বাংলাদেশে জোরপূর্বক বিয়ে এবং একজন জাহানের পরিণতি -নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট
বাংলাদেশে
জোরপূর্বক বিয়ের ঘটনা ব্যাপক। ইউনিসেফের মতে, এখানে ১৮ বছরের মধ্যে বিয়ে
দেয়া হয় শতকরা ৫৯ ভাগ মেয়েকে। জোরপূর্বক বিয়ের পর এসব মেয়ের পরিণতি খুব
একটা ভাল হয় না। নানা রকম অনিয়ম, নির্যাতনের শিকার হন তারা। কিন্তু
মানসম্মান, পরিবারের কথা চিন্তা করে মুখ বুজে সয়ে যান তার সবটাই তারা। তারই
একটি উদাহরণ তুলে ধরেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। এতে বাংলাদেশী একটি মেয়ে জাহানের
দুর্দশার কথা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ঢাকায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসবাস
করছিলেন তিনি।
পড়ছিলেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং। স্বপ্ন দেখতেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে আত্মনির্ভরশীল হবেন। কিন্তু এর মধ্যে ব্যাঘাত ঘটে। তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর দেখা দেয় নানা বিপত্তি। তার স্বামী চান তার ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে। অর্থাৎ তিনি যেমনটা বলবেন জাহানকে সেভাবেই চলতে হবে। এ নিয়ে নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে রাস্তায় তাদের মধ্যে প্রচ- বাকবিতন্ডা হয়। ব্যস প্রকাশ হয়ে পড়ে সব কিছু।
সেটা ছিল গত বছরের মধ্য আগষ্ট। এদিন সরকারি স্কুলের থিরেটারের শিক্ষিকা ক্যারি এলম্যান লারসেন প্রসপেক্ট পার্কের পাশে এক প্রতিবশেীর বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে দেখতে পান একজন পুরুষ এক যুবতীকে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। আর ওই যুবতী তার কাছ থেকে ছোটার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তারা বাংলায় কথা বলছিলেন। ফলে এলম্যান লারসেন তাদের কথা বলতে পারছিলেন না। তবে তিনি এটুকু বুঝতে পেরেছেন যে কিছু একটা গ-গোল আছে। তিনি তাদের কাছে জানতে চান, সব ঠিকঠাক আছে? জবাবে পুরুষ ব্যক্তি তার স্ত্রীকে মানসিক রোগি বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু তার উত্তরে সন্তষ্টু হতে পারেন নি এলম্যান লারসেন। লোকজন জড়ো হয়ে যায় তাদের পাশে। এলম্যান লারসেনকে তারা বলতে থাকেন, ওদেরকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিন। এটা একটি বাঙালি সমস্যা। আমরা তাদেরকে সাহায্য করবো।
কিন্তু সন্দেহ যায় না এলম্যান লারসেনের। তিনি ওই যুবতীর সঙ্গে কথা বলতে চান। শেষ পর্যন্ত ওই যুবতী তাকে ইংরেজিতে বলেন ‘ফোর্সড ম্যারিজ’। আমি নিরাপদ নই। দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন।
সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন প্রতিবেশী জরুরি নম্বর ৯১১-এ ফোন করেন। পুলিশ উপস্থিত হয় ঘটনাস্থলে। এলম্যান লারসেন তাদেরকে জানান, কিছু একটা ঘটেছে। যা আমি বুঝতে পারছি না।
জোরপূর্বক বিয়ের কাহিনী
ওই রাতে জানা যায়, ২০ বছর বয়সী ওই অভিবাসী যুবতীর নাম জাহান। তার পুরো নাম এখানে নিরাপত্তার কারণে প্রকাশ করা হচ্ছে না। তিনিই তার কাহিনী জানিয়েছেন। তার মতো এমন অনেকে আছেন যারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেয়া হবে, পরিবারের মান সম্মানের কথা চিন্তা করে অনেক নির্যাতন সহ্য করে বসবাস করছেন। বসবাস করছেন ঝুঁকি নিয়ে। তাদের মধ্যে জাহান একজন। ব্রুকলিনের ওই ঘটনার মাত্র তিন মাস আগে তিনি নিউ ইয়র্কে গিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে তিনি সেখানে গিয়েছেন। কিভাবে তার বিয়ে হয়, কিভাবে নিউ ইয়র্ক যান তারও একটি বর্ণনা দিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
২০১৭ সালের কোনো এক বিকেল। জাহানের পিতামাতা তাকে বললেন, আত্মীয় আসবে। তিনি যেন ভালভাবে পোশাক পরে প্রস্তুত থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ৩০ বছর বয়সী এক যুবককে সঙ্গে নিয়ে জাহানদের বাসায় প্রবেশ করেন এক বয়স্ক দম্পতি। বলা হয়, অচেনা ওই যুবকের সঙ্গে জাহানের বিয়ে হবে। জাহান বলেন, এটা জানতে পেরে বিস্মিত হই। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি।
এর আগেও তার বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। প্রতিবারই এমন ঘটনায় তিনি পালিয়েছেন অথবা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। জাহান বলেন, পিতামাতাকে বলেছি, আমাকে এখন বিয়ে দিও না। আমাকে একটু সময় দাও। দুই-তিন বছরের মধ্যে বিয়ে করবো। কিন্তু এখন না, প্লিজ।
কিন্তু শেষ দফায় পিতামাতা তাকে বলে দিলেন, এখন সময় হয়ে গেছে। আর দেরি নয়। ব্যাস বিয়ে হয়ে যায়। দু’দিনের জন্য হানিমুনে যান তারা। সঙ্গে যায় তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। বোনের বিপদআপদের কথা মাথায় রেখে সঙ্গে যান তার এক বড়ভাইও। সেই হানিমুনে গিয়ে ভোর ৪টার দিকে ভাইয়ের হোটেল কক্ষের দরজায় নক করেন জাহান। এ সম্পর্কে জাহানের ওই ভাই বলেছেন, দরজা খুলতেই জাহান আমাকে জড়িয়ে ধরলো। একটানা কেঁদে যেতে লাগলো। তিনি বাংলাদেশ থেকে টেলিফোনে এসব কথা জানিয়েছেন নিউ ইয়র্ক টাইমসকে। তিনি আরো বলেছেন, ওই সময় জাহান আমাকে বলেছিল ভাই আমাকে বাঁচাও।
হানিমুন শেষে জাহানের স্বামী ফিরে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে গিয়ে স্ত্রীর জন্য ভিসা আবেদন করেন। অন্যদিকে দেশে পরিবারের সদস্যদের কাছে জাহান কাকুতি জানান বিয়েটা বাতিল করে দিতে। এক পর্যায়ে তার পিতামাতা জানতে পারেন জাহান বিচ্ছেদ সম্পর্কিত একজন আইনজীবীর কাছে যোগাযোগ করছে। এটা জানতে পেরে তারা জাহানকে ‘পতিতা’ আখ্যা দেন। পড়াশোনা বন্ধ করে দেন। ঘরে আটকে রাখেন। তার বিরুদ্ধে নৃশংস হয়ে ওঠেন। এসব তথ্য দিয়েছেন জাহান।
তার ভাই বলেছেন, জাহান ভীষণ হতাশায় ভুগছিল। তাই তিনি বোনের পাশে দাঁড়ান। বলেন, ওই সময়ে জাহানের করার কিছুই ছিল না। ভাগ্যের ওপর নিজেকে ছেড়ে দেন জাহান। এক বছর পরে তার স্বামী বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তাদের সম্মানে পার্টি আয়োজন করা হয়। শুধু তখনই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হেসেছিলেন জাহান। এরপর তারা দু’জনে একসঙ্গে চলে যান নিউ ইয়র্কে।
প্রাধান্য বিস্তার করেন স্বামী
২০১৮ সালের মে মাস। কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন জাহান দম্পতি। নিউ ইয়র্কে তাদের প্রথম রাত। স্বামীর কাছে জাহান অনুরোধ করলেন, তাদের প্রথমে দু’জনকে ভালভাবে জানা উচিত। যদি তিনি তাকে বলিউডের কোনো ছবি দেখাতে নিয়ে যান অথবা শহরে ঘোরার সময় তার হাত ধরে রাখেনÑ তাতে খুশি হবেন জাহান। কিন্তু তার এসব কথায় সম্মত হলেন না তার স্বামী।
তার বালাদেশী ওই স্বামী মনে করেন তিনি যেটা বলবেন সেটা তার দাম্পত্য অধিকার। জাহান বলেন, আমি কাঁদতে থাকি। কিন্তু সে কেয়ার করে না তাতে। জাহানের হাতে নিজেই ক্ষত করেছেন। তাকে বলা হয়েছে, যদি তিনি তার স্বামীকে ছেড়ে দেন বা দেয়ার চেষ্টা করেন তাহলে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। নিউ ইয়র্কে পৌঁছার পর তার পাসপোর্ট নিয়ে নিয়েছেন তার স্বামী। তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কলেজে ভর্তি করে দেবেন। অথবা তাকে কাজ করতে বাধা দেবেন না। জাহান বলেন, আমার কাছে কোনো অর্থ ছিল না। বাসার কোনো চাবি পর্যন্ত আমাকে দেয়া হয় নি। সব কিছুতেই থাকতো তার প্রাধান্য।
এ বিষয়ে জাহানের স্বামীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে নিউ ইয়র্ক টাইমস। এ সময় তিনি স্ত্রীর ওপর সহিংসতা বা নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেন। চ্যালেঞ্জ জানান। বলেন, তাদের বিয়ে জোরপূর্বক ছিল না। এ সময় তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কিভাবে তার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। জবাবে তিনি বলেছেন, পারিবারিকভাবে। কিভাবে বিয়ে হয়েছে এ প্রশ্নের উত্তর দেন নি তিনি।
ব্রুকলিনে এক রোববারের রাতে বার্ষিক এক বাংলাদেশী মেলায় জাহানকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার স্বামী। এ সময় তিনি তাকে হাসতে বলেন, যাতে মানুষজন দেখে ভাবে তাদের মধ্যে মধুর ভালবাসা। তার কথামতো কাজ করেছেন জাহান। কিন্তু ওই রাতে যখন তারা বাসায় ফিরছিলেন, তখন জাহানের মনে হলো এভাবে আর নয়। তাই তিনি দৌড়াতে শুরু করেন। দৌড়ে কোথায় যাবেনÑ সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না তার। কিন্তু পিছন থেকে তাকে ধরে ফেলেন তার স্বামী।
আর এই দৃশ্যই দেখতে পান এলম্যান লারসেন। তিনিই জাহানের সহায়তায় এগিয়ে যান। লারসেন বলেছেন, ওই মেয়েটির কোনো সাপোর্ট নেই। সে কাউকে চেনে না। আমরা তার একজন বন্ধু খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সে কাউকে চেনে না। তার কাছে ছিল না কিছুই। এ অবস্থায় বাংলাদেশে ফোন করলো পুলিশ। তার পিতা বললেন, স্বামীর সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া উচিত জাহানের। কারণ, স্বামীর সঙ্গেই তাকে থাকতে হবে।
এ অবস্থায় নিজের মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন এলম্যান লারসেন। তিনি নিজের ফেসবুকে একটি বার্তা পোস্ট করেন। তাতে লেখেনম ‘ঠিক এই মুহূর্তে একজন বাঙালি নারী আইনজীবী প্রয়োজন আমার’।
এই ম্যাসেজটি চোখে পড়লো বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন মুসলিম নারীবাদী শাহানা হানিফের। তিনি অবিলম্বে যোগাযোগ করলেন। জাহানকে কোথায় রাখা যায় তা খুঁজে পেতে চেষ্টা করলেন। কয়েক ঘন্টা চেষ্টা করে তিনি স্থানীয় একটি মসজিদ পেলেন। সেখানে অভিবাসী মুসলিম নারীরা নিরাপদে থাকেন। তারা জাহানের কাছে চলে গেলেন রাত ২টায়। এর তিন দিন পরে পুলিশে রিপোর্ট করেন জাহান।
পড়ছিলেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং। স্বপ্ন দেখতেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে আত্মনির্ভরশীল হবেন। কিন্তু এর মধ্যে ব্যাঘাত ঘটে। তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর দেখা দেয় নানা বিপত্তি। তার স্বামী চান তার ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে। অর্থাৎ তিনি যেমনটা বলবেন জাহানকে সেভাবেই চলতে হবে। এ নিয়ে নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে রাস্তায় তাদের মধ্যে প্রচ- বাকবিতন্ডা হয়। ব্যস প্রকাশ হয়ে পড়ে সব কিছু।
সেটা ছিল গত বছরের মধ্য আগষ্ট। এদিন সরকারি স্কুলের থিরেটারের শিক্ষিকা ক্যারি এলম্যান লারসেন প্রসপেক্ট পার্কের পাশে এক প্রতিবশেীর বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে দেখতে পান একজন পুরুষ এক যুবতীকে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। আর ওই যুবতী তার কাছ থেকে ছোটার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তারা বাংলায় কথা বলছিলেন। ফলে এলম্যান লারসেন তাদের কথা বলতে পারছিলেন না। তবে তিনি এটুকু বুঝতে পেরেছেন যে কিছু একটা গ-গোল আছে। তিনি তাদের কাছে জানতে চান, সব ঠিকঠাক আছে? জবাবে পুরুষ ব্যক্তি তার স্ত্রীকে মানসিক রোগি বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু তার উত্তরে সন্তষ্টু হতে পারেন নি এলম্যান লারসেন। লোকজন জড়ো হয়ে যায় তাদের পাশে। এলম্যান লারসেনকে তারা বলতে থাকেন, ওদেরকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিন। এটা একটি বাঙালি সমস্যা। আমরা তাদেরকে সাহায্য করবো।
কিন্তু সন্দেহ যায় না এলম্যান লারসেনের। তিনি ওই যুবতীর সঙ্গে কথা বলতে চান। শেষ পর্যন্ত ওই যুবতী তাকে ইংরেজিতে বলেন ‘ফোর্সড ম্যারিজ’। আমি নিরাপদ নই। দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন।
সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন প্রতিবেশী জরুরি নম্বর ৯১১-এ ফোন করেন। পুলিশ উপস্থিত হয় ঘটনাস্থলে। এলম্যান লারসেন তাদেরকে জানান, কিছু একটা ঘটেছে। যা আমি বুঝতে পারছি না।
জোরপূর্বক বিয়ের কাহিনী
ওই রাতে জানা যায়, ২০ বছর বয়সী ওই অভিবাসী যুবতীর নাম জাহান। তার পুরো নাম এখানে নিরাপত্তার কারণে প্রকাশ করা হচ্ছে না। তিনিই তার কাহিনী জানিয়েছেন। তার মতো এমন অনেকে আছেন যারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেয়া হবে, পরিবারের মান সম্মানের কথা চিন্তা করে অনেক নির্যাতন সহ্য করে বসবাস করছেন। বসবাস করছেন ঝুঁকি নিয়ে। তাদের মধ্যে জাহান একজন। ব্রুকলিনের ওই ঘটনার মাত্র তিন মাস আগে তিনি নিউ ইয়র্কে গিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে তিনি সেখানে গিয়েছেন। কিভাবে তার বিয়ে হয়, কিভাবে নিউ ইয়র্ক যান তারও একটি বর্ণনা দিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
২০১৭ সালের কোনো এক বিকেল। জাহানের পিতামাতা তাকে বললেন, আত্মীয় আসবে। তিনি যেন ভালভাবে পোশাক পরে প্রস্তুত থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ৩০ বছর বয়সী এক যুবককে সঙ্গে নিয়ে জাহানদের বাসায় প্রবেশ করেন এক বয়স্ক দম্পতি। বলা হয়, অচেনা ওই যুবকের সঙ্গে জাহানের বিয়ে হবে। জাহান বলেন, এটা জানতে পেরে বিস্মিত হই। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি।
এর আগেও তার বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। প্রতিবারই এমন ঘটনায় তিনি পালিয়েছেন অথবা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। জাহান বলেন, পিতামাতাকে বলেছি, আমাকে এখন বিয়ে দিও না। আমাকে একটু সময় দাও। দুই-তিন বছরের মধ্যে বিয়ে করবো। কিন্তু এখন না, প্লিজ।
কিন্তু শেষ দফায় পিতামাতা তাকে বলে দিলেন, এখন সময় হয়ে গেছে। আর দেরি নয়। ব্যাস বিয়ে হয়ে যায়। দু’দিনের জন্য হানিমুনে যান তারা। সঙ্গে যায় তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। বোনের বিপদআপদের কথা মাথায় রেখে সঙ্গে যান তার এক বড়ভাইও। সেই হানিমুনে গিয়ে ভোর ৪টার দিকে ভাইয়ের হোটেল কক্ষের দরজায় নক করেন জাহান। এ সম্পর্কে জাহানের ওই ভাই বলেছেন, দরজা খুলতেই জাহান আমাকে জড়িয়ে ধরলো। একটানা কেঁদে যেতে লাগলো। তিনি বাংলাদেশ থেকে টেলিফোনে এসব কথা জানিয়েছেন নিউ ইয়র্ক টাইমসকে। তিনি আরো বলেছেন, ওই সময় জাহান আমাকে বলেছিল ভাই আমাকে বাঁচাও।
হানিমুন শেষে জাহানের স্বামী ফিরে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে গিয়ে স্ত্রীর জন্য ভিসা আবেদন করেন। অন্যদিকে দেশে পরিবারের সদস্যদের কাছে জাহান কাকুতি জানান বিয়েটা বাতিল করে দিতে। এক পর্যায়ে তার পিতামাতা জানতে পারেন জাহান বিচ্ছেদ সম্পর্কিত একজন আইনজীবীর কাছে যোগাযোগ করছে। এটা জানতে পেরে তারা জাহানকে ‘পতিতা’ আখ্যা দেন। পড়াশোনা বন্ধ করে দেন। ঘরে আটকে রাখেন। তার বিরুদ্ধে নৃশংস হয়ে ওঠেন। এসব তথ্য দিয়েছেন জাহান।
তার ভাই বলেছেন, জাহান ভীষণ হতাশায় ভুগছিল। তাই তিনি বোনের পাশে দাঁড়ান। বলেন, ওই সময়ে জাহানের করার কিছুই ছিল না। ভাগ্যের ওপর নিজেকে ছেড়ে দেন জাহান। এক বছর পরে তার স্বামী বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তাদের সম্মানে পার্টি আয়োজন করা হয়। শুধু তখনই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হেসেছিলেন জাহান। এরপর তারা দু’জনে একসঙ্গে চলে যান নিউ ইয়র্কে।
প্রাধান্য বিস্তার করেন স্বামী
২০১৮ সালের মে মাস। কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন জাহান দম্পতি। নিউ ইয়র্কে তাদের প্রথম রাত। স্বামীর কাছে জাহান অনুরোধ করলেন, তাদের প্রথমে দু’জনকে ভালভাবে জানা উচিত। যদি তিনি তাকে বলিউডের কোনো ছবি দেখাতে নিয়ে যান অথবা শহরে ঘোরার সময় তার হাত ধরে রাখেনÑ তাতে খুশি হবেন জাহান। কিন্তু তার এসব কথায় সম্মত হলেন না তার স্বামী।
তার বালাদেশী ওই স্বামী মনে করেন তিনি যেটা বলবেন সেটা তার দাম্পত্য অধিকার। জাহান বলেন, আমি কাঁদতে থাকি। কিন্তু সে কেয়ার করে না তাতে। জাহানের হাতে নিজেই ক্ষত করেছেন। তাকে বলা হয়েছে, যদি তিনি তার স্বামীকে ছেড়ে দেন বা দেয়ার চেষ্টা করেন তাহলে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। নিউ ইয়র্কে পৌঁছার পর তার পাসপোর্ট নিয়ে নিয়েছেন তার স্বামী। তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কলেজে ভর্তি করে দেবেন। অথবা তাকে কাজ করতে বাধা দেবেন না। জাহান বলেন, আমার কাছে কোনো অর্থ ছিল না। বাসার কোনো চাবি পর্যন্ত আমাকে দেয়া হয় নি। সব কিছুতেই থাকতো তার প্রাধান্য।
এ বিষয়ে জাহানের স্বামীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে নিউ ইয়র্ক টাইমস। এ সময় তিনি স্ত্রীর ওপর সহিংসতা বা নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেন। চ্যালেঞ্জ জানান। বলেন, তাদের বিয়ে জোরপূর্বক ছিল না। এ সময় তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কিভাবে তার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। জবাবে তিনি বলেছেন, পারিবারিকভাবে। কিভাবে বিয়ে হয়েছে এ প্রশ্নের উত্তর দেন নি তিনি।
ব্রুকলিনে এক রোববারের রাতে বার্ষিক এক বাংলাদেশী মেলায় জাহানকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার স্বামী। এ সময় তিনি তাকে হাসতে বলেন, যাতে মানুষজন দেখে ভাবে তাদের মধ্যে মধুর ভালবাসা। তার কথামতো কাজ করেছেন জাহান। কিন্তু ওই রাতে যখন তারা বাসায় ফিরছিলেন, তখন জাহানের মনে হলো এভাবে আর নয়। তাই তিনি দৌড়াতে শুরু করেন। দৌড়ে কোথায় যাবেনÑ সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না তার। কিন্তু পিছন থেকে তাকে ধরে ফেলেন তার স্বামী।
আর এই দৃশ্যই দেখতে পান এলম্যান লারসেন। তিনিই জাহানের সহায়তায় এগিয়ে যান। লারসেন বলেছেন, ওই মেয়েটির কোনো সাপোর্ট নেই। সে কাউকে চেনে না। আমরা তার একজন বন্ধু খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সে কাউকে চেনে না। তার কাছে ছিল না কিছুই। এ অবস্থায় বাংলাদেশে ফোন করলো পুলিশ। তার পিতা বললেন, স্বামীর সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া উচিত জাহানের। কারণ, স্বামীর সঙ্গেই তাকে থাকতে হবে।
এ অবস্থায় নিজের মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন এলম্যান লারসেন। তিনি নিজের ফেসবুকে একটি বার্তা পোস্ট করেন। তাতে লেখেনম ‘ঠিক এই মুহূর্তে একজন বাঙালি নারী আইনজীবী প্রয়োজন আমার’।
এই ম্যাসেজটি চোখে পড়লো বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন মুসলিম নারীবাদী শাহানা হানিফের। তিনি অবিলম্বে যোগাযোগ করলেন। জাহানকে কোথায় রাখা যায় তা খুঁজে পেতে চেষ্টা করলেন। কয়েক ঘন্টা চেষ্টা করে তিনি স্থানীয় একটি মসজিদ পেলেন। সেখানে অভিবাসী মুসলিম নারীরা নিরাপদে থাকেন। তারা জাহানের কাছে চলে গেলেন রাত ২টায়। এর তিন দিন পরে পুলিশে রিপোর্ট করেন জাহান।
No comments