কালি ও কলমে প্রকাশিত শহীদ কাদরীর কবিতা
>>কালি ও কলমে প্রকাশিত শহীদ কাদরীর কবিতা<<
একে ব’লতে পারো একুশের কবিতা
এই কবিতাটি সরাসরি একুশের কবিতা নয়,
কিন্তু যদি তুমি অপলক তাকিয়ে থাকো এই শব্দমালার দিকে,
তুমি দেখতে পাবে এই কবিতার ভেতর ফল্গুধারার মত বয়ে
চলেছে
শ্রাবণের রাঙা জল – একে তুমি একুশের কবিতা বলতে পারো।
এই কবিতাটি সরাসরি একুশের কবিতা নয়,
কিন্তু যারা প্রেমিক তাদের চোখে ঠিক ধরা পড়বে –
এই কবিতার উপর আষাঢ়ের ঘনমেঘের এবং শাড়ি পরা বাংলার
মায়েদের
দীর্ঘ ছায়া পড়ে আছে;
এই কবিতার গভীরে এখনও ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’,
এখনও বিরতিহীনভাবে বয়ে চলেছে বাংলার বর্ষণমুখর রাত্রির
কালো হাওয়া
এ কবিতা একুশেরই কবিতা।
এই কবিতাটি সরাসরি একুশের কবিতা নয়।
কিন্তু বৈশাখের খররৌদ্রে সোনালি খড়বাহী গাড়ির মতো
মন্থরভাবে এগিয়ে চলেছে এই কবিতা, এখন আমি জানি
একুশই হচ্ছে এই পঙ্ক্তিগুলোর জরায়ু – একে আমি একুশের
কবিতাই বলতে চাই!
আমার মনে আছে ১৯৫২-র শেস্নøvগান চঞ্চল একুশের অপরাহ্ণে
আমি দেখেছি পাখির পালকের মতো হালকা এক
ভিখিরি বালকের মৃত্যু এক অমোঘ থ্রি-নট-থ্রির গুলিতে।
তার কথা একুশের ইতিহাসে লেখাজোখা নেই;
এই কবিতাটিকে আমি সেই নিহত বালকের
শ্বেত কফিন ও স্মৃতির মিনার বলতে চাই,
এবং সেই অর্থেও একে আমি একুশের কবিতাই বলবো।
সেই এক সময় ছিল যখন বাংলা ভাষা থেকে নির্বাসনে পাঠানো
হয়েছিল
বাংলা ভাষাকেই। সরকারি উর্দিপরা বিদেশি সৈনিকের মতো ভারি
বুট পরে
সদর্পে কুচকাওয়াজ করে বেড়িয়েছে আমাদের অচেনা শব্দগুলো
অথচ আমার এ শব্দমালা বাংলা ছাড়া অন্য কিছু নয়,
আর সে অর্থেও একে আমি একুশের কবিতা বলতে চাই।
এই কবিতাটি সরাসরি একুশের কবিতা নয়।
কিন্তু যদি বরকত, রফিক, সালাম, জববারের অফুরান রক্তের
লালে
আমার স্বদেশ ডুবে না যেতো – এই কবিতাটি লেখা হতো না
কোনোদিন
অতএব এই কবিতাটিকে আমি একুশের কবিতাই বলতে চাই
দোহাই তোমাদের, তোমরা আপত্তি করো না।
পথে হলো দেরি
পথে পথে আর পান্থশালায়
হয়ে গেল বড় দেরি
কাঁধে নিয়ে সব মৃত হরিণের
দুয়ারে দুয়ারে স্বপ্ন করেছি ফেরি।
তোমার বাগানে মালাকার নেই
বাগানে ঝরছে চেরি
দরোজা জানালা বন্ধ সকলই
হয়েছে কি খুব দেরি?
তবু আজকে লণ্ঠন জ্বেলে
লিখব তোমার কথা
সে-সব কথা কি নিমেষে মেলাবে?
আমার বেলায় হবে নাকি অন্যথা?
শীতের পাহাড়ি তীব্র হিম বাতাস
ছিঁড়েছে আমার তাঁবু;
‘আপনি বড্ড দেরি করেছেন’
হেঁকে বলেস্নøন ইস্টিশনের বাবু।
পথে পথে আর পান্থশালায়
হয়ে গেল বড় দেরি,
কাঁধে নিয়ে আমি মৃত হরিণের শব
একা একা হাঁটি। তোমার বাগানে
সারা দিনরাত অঝোরে ঝরবে চেরি।
আপনারা জানেন
Philosophers have only interpreted the world in various ways; the point however is to change it – Marxs, Thesis on Feurbach
আপনারা জানেন
মহামতি পেস্নøটো কী বলেছেন…
দার্শনিক কান্ট কী বলেছেন…
হেগেল কী বলেছেন…
মহামতি বুদ্ধ কী বলেছেন…
দেকার্তে কিংবা
বের্গসঁ কী বলেছেন…
বার্ট্রান্ড রাসেল কী বলেছেন…
হোয়াইটহেড কী বলেছেন…
জীবনানন্দ দাশ কী বলেছেন…
বুদ্ধদেব বসু কিংবা বিষ্ণু দে কী বলেছেন…
কী বলেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ!
কী বলেছেন কবিকুলচূড়মণি মাইকেল!
আপনারা জানেন
ঈশ্বরের পুত্র যিশু কী বলেছেন…
ইউরিপিডিস কিংবা সফোক্লিস কী বলেছেন…
মিশেল ফুকো কী বলেছেন,
দেরিদ্দা কী বলেছেন
কী বলেছেন পিকাসো
কিংবা পল এলুয়ার!
এই গ্রহের মহাপুরুষরা কে কী বলেছেন
আপনারা সবই জানেন। এখানে বক্তৃতা আমার উদ্দেশ্য
নয়। আমি এক নগণ্য মানুষ, আমি
শুধু বলি : জলে প’ড়ে যাওয়া ঐ পিঁপড়েটাকে ডাঙায় তুলে দিন
বিপস্নøব
মনজুর এলাহীর বাগানে,
ছায়াচ্ছন্ন সন্ধ্যায়, বসেছিলাম আমরা
কয়েকজন। কথা হ’লো, অনেক ধরনের
কথা হ’লো। কেউ বললেন বঙ্গবন্ধুর কথা,
সেই প্রসঙ্গে নিহত এ্যালেন্দে এবং
চিলিতে সামরিক উত্থানের ইতিহাসও
উলেস্নøখ করলেন কেউ কেউ। বলা বাহুল্য
ইরাক ইরানের কথাও উঠলো। ক্যাস্ট্রোর পর
কিউবার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ,
বিশ্বব্যাপী অসৎ বণিকদের দাপট,
এবং বাংলার বিপন্ন মানুষ
নিরন্ন আজীবন – এইসব কথা বলাবলি
করলাম আমরা কাজু বাদাম আর
কফি খেতে খেতে। ক্রমশ রাত্রি নেমে এলো
কালো বেড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে।
টেবিল চেয়ারগুলো ঘিরে জোনাকিরা
জ্বলতে লাগলো – যেন চিরটাকাল এরকম
জ্বলতে থাকবে তারা। আমরা উঠে গেলাম
ডিনার টেবিলে।
মনজুর এলাহী আবার বললেন : বন্দুকের নলই
শক্তির উৎস! রক্তপাত ছাড়া শ্রেণিসাম্য প্রতিষ্ঠা
অসম্ভব, অনায়াসে কেউ শ্রেণিস্বার্থ ছেড়ে দেয় না।
আমি জানালা থেকে দেখলাম
মনজুর এলাহীর গোটা বাগান
জোনাকিরা দখল করে নিয়েছে –
বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে।
হমত্মারকদের প্রতি
বাঘ কিংবা ভালুকের মতো নয়,
বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা হাঙরের দল নয়
না, কোনো উপমায় তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে না
তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম
বুট, সৈনিকের টুপি,
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের কথাও হয়েছিলো,
তারা ব্যবহার করেছিল
এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো
বাংলা ভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো
দেখতে, এবং ওরা মানুষই
ওরা বাংলা মানুষ
এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনবো না কোনোদিন।
বিব্রত সংলাপ
তুমি বারবার নতুন কিছু শুনতে চাইলে
বোল্লে : ‘আমাকে নতুন কিছু শোনাও’
আমি বোলস্নাম : ‘অমাবস্যার পুঞ্জপুঞ্জ অন্ধকার
একদল কালো মুখোশ-পরা
ডাকাতের মতো
শিকার করতে চাইছে শাদা খরগোশের মতো কম্পমান
চাঁদটাকে’
তুমি বোলেস্ন : ‘এর কোনো অর্থ নেই!’
আমি আবার বোলস্নাম : ‘তুমি কী শোনোনি
তিনটে মাছের আক্রমণে নিহত মাছরাঙা প’ড়ে আছে নদীর
ওপারে’
তোমার চোখের তারা
অবিশ্বাসে বারবার নেচে উঠলো : ‘এটা একটা
প্রকৃতি-বিরুদ্ধ ঘটনা, হতেই পারে না’
আমি এবার একটু উঁচু গলায় : ‘বিশ্বাস করো অরণ্যের অব্যাহত
আক্রমণে দারুণ সংকুচিত হয়ে পড়ছে
আমাদের শহরগুলো।’
মস্নান হেসে তুমি বোলেস্ন : ‘ব্যাপারটা বরং উলটো
মানুষের হমত্মারক হাতের কল্যাণে এ-দেশে
পুষ্পল ঋতু আর দেখাই যায় না’
আমি এবার রেগে উঠলাম : ‘তুমি জানো
সমুদ্র প্রত্যাখ্যান করেছে আমাদের নদীগুলোকে,
তারা ফিরে আসছে তাতার দস্যুর তরঙ্গের মতো
আমাদের গ্রাম ও শহরের দিকে।’
হেলায়-ফেলায় তুমি বোলেস্ন : ‘অমন অলক্ষুণে কথা
শুনতেও নেই।’
আমি আবার বোলস্নাম : ‘ঐ দ্যাখো হরিণশাবকের তাড়া খেয়ে
দিশেহারা ডোরাকাটা বাঘগুলো
দিগ্বিদিক
পালাচ্ছে ছুটে।’
তুমি মস্নান হেসে বোলেস্ন : ‘এমন সুদিন কখনো কি আসবে?’
বস্টন ১৯৯০
সেই সময়
শ্রাবণ তোমার
শরীরে লিখেছে গল্প
– তার স্বাদ ভুলি নাই
শত্রম্নসেনার সতর্ক চোখ এড়িয়ে
তুমি এসেছিলে
তিনটে রাসত্মা পেরিয়ে
বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে
– ভুলি নাই
সময়টা ছিল যুদ্ধের
কারফিউ চতুর্দিকে
বোকা, হাবা ও অবুঝদের
দলে মিশে গিয়ে আমরা
জ্ঞানী বুদ্ধের
বাণীর বদলে বন্দুক
নিয়েছি নির্দ্বিধায়
– ভুলি নাই
ক্রন্দন আর কলেস্নাল-ভরা
এলো স্বাধীনতা, শামিত্ম
এলো যুদ্ধশেষের ক্লামিত্ম
তখন তোমাকে
বলিনি কি ‘‘অপ্সরা
‘‘সম্বল শুধু
‘‘তোমার মুখের কামিত্ম
কিন্তু তবুও দাওনি ত তুমি ধরা
– ভুলি নাই
যদি মুখ খুলি
আমি মুখ খুললে কী বলবো বলুন,
যদি আমাকে কিছু বলতেই হয়,
তাহলে কী ব’লবো – ঐ দেখুন
রুপালি অলংকার পরা নিগ্রো রমণীর মতো
রাত্রির শরীর জ্বলছে
কিংবা যদি বলি : কিন্নরকণ্ঠ নদীগুলো
আজো গান গাইছে – কেউ শুনবে না
এইসব কাব্যিক কথা।
যদি মুখ খুলতেই হয়
আমি ব’লবো : আমাদের নদীগুলোর নাব্যতা
ক্রমশ কমে যাচ্ছে, উত্তর বাংলায়
শীতের পোশাক যাওয়া দরকার;
আমেরিকা না বেজিং – সাহায্যের হাত
প্রসারিত হবে কার দিকে? এ ব্যাপারে
সুশীল সমাজ আজ কী মনে করেন?
কার কণ্ঠে তুলে দেবো
কবিতার এই মণিহার?
আমি জানি গুপ্তঘাতকেরা
ছড়িয়ে রয়েছে আমার শহরে।
তাদের নিধন চেয়ে
কবিতাকে অস্ত্রের মতো
ব্যবহার করতে চেয়েছি আমি বহুবার।
কিন্তু কবিতা কেবল
ঘুরে বেড়ায় যেখানে রাঙা বল নিয়ে
বিকেলে খেলার মাঠে ছেলেরা জটলা পাকায়
অথবা মুখ গুঁজে পড়ে থাকে
মহিলাদের চুলের অন্ধকারে।
অপেক্ষা করছি
সেই সাত-সকালে তুমি বেরিয়েছো,
এখনও ফেরার নাম নেই।
টেলিফোন করছি এমনভাবে
যাতে বৃষ্টিধারার মতো নম্বরগুলো বেজে ওঠে,
যাতে তোমার মনে হয়
কে যেন গাইছে গীতবিতানের গানগুলো,
কিন্তু তবুও তোমার কোনো উত্তর নেই।
তিনটে এসএমএস করলাম,
দয়া করে উত্তর দাও।
তুমি যখন বাইরে যাও
ভয়ে আমি (কবির ভাষায়) কাঁপতে থাকি,
আর যখন ফিরে আসো
মনে হয় আমি সেই লোক যে-একদা
চন্দ্রপৃষ্ঠে হেঁটেছিল।
দ্যাখো, ভয় আমি পাই
কেননা ইতিহাসের অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে
আজ আমি জ্বরাগ্রস্ত –
বন্দি একটি বিদেশি বারান্দায়।
হ্যাঁ, বিচ্ছেদ তা যতো ক্ষণকালীনই হোক
তাকে আমি ভয় পাই।
সব বিচ্ছেদের মধ্যেই রয়েছে মৃত্যুর স্বাদ।
শামত্ম বিকেলে
দেবতার মতো দেবদারু গাছ
আজ আর কোনো মন্ত্র উচ্চারণ করে না;
সোনালি সূর্যাস্তকে
আহবান জানায় না কোনো ঊর্ধ্বযানী সন্ধ্যার আজান;
সংহারের কালী-মূর্তির মতো রাত্রি নামে
পৃথিবীব্যাপী।
সকাল সাতটায় তুমি বেরিয়ে গেছো,
এখন বিকেল পাঁচটা। তবে কি আমাদের আর
দেখা হবে না কোনোদিন?
ইরাক জ্বলছে। আফগানিসত্মানের পাহাড়ে-পাহাড়ে
হমত্মারকদের সাব-মেশিনগান
গর্জন করছে বারবার। আত্মহত্যাকামী
ব্রেনওয়াশ্ড্ বালকেরা ঊরুতে গ্রেনেড বেঁধে
ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের শহরে।
ঘন ঘন সাইরেন বাজিয়ে ছুটছে
পুলিশের হলুদ গাড়ি।
টুইন টাওয়ারে যেদিন বিমান আক্রমণ হ’লো
সেদিন তুমি নিউইয়র্কে।
আর গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর সময়
আমি কলকাতায়। প্রায় আজীবন
বিচ্ছেদ ভাবাতুর আমি।
বেরিয়েছো সেই সাত-সকালে
এখনও ফেরার নাম নেই।
মৃত্যুর আগে প্রত্যেকেরই প্রাপ্য
একটি শেষ চুম্বন – আমি কী তাও পাবো না!
মানুষ, নতুন শতকে
আজ আবার উদ্যত ছুরি মানুষের হাতে,
ওর পায়ের নিচে
পিষ্ট হচ্ছে নারী,
শিশুরা নিহত হচ্ছে চতুর্দিকে!
কবি, তোমার বর্মগুলো বের করে নাও।
তোমার কবিতাই শ্রেষ্ঠ বর্ম আজ!
মধ্যযুগের অন্ধকার ছিঁড়ে
আবার উদ্যত ছুরি
মানুষের হাতে।
আমাদের চেনা নগরগুলো থেকে
উঠছে ক্রন্দনধ্বনি
কবি, ওকে প্রতিহত করো।
কবি তুমি জানো আমাদের প্রিয় কবিতার
অমর পঙ্ক্তিগুলো
হত্যার বিরুদ্ধে চিরকাল – চিরকাল…
কবি, ওকে প্রতিহত করো \
এখন সেই সময়
যাকে অসময় বলতে পারো, দুঃসময় বলতে পারো
দোয়েলের গান কেউ পছন্দ ক’রছে না
কোয়েলের গান কেউ পছন্দ ক’রছে না
পৃথিবীব্যাপী এখন শুধু
পাতা ঝরার শীতার্ত গান ছাড়া
অন্য কোনো ধ্বনি নেই
ওক গাছ কিংবা পাইন গাছ
শিমুল অথবা কৃষ্ণচূড়া
শীতের আক্রমণ থেকে নিসত্মার নেই কারুর
শুধু আর্তনাদ ঝরা-পাতার
আমাদের লাল, নীল, সবুজ পাতাগুলো,
আমাদের প্রিয় পাতাগুলো ঝ’রে পড়ছে,
স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈনিকদের মতো ঝ’রে পড়ছে,
শুধু পাতা ঝ’রার আর্তনাদ
শুধু পাতা ঝরার শোকার্ত চিৎকার চতুর্দিকে।
অথচ সমস্ত পৃথিবীর ঝরা-পাতাদের চিৎকারকে ছাপিয়ে
ভূকম্পনে বিধ্বস্ত গ্রামের মন্দিরে
ঘণ্টাধ্বনির মতো,
জলোচ্ছ্বাসের পরের প্রথম ভোরের
আজানের মতো,
কবি তার উত্থানের গানটি গাইবে
অসময় বলো, দুঃসময় বলো,
গান থামবে না।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের গল্প
সেদিন দুপুরবেলা
অন্যমনে ছিলাম ব’সে মন্দির-চত্বরে
আমার কৈশোরের এক
ছায়াচ্ছন্ন দিনে।
এয়ারগানের ছর্রাবেঁধা নিহত কাকের কলকাতাকে
স্মৃতির একটি গুচ্ছে
মিলিয়ে নিয়ে,
সংহত ক’রে,
বসেছিলাম আমরা তিনজন (আমি,
জাহাঙ্গীর আর সুকুমার)।
আবাল্য অবাধ্য কথক আমি নতুন
বন্ধুদের শোনাচ্ছিলাম কলকাতার ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে
ঘুরে ঘুরে আমার (জন্মদিনে পাওয়া)
এয়ারগান কত-না চড়ুই আর কাকাতুয়া নির্দ্বিধায়
শিকার করেছে।
আর সূর্যটাকে সেদিন
মনে হয়েছিল একটা লাল বিশাল ললিপপ্ (নিউ-
মার্কেট থেকে কেনা) – আমার মুখে এই
উক্তিটা শুনে জাহাঙ্গীর উঠলো ব’লে ‘আর
গুল-তাপ্পি মারিস না-তো’ আর আমি যেই বলতে গেছি
‘ঠিক্ বলেছিস্!’ অমনি চোখজোড়াটা
আটকে গ্যালো বটগাছের নিচে,
দেখি, একটা মরা শালিক
টেলিভিশনের অ্যান্টেনার মতো
শূন্যে দু’পা তুলে
নিশ্চিন্তে রয়েছে প’ড়ে।
আর লাইন দিয়ে সারিসারি লাল পিঁপড়ে
শালিকটার চোখের মণি খুঁটেখুঁটে খাচ্ছে!
কোথাও কোনো বেদনার চিহ্ন নেই,
না-নৃত্যরত গাছের পাতায়, না-গগনম-লের অসীম
নীলিমায়
এ-ভাবেই আমার বিশ্বাসগুলো
পাখির চোখের মতো খুঁটেখুঁটে
খেয়ে ফেলেছে দুপুর-বেলার সেই লাল পিঁপড়েগুলো।
কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর
কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর –
ব্যক্তিগত গ্রাম থেকে অনাত্মীয় শহরে
পুকুরের যৌথ স্নান থেকে নিঃসঙ্গ বাথরুমে
কোনো নির্বাসনই কাম্য নয়
কাম্য নয়
কাম্য নয় আর –
জুঁই, চামেলি, চন্দ্রমলিস্নøকা কিংবা কাঠগোলাপ থেকে
টিউলিপ ম্যাগনোলিয়া অথবা ক্রিসেনথিমাম
নিজস্ব শহর থেকে অচেনা ফুটপাতে
এশিয়ার আকাশে ময়ূর নীল থেকে
কুয়াশাচ্ছন্ন প্রতীচ্য
না, কোনো নির্বাসনই
কাম্য নয়
আর।
কাম্য নয় আপন ভদ্রাসন থেকে ভাড়াটে ফ্লাটে
এই শব্দহীন শোল মাছের ঝোল থেকে
স্বাদমুক্ত চিকেন স্যুপ
আর ডিনার রোলে এ নির্বাসন
না, কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর।
পোকা-মাকড়ের গুঞ্জনে ভরা
তলোয়ারের মতন দীপ্তিমান বৈশাখ থেকে
শিকারি কুকুরের মতো শীত হাওয়ার চিৎকারে
এই যে নির্বাসন – কাম্য নয় তা।
নিজস্ব মহিলার আলিঙ্গন থেকে
হননমত্ত জনতার ব্যুহে
এই যে নির্বাসন – কাম্য নয় আর।
প্রাচ্য থেকে প্রতীচ্যে
অন্য এক উল্লাস-মত্ত পতাকার নিচে
এই যে নতজানু নির্বাসন – কাম্য নয় আর
প্রেম থেকে অপ্রেমে,
ধর্ম থেকে ধর্মান্ধতায়
প্রগতি থেকে প্রতিক্রিয়ার মধ্যযুগীয় আবর্তে,
চুম্বন থেকে চুম্বনহীনতায়
জীবনের ওপারে কোনো অমত্মহীন কফিনে
এই যে নির্বাসন
আমার কাম্য নয় আর
কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর।
এই কবিতাটি সরাসরি একুশের কবিতা নয়,
কিন্তু যদি তুমি অপলক তাকিয়ে থাকো এই শব্দমালার দিকে,
তুমি দেখতে পাবে এই কবিতার ভেতর ফল্গুধারার মত বয়ে
চলেছে
শ্রাবণের রাঙা জল – একে তুমি একুশের কবিতা বলতে পারো।
এই কবিতাটি সরাসরি একুশের কবিতা নয়,
কিন্তু যারা প্রেমিক তাদের চোখে ঠিক ধরা পড়বে –
এই কবিতার উপর আষাঢ়ের ঘনমেঘের এবং শাড়ি পরা বাংলার
মায়েদের
দীর্ঘ ছায়া পড়ে আছে;
এই কবিতার গভীরে এখনও ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’,
এখনও বিরতিহীনভাবে বয়ে চলেছে বাংলার বর্ষণমুখর রাত্রির
কালো হাওয়া
এ কবিতা একুশেরই কবিতা।
এই কবিতাটি সরাসরি একুশের কবিতা নয়।
কিন্তু বৈশাখের খররৌদ্রে সোনালি খড়বাহী গাড়ির মতো
মন্থরভাবে এগিয়ে চলেছে এই কবিতা, এখন আমি জানি
একুশই হচ্ছে এই পঙ্ক্তিগুলোর জরায়ু – একে আমি একুশের
কবিতাই বলতে চাই!
আমার মনে আছে ১৯৫২-র শেস্নøvগান চঞ্চল একুশের অপরাহ্ণে
আমি দেখেছি পাখির পালকের মতো হালকা এক
ভিখিরি বালকের মৃত্যু এক অমোঘ থ্রি-নট-থ্রির গুলিতে।
তার কথা একুশের ইতিহাসে লেখাজোখা নেই;
এই কবিতাটিকে আমি সেই নিহত বালকের
শ্বেত কফিন ও স্মৃতির মিনার বলতে চাই,
এবং সেই অর্থেও একে আমি একুশের কবিতাই বলবো।
সেই এক সময় ছিল যখন বাংলা ভাষা থেকে নির্বাসনে পাঠানো
হয়েছিল
বাংলা ভাষাকেই। সরকারি উর্দিপরা বিদেশি সৈনিকের মতো ভারি
বুট পরে
সদর্পে কুচকাওয়াজ করে বেড়িয়েছে আমাদের অচেনা শব্দগুলো
অথচ আমার এ শব্দমালা বাংলা ছাড়া অন্য কিছু নয়,
আর সে অর্থেও একে আমি একুশের কবিতা বলতে চাই।
এই কবিতাটি সরাসরি একুশের কবিতা নয়।
কিন্তু যদি বরকত, রফিক, সালাম, জববারের অফুরান রক্তের
লালে
আমার স্বদেশ ডুবে না যেতো – এই কবিতাটি লেখা হতো না
কোনোদিন
অতএব এই কবিতাটিকে আমি একুশের কবিতাই বলতে চাই
দোহাই তোমাদের, তোমরা আপত্তি করো না।
পথে হলো দেরি
পথে পথে আর পান্থশালায়
হয়ে গেল বড় দেরি
কাঁধে নিয়ে সব মৃত হরিণের
দুয়ারে দুয়ারে স্বপ্ন করেছি ফেরি।
তোমার বাগানে মালাকার নেই
বাগানে ঝরছে চেরি
দরোজা জানালা বন্ধ সকলই
হয়েছে কি খুব দেরি?
তবু আজকে লণ্ঠন জ্বেলে
লিখব তোমার কথা
সে-সব কথা কি নিমেষে মেলাবে?
আমার বেলায় হবে নাকি অন্যথা?
শীতের পাহাড়ি তীব্র হিম বাতাস
ছিঁড়েছে আমার তাঁবু;
‘আপনি বড্ড দেরি করেছেন’
হেঁকে বলেস্নøন ইস্টিশনের বাবু।
পথে পথে আর পান্থশালায়
হয়ে গেল বড় দেরি,
কাঁধে নিয়ে আমি মৃত হরিণের শব
একা একা হাঁটি। তোমার বাগানে
সারা দিনরাত অঝোরে ঝরবে চেরি।
আপনারা জানেন
Philosophers have only interpreted the world in various ways; the point however is to change it – Marxs, Thesis on Feurbach
আপনারা জানেন
মহামতি পেস্নøটো কী বলেছেন…
দার্শনিক কান্ট কী বলেছেন…
হেগেল কী বলেছেন…
মহামতি বুদ্ধ কী বলেছেন…
দেকার্তে কিংবা
বের্গসঁ কী বলেছেন…
বার্ট্রান্ড রাসেল কী বলেছেন…
হোয়াইটহেড কী বলেছেন…
জীবনানন্দ দাশ কী বলেছেন…
বুদ্ধদেব বসু কিংবা বিষ্ণু দে কী বলেছেন…
কী বলেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ!
কী বলেছেন কবিকুলচূড়মণি মাইকেল!
আপনারা জানেন
ঈশ্বরের পুত্র যিশু কী বলেছেন…
ইউরিপিডিস কিংবা সফোক্লিস কী বলেছেন…
মিশেল ফুকো কী বলেছেন,
দেরিদ্দা কী বলেছেন
কী বলেছেন পিকাসো
কিংবা পল এলুয়ার!
এই গ্রহের মহাপুরুষরা কে কী বলেছেন
আপনারা সবই জানেন। এখানে বক্তৃতা আমার উদ্দেশ্য
নয়। আমি এক নগণ্য মানুষ, আমি
শুধু বলি : জলে প’ড়ে যাওয়া ঐ পিঁপড়েটাকে ডাঙায় তুলে দিন
বিপস্নøব
মনজুর এলাহীর বাগানে,
ছায়াচ্ছন্ন সন্ধ্যায়, বসেছিলাম আমরা
কয়েকজন। কথা হ’লো, অনেক ধরনের
কথা হ’লো। কেউ বললেন বঙ্গবন্ধুর কথা,
সেই প্রসঙ্গে নিহত এ্যালেন্দে এবং
চিলিতে সামরিক উত্থানের ইতিহাসও
উলেস্নøখ করলেন কেউ কেউ। বলা বাহুল্য
ইরাক ইরানের কথাও উঠলো। ক্যাস্ট্রোর পর
কিউবার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ,
বিশ্বব্যাপী অসৎ বণিকদের দাপট,
এবং বাংলার বিপন্ন মানুষ
নিরন্ন আজীবন – এইসব কথা বলাবলি
করলাম আমরা কাজু বাদাম আর
কফি খেতে খেতে। ক্রমশ রাত্রি নেমে এলো
কালো বেড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে।
টেবিল চেয়ারগুলো ঘিরে জোনাকিরা
জ্বলতে লাগলো – যেন চিরটাকাল এরকম
জ্বলতে থাকবে তারা। আমরা উঠে গেলাম
ডিনার টেবিলে।
মনজুর এলাহী আবার বললেন : বন্দুকের নলই
শক্তির উৎস! রক্তপাত ছাড়া শ্রেণিসাম্য প্রতিষ্ঠা
অসম্ভব, অনায়াসে কেউ শ্রেণিস্বার্থ ছেড়ে দেয় না।
আমি জানালা থেকে দেখলাম
মনজুর এলাহীর গোটা বাগান
জোনাকিরা দখল করে নিয়েছে –
বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে।
হমত্মারকদের প্রতি
বাঘ কিংবা ভালুকের মতো নয়,
বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা হাঙরের দল নয়
না, কোনো উপমায় তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে না
তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম
বুট, সৈনিকের টুপি,
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের কথাও হয়েছিলো,
তারা ব্যবহার করেছিল
এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো
বাংলা ভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো
দেখতে, এবং ওরা মানুষই
ওরা বাংলা মানুষ
এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনবো না কোনোদিন।
বিব্রত সংলাপ
তুমি বারবার নতুন কিছু শুনতে চাইলে
বোল্লে : ‘আমাকে নতুন কিছু শোনাও’
আমি বোলস্নাম : ‘অমাবস্যার পুঞ্জপুঞ্জ অন্ধকার
একদল কালো মুখোশ-পরা
ডাকাতের মতো
শিকার করতে চাইছে শাদা খরগোশের মতো কম্পমান
চাঁদটাকে’
তুমি বোলেস্ন : ‘এর কোনো অর্থ নেই!’
আমি আবার বোলস্নাম : ‘তুমি কী শোনোনি
তিনটে মাছের আক্রমণে নিহত মাছরাঙা প’ড়ে আছে নদীর
ওপারে’
তোমার চোখের তারা
অবিশ্বাসে বারবার নেচে উঠলো : ‘এটা একটা
প্রকৃতি-বিরুদ্ধ ঘটনা, হতেই পারে না’
আমি এবার একটু উঁচু গলায় : ‘বিশ্বাস করো অরণ্যের অব্যাহত
আক্রমণে দারুণ সংকুচিত হয়ে পড়ছে
আমাদের শহরগুলো।’
মস্নান হেসে তুমি বোলেস্ন : ‘ব্যাপারটা বরং উলটো
মানুষের হমত্মারক হাতের কল্যাণে এ-দেশে
পুষ্পল ঋতু আর দেখাই যায় না’
আমি এবার রেগে উঠলাম : ‘তুমি জানো
সমুদ্র প্রত্যাখ্যান করেছে আমাদের নদীগুলোকে,
তারা ফিরে আসছে তাতার দস্যুর তরঙ্গের মতো
আমাদের গ্রাম ও শহরের দিকে।’
হেলায়-ফেলায় তুমি বোলেস্ন : ‘অমন অলক্ষুণে কথা
শুনতেও নেই।’
আমি আবার বোলস্নাম : ‘ঐ দ্যাখো হরিণশাবকের তাড়া খেয়ে
দিশেহারা ডোরাকাটা বাঘগুলো
দিগ্বিদিক
পালাচ্ছে ছুটে।’
তুমি মস্নান হেসে বোলেস্ন : ‘এমন সুদিন কখনো কি আসবে?’
বস্টন ১৯৯০
সেই সময়
শ্রাবণ তোমার
শরীরে লিখেছে গল্প
– তার স্বাদ ভুলি নাই
শত্রম্নসেনার সতর্ক চোখ এড়িয়ে
তুমি এসেছিলে
তিনটে রাসত্মা পেরিয়ে
বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে
– ভুলি নাই
সময়টা ছিল যুদ্ধের
কারফিউ চতুর্দিকে
বোকা, হাবা ও অবুঝদের
দলে মিশে গিয়ে আমরা
জ্ঞানী বুদ্ধের
বাণীর বদলে বন্দুক
নিয়েছি নির্দ্বিধায়
– ভুলি নাই
ক্রন্দন আর কলেস্নাল-ভরা
এলো স্বাধীনতা, শামিত্ম
এলো যুদ্ধশেষের ক্লামিত্ম
তখন তোমাকে
বলিনি কি ‘‘অপ্সরা
‘‘সম্বল শুধু
‘‘তোমার মুখের কামিত্ম
কিন্তু তবুও দাওনি ত তুমি ধরা
– ভুলি নাই
যদি মুখ খুলি
আমি মুখ খুললে কী বলবো বলুন,
যদি আমাকে কিছু বলতেই হয়,
তাহলে কী ব’লবো – ঐ দেখুন
রুপালি অলংকার পরা নিগ্রো রমণীর মতো
রাত্রির শরীর জ্বলছে
কিংবা যদি বলি : কিন্নরকণ্ঠ নদীগুলো
আজো গান গাইছে – কেউ শুনবে না
এইসব কাব্যিক কথা।
যদি মুখ খুলতেই হয়
আমি ব’লবো : আমাদের নদীগুলোর নাব্যতা
ক্রমশ কমে যাচ্ছে, উত্তর বাংলায়
শীতের পোশাক যাওয়া দরকার;
আমেরিকা না বেজিং – সাহায্যের হাত
প্রসারিত হবে কার দিকে? এ ব্যাপারে
সুশীল সমাজ আজ কী মনে করেন?
কার কণ্ঠে তুলে দেবো
কবিতার এই মণিহার?
আমি জানি গুপ্তঘাতকেরা
ছড়িয়ে রয়েছে আমার শহরে।
তাদের নিধন চেয়ে
কবিতাকে অস্ত্রের মতো
ব্যবহার করতে চেয়েছি আমি বহুবার।
কিন্তু কবিতা কেবল
ঘুরে বেড়ায় যেখানে রাঙা বল নিয়ে
বিকেলে খেলার মাঠে ছেলেরা জটলা পাকায়
অথবা মুখ গুঁজে পড়ে থাকে
মহিলাদের চুলের অন্ধকারে।
অপেক্ষা করছি
সেই সাত-সকালে তুমি বেরিয়েছো,
এখনও ফেরার নাম নেই।
টেলিফোন করছি এমনভাবে
যাতে বৃষ্টিধারার মতো নম্বরগুলো বেজে ওঠে,
যাতে তোমার মনে হয়
কে যেন গাইছে গীতবিতানের গানগুলো,
কিন্তু তবুও তোমার কোনো উত্তর নেই।
তিনটে এসএমএস করলাম,
দয়া করে উত্তর দাও।
তুমি যখন বাইরে যাও
ভয়ে আমি (কবির ভাষায়) কাঁপতে থাকি,
আর যখন ফিরে আসো
মনে হয় আমি সেই লোক যে-একদা
চন্দ্রপৃষ্ঠে হেঁটেছিল।
দ্যাখো, ভয় আমি পাই
কেননা ইতিহাসের অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে
আজ আমি জ্বরাগ্রস্ত –
বন্দি একটি বিদেশি বারান্দায়।
হ্যাঁ, বিচ্ছেদ তা যতো ক্ষণকালীনই হোক
তাকে আমি ভয় পাই।
সব বিচ্ছেদের মধ্যেই রয়েছে মৃত্যুর স্বাদ।
শামত্ম বিকেলে
দেবতার মতো দেবদারু গাছ
আজ আর কোনো মন্ত্র উচ্চারণ করে না;
সোনালি সূর্যাস্তকে
আহবান জানায় না কোনো ঊর্ধ্বযানী সন্ধ্যার আজান;
সংহারের কালী-মূর্তির মতো রাত্রি নামে
পৃথিবীব্যাপী।
সকাল সাতটায় তুমি বেরিয়ে গেছো,
এখন বিকেল পাঁচটা। তবে কি আমাদের আর
দেখা হবে না কোনোদিন?
ইরাক জ্বলছে। আফগানিসত্মানের পাহাড়ে-পাহাড়ে
হমত্মারকদের সাব-মেশিনগান
গর্জন করছে বারবার। আত্মহত্যাকামী
ব্রেনওয়াশ্ড্ বালকেরা ঊরুতে গ্রেনেড বেঁধে
ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের শহরে।
ঘন ঘন সাইরেন বাজিয়ে ছুটছে
পুলিশের হলুদ গাড়ি।
টুইন টাওয়ারে যেদিন বিমান আক্রমণ হ’লো
সেদিন তুমি নিউইয়র্কে।
আর গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর সময়
আমি কলকাতায়। প্রায় আজীবন
বিচ্ছেদ ভাবাতুর আমি।
বেরিয়েছো সেই সাত-সকালে
এখনও ফেরার নাম নেই।
মৃত্যুর আগে প্রত্যেকেরই প্রাপ্য
একটি শেষ চুম্বন – আমি কী তাও পাবো না!
মানুষ, নতুন শতকে
আজ আবার উদ্যত ছুরি মানুষের হাতে,
ওর পায়ের নিচে
পিষ্ট হচ্ছে নারী,
শিশুরা নিহত হচ্ছে চতুর্দিকে!
কবি, তোমার বর্মগুলো বের করে নাও।
তোমার কবিতাই শ্রেষ্ঠ বর্ম আজ!
মধ্যযুগের অন্ধকার ছিঁড়ে
আবার উদ্যত ছুরি
মানুষের হাতে।
আমাদের চেনা নগরগুলো থেকে
উঠছে ক্রন্দনধ্বনি
কবি, ওকে প্রতিহত করো।
কবি তুমি জানো আমাদের প্রিয় কবিতার
অমর পঙ্ক্তিগুলো
হত্যার বিরুদ্ধে চিরকাল – চিরকাল…
কবি, ওকে প্রতিহত করো \
এখন সেই সময়
যাকে অসময় বলতে পারো, দুঃসময় বলতে পারো
দোয়েলের গান কেউ পছন্দ ক’রছে না
কোয়েলের গান কেউ পছন্দ ক’রছে না
পৃথিবীব্যাপী এখন শুধু
পাতা ঝরার শীতার্ত গান ছাড়া
অন্য কোনো ধ্বনি নেই
ওক গাছ কিংবা পাইন গাছ
শিমুল অথবা কৃষ্ণচূড়া
শীতের আক্রমণ থেকে নিসত্মার নেই কারুর
শুধু আর্তনাদ ঝরা-পাতার
আমাদের লাল, নীল, সবুজ পাতাগুলো,
আমাদের প্রিয় পাতাগুলো ঝ’রে পড়ছে,
স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈনিকদের মতো ঝ’রে পড়ছে,
শুধু পাতা ঝ’রার আর্তনাদ
শুধু পাতা ঝরার শোকার্ত চিৎকার চতুর্দিকে।
অথচ সমস্ত পৃথিবীর ঝরা-পাতাদের চিৎকারকে ছাপিয়ে
ভূকম্পনে বিধ্বস্ত গ্রামের মন্দিরে
ঘণ্টাধ্বনির মতো,
জলোচ্ছ্বাসের পরের প্রথম ভোরের
আজানের মতো,
কবি তার উত্থানের গানটি গাইবে
অসময় বলো, দুঃসময় বলো,
গান থামবে না।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের গল্প
সেদিন দুপুরবেলা
অন্যমনে ছিলাম ব’সে মন্দির-চত্বরে
আমার কৈশোরের এক
ছায়াচ্ছন্ন দিনে।
এয়ারগানের ছর্রাবেঁধা নিহত কাকের কলকাতাকে
স্মৃতির একটি গুচ্ছে
মিলিয়ে নিয়ে,
সংহত ক’রে,
বসেছিলাম আমরা তিনজন (আমি,
জাহাঙ্গীর আর সুকুমার)।
আবাল্য অবাধ্য কথক আমি নতুন
বন্ধুদের শোনাচ্ছিলাম কলকাতার ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে
ঘুরে ঘুরে আমার (জন্মদিনে পাওয়া)
এয়ারগান কত-না চড়ুই আর কাকাতুয়া নির্দ্বিধায়
শিকার করেছে।
আর সূর্যটাকে সেদিন
মনে হয়েছিল একটা লাল বিশাল ললিপপ্ (নিউ-
মার্কেট থেকে কেনা) – আমার মুখে এই
উক্তিটা শুনে জাহাঙ্গীর উঠলো ব’লে ‘আর
গুল-তাপ্পি মারিস না-তো’ আর আমি যেই বলতে গেছি
‘ঠিক্ বলেছিস্!’ অমনি চোখজোড়াটা
আটকে গ্যালো বটগাছের নিচে,
দেখি, একটা মরা শালিক
টেলিভিশনের অ্যান্টেনার মতো
শূন্যে দু’পা তুলে
নিশ্চিন্তে রয়েছে প’ড়ে।
আর লাইন দিয়ে সারিসারি লাল পিঁপড়ে
শালিকটার চোখের মণি খুঁটেখুঁটে খাচ্ছে!
কোথাও কোনো বেদনার চিহ্ন নেই,
না-নৃত্যরত গাছের পাতায়, না-গগনম-লের অসীম
নীলিমায়
এ-ভাবেই আমার বিশ্বাসগুলো
পাখির চোখের মতো খুঁটেখুঁটে
খেয়ে ফেলেছে দুপুর-বেলার সেই লাল পিঁপড়েগুলো।
কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর
কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর –
ব্যক্তিগত গ্রাম থেকে অনাত্মীয় শহরে
পুকুরের যৌথ স্নান থেকে নিঃসঙ্গ বাথরুমে
কোনো নির্বাসনই কাম্য নয়
কাম্য নয়
কাম্য নয় আর –
জুঁই, চামেলি, চন্দ্রমলিস্নøকা কিংবা কাঠগোলাপ থেকে
টিউলিপ ম্যাগনোলিয়া অথবা ক্রিসেনথিমাম
নিজস্ব শহর থেকে অচেনা ফুটপাতে
এশিয়ার আকাশে ময়ূর নীল থেকে
কুয়াশাচ্ছন্ন প্রতীচ্য
না, কোনো নির্বাসনই
কাম্য নয়
আর।
কাম্য নয় আপন ভদ্রাসন থেকে ভাড়াটে ফ্লাটে
এই শব্দহীন শোল মাছের ঝোল থেকে
স্বাদমুক্ত চিকেন স্যুপ
আর ডিনার রোলে এ নির্বাসন
না, কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর।
পোকা-মাকড়ের গুঞ্জনে ভরা
তলোয়ারের মতন দীপ্তিমান বৈশাখ থেকে
শিকারি কুকুরের মতো শীত হাওয়ার চিৎকারে
এই যে নির্বাসন – কাম্য নয় তা।
নিজস্ব মহিলার আলিঙ্গন থেকে
হননমত্ত জনতার ব্যুহে
এই যে নির্বাসন – কাম্য নয় আর।
প্রাচ্য থেকে প্রতীচ্যে
অন্য এক উল্লাস-মত্ত পতাকার নিচে
এই যে নতজানু নির্বাসন – কাম্য নয় আর
প্রেম থেকে অপ্রেমে,
ধর্ম থেকে ধর্মান্ধতায়
প্রগতি থেকে প্রতিক্রিয়ার মধ্যযুগীয় আবর্তে,
চুম্বন থেকে চুম্বনহীনতায়
জীবনের ওপারে কোনো অমত্মহীন কফিনে
এই যে নির্বাসন
আমার কাম্য নয় আর
কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর।
No comments