ফিলিস্তিনের পক্ষে কেন সোচ্চার শিখ তরুণরা? by জসপ্রিত ওবেরয়
কানাডায়
এই ৮ বছরে বসবাস করতে গিয়ে প্রাণহানির যেকোনো খবর নিয়ে আমার মধ্যে ভীষণ
সংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছে। কেবল বড় কোনো প্রাণসংহার, বা জোড়া খুন কিংবা
মানুষের মৃত্যুই যে কেবল আমার মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা নয়। মৃত্যু
বিষয়টিই আমার মধ্যে অপরিসীম দুঃখের জন্ম দেয়। মনে হয় যে, আমার এই
পরিবর্তনের নেপথ্যে হয়তো কাজ করছে কানাডার সংবেদনশীলতা ও মূল্যবোধ।
১৪ই মে যখন গাজায় ৫৯ ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হলেন, আমি এই তীব্র দুঃখ বৈ কিছু বোধ করিনি। যন্ত্রণা, ক্ষোভ, পরিতাপ আর ঘৃণা আমার হাবভাবে যেন প্রকট হয়ে উঠছিল। কিন্তু নিজেকে শান্ত করার পর আমি যখন চারদিকে তাকালাম, তখন শুদুই নিস্তব্ধ নীরবতাই টের পেলাম।
কানাডার কেউই হয়তো এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে উল্লাশ বা একে যৌক্তিক দাবি করছে না, যেমনটা বিশ্বের অনেক ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলো করছে। তবে কোনো কড়া সমালোচনাও দেখতে পেলাম না।
তবে কিছুদিন পর যখন জানা গেল নিহতদের মধ্যে একজন কানাডিয়ান ডাক্তারও রয়েছেন, তখন বেশ শোরগোল হলো। এরপরও এই ঘটনায় কানাডাবাসী যতটা ক্ষোভ দেখিয়েছে, তা এক বনবিড়াল মারা যাওয়া কিংবা গরুর ওপর নিষ্ঠুরতা নিয়ে সৃষ্ট সাম্প্রতিক জনক্ষোভের ধারে কাছেও তা ছিল না। লজ্জাজনক হলেও এটাই সত্যি।
এ কারণেই আমি ভাবছিলাম, তাহলে আমিই কেন গাজার ঘটনা নিয়ে অন্য কানাডিয়ানের চেয়ে এত বেশি ক্ষোভ অনুভব করছি? উত্তরটা সম্ভবত নিহিত আছে আমার শিখ শেকড়ে।
শিখ ধর্মের বয়স ৫০০ বছর। বিশ্বজুড়ে মোট আড়াই কোটি অনুসারী আছে এই ধর্মের। এর মধ্যে দুই কোটিই বসবাস করেন ভারতে। আর ভারতে বসবাসরত শিখদের ৭৭ শতাংশই বসবাস করেন পাঞ্জাব অঙ্গরাজ্যে। ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.৭ শতাংশ হলেন শিখ। ভারতের স্বাধীনতার পর এই ৭০ বছরে শিখ ধর্মাবলম্বীরা শুধুমাত্র তাদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে নানা সময়ে নির্যাতিত হয়েছেন।
তুলনামূলকভাবে সংখ্যায় কম হলেও, শিখ জাতিগোষ্ঠী বৃটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বেশ বড় ভূমিকা রেখেছিল। স্বাধীনতার প্রশ্নে পরে মুসলিমরা পৃথক হয়ে আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়ে তোলে। তবে শিখ নেতারা নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ধারণায় আস্থা রাখে। বিনিময়ে তাদেরকে ভারতের আইনসভায় পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
তবে সময় যত যেতে থাকে, ততই ভারতের তৎকালীন সর্ববৃহৎ দল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার পাঞ্জাব রাজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। ভারতের এই একটি রাজ্যে শিখ জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ। ওই সময়ে শিখ রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিহত করতে কংগ্রেস একসময় জারনাইল সিং ভিন্দেরানোয়ালে নামে এক উগ্রপন্থীকে সমর্থন দেয়। তবে পরে এই জারনাইল এত জনপ্রিয় ও ক্ষমতাধর হয়ে উঠেন যে, তিনি নিজেকে অজেয় ভাবতে থাকেন। এবং নিজেরই প্রভু কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান।
এই যে ভুল করে ফ্রাংকেন্সটাইন দানব তৈরি করার ন্যারেটিভ, এটা কি পরিচিত মনে হয়?
১৯৮৪ সালে, জারনাইল একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। এই দাবি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ভালোভাবে নেয়নি। ভারতীয় বাহিনীর অভিযানে তিনি পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। তিনি একসময় লুকিয়ে ছিলেন অমৃতসরে অবস্থিত শিখদের সবচেয়ে পবিত্র মন্দির গোল্ডেন টেম্পলে।
জারনাইল ও তার সঙ্গীদের ধরতে ভারতীয় বাহিনী গোল্ডেন টেম্পলে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। হাজার হাজার নিরীহ পূণ্যার্থীর ওপর আক্রমণ করতে ভারতীয় সেনাবাহিনী ¯œাইপার, মর্টার, মেশিন গান ব্যবহার করে। এই পূন্যার্থীদের মধ্যে নারী, পুরুষ, আবাল, বৃদ্ধ-বণিতা - সকলেই ছিলেন। তারা একটি শিখ উৎসবে সামিল হতে সেখানে গিয়েছিলেন। এই হামলা শুধু স্রেফ একটি ভবনের ওপর হামলা ছিল না। ছিল হাজার হাজার নিরীহ মানুষের ওপর হামলা। ছিল লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ শিখের অনুভূতির ওপর খুনে পাশবিকতা। ভারতের সামরিক বাহিনী কখনই কোনো হিন্দু মন্দিরে এই ধরণের হামলা চালাতে পারতো না, ভবিষ্যতেও পারবেও না।
তবে গোল্ডেন টেম্পল অভিযানের পরের কাহিনী আরও মর্মস্তুদ। ওই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তার শিখ দেহরক্ষীরা একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে হত্যা করে। আর এই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে শিখদের বিরুদ্ধে ভারত-জুড়ে এক গণহত্যা রচিত হয়।
হাজার হাজার শিখ পুরুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। নারীদেরকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। শিশু-বৃদ্ধও বাঁচতে পারেননি হত্যাযজ্ঞ থেকে। কিন্তু যেই রাজনৈতিক নেতারা এসব দাঙ্গা উস্কে দিয়েছিলেন তাদের কারও সাজা হয়নি। তারা এখনও মুক্ত। এবং, পুরো দুনিয়া থেকে আসেনি কোনো প্রতিবাদ। এই ন্যারেটিভও কি পরিচিত মনে হচ্ছে না?
পরবর্তীতে পাঞ্জাবে শুরু হয় সশস্ত্র বিচ্ছন্নতাবাদ। পুরো রাজ্যে সার্বক্ষণিক মোতায়েন থাকে সেনাবাহিনী। ১৯৮৪ সালের পরের এক দশকে দাঙ্গাহাঙ্গামা ছিল এই রাজ্যের নিত্য নৈমিত্যিক ঘটনা। রাজ্য পুলিশ ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী যা খুশি তা-ই করতে পারতো পাঞ্জাবে। এতে নজিরবিহীন নৃশংসতা আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- দুইই ঘটেছে। এই ১০-১২ বছরে যত শিখ পুরুষ নিখোঁজ হয়েছে তাদের সংখ্যা বিপুল। এই কাহিনীও কি পরিচিত মনে হচ্ছে না?
ওই মৃত্যুর রঙ্গভূমি থেকে যারা পালাতে পেরেছিলেন তারা যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। আজ বিদেশে অবস্থানরত শিখ সম্প্রদায় সমৃদ্ধশালী, যোগাযোগসম্পন্ন ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী।
কিন্তু এরপরও যখনই এই সম্প্রদায় ১৯৮৪ সালের গণহত্যা ও অন্ধকার সময় নিয়ে কথা বলে, তখনই ভারত সরকার যেই প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা ফিলিস্তিনিদের কান্নায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াহীনতারই সমতুল্য।
ভারত সরকার শুধু আমাদের ন্যায়বিচারের আবেদনই প্রকাশ্যে অগ্রাহ্য করছে না, বিদেশের রাজনৈতিক প্রাঙ্গনে শিখদের উত্থান দমাতেও সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এর একটি বড় উদাহরণ হলো কানাডার তৃতীয় বৃহত্তম দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা জগমিত সিং-এর রাজনৈতিক উত্থান প্রতিহত করতে ডানপন্থী হিন্দু দলগুলোর ধারাবাহিক প্রচেষ্টা।
শিখ সম্প্রদায় জানে নিজের মাতৃভূমি থেকে কার্যত উৎখাত হয়ে অন্য দেশে বাধ্যতামূলক নির্বাসনে থাকতে কেমন লাগে। ‘শুধু মজা’র জন্য কারও টার্গেট প্র্যকটিস হিসেবে গুলিবিদ্ধ হতে কেমন লাগে। তারা বোঝেন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিত্য হয়রানির শিকার হতে কেমন লাগে। তারা আরও জানেন ৭ বছর ধরে ‘সন্ত্রাসবাদে’র অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় ঝুললে কেমন লাগে। তারা বোঝেন যখন পুরো বিশ্ব আপনার দুর্দশা অগ্রাহ্য করে তেমন কেমন বোধ হয়।
হয়তো এ কারণেই আমি আজ ফিলিস্তিনিদের ওপর নৃশংসতার প্রতিবাদ করছি। হয়তো এ কারণেই আমার মতো আরও অনেক শিখ একই কাজ করছেন। এ কারণেই হয়তো অন্যরা যা অনুভব করেনি বা করবে না, সেই কষ্ট আমি অনুভব করি। তবে একজন শিখ, মুসলিম, ইহুদী বা খ্রিস্টান হওয়ার আগে আমরা সবাই সমানভাবে একই হৃদয় আর মগজের, রক্তে আর মাংসের মানুষ। অন্তত আমি আশা করি আমরা তা-ই।
(জসপ্রিত ওবেরয় একজন ব্লগার ও কলামিস্ট। তার এই নিবন্ধ ইসরাইলি পত্রিকা হারেৎসে প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন মাহমুদ ফেরদৌস।)
১৪ই মে যখন গাজায় ৫৯ ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হলেন, আমি এই তীব্র দুঃখ বৈ কিছু বোধ করিনি। যন্ত্রণা, ক্ষোভ, পরিতাপ আর ঘৃণা আমার হাবভাবে যেন প্রকট হয়ে উঠছিল। কিন্তু নিজেকে শান্ত করার পর আমি যখন চারদিকে তাকালাম, তখন শুদুই নিস্তব্ধ নীরবতাই টের পেলাম।
কানাডার কেউই হয়তো এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে উল্লাশ বা একে যৌক্তিক দাবি করছে না, যেমনটা বিশ্বের অনেক ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলো করছে। তবে কোনো কড়া সমালোচনাও দেখতে পেলাম না।
তবে কিছুদিন পর যখন জানা গেল নিহতদের মধ্যে একজন কানাডিয়ান ডাক্তারও রয়েছেন, তখন বেশ শোরগোল হলো। এরপরও এই ঘটনায় কানাডাবাসী যতটা ক্ষোভ দেখিয়েছে, তা এক বনবিড়াল মারা যাওয়া কিংবা গরুর ওপর নিষ্ঠুরতা নিয়ে সৃষ্ট সাম্প্রতিক জনক্ষোভের ধারে কাছেও তা ছিল না। লজ্জাজনক হলেও এটাই সত্যি।
এ কারণেই আমি ভাবছিলাম, তাহলে আমিই কেন গাজার ঘটনা নিয়ে অন্য কানাডিয়ানের চেয়ে এত বেশি ক্ষোভ অনুভব করছি? উত্তরটা সম্ভবত নিহিত আছে আমার শিখ শেকড়ে।
শিখ ধর্মের বয়স ৫০০ বছর। বিশ্বজুড়ে মোট আড়াই কোটি অনুসারী আছে এই ধর্মের। এর মধ্যে দুই কোটিই বসবাস করেন ভারতে। আর ভারতে বসবাসরত শিখদের ৭৭ শতাংশই বসবাস করেন পাঞ্জাব অঙ্গরাজ্যে। ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.৭ শতাংশ হলেন শিখ। ভারতের স্বাধীনতার পর এই ৭০ বছরে শিখ ধর্মাবলম্বীরা শুধুমাত্র তাদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে নানা সময়ে নির্যাতিত হয়েছেন।
তুলনামূলকভাবে সংখ্যায় কম হলেও, শিখ জাতিগোষ্ঠী বৃটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বেশ বড় ভূমিকা রেখেছিল। স্বাধীনতার প্রশ্নে পরে মুসলিমরা পৃথক হয়ে আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়ে তোলে। তবে শিখ নেতারা নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ধারণায় আস্থা রাখে। বিনিময়ে তাদেরকে ভারতের আইনসভায় পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
তবে সময় যত যেতে থাকে, ততই ভারতের তৎকালীন সর্ববৃহৎ দল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার পাঞ্জাব রাজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। ভারতের এই একটি রাজ্যে শিখ জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ। ওই সময়ে শিখ রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিহত করতে কংগ্রেস একসময় জারনাইল সিং ভিন্দেরানোয়ালে নামে এক উগ্রপন্থীকে সমর্থন দেয়। তবে পরে এই জারনাইল এত জনপ্রিয় ও ক্ষমতাধর হয়ে উঠেন যে, তিনি নিজেকে অজেয় ভাবতে থাকেন। এবং নিজেরই প্রভু কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান।
এই যে ভুল করে ফ্রাংকেন্সটাইন দানব তৈরি করার ন্যারেটিভ, এটা কি পরিচিত মনে হয়?
১৯৮৪ সালে, জারনাইল একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। এই দাবি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ভালোভাবে নেয়নি। ভারতীয় বাহিনীর অভিযানে তিনি পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। তিনি একসময় লুকিয়ে ছিলেন অমৃতসরে অবস্থিত শিখদের সবচেয়ে পবিত্র মন্দির গোল্ডেন টেম্পলে।
জারনাইল ও তার সঙ্গীদের ধরতে ভারতীয় বাহিনী গোল্ডেন টেম্পলে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। হাজার হাজার নিরীহ পূণ্যার্থীর ওপর আক্রমণ করতে ভারতীয় সেনাবাহিনী ¯œাইপার, মর্টার, মেশিন গান ব্যবহার করে। এই পূন্যার্থীদের মধ্যে নারী, পুরুষ, আবাল, বৃদ্ধ-বণিতা - সকলেই ছিলেন। তারা একটি শিখ উৎসবে সামিল হতে সেখানে গিয়েছিলেন। এই হামলা শুধু স্রেফ একটি ভবনের ওপর হামলা ছিল না। ছিল হাজার হাজার নিরীহ মানুষের ওপর হামলা। ছিল লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ শিখের অনুভূতির ওপর খুনে পাশবিকতা। ভারতের সামরিক বাহিনী কখনই কোনো হিন্দু মন্দিরে এই ধরণের হামলা চালাতে পারতো না, ভবিষ্যতেও পারবেও না।
তবে গোল্ডেন টেম্পল অভিযানের পরের কাহিনী আরও মর্মস্তুদ। ওই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তার শিখ দেহরক্ষীরা একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে হত্যা করে। আর এই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে শিখদের বিরুদ্ধে ভারত-জুড়ে এক গণহত্যা রচিত হয়।
হাজার হাজার শিখ পুরুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। নারীদেরকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। শিশু-বৃদ্ধও বাঁচতে পারেননি হত্যাযজ্ঞ থেকে। কিন্তু যেই রাজনৈতিক নেতারা এসব দাঙ্গা উস্কে দিয়েছিলেন তাদের কারও সাজা হয়নি। তারা এখনও মুক্ত। এবং, পুরো দুনিয়া থেকে আসেনি কোনো প্রতিবাদ। এই ন্যারেটিভও কি পরিচিত মনে হচ্ছে না?
পরবর্তীতে পাঞ্জাবে শুরু হয় সশস্ত্র বিচ্ছন্নতাবাদ। পুরো রাজ্যে সার্বক্ষণিক মোতায়েন থাকে সেনাবাহিনী। ১৯৮৪ সালের পরের এক দশকে দাঙ্গাহাঙ্গামা ছিল এই রাজ্যের নিত্য নৈমিত্যিক ঘটনা। রাজ্য পুলিশ ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী যা খুশি তা-ই করতে পারতো পাঞ্জাবে। এতে নজিরবিহীন নৃশংসতা আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- দুইই ঘটেছে। এই ১০-১২ বছরে যত শিখ পুরুষ নিখোঁজ হয়েছে তাদের সংখ্যা বিপুল। এই কাহিনীও কি পরিচিত মনে হচ্ছে না?
ওই মৃত্যুর রঙ্গভূমি থেকে যারা পালাতে পেরেছিলেন তারা যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। আজ বিদেশে অবস্থানরত শিখ সম্প্রদায় সমৃদ্ধশালী, যোগাযোগসম্পন্ন ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী।
কিন্তু এরপরও যখনই এই সম্প্রদায় ১৯৮৪ সালের গণহত্যা ও অন্ধকার সময় নিয়ে কথা বলে, তখনই ভারত সরকার যেই প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা ফিলিস্তিনিদের কান্নায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াহীনতারই সমতুল্য।
ভারত সরকার শুধু আমাদের ন্যায়বিচারের আবেদনই প্রকাশ্যে অগ্রাহ্য করছে না, বিদেশের রাজনৈতিক প্রাঙ্গনে শিখদের উত্থান দমাতেও সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এর একটি বড় উদাহরণ হলো কানাডার তৃতীয় বৃহত্তম দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা জগমিত সিং-এর রাজনৈতিক উত্থান প্রতিহত করতে ডানপন্থী হিন্দু দলগুলোর ধারাবাহিক প্রচেষ্টা।
শিখ সম্প্রদায় জানে নিজের মাতৃভূমি থেকে কার্যত উৎখাত হয়ে অন্য দেশে বাধ্যতামূলক নির্বাসনে থাকতে কেমন লাগে। ‘শুধু মজা’র জন্য কারও টার্গেট প্র্যকটিস হিসেবে গুলিবিদ্ধ হতে কেমন লাগে। তারা বোঝেন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিত্য হয়রানির শিকার হতে কেমন লাগে। তারা আরও জানেন ৭ বছর ধরে ‘সন্ত্রাসবাদে’র অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় ঝুললে কেমন লাগে। তারা বোঝেন যখন পুরো বিশ্ব আপনার দুর্দশা অগ্রাহ্য করে তেমন কেমন বোধ হয়।
হয়তো এ কারণেই আমি আজ ফিলিস্তিনিদের ওপর নৃশংসতার প্রতিবাদ করছি। হয়তো এ কারণেই আমার মতো আরও অনেক শিখ একই কাজ করছেন। এ কারণেই হয়তো অন্যরা যা অনুভব করেনি বা করবে না, সেই কষ্ট আমি অনুভব করি। তবে একজন শিখ, মুসলিম, ইহুদী বা খ্রিস্টান হওয়ার আগে আমরা সবাই সমানভাবে একই হৃদয় আর মগজের, রক্তে আর মাংসের মানুষ। অন্তত আমি আশা করি আমরা তা-ই।
(জসপ্রিত ওবেরয় একজন ব্লগার ও কলামিস্ট। তার এই নিবন্ধ ইসরাইলি পত্রিকা হারেৎসে প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন মাহমুদ ফেরদৌস।)
No comments