ইসলামের আলোকে শিক্ষা ও গবেষণা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
আধুনিক কালে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে চরম উৎকর্ষ, তা ইসলামের অবদান। বর্তমানে মানবজাতির ইতিহাস এমন পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে, যা থেকে সব জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্রোতোধারা ইসলামের দিকেই প্রবাহিত হচ্ছে। ইসলাম সূচনাকাল থেকেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। জ্ঞানার্জন ছাড়া ইসলাম বোঝা অসম্ভব। এ জন্য ইসলাম তার অনুসারীদের জ্ঞানার্জনের প্রতি সর্বাধিক উৎসাহিত করেছে। পবিত্র কোরআনে মুসলমানদের এ প্রার্থনা করতে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করো।’
আল্লাহ তাআলা মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধির বদৌলতেই সব সৃষ্টিজীবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন। ফেরেশতাদের অসম্মতি সত্ত্বেও তিনি হজরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি করে তাঁকে সবকিছুর নাম শিক্ষা দেন। এসব বিষয়বস্তুর জ্ঞান ও বিদ্যালাভের মাধ্যমেই হজরত আদম (আ.) ফেরেশতাদের থেকে বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন তথা সম্মানের শীর্ষ পর্যায়ে উন্নীত হন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর স্মরণ কর যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, “আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি পাঠাতে যাচ্ছি”।’ ফেরেশতারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কিছু পাঠাবেন, যারা অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার প্রশংসা, মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করছি।’ তিনি বললেন, ‘আমি যা জানি তোমরা তা জানো না।’ আর তিনি আদমকে যাবতীয় বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়ে সেগুলো ফেরেশতাদের সামনে প্রকাশ করলেন এবং বললেন, এগুলোর নাম আমাকে বলো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৩০-৩১) অতঃপর ফেরেশতারা হজরত আদম (আ.)-এর জ্ঞান-বুদ্ধি ও শিক্ষার কাছে পরাজিত হয় এবং আল্লাহর নির্দেশে তাঁকে সম্মানসূচক সিজদা করে।
মহানবী (সা.) জ্ঞানলোক ও সভ্যতার যে বিরাট অট্টালিকার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন, তা তাঁর সমকাল থেকেই সারা পৃথিবীকে অলংকৃত করে আসছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘জ্ঞানার্জন করা প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরজ।’ (ইবনে মাজা ও বায়হাকি) তিনি আরও বলেছেন, ‘জ্ঞান হচ্ছে মুমিনের জন্মগত অধিকার, যেখানেই এটা দেখো গ্রহণ করো।’ নবী করিম (সা.)-এর কাছে ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ রমজান লাইলাতুল কদরের রাতে নাজিলকৃত ওহির সর্বপ্রথম বাণীতেই অধ্যয়ন করার নির্দেশসহ মানব সৃষ্টিতত্ত্ব ও কলমের উল্লেখ রয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে জমাট রক্ত হতে সৃষ্টি করেছেন। পড়ো, আর তোমার প্রভু মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।’ (সূরা আল-আলাক, আয়াত: ১-৫) আল্লাহর বাণী আল-কোরআন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অফুরন্ত ভাণ্ডার। জ্ঞানের যেকোনো শাখার সুস্পষ্ট নিদর্শন কোরআন মজিদ থেকে লাভ করা সম্ভব। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে, ‘শপথ বিজ্ঞানময় কোরআনের।’ (সূরা ইয়াসিন, আয়াত-২)
জ্ঞান অন্বেষণ ছাড়া আল্লাহর পরিচয় লাভ করা সম্ভব নয়। সঠিক গবেষণা ও গভীর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান বাস্তব অর্থে ইসলামের পরিচয় লাভেরই নামান্তর। কোরআন মজিদ মানুষকে পারিপার্শ্বিক ও নিজেদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার আহ্বান জানিয়েছে। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টিতে এবং দিবা-রাত্রির আবর্তনের মধ্যে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে; যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করে এবং বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করোনি। সব পবিত্রতা একমাত্র তোমারই। আমাদেরকে তুমি দোজখের শাস্তি হতে বাঁচাও।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯০-১৯১) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং সমুদ্রে বিচরণশীল নৌযানগুলোতে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর আল্লাহ আকাশ থেকে যে পানি নাজিল করেছেন, তৎদ্বারা মৃত ভূমিকে সজীব করে তুলেছেন এবং এতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সব রকম জীবজন্তু। আর আবহাওয়া পরিবর্তনে এবং মেঘমালায় যা তাঁরই নির্দেশের অধীনে মহাকাশ ও পৃথিবীর মাঝে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৬৪)
পবিত্র কোরআন কেবল ধর্মগ্রন্থই নয়, এতে একজন ব্যক্তির জীবনযাত্রা থেকে সামাজিক জীবনযাত্রা তথা মানবজাতির জন্য চিরকল্যাণের দিকনির্দেশনা রয়েছে। জ্ঞান সাধনা ও বিজ্ঞান চর্চার অসংখ্য নিদর্শন কোরআন মজিদে বিদ্যমান রয়েছে। যেমন—আলোকবর্ষের পরিমাপ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘ফেরেশতাগণ ও রূহ আল্লাহর দিকে ঊর্ধ্বগামী হয় এমন একদিকে, যার পরিমাণ পার্থিব পঞ্চাশ হাজার সমান।’ (সূরা আল-মা’আরিজ, আয়াত-৪) এ ছাড়া সমুদ্র ও পর্বতমালা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তিনিই কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন সমুদ্রকে, যাতে তা থেকে তোমরা তাজা মাছ খেতে পারো, তা থেকে বের করতে পারো পরিধেয় অলংকার। তুমি তাতে জলযানসমূহকে পানি চিরে চলতে দেখবে এবং যাতে তোমরা আল্লাহর কৃপা অন্বেষণ করো এবং যাতে তাঁর অনুগ্রহ স্বীকার করো। আর তিনি পৃথিবীর ওপর বোঝা রেখেছেন যে, কখনো যেন তা তোমাদের নিয়ে হেলে-দুলে না পড়ে এবং নদী ও পথ তৈরি করেছেন, যাতে তোমরা তোমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারো। আর তিনি নির্ণায়ক বহু চিহ্ন সৃষ্টি করেছেন এবং তারকা দ্বারাও মানুষ পথের নির্দেশ পায়।’ (সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১৪-১৬)
পবিত্র কোরআনে উদ্ভিদবিজ্ঞানের নানাবিধ নিদর্শনের সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। যেমন—ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি ভূপৃষ্ঠের দিকে দৃষ্টিপাত করে না? আমি এতে প্রত্যেক প্রকারের কত উদ্ভিদ উদ্গত করেছি। নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী নয়।’ (সূরা আশ-শুয়ারা, আয়াত: ৭-৮) মধু ও মৌমাছি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আপনার পালনকর্তা মৌমাছিকে তাঁর অন্তরের ইঙ্গিত দ্বারা নির্দেশ দিলেন—পাহাড়ে, বৃক্ষে ও উঁচু চালে গৃহ তৈরি করো, এরপর সর্বপ্রকার ফল থেকে ভক্ষণ করো এবং আপন পালনকর্তার উন্মুক্ত পথসমূহ অনুসরণ করো। ফলে তার পেট থেকে বিভিন্ন বর্ণের পানীয় নির্গত হয়। এতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা আন-নাহ্ল, আয়াত: ৬৮-৬৯) পানি থেকেই যে পৃথিবীতে প্রথম জীবনের উদ্ভব ঘটেছে, এ সম্পর্কে কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবিশ্বাসীরা কি ভাবে না যে, মহাকাশ ও পৃথিবীর মুখ বন্ধ ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে খুলে দিলাম এবং প্রাণবন্ত সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। এর পরও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না?’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত-৩০)
আল কোরআনে জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে এ ধরনের অসংখ্য আয়াত রয়েছে, যা শিক্ষা ও গবেষণা করে মুসলিম বিজ্ঞানীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন দিক উন্মোচন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সৃষ্টিতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র, পদার্থ, রসায়ন, খনিজবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, বিদ্যুৎ, আলো, তাপ, অঙ্কশাস্ত্র, মহাশূন্যে গবেষণাসহ বিজ্ঞানের সব উন্নতি মুসলমানদের আল কোরআনের শিক্ষা ও গবেষণার ফসল। যুগে যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞান যতই চরম উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করবে, বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামের সভ্যতা ও বাস্তবতা ততই সমুজ্জ্বল হয়ে মানুষের কাছে প্রতিভাত হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
আল্লাহ তাআলা মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধির বদৌলতেই সব সৃষ্টিজীবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন। ফেরেশতাদের অসম্মতি সত্ত্বেও তিনি হজরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি করে তাঁকে সবকিছুর নাম শিক্ষা দেন। এসব বিষয়বস্তুর জ্ঞান ও বিদ্যালাভের মাধ্যমেই হজরত আদম (আ.) ফেরেশতাদের থেকে বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন তথা সম্মানের শীর্ষ পর্যায়ে উন্নীত হন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর স্মরণ কর যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, “আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি পাঠাতে যাচ্ছি”।’ ফেরেশতারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কিছু পাঠাবেন, যারা অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার প্রশংসা, মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করছি।’ তিনি বললেন, ‘আমি যা জানি তোমরা তা জানো না।’ আর তিনি আদমকে যাবতীয় বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়ে সেগুলো ফেরেশতাদের সামনে প্রকাশ করলেন এবং বললেন, এগুলোর নাম আমাকে বলো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৩০-৩১) অতঃপর ফেরেশতারা হজরত আদম (আ.)-এর জ্ঞান-বুদ্ধি ও শিক্ষার কাছে পরাজিত হয় এবং আল্লাহর নির্দেশে তাঁকে সম্মানসূচক সিজদা করে।
মহানবী (সা.) জ্ঞানলোক ও সভ্যতার যে বিরাট অট্টালিকার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন, তা তাঁর সমকাল থেকেই সারা পৃথিবীকে অলংকৃত করে আসছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘জ্ঞানার্জন করা প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরজ।’ (ইবনে মাজা ও বায়হাকি) তিনি আরও বলেছেন, ‘জ্ঞান হচ্ছে মুমিনের জন্মগত অধিকার, যেখানেই এটা দেখো গ্রহণ করো।’ নবী করিম (সা.)-এর কাছে ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ রমজান লাইলাতুল কদরের রাতে নাজিলকৃত ওহির সর্বপ্রথম বাণীতেই অধ্যয়ন করার নির্দেশসহ মানব সৃষ্টিতত্ত্ব ও কলমের উল্লেখ রয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে জমাট রক্ত হতে সৃষ্টি করেছেন। পড়ো, আর তোমার প্রভু মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।’ (সূরা আল-আলাক, আয়াত: ১-৫) আল্লাহর বাণী আল-কোরআন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অফুরন্ত ভাণ্ডার। জ্ঞানের যেকোনো শাখার সুস্পষ্ট নিদর্শন কোরআন মজিদ থেকে লাভ করা সম্ভব। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে, ‘শপথ বিজ্ঞানময় কোরআনের।’ (সূরা ইয়াসিন, আয়াত-২)
জ্ঞান অন্বেষণ ছাড়া আল্লাহর পরিচয় লাভ করা সম্ভব নয়। সঠিক গবেষণা ও গভীর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান বাস্তব অর্থে ইসলামের পরিচয় লাভেরই নামান্তর। কোরআন মজিদ মানুষকে পারিপার্শ্বিক ও নিজেদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার আহ্বান জানিয়েছে। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টিতে এবং দিবা-রাত্রির আবর্তনের মধ্যে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে; যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করে এবং বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করোনি। সব পবিত্রতা একমাত্র তোমারই। আমাদেরকে তুমি দোজখের শাস্তি হতে বাঁচাও।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯০-১৯১) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং সমুদ্রে বিচরণশীল নৌযানগুলোতে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর আল্লাহ আকাশ থেকে যে পানি নাজিল করেছেন, তৎদ্বারা মৃত ভূমিকে সজীব করে তুলেছেন এবং এতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সব রকম জীবজন্তু। আর আবহাওয়া পরিবর্তনে এবং মেঘমালায় যা তাঁরই নির্দেশের অধীনে মহাকাশ ও পৃথিবীর মাঝে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৬৪)
পবিত্র কোরআন কেবল ধর্মগ্রন্থই নয়, এতে একজন ব্যক্তির জীবনযাত্রা থেকে সামাজিক জীবনযাত্রা তথা মানবজাতির জন্য চিরকল্যাণের দিকনির্দেশনা রয়েছে। জ্ঞান সাধনা ও বিজ্ঞান চর্চার অসংখ্য নিদর্শন কোরআন মজিদে বিদ্যমান রয়েছে। যেমন—আলোকবর্ষের পরিমাপ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘ফেরেশতাগণ ও রূহ আল্লাহর দিকে ঊর্ধ্বগামী হয় এমন একদিকে, যার পরিমাণ পার্থিব পঞ্চাশ হাজার সমান।’ (সূরা আল-মা’আরিজ, আয়াত-৪) এ ছাড়া সমুদ্র ও পর্বতমালা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তিনিই কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন সমুদ্রকে, যাতে তা থেকে তোমরা তাজা মাছ খেতে পারো, তা থেকে বের করতে পারো পরিধেয় অলংকার। তুমি তাতে জলযানসমূহকে পানি চিরে চলতে দেখবে এবং যাতে তোমরা আল্লাহর কৃপা অন্বেষণ করো এবং যাতে তাঁর অনুগ্রহ স্বীকার করো। আর তিনি পৃথিবীর ওপর বোঝা রেখেছেন যে, কখনো যেন তা তোমাদের নিয়ে হেলে-দুলে না পড়ে এবং নদী ও পথ তৈরি করেছেন, যাতে তোমরা তোমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারো। আর তিনি নির্ণায়ক বহু চিহ্ন সৃষ্টি করেছেন এবং তারকা দ্বারাও মানুষ পথের নির্দেশ পায়।’ (সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১৪-১৬)
পবিত্র কোরআনে উদ্ভিদবিজ্ঞানের নানাবিধ নিদর্শনের সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। যেমন—ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি ভূপৃষ্ঠের দিকে দৃষ্টিপাত করে না? আমি এতে প্রত্যেক প্রকারের কত উদ্ভিদ উদ্গত করেছি। নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী নয়।’ (সূরা আশ-শুয়ারা, আয়াত: ৭-৮) মধু ও মৌমাছি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আপনার পালনকর্তা মৌমাছিকে তাঁর অন্তরের ইঙ্গিত দ্বারা নির্দেশ দিলেন—পাহাড়ে, বৃক্ষে ও উঁচু চালে গৃহ তৈরি করো, এরপর সর্বপ্রকার ফল থেকে ভক্ষণ করো এবং আপন পালনকর্তার উন্মুক্ত পথসমূহ অনুসরণ করো। ফলে তার পেট থেকে বিভিন্ন বর্ণের পানীয় নির্গত হয়। এতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা আন-নাহ্ল, আয়াত: ৬৮-৬৯) পানি থেকেই যে পৃথিবীতে প্রথম জীবনের উদ্ভব ঘটেছে, এ সম্পর্কে কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবিশ্বাসীরা কি ভাবে না যে, মহাকাশ ও পৃথিবীর মুখ বন্ধ ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে খুলে দিলাম এবং প্রাণবন্ত সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। এর পরও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না?’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত-৩০)
আল কোরআনে জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে এ ধরনের অসংখ্য আয়াত রয়েছে, যা শিক্ষা ও গবেষণা করে মুসলিম বিজ্ঞানীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন দিক উন্মোচন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সৃষ্টিতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র, পদার্থ, রসায়ন, খনিজবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, বিদ্যুৎ, আলো, তাপ, অঙ্কশাস্ত্র, মহাশূন্যে গবেষণাসহ বিজ্ঞানের সব উন্নতি মুসলমানদের আল কোরআনের শিক্ষা ও গবেষণার ফসল। যুগে যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞান যতই চরম উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করবে, বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামের সভ্যতা ও বাস্তবতা ততই সমুজ্জ্বল হয়ে মানুষের কাছে প্রতিভাত হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
No comments