দুই নেত্রীর আপিল বিভাগ ও সংসদ অবমাননা by মিজানুর রহমান খান
আওয়ামী লীগ আপিল বিভাগের রায়ের অপব্যাখ্যা ব্যাখ্যা করেছে। বিরোধী দলও রায়ের সঠিক ব্যাখ্যা করেনি। তারা কেউ পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষায় থাকার দরকার মনে করেনি। বিশেষ কমিটিও নয়। উভয় দল পানি ঘোলা করছে। তবে যদি বলা হয়, ঠিক এই পর্বের দায় কার কাঁধে বেশি চাপবে, তাহলে সেটা সরকারি দলের কাঁধেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। দুটোতেই দুটি মুদ্রিত কপি ছিল, এর বাইরে ছিল প্রশ্নোত্তর। এই দুটো কপি দুটি অকাট্য প্রমাণ। মাত্রাভেদে এ দুটিতেই রয়েছে আপিল বিভাগ অবমাননার উপকরণ। দুটোতেই ত্রয়োদশ সংশোধনী-সংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায়কে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
আপিল বিভাগের ছয় বিচারক বিভক্ত রায় দিয়েছেন। আমরা জানি না কতজন মিলে তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘু হয়েছেন। ছয় বিচারক স্বাক্ষরিত সংক্ষিপ্ত আদেশটি অবিকল এ রকম: ‘(১) সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে বিনা খরচায় আপিলটি মঞ্জুর করা হইল। (২) সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন ১৯৯৬ ভাবিসাপেক্ষে (প্রসপেক্টিভলি) বাতিল ও সংবিধানবহির্ভূত ঘোষণা করা হইল। (৩) দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন সুপ্রাচীন নীতিসমূহ, যা অন্যবিধভাবে বৈধ নয়, প্রয়োজনের কারণে বৈধ, জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন—এর ভিত্তিতে উল্লিখিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। যা হোক জাতীয় সংসদ অন্তর্বর্তীকালে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের বিচারপতিদের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার বিধান বাদ দিয়ে স্বাধীনভাবে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে পারে। রায়ের বিস্তারিত বিবরণ অনুসরণীয়। সংশ্লিষ্ট সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল নং ৫৯৬/২০০৫ এতদ্দ্বারা নিষ্পত্তি করা হইল।’
১০ মে ওই রায় ঘোষণা করা হয়েছে। ছয়জন বিচারক ছয়টি বাক্যে সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়েছেন। এটা হলো রায়ের চুম্বক অংশ। ওই আদেশের তিনটি দফাকে বিচ্ছিন্নভাবে পড়া বা তেমনভাবে মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই; বরং এ ধরনের দাবি করা প্রলাপের নামান্তর।
পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা যে করতেই হবে, সে বিষয়টিও কিন্তু আপিল বিভাগ স্পষ্ট করেছেন। কিন্তু নেতা-নেত্রীরা কেউ পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করেননি। অথচ কয়েকটি বিষয় জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আপিল বিভাগ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেছে মর্মে গণমাধ্যমে যেভাবে বড় শিরোনাম করেছিল, সেটা বিভ্রান্তিকর অন্তত সংক্ষিপ্ত আদেশের মতে। এর কারণ, আমাদের অনুমান সত্যি হলে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম ‘ডকট্রিন অব প্রসপেক্টিভ ওভাররুলিং’ প্রয়োগ করে রায় লেখা হয়েছে। এর আগে সংবাদপত্রের রিপোর্টের ভিত্তিতে লিখেছিলাম, এটা দেখা গুরুত্বপূর্ণ যে মূল রায়ে কখন থেকে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল বলে গণ্য করা হবে বলা হয়। ভয়েড, মানে গোড়া থেকে বাতিল। আমাদের দেশে সামরিক শাসনসংশ্লিষ্ট পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী এবং সংসদের করা অষ্টম সংশোধনীকে গোড়া থেকে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু ত্রয়োদশ সংশোধনীর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে প্রসপেক্টিভ অর্থাৎ ভবিষ্যৎ থেকে রহিত করা হয়েছে। এটা যে দেশের বিচার বিভাগে এই প্রথম, সেটুকু ব্যারিস্টার রফিক-উল হক রোববার আমাদের নিশ্চিত করেন। তবে এখনই হলফ করে কিছু বলব না। কারণ, সাম্প্রতিক কালে আমরা দেখেছি, রায় ঘোষণার দিনে যে ধরনের আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে, পরে পূর্ণাঙ্গ রায়ের পরে তা বিস্ময়করভাবে বদলে গেছে।
ভবিষ্যৎকালে সংবিধানের সংশোধনী বাতিলে আদালতের ক্ষমতাও আইনে লেখা নেই। এটা এক কল্পনাপ্রসূত লিগ্যাল ফিকশন। মৌলিক কাঠামোর মতো এই ডকট্রিনও একটা ফিকশন। বিশেষ কমিটির রিপোর্টে মৌলিক কাঠামোর উল্লেখ দেখে আমরা হতবাক। কোনো সংবিধানে এটা দেখিনি। যাক, কোনো আইন ভবিষ্যৎকালে বাতিলে অভিনবত্ব ও চমৎকারিত্ব দুই-ই আছে। এর প্রথম উন্মেষ ঘটে আমেরিকায়। ভারতের প্রধান বিচারপতি সুভা রায় ১৯৬৭তে ‘গোলকনাথ’ মামলায় এর প্রথম প্রয়োগ করেন। সাংবিধানিক পণ্ডিতদের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদ প্রবল। কারণ, আদালতের এ ধরনের ‘কল্পনাপ্রসূতা’ চূড়ান্ত অর্থে সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতাকে সংকুচিত করতে পারে। ভারতে এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম হয়নি। বিখ্যাত মণ্ডল মামলায় বিচারপতি জীবন রেড্ডি রায় দিয়েছিলেন যে, রায়ের কার্যকারিতা রায় ঘোষণার দিন থেকে আগামী পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর বলবৎ হবে।
আমরা তো কল্পনায় ভাসতে পারি না। নবম ও দশম সংসদের মেয়াদ শেষ হলে পরেই তবে বাতিল কথাটি কার্যকর হবে, সেটা পূর্ণাঙ্গ রায়ে থাকবে বা থাকবে না, তা ধরে নেওয়ার বিষয় নয়। অথচ বিশেষ কমিটি আদালতের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বলি দিল। তাদের দুরভিসন্ধি না থাকলে রায়ের দোহাই দিত না।
অন্যদিকে আপিল বিভাগ যদি নিঃশর্তে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলই করবেন, তাহলে তারা কি দুই ও তিন নম্বর দফা যুক্ত করলেন বেহুদাই? বাতিল জিনিসের আবার প্রয়োজনীয় সংশোধনী কী। সে জন্য সংসদকে ‘লিবার্টি’ দেওয়ার মানে কী। এই লিবার্টি তো স্ট্যাচু অব লিবার্টি নয়।
তবে যা-ই ঘটুক না কেন, আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশ যেটি আমাদের হাতে রয়েছে, তার যে অপব্যাখ্যা করে বিশেষ কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে ও ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ হরতাল হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই বললেই চলে।
আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতি শুনে আইনবিদ্যায় যাঁদের অ আ ক খ জ্ঞান আছে, লজ্জায় তাঁরা হয়তো মাটিতে মিশে যাচ্ছেন। গত বছর সংসদ নেতার মোশনে বিশেষ কমিটি হয়। তারা দুই নেত্রীকে আমন্ত্রণ জানায়। এটা পকেট কমিটি ছিল না। এর রিপোর্ট যাবে সংসদে, যেকোনো সিদ্ধান্ত সংসদের ফ্লোরে হওয়ার কথা। কিন্তু তা হতে দেওয়া হলো না। এর মাধ্যমে স্পষ্টতই শুধু আদালত নয়, সংসদেরও অবমাননা ঘটেছে। আজ যদি সংসদের নেতা, প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি তিনটি আলাদা মাথা থাকত, তাহলে হয়তো এমনটা ঘটত না।
প্রধানমন্ত্রী সাফ বলেছেন, আদালতে বাতিল হওয়ার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই। ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা ডাহা মিথ্যাচার করছেন। হয়তো ‘মে’ শব্দটি থেকে ফায়দা নিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, দুই মেয়াদের নির্বাচন কথাটা নাকি অবিটার ডিকটা। লাতিন এ শব্দের মানে বাতকিবাত, পর্যবেক্ষণ। তবে এর কোনো দাম নেই—এটাও ডাহা মিথ্যা। যদি ধরেও নিই, এটা অবিটার ডিকটা। তাহলেও বলব, আওয়ামী লীগ অসত্য বলছে। ১৯৬০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় আছে, অবিটার ও পর্যবেক্ষণ সুপ্রিম কোর্টের হলে তা বাধ্যতামূলকই। ভারতের প্রধান বিচারপতি এ এম আহমেদির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ, যেখানে জে.এস. ভারমার (পরে প্রধান বিচারপতি) মতো বরেণ্য বিচারক ছিলেন; ১৯৯৫ সালে তাঁরা বলেন, অবিটার ডিকটার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং তা মেনে চলাটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। নেহাত শুনানিকালে মার্কিন প্রধান বিচারপতি ওয়েটারের একটা মামুলি উক্তি পরে একটি নন্দিত ডকট্রিনে পরিণত হয়েছিল।
আমাদের শাসকগোষ্ঠীকে এসব বলে লাভ নেই। আমরা পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। বিরোধী দলের নেতা (অভ্যাসগত সংসদ অবমাননাকারী) বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ৪ জুনের সংবাদ সম্মেলনে ১৭১৯ শব্দের একটি লিখিত বিবৃতি পাঠ করেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রতি তাঁর রাগ বোধগম্য। ওই বিবৃতিতে রায়সংক্রান্ত ৩৪৮ শব্দের একটি প্যারাগ্রাফ আছে। সেখানে আছে, ‘বিতর্কিত এ রায়টি আইন ও সংবিধানসম্মত নয়। পরস্পরবিরোধী, দুর্বল, যুক্তিহীন ও বিতর্কিত। সরকারের অনুগ্রহভাজন এই ধরনের বিচারপতির রায়ের ছুতা ধরেই আজ সংবিধান বদল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা চলছে।’ অবশ্য এ কথাও আছে যে, ‘এই বিতর্কিত রায়ের একটি অংশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান আরও দুই মেয়াদ বহাল রাখা যাবে বলে যে মত দেওয়া হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার এখন সেটিও এড়িয়ে যেতে চাইছে।’
পূর্ণাঙ্গ রায় পাঠে তাঁর আগ্রহ নেই। তাঁদের দরকার অস্থিতিশীলতার মসলা। ক্ষমতাসীনেরা চেয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বাতিল করতে। এই আকাঙ্ক্ষা তাদের গোড়াতেই প্রকাশ পায়। সেটা তারা রায় অপব্যাখ্যা করে, কালবিলম্ব না করে উসুল করেছে। আর বিএনপি-জামায়াত চেয়েছিল ‘জনসমর্থিত’ জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচির ফিতাকাটা। এ উপলক্ষটি পেয়ে তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। সেটাও ওই রায়ের ছুতোয়, বিশেষ করে লাভবান হয় জামায়াত। তারা প্রথমবারের মতো ‘গণমুখী’ হরতাল ডাকতে সক্ষম হয়। বিএনপি নেত্রীর মলিন ভাবমূর্তির ছেলেদের জন্য হরতাল দিতে তাঁরা মওকা পায়নি। কদিন পরেই জামায়াতের নতুন পাখনা গজাবে। সাঈদী ও সাকা চৌধুরীর মতো ব্যক্তিদের বিচারের জন্য ৪৭ অনুচ্ছেদ শোধরানোর সুপারিশ এলেও ধর্মভিত্তিক দলগুলো তো বেঁচে গেল। জামায়াত নিষিদ্ধের রাজনীতি আওয়ামী লীগই নিষিদ্ধ করল।
আমরা আপিল বিভাগের কাছে অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ রায় আশা করি। দ্ব্যর্থক নয়, পষ্টাপষ্টি। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যারা ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ধরে নিয়েছেন এবং নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণসহ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপায় বাতলাচ্ছেন, তাঁদের আশু করণীয় রায়ের সঠিক ব্যাখ্যার বিষয়ে কলম ধরা। ক্ষমতাসীনেরা সংবিধান ও আদালতের রায় কাকে বলে—যা কিছুই ঠিক করে দিচ্ছেন, সেটাই কোনো না কোনোভাবে কল্কে পাচ্ছে। সংবিধান পুনর্মুদ্রণ পর্বে আমরা অসহায় বোধ করেছি, বিশেষ করে আদালত যখন এই নীতি নেন যে তাঁরা রায় অপব্যাখ্যার বিষয়ে নীরব থাকবেন। যে যা বুঝে সারতে পারে। তবে ক্ষমতাসীনের বোঝাটাই সার।
পাদটীকা: ৫ জুন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের মানবজমিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারটি স্ববিরোধী। আপিল বিভাগের ওই সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গেও তা সংগতিপূর্ণ নয়। ‘বিতর্ক এড়াতেই দুই মেয়াদে নির্বাচন রেখেছি’ বলার পরে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়ে গেছে। এখন আর তা নেই’, এটা কীভাবে যৌক্তিক হতে পারে?’ পঞ্চম সংশোধনীর রায় অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে একটি রিট হয়েছে। গতকাল অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর এক সপ্তাহ সময় নিয়েছে। ১৩ জুন শুনানি হবে। এ লড়াইটা চালাতে হবে। এটা এক নতুন লড়াইয়ের ক্ষেত্র। শুধু রাজনীতিকেরাই এর কুশীলব নন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। দুটোতেই দুটি মুদ্রিত কপি ছিল, এর বাইরে ছিল প্রশ্নোত্তর। এই দুটো কপি দুটি অকাট্য প্রমাণ। মাত্রাভেদে এ দুটিতেই রয়েছে আপিল বিভাগ অবমাননার উপকরণ। দুটোতেই ত্রয়োদশ সংশোধনী-সংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায়কে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
আপিল বিভাগের ছয় বিচারক বিভক্ত রায় দিয়েছেন। আমরা জানি না কতজন মিলে তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘু হয়েছেন। ছয় বিচারক স্বাক্ষরিত সংক্ষিপ্ত আদেশটি অবিকল এ রকম: ‘(১) সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে বিনা খরচায় আপিলটি মঞ্জুর করা হইল। (২) সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন ১৯৯৬ ভাবিসাপেক্ষে (প্রসপেক্টিভলি) বাতিল ও সংবিধানবহির্ভূত ঘোষণা করা হইল। (৩) দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন সুপ্রাচীন নীতিসমূহ, যা অন্যবিধভাবে বৈধ নয়, প্রয়োজনের কারণে বৈধ, জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন—এর ভিত্তিতে উল্লিখিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। যা হোক জাতীয় সংসদ অন্তর্বর্তীকালে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের বিচারপতিদের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার বিধান বাদ দিয়ে স্বাধীনভাবে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে পারে। রায়ের বিস্তারিত বিবরণ অনুসরণীয়। সংশ্লিষ্ট সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল নং ৫৯৬/২০০৫ এতদ্দ্বারা নিষ্পত্তি করা হইল।’
১০ মে ওই রায় ঘোষণা করা হয়েছে। ছয়জন বিচারক ছয়টি বাক্যে সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়েছেন। এটা হলো রায়ের চুম্বক অংশ। ওই আদেশের তিনটি দফাকে বিচ্ছিন্নভাবে পড়া বা তেমনভাবে মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই; বরং এ ধরনের দাবি করা প্রলাপের নামান্তর।
পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা যে করতেই হবে, সে বিষয়টিও কিন্তু আপিল বিভাগ স্পষ্ট করেছেন। কিন্তু নেতা-নেত্রীরা কেউ পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করেননি। অথচ কয়েকটি বিষয় জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আপিল বিভাগ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেছে মর্মে গণমাধ্যমে যেভাবে বড় শিরোনাম করেছিল, সেটা বিভ্রান্তিকর অন্তত সংক্ষিপ্ত আদেশের মতে। এর কারণ, আমাদের অনুমান সত্যি হলে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম ‘ডকট্রিন অব প্রসপেক্টিভ ওভাররুলিং’ প্রয়োগ করে রায় লেখা হয়েছে। এর আগে সংবাদপত্রের রিপোর্টের ভিত্তিতে লিখেছিলাম, এটা দেখা গুরুত্বপূর্ণ যে মূল রায়ে কখন থেকে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল বলে গণ্য করা হবে বলা হয়। ভয়েড, মানে গোড়া থেকে বাতিল। আমাদের দেশে সামরিক শাসনসংশ্লিষ্ট পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী এবং সংসদের করা অষ্টম সংশোধনীকে গোড়া থেকে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু ত্রয়োদশ সংশোধনীর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে প্রসপেক্টিভ অর্থাৎ ভবিষ্যৎ থেকে রহিত করা হয়েছে। এটা যে দেশের বিচার বিভাগে এই প্রথম, সেটুকু ব্যারিস্টার রফিক-উল হক রোববার আমাদের নিশ্চিত করেন। তবে এখনই হলফ করে কিছু বলব না। কারণ, সাম্প্রতিক কালে আমরা দেখেছি, রায় ঘোষণার দিনে যে ধরনের আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে, পরে পূর্ণাঙ্গ রায়ের পরে তা বিস্ময়করভাবে বদলে গেছে।
ভবিষ্যৎকালে সংবিধানের সংশোধনী বাতিলে আদালতের ক্ষমতাও আইনে লেখা নেই। এটা এক কল্পনাপ্রসূত লিগ্যাল ফিকশন। মৌলিক কাঠামোর মতো এই ডকট্রিনও একটা ফিকশন। বিশেষ কমিটির রিপোর্টে মৌলিক কাঠামোর উল্লেখ দেখে আমরা হতবাক। কোনো সংবিধানে এটা দেখিনি। যাক, কোনো আইন ভবিষ্যৎকালে বাতিলে অভিনবত্ব ও চমৎকারিত্ব দুই-ই আছে। এর প্রথম উন্মেষ ঘটে আমেরিকায়। ভারতের প্রধান বিচারপতি সুভা রায় ১৯৬৭তে ‘গোলকনাথ’ মামলায় এর প্রথম প্রয়োগ করেন। সাংবিধানিক পণ্ডিতদের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদ প্রবল। কারণ, আদালতের এ ধরনের ‘কল্পনাপ্রসূতা’ চূড়ান্ত অর্থে সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতাকে সংকুচিত করতে পারে। ভারতে এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম হয়নি। বিখ্যাত মণ্ডল মামলায় বিচারপতি জীবন রেড্ডি রায় দিয়েছিলেন যে, রায়ের কার্যকারিতা রায় ঘোষণার দিন থেকে আগামী পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর বলবৎ হবে।
আমরা তো কল্পনায় ভাসতে পারি না। নবম ও দশম সংসদের মেয়াদ শেষ হলে পরেই তবে বাতিল কথাটি কার্যকর হবে, সেটা পূর্ণাঙ্গ রায়ে থাকবে বা থাকবে না, তা ধরে নেওয়ার বিষয় নয়। অথচ বিশেষ কমিটি আদালতের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বলি দিল। তাদের দুরভিসন্ধি না থাকলে রায়ের দোহাই দিত না।
অন্যদিকে আপিল বিভাগ যদি নিঃশর্তে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলই করবেন, তাহলে তারা কি দুই ও তিন নম্বর দফা যুক্ত করলেন বেহুদাই? বাতিল জিনিসের আবার প্রয়োজনীয় সংশোধনী কী। সে জন্য সংসদকে ‘লিবার্টি’ দেওয়ার মানে কী। এই লিবার্টি তো স্ট্যাচু অব লিবার্টি নয়।
তবে যা-ই ঘটুক না কেন, আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশ যেটি আমাদের হাতে রয়েছে, তার যে অপব্যাখ্যা করে বিশেষ কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে ও ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ হরতাল হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই বললেই চলে।
আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতি শুনে আইনবিদ্যায় যাঁদের অ আ ক খ জ্ঞান আছে, লজ্জায় তাঁরা হয়তো মাটিতে মিশে যাচ্ছেন। গত বছর সংসদ নেতার মোশনে বিশেষ কমিটি হয়। তারা দুই নেত্রীকে আমন্ত্রণ জানায়। এটা পকেট কমিটি ছিল না। এর রিপোর্ট যাবে সংসদে, যেকোনো সিদ্ধান্ত সংসদের ফ্লোরে হওয়ার কথা। কিন্তু তা হতে দেওয়া হলো না। এর মাধ্যমে স্পষ্টতই শুধু আদালত নয়, সংসদেরও অবমাননা ঘটেছে। আজ যদি সংসদের নেতা, প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি তিনটি আলাদা মাথা থাকত, তাহলে হয়তো এমনটা ঘটত না।
প্রধানমন্ত্রী সাফ বলেছেন, আদালতে বাতিল হওয়ার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই। ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা ডাহা মিথ্যাচার করছেন। হয়তো ‘মে’ শব্দটি থেকে ফায়দা নিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, দুই মেয়াদের নির্বাচন কথাটা নাকি অবিটার ডিকটা। লাতিন এ শব্দের মানে বাতকিবাত, পর্যবেক্ষণ। তবে এর কোনো দাম নেই—এটাও ডাহা মিথ্যা। যদি ধরেও নিই, এটা অবিটার ডিকটা। তাহলেও বলব, আওয়ামী লীগ অসত্য বলছে। ১৯৬০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় আছে, অবিটার ও পর্যবেক্ষণ সুপ্রিম কোর্টের হলে তা বাধ্যতামূলকই। ভারতের প্রধান বিচারপতি এ এম আহমেদির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ, যেখানে জে.এস. ভারমার (পরে প্রধান বিচারপতি) মতো বরেণ্য বিচারক ছিলেন; ১৯৯৫ সালে তাঁরা বলেন, অবিটার ডিকটার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং তা মেনে চলাটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। নেহাত শুনানিকালে মার্কিন প্রধান বিচারপতি ওয়েটারের একটা মামুলি উক্তি পরে একটি নন্দিত ডকট্রিনে পরিণত হয়েছিল।
আমাদের শাসকগোষ্ঠীকে এসব বলে লাভ নেই। আমরা পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। বিরোধী দলের নেতা (অভ্যাসগত সংসদ অবমাননাকারী) বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ৪ জুনের সংবাদ সম্মেলনে ১৭১৯ শব্দের একটি লিখিত বিবৃতি পাঠ করেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রতি তাঁর রাগ বোধগম্য। ওই বিবৃতিতে রায়সংক্রান্ত ৩৪৮ শব্দের একটি প্যারাগ্রাফ আছে। সেখানে আছে, ‘বিতর্কিত এ রায়টি আইন ও সংবিধানসম্মত নয়। পরস্পরবিরোধী, দুর্বল, যুক্তিহীন ও বিতর্কিত। সরকারের অনুগ্রহভাজন এই ধরনের বিচারপতির রায়ের ছুতা ধরেই আজ সংবিধান বদল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা চলছে।’ অবশ্য এ কথাও আছে যে, ‘এই বিতর্কিত রায়ের একটি অংশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান আরও দুই মেয়াদ বহাল রাখা যাবে বলে যে মত দেওয়া হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার এখন সেটিও এড়িয়ে যেতে চাইছে।’
পূর্ণাঙ্গ রায় পাঠে তাঁর আগ্রহ নেই। তাঁদের দরকার অস্থিতিশীলতার মসলা। ক্ষমতাসীনেরা চেয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বাতিল করতে। এই আকাঙ্ক্ষা তাদের গোড়াতেই প্রকাশ পায়। সেটা তারা রায় অপব্যাখ্যা করে, কালবিলম্ব না করে উসুল করেছে। আর বিএনপি-জামায়াত চেয়েছিল ‘জনসমর্থিত’ জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচির ফিতাকাটা। এ উপলক্ষটি পেয়ে তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। সেটাও ওই রায়ের ছুতোয়, বিশেষ করে লাভবান হয় জামায়াত। তারা প্রথমবারের মতো ‘গণমুখী’ হরতাল ডাকতে সক্ষম হয়। বিএনপি নেত্রীর মলিন ভাবমূর্তির ছেলেদের জন্য হরতাল দিতে তাঁরা মওকা পায়নি। কদিন পরেই জামায়াতের নতুন পাখনা গজাবে। সাঈদী ও সাকা চৌধুরীর মতো ব্যক্তিদের বিচারের জন্য ৪৭ অনুচ্ছেদ শোধরানোর সুপারিশ এলেও ধর্মভিত্তিক দলগুলো তো বেঁচে গেল। জামায়াত নিষিদ্ধের রাজনীতি আওয়ামী লীগই নিষিদ্ধ করল।
আমরা আপিল বিভাগের কাছে অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ রায় আশা করি। দ্ব্যর্থক নয়, পষ্টাপষ্টি। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যারা ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ধরে নিয়েছেন এবং নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণসহ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপায় বাতলাচ্ছেন, তাঁদের আশু করণীয় রায়ের সঠিক ব্যাখ্যার বিষয়ে কলম ধরা। ক্ষমতাসীনেরা সংবিধান ও আদালতের রায় কাকে বলে—যা কিছুই ঠিক করে দিচ্ছেন, সেটাই কোনো না কোনোভাবে কল্কে পাচ্ছে। সংবিধান পুনর্মুদ্রণ পর্বে আমরা অসহায় বোধ করেছি, বিশেষ করে আদালত যখন এই নীতি নেন যে তাঁরা রায় অপব্যাখ্যার বিষয়ে নীরব থাকবেন। যে যা বুঝে সারতে পারে। তবে ক্ষমতাসীনের বোঝাটাই সার।
পাদটীকা: ৫ জুন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের মানবজমিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারটি স্ববিরোধী। আপিল বিভাগের ওই সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গেও তা সংগতিপূর্ণ নয়। ‘বিতর্ক এড়াতেই দুই মেয়াদে নির্বাচন রেখেছি’ বলার পরে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়ে গেছে। এখন আর তা নেই’, এটা কীভাবে যৌক্তিক হতে পারে?’ পঞ্চম সংশোধনীর রায় অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে একটি রিট হয়েছে। গতকাল অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর এক সপ্তাহ সময় নিয়েছে। ১৩ জুন শুনানি হবে। এ লড়াইটা চালাতে হবে। এটা এক নতুন লড়াইয়ের ক্ষেত্র। শুধু রাজনীতিকেরাই এর কুশীলব নন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments