রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমাদেরকে কি ছাড়িয়ে গেছে চীন? by আফসান চৌধুরী
মিয়ানমারে
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত ঘৃণা এবং সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এর
রাজনৈতিক রূপটি যদিও অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক এবং সেটার শুরু হয় ব্রিটিশ
শাসনামলে, তবে এর মূল রয়ে গেছে আরও আগে, মুঘল আমলের মধ্যে। চট্টগ্রাম ও
মিয়ানমারের মানুষেরা উভয়েই একে অন্যের এলাকায় বহু শতাব্দি ধরে অভিবাসিত হয়ে
আসছে। শায়েস্তা খান যখন চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব নেন তখন সেটা মোং রাজাদের
অধীনস্থ ছিল।
যাদেরকে রোহিঙ্গা বলা হচ্ছে, ইতিহাসে তাদের আগমণ সম্প্রতিকালে। এরা মূলত অভিবাসী শ্রমিক যারা জীবিকার জন্য বহু শতাব্দি ধরে নিজেদের কাছাকাছি এলাকায় অভিবাসন করে আসছে কিন্তু এখন ইতিহাসের খারাপ একটা মুহূর্তে এসে আটকা পড়ে গেছে। মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন শ্রেণী বেশ কিছুকাল ধরে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য অভিবাসী- বর্ণবাদী কার্ড ব্যবহার শুরু করেছে। ইঙ্গ-বার্মিজ যুদ্ধের পর এবং তারও পরে রোহিঙ্গা-বিরোধী মানসিকতা দেখা দিতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত ছিল আর মিয়ানমারের জনগণ পক্ষ নিয়েছিল দখলদার জাপানিজদের।
খোলামেলা বর্ণবাদ ভাল কাজ দেয় মিয়ানমারে
বিংশ শতকের শুরুর দিকেও রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করার আন্দোলন জোরদার ছিল এবং যুদ্ধের পর ভারতে নতুন রাজ্য সৃষ্ট হলে, রোহিঙ্গারা পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার যেহেতু আলাদা উপনিবেশ ছিল এবং ভারতের অংশ ছিল না, তাই সেটা ঘটেনি। পরে, এই সম্পর্কের অবনতি অব্যাহত থাকে এবং এই কৃষি-নির্ভর চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠিটি ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হয়। ১৯৭৭-৭৮ সালে তাদেরকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়া হয় কিন্তু পরে আন্তর্জাতিক চাপে তারা তাদেরকে ফেরত নিতে বাধ্য হয়।
১৯৮২ সালে রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিকত্বের স্ট্যাটাস হারায়। ১৯৯২ সালে আবারও তাদের বের করে দেয়া শুরু হয় এবং আবারও তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তবে, সবশেষ ২০১৭ সালে সবচেয়ে বড় সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করা হয়েছে এবং তাদের ফিরিয়ে না নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার একটা শক্ত অবস্থান নিয়েছে।
মিয়ানমার একটা খোলামেলা বর্ণবাদী দেশ যেমনটা বাংলাদেশ নয়। বাংলাদেশে বর্ণবাদ যা আছে, তা গোপন রয়েছে যদিও সংখ্যালঘুরা এখানেও সমস্যায় পড়ছে। মিয়ানমারে এই সমস্যা অনেক তীব্র। রোহিঙ্গারা যেহেতু মোঙ্গল বংশোদ্ভূত নয় এবং তাদের ভাষা যেহেতু এক নয়, তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলাটা তাই সহজ হয়েছে। এই জাতিগত বৈষম্য থেকে মিয়ানমার কি অর্জন করেছে, সেটা সবসময় স্পষ্ট হয়নি, কারণ রোহিঙ্গারা কখনই অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না এবং সেখানে কখনও ভূমির সঙ্কটও ছিল না।
তবে, সাধারণভাবে এই গ্রুপসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণা সবসময় সেখানকার মোঙ্গল বংশোদ্ভূত বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে সহায়তা করেছে। তারা যেটা দেখছে, সেটা সম্ভবত ভারতে মুসলিমদের অভিজ্ঞতার মতো একই রকম, বহিরাগত হিসেবে যাদেরকে দেখা হয়, হয় পাকিস্তানী, না হয় বাংলাদেশী। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জন্য কোন কাশ্মীর নেই যেমন বাংলাদেশের এ অঞ্চলে কোন ভূ-কৌশলগত ভূমিকা নেই।
এই সঙ্কটের সাথে বহু মানুষ ও ক্ষমতা জড়িত কিন্তু এখানে একটা প্রধান ভূমিকা পালন করছে চীন।
চীনের অর্জনের জন্য আরসা কোন হুমকি নয়
অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ যথেষ্ট মিয়ানমারপন্থী ও সু চিপন্থী ছিল এবং রোহিঙ্গাদের ইস্যুটিকে বিশেষ করে গেরিলা রোহিঙ্গা সংগঠন আরসাকে তারা সম্ভাব্য ইসলামপন্থীদের ইস্যু হিসেবে দেখে এসেছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠেছে যে তাদের মতো দুর্বল একটি সংগঠন কিভাবে মিয়ানমারের আউটপোস্টে হামলা করলো? এখানে কি কোন বিদেশী ভূমিকা ছিল যে, এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার পাল্টা হামলা করলো এবং তার ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গাদের বের হয়ে যেতে হলো।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আশা করেনি যে এই ঘটনার ফলশ্রুতিতে তাদের সুনামের এতটা ক্ষতি হবে কারণ মিডিয়া, মানবাধিকার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলো তাদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার উদ্দেশ্যে’ অভিযান চালানোর অভিযোগ এনেছে। এর অর্থ হলো মিয়ানমারের সাথে এখন ব্যবসা করাটা কিছুটা হলেও অনৈতিক। ইতোমধ্যে, সু চি’র যশ খ্যাতি বিলুপ্ত হয়েছে এবং সামরিক জেনারেলরা আরও প্রভাব অর্জন করেছে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের চাবিকাঠি এখন তাদের হাতেই রয়েছে। তারা দীর্ঘদিন সাধারণ জনগণের মধ্যে অজনপ্রিয় ছিল কিন্তু রোহিঙ্গাদের বের করে দেয়ায় তাদের জনপ্রিয়তা এখন বেড়েছে।
পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা সে সময় ধারণা করেছিলো যে মিয়ানমারে চীনের প্রভাব হ্রাস পেতে শুরু করেছে এবং মিয়ানমার এখন নিজেকে ধরে রাখতে সক্ষম। কিন্তু এক বছর পরেই, চীন এখনও সেখানে অজনপ্রিয় হলেও তাদের উপস্থিতি বাড়তে শুরু করে। চীনই এখন একমাত্র বড় দেশ যারা তাদের অর্থনৈতিক বিনিময় এবং তাদের প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি পেলে জাতিগত নিধনের বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে প্রস্তুত রয়েছে। পুরো বিশ্ব যেখানে কিছুটা পিছিয়ে এসেছে, সেখানে চীন আরও এগিয়ে গেছে এবং মিয়ানমারকে তাদের উপর নির্ভরশীল করে তুলেছে।
ইতোমধ্যে আরসা কোন ধরনের ‘চরমপন্থী বিস্ফোরণ’ ঘটায়নি, যেটা সবাই ধারণা করেছিল এবং বাংলাদেশেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কোন ধরনের সন্ত্রাসী হামলাও হয়নি যদিও আরসার সাথে সম্পৃক্ততার সন্দেহে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে, বাংলাদেশে নিজস্ব চরমপন্থী গ্রুপ রয়েছে কিন্তু আরসার সাথে তাদের সম্পর্কের কোন অগ্রগতি হয়নি।
বাংলাদেশের অগ্রাধিকার ও চীন
রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। চীন মিয়ানমারের সাথে একটা দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিল, যেটা স্বাভাবিকভাবেই কাজ করেনি। বাংলাদেশের সরকারী বলয়ে এই ধারণাটা ক্রমেই বাড়ছে যে, রোহিঙ্গারা এখানে স্থায়ীভাবে থাকতেই এসেছে। তহবিল ঠিকঠাক মতো পাওয়া গেলে বাংলাদেশ এ বিষয়টি নিয়ে হয়তো অতটা তোড়জোড় করবে না।
এদিকে, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য অগ্রাধিকার হওয়ায় চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা একটা দ্বিমুখী প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ চায় শরণার্থীরা বাড়ি ফিরে যাক এবং এজন্য তারা চীনকে সহায়তা করার অনুরোধ করেছে। চীন প্রতিশ্রুতি দিলেও খুব বেশি বাস্তবায়ন হয়নি। অন্যদিকে, বাণিজ্য সম্পর্ক যথেষ্ট ইতিবাচক গতিতে চলছে এবং চীনের সহায়তার কারণে ভারতের উপর বাংলাদেশের একক নির্ভরতার জায়গাটিতে কিছুটা হলেও ভারসাম্য এসেছে।
বাংলাদেশ খুব একটা তোড়জোড় করবে না এবং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সামনে এগুবে। মিয়ানমারে দুটো জিনিস অর্জনে সক্ষম হয়েছে চীন। পশ্চিমাদের হুমকি থেকে মুক্ত হয়েছে তারা, যেটা মিয়ানমারে তাদের একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারতো আর নিজেদের প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে আরও বেশি প্রতিশ্রুতি পেয়েছে তারা। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে চলে আসার আগে মিয়ানমারের চীনকে যতটা প্রয়োজন ছিল, এখন তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন তাদের।
এই দুটো বিষয়ের মধ্যে কোন যোগাযোগ আছে কি না, সেটা জানা না গেলেও এতে কোন সন্দেহ নেই যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে সহায়তা করায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের যে সমালোচনার মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল, সেই জায়গাটা ভালোই সামলেছে তারা।
যাদেরকে রোহিঙ্গা বলা হচ্ছে, ইতিহাসে তাদের আগমণ সম্প্রতিকালে। এরা মূলত অভিবাসী শ্রমিক যারা জীবিকার জন্য বহু শতাব্দি ধরে নিজেদের কাছাকাছি এলাকায় অভিবাসন করে আসছে কিন্তু এখন ইতিহাসের খারাপ একটা মুহূর্তে এসে আটকা পড়ে গেছে। মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন শ্রেণী বেশ কিছুকাল ধরে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য অভিবাসী- বর্ণবাদী কার্ড ব্যবহার শুরু করেছে। ইঙ্গ-বার্মিজ যুদ্ধের পর এবং তারও পরে রোহিঙ্গা-বিরোধী মানসিকতা দেখা দিতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত ছিল আর মিয়ানমারের জনগণ পক্ষ নিয়েছিল দখলদার জাপানিজদের।
খোলামেলা বর্ণবাদ ভাল কাজ দেয় মিয়ানমারে
বিংশ শতকের শুরুর দিকেও রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করার আন্দোলন জোরদার ছিল এবং যুদ্ধের পর ভারতে নতুন রাজ্য সৃষ্ট হলে, রোহিঙ্গারা পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার যেহেতু আলাদা উপনিবেশ ছিল এবং ভারতের অংশ ছিল না, তাই সেটা ঘটেনি। পরে, এই সম্পর্কের অবনতি অব্যাহত থাকে এবং এই কৃষি-নির্ভর চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠিটি ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হয়। ১৯৭৭-৭৮ সালে তাদেরকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়া হয় কিন্তু পরে আন্তর্জাতিক চাপে তারা তাদেরকে ফেরত নিতে বাধ্য হয়।
১৯৮২ সালে রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিকত্বের স্ট্যাটাস হারায়। ১৯৯২ সালে আবারও তাদের বের করে দেয়া শুরু হয় এবং আবারও তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তবে, সবশেষ ২০১৭ সালে সবচেয়ে বড় সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করা হয়েছে এবং তাদের ফিরিয়ে না নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার একটা শক্ত অবস্থান নিয়েছে।
মিয়ানমার একটা খোলামেলা বর্ণবাদী দেশ যেমনটা বাংলাদেশ নয়। বাংলাদেশে বর্ণবাদ যা আছে, তা গোপন রয়েছে যদিও সংখ্যালঘুরা এখানেও সমস্যায় পড়ছে। মিয়ানমারে এই সমস্যা অনেক তীব্র। রোহিঙ্গারা যেহেতু মোঙ্গল বংশোদ্ভূত নয় এবং তাদের ভাষা যেহেতু এক নয়, তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলাটা তাই সহজ হয়েছে। এই জাতিগত বৈষম্য থেকে মিয়ানমার কি অর্জন করেছে, সেটা সবসময় স্পষ্ট হয়নি, কারণ রোহিঙ্গারা কখনই অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না এবং সেখানে কখনও ভূমির সঙ্কটও ছিল না।
তবে, সাধারণভাবে এই গ্রুপসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণা সবসময় সেখানকার মোঙ্গল বংশোদ্ভূত বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে সহায়তা করেছে। তারা যেটা দেখছে, সেটা সম্ভবত ভারতে মুসলিমদের অভিজ্ঞতার মতো একই রকম, বহিরাগত হিসেবে যাদেরকে দেখা হয়, হয় পাকিস্তানী, না হয় বাংলাদেশী। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জন্য কোন কাশ্মীর নেই যেমন বাংলাদেশের এ অঞ্চলে কোন ভূ-কৌশলগত ভূমিকা নেই।
এই সঙ্কটের সাথে বহু মানুষ ও ক্ষমতা জড়িত কিন্তু এখানে একটা প্রধান ভূমিকা পালন করছে চীন।
চীনের অর্জনের জন্য আরসা কোন হুমকি নয়
অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ যথেষ্ট মিয়ানমারপন্থী ও সু চিপন্থী ছিল এবং রোহিঙ্গাদের ইস্যুটিকে বিশেষ করে গেরিলা রোহিঙ্গা সংগঠন আরসাকে তারা সম্ভাব্য ইসলামপন্থীদের ইস্যু হিসেবে দেখে এসেছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠেছে যে তাদের মতো দুর্বল একটি সংগঠন কিভাবে মিয়ানমারের আউটপোস্টে হামলা করলো? এখানে কি কোন বিদেশী ভূমিকা ছিল যে, এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার পাল্টা হামলা করলো এবং তার ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গাদের বের হয়ে যেতে হলো।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আশা করেনি যে এই ঘটনার ফলশ্রুতিতে তাদের সুনামের এতটা ক্ষতি হবে কারণ মিডিয়া, মানবাধিকার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলো তাদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার উদ্দেশ্যে’ অভিযান চালানোর অভিযোগ এনেছে। এর অর্থ হলো মিয়ানমারের সাথে এখন ব্যবসা করাটা কিছুটা হলেও অনৈতিক। ইতোমধ্যে, সু চি’র যশ খ্যাতি বিলুপ্ত হয়েছে এবং সামরিক জেনারেলরা আরও প্রভাব অর্জন করেছে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের চাবিকাঠি এখন তাদের হাতেই রয়েছে। তারা দীর্ঘদিন সাধারণ জনগণের মধ্যে অজনপ্রিয় ছিল কিন্তু রোহিঙ্গাদের বের করে দেয়ায় তাদের জনপ্রিয়তা এখন বেড়েছে।
পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা সে সময় ধারণা করেছিলো যে মিয়ানমারে চীনের প্রভাব হ্রাস পেতে শুরু করেছে এবং মিয়ানমার এখন নিজেকে ধরে রাখতে সক্ষম। কিন্তু এক বছর পরেই, চীন এখনও সেখানে অজনপ্রিয় হলেও তাদের উপস্থিতি বাড়তে শুরু করে। চীনই এখন একমাত্র বড় দেশ যারা তাদের অর্থনৈতিক বিনিময় এবং তাদের প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি পেলে জাতিগত নিধনের বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে প্রস্তুত রয়েছে। পুরো বিশ্ব যেখানে কিছুটা পিছিয়ে এসেছে, সেখানে চীন আরও এগিয়ে গেছে এবং মিয়ানমারকে তাদের উপর নির্ভরশীল করে তুলেছে।
ইতোমধ্যে আরসা কোন ধরনের ‘চরমপন্থী বিস্ফোরণ’ ঘটায়নি, যেটা সবাই ধারণা করেছিল এবং বাংলাদেশেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কোন ধরনের সন্ত্রাসী হামলাও হয়নি যদিও আরসার সাথে সম্পৃক্ততার সন্দেহে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে, বাংলাদেশে নিজস্ব চরমপন্থী গ্রুপ রয়েছে কিন্তু আরসার সাথে তাদের সম্পর্কের কোন অগ্রগতি হয়নি।
বাংলাদেশের অগ্রাধিকার ও চীন
রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। চীন মিয়ানমারের সাথে একটা দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিল, যেটা স্বাভাবিকভাবেই কাজ করেনি। বাংলাদেশের সরকারী বলয়ে এই ধারণাটা ক্রমেই বাড়ছে যে, রোহিঙ্গারা এখানে স্থায়ীভাবে থাকতেই এসেছে। তহবিল ঠিকঠাক মতো পাওয়া গেলে বাংলাদেশ এ বিষয়টি নিয়ে হয়তো অতটা তোড়জোড় করবে না।
এদিকে, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য অগ্রাধিকার হওয়ায় চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা একটা দ্বিমুখী প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ চায় শরণার্থীরা বাড়ি ফিরে যাক এবং এজন্য তারা চীনকে সহায়তা করার অনুরোধ করেছে। চীন প্রতিশ্রুতি দিলেও খুব বেশি বাস্তবায়ন হয়নি। অন্যদিকে, বাণিজ্য সম্পর্ক যথেষ্ট ইতিবাচক গতিতে চলছে এবং চীনের সহায়তার কারণে ভারতের উপর বাংলাদেশের একক নির্ভরতার জায়গাটিতে কিছুটা হলেও ভারসাম্য এসেছে।
বাংলাদেশ খুব একটা তোড়জোড় করবে না এবং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সামনে এগুবে। মিয়ানমারে দুটো জিনিস অর্জনে সক্ষম হয়েছে চীন। পশ্চিমাদের হুমকি থেকে মুক্ত হয়েছে তারা, যেটা মিয়ানমারে তাদের একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারতো আর নিজেদের প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে আরও বেশি প্রতিশ্রুতি পেয়েছে তারা। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে চলে আসার আগে মিয়ানমারের চীনকে যতটা প্রয়োজন ছিল, এখন তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন তাদের।
এই দুটো বিষয়ের মধ্যে কোন যোগাযোগ আছে কি না, সেটা জানা না গেলেও এতে কোন সন্দেহ নেই যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে সহায়তা করায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের যে সমালোচনার মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল, সেই জায়গাটা ভালোই সামলেছে তারা।
No comments