ভঙ্গুর রাষ্ট্র, ভঙ্গুরতম নেতৃত্ব by মিজানুর রহমান খান

ব্যর্থ রাষ্ট্র কথাটি ছিল গোলমেলে। ওয়াশিংটনভিত্তিক দ্য ফান্ড ফর পিস এবং ফরেন পলিসি, যারা যথাক্রমে ২০০৫ সালে প্রথম ব্যর্থ রাষ্ট্রের সূচক (ফেইল্ড স্টেট ইনডেক্স) প্রস্তুত ও প্রকাশ করা শুরু করেছিল, তারা সম্প্রতি ২০১৪ সালের সূচক প্রকাশ করে বলেছে, তারা আর কোনো রাষ্ট্রকে ফেইল্ড বলবে না, বলবে ফ্রাজাইল বা ভঙ্গুর।
বাংলাদেশ বিশ্বের ১৭৮টি দেশের মধ্যে ‘অ্যালার্টে’ মানে বিপদে থাকা ২৯তম ভঙ্গুর রাষ্ট্র। এর অর্থ, আমাদের চেয়ে ১৪৯টি দেশের মানুষ ভালো আছে, আর আমরা ২৮টি দেশের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছি। আগের নয় বছরের সূচকের আলোকে বলা যায়, বাংলাদেশ ক্রমাগত ভালোই করছিল। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের তিন বছর আগেই এই অগ্রগতি থমকে দাঁড়ায় ২৯তম র্যাঙ্কিংয়ে।
বিএনপির শাসনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তুলনা করলে আওয়ামী লীগ ঢের ভালো করেছে। বিএনপির আমলের খুব খারাপ থাকা ১৬ ও ১৭তম এবং সেনা-সমর্থিত আমলের আরও অবনতিশীল ১৬ ও ১২তম অবস্থানকে পেছনে ফেলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এগিয়ে চলছিল।
সুতরাং যাঁরা আমাদের জীবনমান বিএনপি-জামায়াতকে আদর্শস্থানীয় ভেবে তুলনা করে আনন্দ পেতে চান, তাঁদের জন্য সুসংবাদ। শাসনগত ১২টি ক্যাটাগরির আওতায় তাঁরা শতাধিক সাব-ক্যাটাগরি করেছে। ১২ ক্যাটাগরির মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যাগত চাপ, উদ্বাস্তু হয়ে দেশত্যাগ ও স্থানান্তর, উত্তেজনা ও সহিংসতা, অভিবাসন ও মেধা পাচার, অসম উন্নয়ন, দারিদ্র্য ও মন্দা, রাষ্ট্রের বৈধতা, সরকারি সেবা, মানবাধিকার, নিরাপত্তাব্যবস্থা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপ।
এতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি তুলনা পেয়েছি। ওই ১২টি বিষয়ের প্রতিটির জন্য নম্বর হচ্ছে ০ থেকে ১০। ১২টিতে নম্বর তাই ১২০। নম্বর যত কম থাকবে, অবস্থান তত ভালো। যত বেশি হবে, তত খারাপ। ২০০৫-০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ৯৪ দশমিক ৩ থেকে ১০০ দশমিক ৩ পর্যন্ত পেয়ে শীর্ষ ২০টি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাংলাদেশ এরপর ক্রমাগত তার অবস্থান বদলাতে শুরু করেছিল। যেমন, ৯৬ দশমিক ১ পেয়ে বাংলাদেশ ২৪তম অবস্থান নেয় ২০১০ সালে। ২০১১ সালে ৯৪ দশমিক ৪ পেয়ে ২৫তম। ২০১২ সালে ৯২ দশমিক ২ পেয়ে ২৯তম অবস্থানে আসে এবং আগেই বলেছি, এখানে এসেই সে আটকা পড়ে। ২০১৪ সালের সূচকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রতিফলন নেই।
কারণ, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য নেওয়া হয়েছে। তবে টানা তিন বছর থমকে দাঁড়ানো ইঙ্গিত দেয় যে ২০১৫ সালের সূচক বিস্ময়করভাবে ইতিবাচক হবে না। বাংলাদেশের বর্তমান ভঙ্গুর নেতৃত্ব সময় পার করতে পারে।
কিন্তু স্বল্প আয় থেকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করার আশাবাদ ভঙ্গুর থেকে যাবে।
২০০৬ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সার্বিক প্রবণতার একটি লেখচিত্র তারা প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে ২০০৭-০৮ এতে খুবই খারাপভাবে চিত্রিত হয়েছে। বহুল আলোচিত এক-এগারোর প্রতি এটি আন্তর্জাতিক অনাস্থার প্রতিফলন হিসেবে দেখা চলে। ২০১২ সালের সূচকে বাংলাদেশ সামান্যই পরিবর্তন দেখেছে। অর্ধেকের বেশি সূচকের পরিবর্তন ঘটেনি। তিনটি সূচকের উন্নতি ছিল প্রান্তিক এবং দুটো সূচকের সামান্য অবনতি ঘটে।
পিস ফর ফান্ড বলেছে, পাঁচ বছর মেয়াদে বাংলাদেশের সূচকগুলো লক্ষণীয়ভাবে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছে জনসংখ্যার চাপ, সহিংসতা কমানো, অসম উন্নয়ন হ্রাস এবং দেশত্যাগ ও মেধা পাচারের গতিরোধে।
ফরেন পলিসির নির্বাহী সম্পাদক বেঞ্জামিন পকার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্য ফান্ড ফর পিসের নির্বাহী পরিচালক ক্রিস্টা হেন্ড্রির। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কেন অনেক দেশ অব্যাহতভাবে শীর্ষ দশে অবস্থান করছে। উত্তরে ক্রিস্টা বলেছেন, দুর্ভাগ্যবশত একটি দেশ খুব তাড়াতাড়ি অধিকতর ভঙ্গুর কিংবা পুরোপুরি সহিংস হয়ে উঠতে পারে। এবং তারা ভঙ্গুরতম হতে পারে।
অথচ তালিকার নিচে যাওয়াটা অর্থাৎ অবস্থান ভালো হওয়াটা দ্রুততার সঙ্গে ঘটে না। অধিকতর স্থিতিশীলতা আনতে হলে একটি প্রজন্ম লেগে যেতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও উন্নয়ন অংশীদারদের এখন এটাই বেশি মনে রাখতে হবে।
সিয়েরা লিওন টপ টেন থেকে মুক্ত হয়েছে। কীভাবে? তারা সুশাসনগত সামর্থ্য বৃদ্ধির জোর চেষ্টা করেছে। কী করে ভালোভাবে একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায়, সে জন্য তারা জ্ঞানচর্চায় মনোযোগ দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের তৃণমূলে পাঠিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে, এসবই দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। আর স্থিতি ছাড়া একে লালন করা চলে না। তবে আমরা ক্রিস্টার সঙ্গে একমত হব যে কেবল সংশ্লিষ্ট দেশই নিজেদের খারাপ অবস্থা থেকে টেনে তুলতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেবল তার প্রচেষ্টায় সহায়তা দিতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশের নেতৃত্বকে এই ব্যর্থতার দায়ভার নিতে হবে। সাফল্য আওয়ামী লীগের, ব্যর্থতা বিএনপি-জামায়াতের কিংবা প্রতিপক্ষের, এ কথা ৫ জানুয়ারির প্রহসনের পরে একেবারেই খাটে না।
ভঙ্গুর রাষ্ট্রের চ্যাম্পিয়ন দক্ষিণ সুদানে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না, যারা সহিংসতা মোকাবিলা করতে পারে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের সহিংসতা বা তাদের ওপর পদ্ধতিগত নিপীড়ন চালিয়ে একটি অবস্থা পার করে এসেছে সত্য। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুরতর হয়েছে। আমরা এমন কিছু রাষ্ট্র দেখছি, যারা শক্তিশালী কিন্তু তারা জনগণের কল্যাণকে থোড়াই কেয়ার করে। এমনকি নিজেদের নাগরিককে আহত করে। আবার এমন অনেক রাষ্ট্র রয়েছে, যারা জনগণের জন্য ভালো করতে চাইলেও তার প্রতিষ্ঠান দিয়ে সেটা তারা করতে পারে না। বাংলাদেশ মনে হয় এই শেষের কাতারে পড়তে যাচ্ছে।
তবে ক্রিস্টার একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। কিছু লোক সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের তাঁবেদার। তাঁরা রাজনীতিকে উন্নয়ন থেকে আলাদা করতে চান। সামরিক শাসনেও বলা হয়েছে, জেনারেলদের বিরক্ত কোরো না। জেনারেল হয়েছে তো কী হয়েছে, দেশের স্বার্থ তো আগে। আগে চাই অর্থনৈতিক মুক্তি আর এটা পেলেই রাজনৈতিক মুক্তি ধরা দেবে। আর বাংলাদেশ এখন কার্যত এরই একটি পরীক্ষাগার। অথচ ক্রিস্টা বলেছেন খাঁটি কথা। ‘আমরা এমন কোনো দেশ দেখিনি, যারা তাদের অর্থনীতিতে বিরাট পরিবর্তন সাধন করে ফেলেছে অথচ তাদের দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিরাট রাজনৈতিক উদ্বেগ রাষ্ট্রকে কাতর করেনি।’ আসলে দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না। কারণ, এ-সংক্রান্ত সব ইস্যু ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ক্রিস্টা প্রশ্ন করেছেন, ভারতের অর্থনৈতিক মন্দা কি দেশটির সামগ্রিক নিরাপত্তা ও শাসনগত দক্ষতাকে প্রভাবিত করেনি? আরব বসন্ত কি প্রকৃত গণতন্ত্রের পথে কোনো স্থায়ী অবদান রাখতে পেরেছে?
বর্তমানে যে অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তা সব সময় ঝড়ের আগের শান্ত অবস্থা হয়ে থাকবে। কারণ, ক্রিস্টার কথায়, ‘একটি রাষ্ট্র, যার কাঠামো শক্তিশালী রয়েছে, তারও একটি বছরে অনেক কিছু ঘটতে পারে। আর সেটা কেবল রাষ্ট্রের বৈধতাকে নয়, তার নাগরিকদের জীবনে তা কয়েক দশকব্যাপী প্রভাব বয়ে আনতে পারে।’
২০১২ সালে শিল্পোন্নত জি-৭ + ফ্রাজাইল ১৮-এর জন্ম হয়েছে। জি-৭-এর সঙ্গে ১৮টি দেশ যুক্ত হয়েছে, যারা ব্যর্থ রাষ্ট্রের সূচকে খুব খারাপ অবস্থায়। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ অবশ্যই দূরে, কিন্তু খুব বেশি দূরে নয়। ২০১২ সালে তারা প্রথমবারের মতো ৫২ পৃষ্ঠার একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জি-৭ তাদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে চায়।
এই প্রতিবেদনে ভয়ানক ভঙ্গুর রাষ্ট্রের ১৪টি বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ঢাকার কূটনৈতিকপল্লি থেকে একটি নতুন পরিভাষা শুনেছিলাম। এই প্রতিবেদনে তা দেখলাম, আর সেটি হলো ‘ইনক্লুসিভ পলিটিকস।’ সোজা কথায়, বিএনপি, জামায়াতসহ সবাইকে নিয়েই রাজনীতি। বাংলাদেশে এর পদ্ধতিগত বিসর্জনকাল চলছে। এ জন্য শাসনসংশ্লিষ্ট সব ‘বাজিকর’ কমবেশি দায়ী। কিন্তু যা খুবই আশঙ্কার তা হলো সবচেয়ে ভঙ্গুর রাষ্ট্রগুলোর যা বৈশিষ্ট্য তার কয়েকটি বাদে সবই বাংলাদেশের জন্য মাত্রাগত তারতম্য সাপেক্ষে এখনই প্রযোজ্য এবং হুঁশিয়ার হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে সংলাপ না থাকা, সব পক্ষ যুদ্ধে থাকা, চুক্তি করে তার বরখেলাপ করা, জবরদস্তি (প্রতিপক্ষকে) এলাকাছাড়া করা, রাজনৈতিক ও সামাজিক নিপীড়ন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের সম্পর্ক ভেঙে পড়া, নির্বাচন না হওয়া, শক্তি প্রয়োগকেই ক্ষমতার ভিত্তি করা, দেশের সর্বত্র রাষ্ট্রের উপস্থিতি অনুভূত না হওয়া, শাসনের ঐতিহ্যগত ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, আবার ঐতিহ্যগত শাসনই একমাত্র চালিকাশক্তি এবং রাজনৈতিকভাবে সমাধানের কোনো পথ একেবারেই খোলা না থাকা।
এই অবস্থা থেকে উতরাতে যে ১১টি সুপারিশ করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই বাংলাদেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বেমালুম অস্বীকার করে চলেছে। এতে তিনটি বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে: নেতৃত্বকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হতে হবে, সংবিধানের রিভিউ শুরু করতে হবে এবং রাজনৈতিক সংলাপ চালু করতে হবে। অবশ্য বাস্তবে এটা কম ভরসার বিষয় নয় যে ২০০৮-১১ সোমালিয়া ভঙ্গুর রাষ্ট্রের সূচকের টপ টেনে থেকেও জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে থাকতে তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
তাদের শীর্ষ নেতা বিদেশে গেলে রাষ্ট্রপ্রধানেরা দেখা করেন। সোমালিয়ার পত্রিকা নিশ্চয় বড় করে সেসব সাক্ষাৎপর্বের আলোকচিত্র ফলাও করেই ছাপে। পাকিস্তান টপ টেনে থেকেও সত্তরের নির্বাচনের পর প্রথম এত বেশি মানুষের অংশগ্রহণে ভোট করল। তার
মানে দাঁড়াল, বিএনপির চাওয়া ভোট এলেও আমাদের উন্নতি হচ্ছে না। ভঙ্গুরতম নেতৃত্বই এর বাধা।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.