি
হ্যাকিং করেছে বলে আমরা সন্দেহ করছি - তারা কর্তৃপক্ষের হেফাজতে আছে।"
"এতে
তারা সন্তুষ্ট হয়ে ডিসি সাহেবের কাছে একটি স্মারকলিপি দেন। তারা থানায়
প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান যে রোববারের সমাবেশটি আর হবে না।"
"আমি তখন ঢাকায় ছিলাম, তবে আমার নির্দেশেই মিটিং হয়। মিটিং শেষে সবার সাথে আমি নিজে ফোনে কথা বলি।"
তাহলে পরদিন পরিস্থিতি এত সহিংস হয়ে উঠলো কীভাবে?
সংসদ
সদস্য আলী আজম বলছিলেন, "আলেম-ওলামারা থানায় প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান যে
রোববারের সমাবেশটি আর হবে না। কিন্তু সকাল দশটার সময় ঈদগাহ মাঠে লোকজন
জড়ো হতে থাকে।"
"এতে 'তৌহিদি জনতা'র ব্যানারে যে ইমাম সাহেবরা ছিলেন তারা এবং এসপি, এডিশনাল ডিআইজি সাহেবরা বক্তব্য দেন, মোনাজাতও করেন।"
"এর পর যখন তারা চলে যাবেন তখন ঈদগাহের উত্তর দিকে মাইনকার হাট এবং দক্ষিণ দিকে দেউলা শার্শা থেকে দুটি মিছিল আসে। "
"তারা বিপ্লব চন্দ্র শুভর ফাঁসি দাবি করে এবং সাথে সাথেই প্রশাসনের ওপর চড়াও হয়" - বলছিলেন সাংসদ আলী আজম।
"এক
পর্যায়ে প্রশাসনের লোকেরা আত্মরক্ষার জন্য দৌড়িয়ে ইমাম সাহেবের রুমে
ঢোকে। তার পরের ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে আমি দেখেছি যে আলেম সমাজের
নেতৃবৃন্দ মানুষকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন।"
"কিন্তু এখানে
মুসলিম উম্মাহ ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছে তাই
আলেম সমাজের পাশাপাশি আমজনতাও জড়িয়ে গেছেন। তবে আলেমরা তাদের থামানোর
চেষ্টা করেছেন।"
কিন্তু পুলিশের ওপর আক্রমণ হলো কেন?
এ প্রশ্নের জবাবে সাংসদ আলী আজম বলেন, "এটা আমি এ মুহূর্তে ব্যাখ্যা দিতে পারবো না।"
"ভিডিও ফুটেজ আছে, তার বিচার বিশ্লেষণ করে পরে আমরা এ ব্যাখ্যা দিতে পারবো যে কে বা কারা এ ঘটনার সাথে জড়িত।"
"পিছন
থেকে কেউ উস্কানি দিয়ে থাকলে সেটাও বেরিয়ে আসবে। তাদের বিরুদ্ধে
প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে" - বলেন সংসদ সদস্য আলী আজম।
সরকার সজাগ
সরকারের একাধিক
সিনিয়র মন্ত্রী বলেছেন, ভোলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোন পরিস্থিতি সৃষ্টির
সুযোগ যাতে কেউ নিতে না পারে, সে ব্যাপারে সরকার সজাগ রয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ঘটনার তদন্ত এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সকলের সহযোগিতা চেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া বলছিলেন, আহতদের চিকিৎসার
ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং নিহতদের ক্ষতিপূরণেরও ব্যবস্থা করা হবে।
'তবে তদন্ত এবং আইনগত ব্যবস্থাগুলোর ক্ষেত্রে কিছুটা সময় প্রয়োজন' বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
তিনি
বলছিলেন, "আমরা আগেও দেখেছি, রামু কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘটনা যা নয়
তা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে কিছু মতলববাজ মানুষ উত্তেজনা সৃষ্টি করে,
নিরাপরাধ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। এটা দুর্ভগ্যজনক।"
"মাননীয়
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকালই নির্দেশনা দিয়েছেন যাতে করে সকল মানুষের
নিরাপত্তা দেয়া হয়। এর পাশাপাশি সেখানে আহতদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা
করা। আর নিহতদেরও ক্ষতিপূরণ অবশ্যই দেয়া হবে।"
ভোলায় রোববারের
বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার ঢাকা
এবং বরিশালে তৌহিদী জনতার ব্যানারে বিক্ষোভ করা হয়েছে।
বিরোধীদল বিএনপি বুধবার এ ব্যাপারে এক বিক্ষোভের কর্মসূচি দিয়েছে।
No comments