জলবায়ু চুক্তিতে ট্রাম্পের 'না', 'বিশ্ব নেতৃত্ব হারালো যুক্তরাষ্ট্র' by কাউসার মুমিন
যুক্তরাষ্ট্রের
অভ্যন্তরে প্রবল আপত্তি ও বাইরের আন্তর্জাতিক দুনিয়ার ব্যাপক অনুরোধ এবং
যুক্তিসঙ্গত জাতীয় স্বার্থ জড়িত থাকা স্বত্ত্বেও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি
পূরণের নামে অবশেষে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার
করে নিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয়
স্বার্থ দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির মুখে পড়লো এবং বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজের মর্যাদা
হারালো যুক্তরাষ্ট্র। গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টায় হোয়াইট হাউসের রোজ
গার্ডেনে এক বিশেষ ব্রিফিংয়ে এই ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।ট্রাম্পের
এই ঘোষণায় বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এর বিপক্ষে
রাজনৈতিক বিভেদ ব্যতিরেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন খোদ
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও
বোদ্ধাসম্প্রদায়। জাতিসংঘ মহাসচিব এন্থোনিও গুটেরেস হতাশা প্রকাশ করে
বলেছেন, এর ফলে বিশ্বের 'যৌথ ভবিষ্যত' হুমকিতে পড়লো। তিনি বলেন, জাতিসংঘের
১৯৫ রাষ্ট্র কর্তৃক সম্মত জলবায়ু বিষয়ক প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র
সরে দাঁড়ালে দেশটি বিশজুড়ে তাঁর প্রভাব হারাবে, যার শূন্যস্থান পূর্ণ করতে
এগিয়ে আসবে চীন।' প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ট্রাম্পের কঠোর
সমালোচনা করে বলেছেন, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ট্রাম্প আমেরিকার ভবিষ্যৎকে
'বাতিল' করে দিলেন।'
জাতিসংঘের মিলেনিয়াম ভেভেলোপমেন্ট গোলস (এমডিজি) এবং সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস (এসডিজি)'র অন্যতম প্রণেতা, কলাম্বিয়া বিশবিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউট ও সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও বর্তমান বিশ্বের প্রভাবশালী উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ প্রফেসর জেফ্রি ডি স্যাক্স এ বিষয়ে 'আমেরিকা'স ব্রোকেন ডেমোক্রেসি' শীর্ষক গতকাল প্রকাশিত তাঁর এক সিন্ডিকেটেড কলামে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে 'ইগ্নোরেন্স (অজ্ঞতা)' আর 'নার্সিসিজম (আত্নবিনাশী) ' বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, এ ধরণের সিদ্ধান্ত মার্কিন রাজনীতির 'দুর্বৃত্তায়নের' প্রমান বহন করে। আমেরিকার রাজনীতি এখন শক্তিশালী কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত-যেখানে ধনীদের ট্যাক্স মওকুফ, গরীবের সকল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বাতিল ও মহা-পরিবেশ দূষণকারীদের পক্ষে আইন তৈরী করে বিশ্বের বাকী অংশকে বৈশ্বিক উষ্ণতা আর যুদ্ধ্বের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।'
বর্তমান সময়ের প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিএনএন-এর ফরিদ জাকারিয়া বলেন, এই সিদ্ধ্বান্তের মাধ্যমে আমেরিকা মুক্ত বিশ্বের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলো। এর ফলে ট্রাম্প যে দায়িত্বহীনতার প্রমান দিলেন তা শ্বাসরুদ্ধকর, কেননা সত্যিকার অর্থেই প্যারিস চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যধিক মাত্রায় নমনীয় ছিলো। এই চুক্তি কোনোভাবেই মার্কিন সার্বভৌমত্বকে সংকুচিত করেনি।'
জলবায়ুর পরিবর্তন বিষয়ক ইউরোপীয় ইউনিয়ন কমিশনার মিগেল আরিয়াস কাঁতে এক বিবৃতিতে বলেছেন প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চীন এই চুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করেছে। বর্তমানে জার্মানী সফররত চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেগিয়াং ও জর্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল এক যৌথ গত বৃহস্পতিবার বিবৃতিতে বলেছেন, চীন ও জার্মানী প্যারিস চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে। এছাড়া পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিনিময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীন যৌথভাবে কাজ করবে।' এর আগে ইউরোপীয়ান কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক বৃহস্পতিবার দিন হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাহার ঘোষণার পূর্বে এই চুক্তি থেকে সরে না যেতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সরাসরি আহবান জানান।ট্রাম্প এর ঘোষণার পর এক টুইট প্রতিক্রিয়ায় টাস্ক বলেন, আজকের দিনটি পৃথিবীর জন্য একটি দুঃখজনক দিন হিসেবে বিবেচিত হবে।
এদিকে রাশিয়ান প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র দিমিত্রি পেস্কোভ এক বিবৃতিতে প্যারিস চুক্তি বাস্তববায়নে রাশিয়া প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করে মুখপাত্র আরও বলেন, এই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে এটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্থ হবে, তবে আমাদের হাতে এই মুহূর্তে আর কোনো বিকল্প নেই। ' সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্গেট ওয়ালসট্রম বলেন, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিশ্ব ও আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ রক্ষার্থে মানবতার সর্বশেষ সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলো। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার ঘোষণার পর পর প্যারিসের সিটি হলে সবুজ বাতি জ্বেলে এই চুক্তির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করা হয়। প্যারিস সিটি মেয়র এনি হিডাল্গো এক বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই ভুল সিদ্ধান্ত মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে।'
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অর্থনীতি বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক রবার্ট স্টেভিন্স-এর মতে, প্যারিস চুক্তি থেকে সরে গেলে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একটি আন্তর্জাতিক দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড্যানিয়েল বোদানস্কি বলছেন, ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি থেকে এখনই সরে গেলেও আগামী ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত জলবায়ু ফোরামে যুক্তরাষ্ট্রে সদস্যপদ থেকে যাবে। এই সময়ের মধ্যে জলবায়ু চুক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে ভূমিকা রাখার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। ড্যানিয়েল বলেন, এই অবস্থা প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নকে কঠিন করে তুলতে পারে। কারণ, চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধ্বান্তের ফলেই আমাদের অনেক মিত্র রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে যাচ্ছে। কিন্তু, যেহেতু ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভোট প্রদানের ক্ষমতা থাকবে সুতরাং এই সুযোগে ট্রাম্প প্রশাসন যদি এই চুক্তির বিপক্ষে কাজ করে, তাহলে আরও অনেক মিত্র রাষ্ট্রের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। '
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে এবং জলবায়ু ক্ষেত্রের বাইরে বিশেষ করে সন্ত্রাস দমন ও বাণিজ্য ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দুর্বল হবে। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আন্ডার সেক্রেটারী অফ স্টেট্ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিবিদ নিকোলাস বার্নস বলেন, পররাষ্ট্র নীতির দৃষ্টিতে এই সিদ্ধান্ত হবে একটি বিরাট ভুল। কেননা, বাণিজ্য, সামরিক কিংবা অন্য যেকোনো ইস্যুতে পররাষ্ট্র নীতিতে আমাদের সাফল্য নির্ভর করে আমরা কতটুকু নির্ভরযোগ্য কিংবা বিশ্বাস যোগ্য। আমি মনে করি প্যারিস চুক্তি থেকে সরে আসা বিশ্বব্যাপী আমাদের গ্রহণযোগ্যতাকে মারাত্মকভাবে ধ্বংস করবে।'
ইউরোপীয় কমিশন প্রেসিডেন্ট জাঁ ক্লাউড জাঙ্কার বলেন, ইউরোপের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এই চুক্তির গুরুত্ব বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এই চুক্তির বিস্তারিত তিনি বুঝতে সক্ষম নন। তিনি বলেন, ট্রাম্পকে বুঝতে হবে যে, আন্তর্জাতিক চুক্তির সবকিছুই 'ফেইক নিউজ' নয়, তাই চুক্তির বাধ্যবাধকতাকে সম্মান জানানো আমাদের সকলের দায়িত্ব। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অজ্ঞতাকে ইঙ্গিত করে ইউরোপীয় কমিশন প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাইলেই এখনই এই চুক্তি থেকে সরে যেতে পারছেন না-এই জন্য কমপক্ষে ৪ বছর সময় লাগবে।কেননা প্যারিস চুক্তির ২৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক কোনো রাষ্ট্র যদি এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে চায় তাহলে এই চুক্তি আইনগতভাবে গৃহীত হওয়ার তারিখ (নভেম্বর ৪, ২০১৬) থেকে ৩ বছর সময় অপেক্ষা করতে হবে এবং তারও ১ বছর পর তা কার্যকর হবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলেও চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই চুক্তির নেতৃত্বের থাকবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও ক্ষুন্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসার ট্রাম্প ঘোষণার বিরোধীতা করে ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্কের মেয়রসহ বিবৃতি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ জন মেয়র। ডেমোক্রেট দলীয় কঠোর সমালোচনাকারীদের অন্যতম হলেন সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন এবং এড মার্কী। এছাড়াও বোস্টন মেয়র মার্টি ওয়ালশ , বোস্টন এটর্নি জেনারেল মাওরা হিলি , নিউইয়র্কের কন্ট্রোলার জেনারেল স্কট স্ট্রিংগার, ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির ভাইস চেয়ার মাইকেল ব্ল্যাক এবং বোস্টনের ডেমোক্রেটিক কংগ্রেশনাল ডেলিগেশনের সকল সদস্য। অন্যদিকে রিপাবলিকান দলীয় কঠোর সমালোচনাকারীদের অন্যতম হলেন প্রাক্তন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মিট রমনী, রিপাবলিকান গভর্নর চার্লি ব্যাকার, গভর্নর ফিল স্কট, প্রমুখ। হাউস মাইনোরিটি লিডার ন্যান্সি পেলোসি বলেন, 'ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত পৃথিবীর ভবিষ্যৎকে ভয়ংকর ঝুঁকিতে ফেলবে। এই সিদ্ধান্ত বিশ্বে মার্কিন নেতৃত্ব ত্যাগ করার এক আশ্চর্য উদ্যোগ।' ডেমোক্রেটিক সিনেটর এড মারকি বলেন, এই সিদ্ধান্ত ট্রাম্প প্রশাসনের নৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয়। এর ফলে আমেরিকা বিপুল ব্যবসা, বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক সম্মান থেকে বঞ্চিত হবে।'
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, হোয়াইট হাউস থেকে একের পর এক ট্রাম্পের নীতিমালা অগ্রিম ফাঁসের বদনামে ট্রাম্প প্রশাসনে বিরাজ করছে লেজে গুবড়ে অবস্থা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্টজন ছাড়া কাউকেই বিশ্বাস করেন না। ফলে বিশ্বস্ত গুটিতিনেক উপদেষ্টার মাঝেই ছোট হয়ে আছে ট্রাম্পের দুনিয়া। এ অবস্থায় পালাক্রমে পদত্যাগ করছেন টিম ট্রাম্পের দক্ষ, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন কর্মকর্তারা। জানা গেছে, ট্রাম্প প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বিশেষ করে স্টেট্ ডিপার্টমেন্ট ও লেবার ডিপার্টমেন্টে প্রয়োজনীয় দক্ষ, বিশ্বস্ত লোকবল নিয়োগের জন্য পাওয়া যাচ্ছে না।এরকম গোলমেলে পরিস্থিতিতেই সর্বশেষ গত পরশু পদত্যাগ করেছেন ট্রাম্প প্রশাসনের স্ট্রেটেজিক কম্যুনিকেশন্স ডিরেক্টর মাইকেল ডিউক যিনি ওয়াশিংটন পলিটিক্সে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ । রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান মাইকেল স্টিল ট্রাম্প হোয়াইট হাউজের চলমান গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, এরকম ক্রেজি লোকের সঙ্গে কাজ করবেই বা কে? এরকম পরিস্থিতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর ব্যবসা-বান্ধব দৃষ্টিতে 'মাইয়োপিক ন্যাশনালিস্ট ভিউ'-এর উর্ধে উঠতে পারছেন না-যার ফলে মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় স্বার্থ এবং আমেরিকার বিশ্বনেতৃত্ব।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ১৯৫টি দেশ কর্তৃক ২০১৫ সালে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত 'প্যারিস চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয়। এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও ৫০টি দেশ চুক্তিটি এখনো রেটিফাই করেনি এবং দুটি দেশ এই চুক্তির বিরোধিতা করছে-দেশ দুটি হলো সিরিয়া ও নিকারাগুয়া।। যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে সিরিয়া ও নিকারাগুয়ার সাথে দেশটির নাম উচ্চারিত হবে।
জাতিসংঘের মিলেনিয়াম ভেভেলোপমেন্ট গোলস (এমডিজি) এবং সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস (এসডিজি)'র অন্যতম প্রণেতা, কলাম্বিয়া বিশবিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউট ও সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও বর্তমান বিশ্বের প্রভাবশালী উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ প্রফেসর জেফ্রি ডি স্যাক্স এ বিষয়ে 'আমেরিকা'স ব্রোকেন ডেমোক্রেসি' শীর্ষক গতকাল প্রকাশিত তাঁর এক সিন্ডিকেটেড কলামে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে 'ইগ্নোরেন্স (অজ্ঞতা)' আর 'নার্সিসিজম (আত্নবিনাশী) ' বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, এ ধরণের সিদ্ধান্ত মার্কিন রাজনীতির 'দুর্বৃত্তায়নের' প্রমান বহন করে। আমেরিকার রাজনীতি এখন শক্তিশালী কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত-যেখানে ধনীদের ট্যাক্স মওকুফ, গরীবের সকল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বাতিল ও মহা-পরিবেশ দূষণকারীদের পক্ষে আইন তৈরী করে বিশ্বের বাকী অংশকে বৈশ্বিক উষ্ণতা আর যুদ্ধ্বের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।'
বর্তমান সময়ের প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিএনএন-এর ফরিদ জাকারিয়া বলেন, এই সিদ্ধ্বান্তের মাধ্যমে আমেরিকা মুক্ত বিশ্বের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলো। এর ফলে ট্রাম্প যে দায়িত্বহীনতার প্রমান দিলেন তা শ্বাসরুদ্ধকর, কেননা সত্যিকার অর্থেই প্যারিস চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যধিক মাত্রায় নমনীয় ছিলো। এই চুক্তি কোনোভাবেই মার্কিন সার্বভৌমত্বকে সংকুচিত করেনি।'
জলবায়ুর পরিবর্তন বিষয়ক ইউরোপীয় ইউনিয়ন কমিশনার মিগেল আরিয়াস কাঁতে এক বিবৃতিতে বলেছেন প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চীন এই চুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করেছে। বর্তমানে জার্মানী সফররত চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেগিয়াং ও জর্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল এক যৌথ গত বৃহস্পতিবার বিবৃতিতে বলেছেন, চীন ও জার্মানী প্যারিস চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে। এছাড়া পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিনিময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীন যৌথভাবে কাজ করবে।' এর আগে ইউরোপীয়ান কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক বৃহস্পতিবার দিন হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাহার ঘোষণার পূর্বে এই চুক্তি থেকে সরে না যেতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সরাসরি আহবান জানান।ট্রাম্প এর ঘোষণার পর এক টুইট প্রতিক্রিয়ায় টাস্ক বলেন, আজকের দিনটি পৃথিবীর জন্য একটি দুঃখজনক দিন হিসেবে বিবেচিত হবে।
এদিকে রাশিয়ান প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র দিমিত্রি পেস্কোভ এক বিবৃতিতে প্যারিস চুক্তি বাস্তববায়নে রাশিয়া প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করে মুখপাত্র আরও বলেন, এই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে এটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্থ হবে, তবে আমাদের হাতে এই মুহূর্তে আর কোনো বিকল্প নেই। ' সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্গেট ওয়ালসট্রম বলেন, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিশ্ব ও আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ রক্ষার্থে মানবতার সর্বশেষ সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলো। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার ঘোষণার পর পর প্যারিসের সিটি হলে সবুজ বাতি জ্বেলে এই চুক্তির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করা হয়। প্যারিস সিটি মেয়র এনি হিডাল্গো এক বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই ভুল সিদ্ধান্ত মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে।'
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অর্থনীতি বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক রবার্ট স্টেভিন্স-এর মতে, প্যারিস চুক্তি থেকে সরে গেলে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একটি আন্তর্জাতিক দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড্যানিয়েল বোদানস্কি বলছেন, ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি থেকে এখনই সরে গেলেও আগামী ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত জলবায়ু ফোরামে যুক্তরাষ্ট্রে সদস্যপদ থেকে যাবে। এই সময়ের মধ্যে জলবায়ু চুক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে ভূমিকা রাখার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। ড্যানিয়েল বলেন, এই অবস্থা প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নকে কঠিন করে তুলতে পারে। কারণ, চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধ্বান্তের ফলেই আমাদের অনেক মিত্র রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে যাচ্ছে। কিন্তু, যেহেতু ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভোট প্রদানের ক্ষমতা থাকবে সুতরাং এই সুযোগে ট্রাম্প প্রশাসন যদি এই চুক্তির বিপক্ষে কাজ করে, তাহলে আরও অনেক মিত্র রাষ্ট্রের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। '
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে এবং জলবায়ু ক্ষেত্রের বাইরে বিশেষ করে সন্ত্রাস দমন ও বাণিজ্য ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দুর্বল হবে। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আন্ডার সেক্রেটারী অফ স্টেট্ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিবিদ নিকোলাস বার্নস বলেন, পররাষ্ট্র নীতির দৃষ্টিতে এই সিদ্ধান্ত হবে একটি বিরাট ভুল। কেননা, বাণিজ্য, সামরিক কিংবা অন্য যেকোনো ইস্যুতে পররাষ্ট্র নীতিতে আমাদের সাফল্য নির্ভর করে আমরা কতটুকু নির্ভরযোগ্য কিংবা বিশ্বাস যোগ্য। আমি মনে করি প্যারিস চুক্তি থেকে সরে আসা বিশ্বব্যাপী আমাদের গ্রহণযোগ্যতাকে মারাত্মকভাবে ধ্বংস করবে।'
ইউরোপীয় কমিশন প্রেসিডেন্ট জাঁ ক্লাউড জাঙ্কার বলেন, ইউরোপের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এই চুক্তির গুরুত্ব বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এই চুক্তির বিস্তারিত তিনি বুঝতে সক্ষম নন। তিনি বলেন, ট্রাম্পকে বুঝতে হবে যে, আন্তর্জাতিক চুক্তির সবকিছুই 'ফেইক নিউজ' নয়, তাই চুক্তির বাধ্যবাধকতাকে সম্মান জানানো আমাদের সকলের দায়িত্ব। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অজ্ঞতাকে ইঙ্গিত করে ইউরোপীয় কমিশন প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাইলেই এখনই এই চুক্তি থেকে সরে যেতে পারছেন না-এই জন্য কমপক্ষে ৪ বছর সময় লাগবে।কেননা প্যারিস চুক্তির ২৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক কোনো রাষ্ট্র যদি এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে চায় তাহলে এই চুক্তি আইনগতভাবে গৃহীত হওয়ার তারিখ (নভেম্বর ৪, ২০১৬) থেকে ৩ বছর সময় অপেক্ষা করতে হবে এবং তারও ১ বছর পর তা কার্যকর হবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলেও চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই চুক্তির নেতৃত্বের থাকবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও ক্ষুন্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসার ট্রাম্প ঘোষণার বিরোধীতা করে ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্কের মেয়রসহ বিবৃতি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ জন মেয়র। ডেমোক্রেট দলীয় কঠোর সমালোচনাকারীদের অন্যতম হলেন সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন এবং এড মার্কী। এছাড়াও বোস্টন মেয়র মার্টি ওয়ালশ , বোস্টন এটর্নি জেনারেল মাওরা হিলি , নিউইয়র্কের কন্ট্রোলার জেনারেল স্কট স্ট্রিংগার, ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির ভাইস চেয়ার মাইকেল ব্ল্যাক এবং বোস্টনের ডেমোক্রেটিক কংগ্রেশনাল ডেলিগেশনের সকল সদস্য। অন্যদিকে রিপাবলিকান দলীয় কঠোর সমালোচনাকারীদের অন্যতম হলেন প্রাক্তন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মিট রমনী, রিপাবলিকান গভর্নর চার্লি ব্যাকার, গভর্নর ফিল স্কট, প্রমুখ। হাউস মাইনোরিটি লিডার ন্যান্সি পেলোসি বলেন, 'ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত পৃথিবীর ভবিষ্যৎকে ভয়ংকর ঝুঁকিতে ফেলবে। এই সিদ্ধান্ত বিশ্বে মার্কিন নেতৃত্ব ত্যাগ করার এক আশ্চর্য উদ্যোগ।' ডেমোক্রেটিক সিনেটর এড মারকি বলেন, এই সিদ্ধান্ত ট্রাম্প প্রশাসনের নৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয়। এর ফলে আমেরিকা বিপুল ব্যবসা, বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক সম্মান থেকে বঞ্চিত হবে।'
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, হোয়াইট হাউস থেকে একের পর এক ট্রাম্পের নীতিমালা অগ্রিম ফাঁসের বদনামে ট্রাম্প প্রশাসনে বিরাজ করছে লেজে গুবড়ে অবস্থা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্টজন ছাড়া কাউকেই বিশ্বাস করেন না। ফলে বিশ্বস্ত গুটিতিনেক উপদেষ্টার মাঝেই ছোট হয়ে আছে ট্রাম্পের দুনিয়া। এ অবস্থায় পালাক্রমে পদত্যাগ করছেন টিম ট্রাম্পের দক্ষ, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন কর্মকর্তারা। জানা গেছে, ট্রাম্প প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বিশেষ করে স্টেট্ ডিপার্টমেন্ট ও লেবার ডিপার্টমেন্টে প্রয়োজনীয় দক্ষ, বিশ্বস্ত লোকবল নিয়োগের জন্য পাওয়া যাচ্ছে না।এরকম গোলমেলে পরিস্থিতিতেই সর্বশেষ গত পরশু পদত্যাগ করেছেন ট্রাম্প প্রশাসনের স্ট্রেটেজিক কম্যুনিকেশন্স ডিরেক্টর মাইকেল ডিউক যিনি ওয়াশিংটন পলিটিক্সে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ । রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান মাইকেল স্টিল ট্রাম্প হোয়াইট হাউজের চলমান গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, এরকম ক্রেজি লোকের সঙ্গে কাজ করবেই বা কে? এরকম পরিস্থিতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর ব্যবসা-বান্ধব দৃষ্টিতে 'মাইয়োপিক ন্যাশনালিস্ট ভিউ'-এর উর্ধে উঠতে পারছেন না-যার ফলে মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় স্বার্থ এবং আমেরিকার বিশ্বনেতৃত্ব।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ১৯৫টি দেশ কর্তৃক ২০১৫ সালে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত 'প্যারিস চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয়। এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও ৫০টি দেশ চুক্তিটি এখনো রেটিফাই করেনি এবং দুটি দেশ এই চুক্তির বিরোধিতা করছে-দেশ দুটি হলো সিরিয়া ও নিকারাগুয়া।। যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে সিরিয়া ও নিকারাগুয়ার সাথে দেশটির নাম উচ্চারিত হবে।
No comments