টেম্পোরাল লোব by নাসিমা আনিস
আকাশে
আলো ফুটতে শুরু করেছে তখন। আমায় আনা হলো একটা আমড়া গাছের নিচে, কিংবা
বাতাবি লেবু গাছের নিচে। কিংবা এমন হতে পারে এখন এই সব গাছেদের কোনো নাম
আমার জানা নেই বলে মনগড়া একটা নাম দিয়ে আপনাদের সাথে বলে চলেছি। দেখুন নাম
দেয়া হয় সনাক্ত করার সুবিধায়। যেমন এখন আমায় ওরা একটা নাম দিয়েছে। এই নাম
ধরেই তারা আমাকে নিয়ে কত কি করছে! কী বিদঘুটে নাম সে আমি উচ্চারণ করতে পারি
না। যদি নাম দিত পারিজাত, দোয়েল কিংবা বুলবুলি। তো আমি খুশি হতাম, পরিচয়
নতুন হলেও তার একটা সুঘ্রাণ কোনো ভাবে আমার নাকে এসে লাগত। এমনকি আমি নিজের
সাকিন পরিচয়ও দিয়ে দিতে পারতাম ওদের। কিন্তু ওরা আমার কাছে কোনো পরিচয়
জানতে চায় না। নিদেনপক্ষে নামটা জানতে চাইতে পারত! আচ্ছা ঠিক আছে, ওরা ধরেই
নিয়েছে এর সাথে কথা বলে লাভ নেই, কিংবা কথা বলার বস্তুই তো সে নয়!
তো এটা ভোর! মানে আমার কাছে জীবনদায়িনী এক মাহেন্দ্রক্ষণ। এই ক্ষণে এক অর্থে নিশ্চয় তাই-ই। আমি জেগে উঠেছি বৈকি! গাছের নিচের বাতাসটায় কেমন যেন ঘ্রাণ! না, আমার পরিচয় নেই এর সাথে। এর ধারে কাছে কোনো ঘ্রাণের সাথেও আমার পরিচয় নেই। ঝাঁঝালো আর তিতকুটে কিছুর ঘ্রাণ এমন হলে হতে পারে। বাল্যে নানাপদের গাছের সাথে আমার সর্ম্পক ছিল গভীর। গভীর মানে ততটা যতটা অন্যের সাথে নেই গাছেদের। এমনকি ধানের বীজতলা থেকে খড় পর্যন্ত আমার বন্ধন! বিচুলি হয়ে যবে গরুর জাবনায় যায়, তখন আমি নিরুপায়! লতা-পাতা, বীরুত-বৃক্ষ সব কিছুর নাম আমার মুখস্ত। আমার বিশ্বাস ছিল আমি খুব গাছপ্রেমিক, মানে প্রেমিকা। আমার কাছ থেকে কখনো কেউ আমায় আলাদা করতে পারবে না যেমন তেমন গাছেদের কাছ থেকেও না। কখনো না। একটা পাতার কাঁপনও আমাকে নাড়িয়ে দিত, যেন ব্যথার দান; ঝিরঝির করে স্নায়ুগুলোকে কয়েকশ কোটিবার আলোড়ন দিয়ে মিইয়ে দেয় যেন! কিন্তু এখন কি দেখছি, এই যে গাছটার নিচে আমি, সে কি গাছ তা জানি না, জানার কথা নয়! কেন নয়! আমি তো সব গাছই চিনতাম। প্রায় সব। দু’একটা ছাড়া। কেননা আমি সারা জীবন শুধু গাছের পিছনে দাঁড়িয়ে থেকেছি। পিছন মানে সামনে পিছন যে কোনো দিকে! নাম না জানতে পারি, কিন্তু তাকে চিনি। সে কখন ফুল দিবে কখন লাল টুকটুকা হবে, ফলগুলো খেতে দলে দলে পাখি এসে কলরব করবে, সব জানতাম। এমন কি বহু ফল আমি মুখে দিয়ে চুষে চুষে দেখেছি, কোনোটা টক, কোনোটা নোনতা কোনোটা আবার তিতকুটে। কড়ই গাছের ফল খেয়ে দেখেছি মিষ্টি মিষ্টি একটা স্বাদ। জারুল, সেই বেগুনি ফুলের গোল্লা গোল্লা ফল খেয়ে দেখেছি, ভিতরে কেমন ভাঁজ ভাঁজ, টকো স্বাদ, মন্দ নয়!
তাহলে এখন কী বলবেন, এই আপনার কি আর কোনো কাজকাম ছিল না! কি সব গাছের গোটা খেয়ে বেড়িয়েছেন! ছিল তো, করেছিও। কিন্তু সে সবে বড্ড ফাঁকি ছিল। কেননা, কেউ যেমন আমায় বুঝত না, আমারও এক ধরনের না বোঝার আয়েশ ছিল। তবে, যেটুকু বুঝেছি সেটুকুতে ফাঁকফাঁকি ছিল না। আমার হাজারটা পশ্চাৎপদতার মধ্যে যে জিনিসটা বড় হয়ে দেখা দিল শেষ পর্যন্ত, সেটা আর কিছু না, টাকা। স্রেফ টাকার অভাবে আমার শেষ জীবনটা যখন দুর্বিসহ হয়ে উঠল যে এক ঝড়ের রাতে, টর্নেডোকে সহায় করে বেরিয়ে পড়লাম, আমি দেখাতে চাইলাম, এটা আমার দোষ নয়, সব দোষ ঐ ঝড়ের, সেই আমায় উড়িয়ে নিয়ে গেল। যখন আমি উড়ছি, একটা হা হা হাওয়ার চাদর আমায় নিয়ে চলেছে, চলেছে অসীম আকাশ পানে। আমি একবার শুধু নিচের দিকে তাকিয়েছি। একটা নিস্তরঙ্গ সমুদ্র, যার পানির রঙ প্রুশিয়ান ব্লু। আমি বোধ হয় একবার নিজের ছায়া দেখতে পেলাম সেই নীলে। আমি কিছুই মনে করতে পারছি না তখন। রান্নাঘরের ভাতের হাড়িটা ঘরে তোলা হয়েছে কিনা, গোয়ালের দরোজাটা খুলে দড়ি খুলে দেয়া হয়েছে কিনা গরুগুলোর, কিচ্ছু মনে থাকল না। কিন্তু আকাশ সমান ভালো লাগায় ভরে গেল ভূবন। কোনো প্রাত্যহিকতার আবিল তাতে মাখাতে চাইলাম না। কিছু পাতা আমার গায়ে ঝড়ে পড়ল, কিছু শীলাখণ্ড হুড়মুড় করে গায়ে পড়ল। আর একটা বৃহৎ কিছুর সঙ্গে সজোরে বাড়ি খেলাম। সেটা কি পাহাড় নাকি সে রকম বৃহত বৃক্ষ নাকি কোনো গ্রহের সাথে বাড়ি খেলাম জানি না। আমি সেখানে গিয়ে থামলাম, দমলাম এবং আমি বুঝলাম এবার আমার ভবলীলা সাঙ্গ হলো। ক্রমে ক্রমে এখন জেনে গেছি যার উপর পড়েছি তা এখন পাললিক শিলা, লক্ষকোটি বছর তার আশ্রয়ে কাটিয়ে দিলাম নানা বর্ণের আকাশ দেখে দেখে। কত রঙের আকাশ! এমন কি গাঢ় তীব্র বেগুনি! কিংবা ঘন কাঁচা হলুদ! রঙ পাল্টালো, ঘ্রাণ পাল্টালো, আলোও পাল্টালো। শুধু পাল্টালো না আমার এক টুকরো হৃদয়ের জমিন। পাললিক মায়ের বুক।
আবিষ্কারে মেতে যারা উঠল, প্রথমেই তারা ধরে নিল এই মহান জীবাস্মটা কোনো শক্তিমান মানুষের, কারণ এমন মহান কাজে শক্তিহীন এই পর্যন্ত আসতেই পারে না। আর কোটি বছর আগে যে পুরুষ নারী বিভাজন, সেখানে নারী অন্তঃপুরবাসিনী, জীবাশ্মের মত মহান কাজে নারীকে ভাবা যায়ই না!
সেই টুকরো জমিন, পাললিক যখন ব্যবচ্ছেদ করতে লাগল, দেখল পরতে পরতে খোলা যায় তাকে। সেটা হৃদপিণ্ড নাকি মস্তিষ্ক! নিশ্চয়ই মস্তিষ্ক, আমি এই কথা জেনেছিলাম, হৃদয় বলে কিছু নেই, মস্তিষ্কই সব। সেই সব চালায়।
আজ পর্যন্ত কোনো ফসিলে তারা জীবন্ত অবশিষ্ট কিছু পায়নি সেখানে এই মস্তিষ্ক জুড়ে রয়েছে আমসত্ত্ব, কি জারুলের ফল, হা হা হা, এই উপমা ছাড়া আর কি উপমা, পেঁয়াজের খোসা! মানে পরতের পর পরত।
টেম্পোরাল লোব উন্মোচন হল, ওরা অবাক বিস্ময়ে আমার মাথার হাড়ের ভিতর তাকিয়ে আছে। অবিশ্বাস্য, অসম্ভব এই জাতীয় কিছু প্রতিক্রিয়া দিয়ে দিয়ে ওরা হয়রান হয়ে গেল, পরস্পরকে আলিঙ্গন করতে ভুলে গেল, কিংবা কি জানি ওদের পৃথিবীতে বোধ হয় আলিঙ্গন টালিঙ্গন নেই! আমি দেখছি মানুষ আসলে মানতেই চায় না তার সীমাবদ্ধতা। এই মানতে না চাওয়াই তার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা। পাললিক শীলায় লেপটে থাকা আমার মাথার কি একটা অংশ হাতে নিয়ে তারা পাগল হয়ে আছে। আমি বলতে চাইছি হে আমার কোটি প্রজন্মের উত্তরসূরী, কেন এত অবাক হচ্ছ। তোমাদের এই গ্রহে কি কোনো অজানা নেই! সব জেনে বসে আছ! ওরা আমার কথা শুনতে পায়, কিন্তু বুঝতে পারে সামান্যই। আমার টেম্পোরাল লোব খুঁজে পেয়েছ, মানে কি আমার সব জেনে বসে আছ! আমার ব্যক্তিগত বলে কিছু রাখনি! তবে কি এই সভ্যতা সে রকম, যেখানে নারী বা পুরুষ নেই, সবাই দুই জননের অধিকারী! কারো কোনো দৈহিক বাহাদুরি নেই, শক্তি দেখানোর ব্যাপার নেই!
কিন্তু তোমরা আমার সব যে জেনে গেলে, কি হবে আমার! আমি আসলে ইচ্ছে করেই সংসার থেকে পালিয়েছিলাম, সেটা জেনে এত হাসছ কেন! কত পরাধীন ছিলাম সংসারের সদস্যদের কাছে, সমাজের কাছে। বলেকয়ে পালানোর কোনো পথ ছিল না। আর পালিয়ে তো কোথাও যাবার জায়গা ছিল না। মেয়েদের নিজের বলে কিছু থাকতে নেই, সে যুগ যে! তো একটা উছিলা খুঁজছিলাম, বিধাতা দিলেন। আমার বিধাতা শব্দটা তারা বুঝতে সময় নিচ্ছিল, আলোচনা করছিল। আমি আকাশের কথা বললাম সেখানে কেউ একজন নিয়ন্ত্রণ করছেন। এবার তারা বুঝল। এভাবে অবশ্য অনেক কিছুই বোঝাতে হয়েছে। বেশিরভাগ কথা তো ওখানে ধরা ছিল, আমারগুলো। ও পাশের কথাগুলো আমার নিউরণে ততটা পরিষ্কার গাথা নেই।—খাবার নিয়ে কী হয়েছিল? কিংবা আরো আরো প্রশ্ন, আমি শুনতে পাই কিন্তু দেখতে পাই সামান্য। শুনছি যে বলছি, আসলে সেটা আমার আন্দাজ, যে আমি খাবার নিয়ে একটা প্রশ্ন পাব ওদের কাছ থেকে। নয় কেন! এটা তো জানা কথা। খাওয়ার খোটা, পরার খোটা, উপার্জন করতে না পারার খোটা, বাবা-মায়ের প্রচুর টাকা পয়সা না থাকার খোটা, সবই তো শুনতে হয়েছে। কিন্তু সত্য, আমি কিচ্ছু হজম করিনি। না হজম হওয়ার যে কী উপকারিতা, এই তো প্রথম পেলুম! কে আর আমার মত কোটি কোটি বছর পর এমন এক ভীন মানুষের মুখোমুখি হয়ে সওয়াল-জবাব করেছে, নির্ভয়ে!
একটা প্রশ্নই হয়ত করে, কী খাওয়া হতো। আমি বলি ভাত, আমরা ভেতো বাঙালি। আমার কথা ওরা বুঝতে পারে, বুঝে অয় অয় বলে। মানে ঠিক আছে বা ঠিক বুঝতে পেরেছি। আমি যা শুনতে পাই তার কিছুই বুঝতে পারি না। কিন্তু কোনো কারণে ওদের বিস্ময়ের কারণগুলোর একটু সুরাহা করতে মন চাইল। আমি কোন কালের তারা কোন কালের এ এক বিশাল ধাঁধাঁ। আমি কোনো কারণ ছাড়াই বলতে চাইলাম, আমার কিছু আগে রবীন্দ্রনাথ, লালন ছিলেন, আমার শেখ মুজিবের যুগ। শুনে ওরা আবার আ আ আ করতে লাগল, মানে ওরা এই নামগুলো জানে। আমি বললাম আমরা ভাত খেতাম, তাই ভাতের খোটা দিত। আমরা কাপড় পরতাম তাই কাপড়ের খোটা দিত। আমাদের বেঁচে থাকতে টাকার দরকার হত, তাই টাকার খোটা দিত। আমরা এসবে খুব কষ্ট পেতাম, হৃদয় থেকে অভিশাপ আসত, কিন্তু ওদের কিছুই হত না। আমাদের অভিশাপে ওরা আরো শক্তিশালী হত। ওরা জোর করে আমাদের সন্তান ধারনে বাধ্য করত, সন্তান থাকলে শক্ত হয় বাঁধন যে। সন্তানহীনের কোনো মূল্য নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের সব কথা শুনতে হত।
ওরা মনে হয় এতক্ষণে সবই বুঝে ফেলেছে। আর আ আ আ করে যাচ্ছে।
ওরা আমায় জাদুঘরে নিয়ে যাবে, সেখানে আজ পর্যন্ত কোনো জ্যান্ত টেম্পোরাল লোব রাখতে পারেনি। আমিই প্রথম। আমি বলি আপনারা এই আবিষ্কারের জন্য কি নোবেল প্রাইজ পাবেন? শুনে ওরা খিক খিক করে হাসে, হাসিতে একধরনের কৃত্রিমতা ছেয়ে থাকে। আমার মনে হয় ওরা নোবেলের নাম জানলেও জানতে পারে কিন্তু সে বড় হাস্যকর একটা বস্তু বলে জানে।
আমায় যখন মাটির নিচের কোনো একটা ল্যাবে নিয়ে যাচ্ছে তখন মনে হল একটা কথা বলা জরুরি, মানে বলে রাখা ভালো। বললাম আমি কিন্তু নারী, আমার স্মৃতিশক্তি তাই পুরুষদের তুলনায় অনেক তীক্ষ্ণ।
তারা এবার একটা জোরে হাসি দিল, সেই খিক খিক নয়, কিছুটা সুন্দর। বলে, তাই তো তোমার সবকিছু অটুট, ঘ্রাণ, শ্রবণ, কথাবলা, দেখা, দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি, সব। আর তুমি সত্যি পৃথিবীর সুন্দরতম মানুষ।
আহ্ টেম্পোরাল লোব সজাগ ছিল ভাগ্যিস, তাইতো এই অনুমোদন পেলুম!
তো এটা ভোর! মানে আমার কাছে জীবনদায়িনী এক মাহেন্দ্রক্ষণ। এই ক্ষণে এক অর্থে নিশ্চয় তাই-ই। আমি জেগে উঠেছি বৈকি! গাছের নিচের বাতাসটায় কেমন যেন ঘ্রাণ! না, আমার পরিচয় নেই এর সাথে। এর ধারে কাছে কোনো ঘ্রাণের সাথেও আমার পরিচয় নেই। ঝাঁঝালো আর তিতকুটে কিছুর ঘ্রাণ এমন হলে হতে পারে। বাল্যে নানাপদের গাছের সাথে আমার সর্ম্পক ছিল গভীর। গভীর মানে ততটা যতটা অন্যের সাথে নেই গাছেদের। এমনকি ধানের বীজতলা থেকে খড় পর্যন্ত আমার বন্ধন! বিচুলি হয়ে যবে গরুর জাবনায় যায়, তখন আমি নিরুপায়! লতা-পাতা, বীরুত-বৃক্ষ সব কিছুর নাম আমার মুখস্ত। আমার বিশ্বাস ছিল আমি খুব গাছপ্রেমিক, মানে প্রেমিকা। আমার কাছ থেকে কখনো কেউ আমায় আলাদা করতে পারবে না যেমন তেমন গাছেদের কাছ থেকেও না। কখনো না। একটা পাতার কাঁপনও আমাকে নাড়িয়ে দিত, যেন ব্যথার দান; ঝিরঝির করে স্নায়ুগুলোকে কয়েকশ কোটিবার আলোড়ন দিয়ে মিইয়ে দেয় যেন! কিন্তু এখন কি দেখছি, এই যে গাছটার নিচে আমি, সে কি গাছ তা জানি না, জানার কথা নয়! কেন নয়! আমি তো সব গাছই চিনতাম। প্রায় সব। দু’একটা ছাড়া। কেননা আমি সারা জীবন শুধু গাছের পিছনে দাঁড়িয়ে থেকেছি। পিছন মানে সামনে পিছন যে কোনো দিকে! নাম না জানতে পারি, কিন্তু তাকে চিনি। সে কখন ফুল দিবে কখন লাল টুকটুকা হবে, ফলগুলো খেতে দলে দলে পাখি এসে কলরব করবে, সব জানতাম। এমন কি বহু ফল আমি মুখে দিয়ে চুষে চুষে দেখেছি, কোনোটা টক, কোনোটা নোনতা কোনোটা আবার তিতকুটে। কড়ই গাছের ফল খেয়ে দেখেছি মিষ্টি মিষ্টি একটা স্বাদ। জারুল, সেই বেগুনি ফুলের গোল্লা গোল্লা ফল খেয়ে দেখেছি, ভিতরে কেমন ভাঁজ ভাঁজ, টকো স্বাদ, মন্দ নয়!
তাহলে এখন কী বলবেন, এই আপনার কি আর কোনো কাজকাম ছিল না! কি সব গাছের গোটা খেয়ে বেড়িয়েছেন! ছিল তো, করেছিও। কিন্তু সে সবে বড্ড ফাঁকি ছিল। কেননা, কেউ যেমন আমায় বুঝত না, আমারও এক ধরনের না বোঝার আয়েশ ছিল। তবে, যেটুকু বুঝেছি সেটুকুতে ফাঁকফাঁকি ছিল না। আমার হাজারটা পশ্চাৎপদতার মধ্যে যে জিনিসটা বড় হয়ে দেখা দিল শেষ পর্যন্ত, সেটা আর কিছু না, টাকা। স্রেফ টাকার অভাবে আমার শেষ জীবনটা যখন দুর্বিসহ হয়ে উঠল যে এক ঝড়ের রাতে, টর্নেডোকে সহায় করে বেরিয়ে পড়লাম, আমি দেখাতে চাইলাম, এটা আমার দোষ নয়, সব দোষ ঐ ঝড়ের, সেই আমায় উড়িয়ে নিয়ে গেল। যখন আমি উড়ছি, একটা হা হা হাওয়ার চাদর আমায় নিয়ে চলেছে, চলেছে অসীম আকাশ পানে। আমি একবার শুধু নিচের দিকে তাকিয়েছি। একটা নিস্তরঙ্গ সমুদ্র, যার পানির রঙ প্রুশিয়ান ব্লু। আমি বোধ হয় একবার নিজের ছায়া দেখতে পেলাম সেই নীলে। আমি কিছুই মনে করতে পারছি না তখন। রান্নাঘরের ভাতের হাড়িটা ঘরে তোলা হয়েছে কিনা, গোয়ালের দরোজাটা খুলে দড়ি খুলে দেয়া হয়েছে কিনা গরুগুলোর, কিচ্ছু মনে থাকল না। কিন্তু আকাশ সমান ভালো লাগায় ভরে গেল ভূবন। কোনো প্রাত্যহিকতার আবিল তাতে মাখাতে চাইলাম না। কিছু পাতা আমার গায়ে ঝড়ে পড়ল, কিছু শীলাখণ্ড হুড়মুড় করে গায়ে পড়ল। আর একটা বৃহৎ কিছুর সঙ্গে সজোরে বাড়ি খেলাম। সেটা কি পাহাড় নাকি সে রকম বৃহত বৃক্ষ নাকি কোনো গ্রহের সাথে বাড়ি খেলাম জানি না। আমি সেখানে গিয়ে থামলাম, দমলাম এবং আমি বুঝলাম এবার আমার ভবলীলা সাঙ্গ হলো। ক্রমে ক্রমে এখন জেনে গেছি যার উপর পড়েছি তা এখন পাললিক শিলা, লক্ষকোটি বছর তার আশ্রয়ে কাটিয়ে দিলাম নানা বর্ণের আকাশ দেখে দেখে। কত রঙের আকাশ! এমন কি গাঢ় তীব্র বেগুনি! কিংবা ঘন কাঁচা হলুদ! রঙ পাল্টালো, ঘ্রাণ পাল্টালো, আলোও পাল্টালো। শুধু পাল্টালো না আমার এক টুকরো হৃদয়ের জমিন। পাললিক মায়ের বুক।
আবিষ্কারে মেতে যারা উঠল, প্রথমেই তারা ধরে নিল এই মহান জীবাস্মটা কোনো শক্তিমান মানুষের, কারণ এমন মহান কাজে শক্তিহীন এই পর্যন্ত আসতেই পারে না। আর কোটি বছর আগে যে পুরুষ নারী বিভাজন, সেখানে নারী অন্তঃপুরবাসিনী, জীবাশ্মের মত মহান কাজে নারীকে ভাবা যায়ই না!
সেই টুকরো জমিন, পাললিক যখন ব্যবচ্ছেদ করতে লাগল, দেখল পরতে পরতে খোলা যায় তাকে। সেটা হৃদপিণ্ড নাকি মস্তিষ্ক! নিশ্চয়ই মস্তিষ্ক, আমি এই কথা জেনেছিলাম, হৃদয় বলে কিছু নেই, মস্তিষ্কই সব। সেই সব চালায়।
আজ পর্যন্ত কোনো ফসিলে তারা জীবন্ত অবশিষ্ট কিছু পায়নি সেখানে এই মস্তিষ্ক জুড়ে রয়েছে আমসত্ত্ব, কি জারুলের ফল, হা হা হা, এই উপমা ছাড়া আর কি উপমা, পেঁয়াজের খোসা! মানে পরতের পর পরত।
টেম্পোরাল লোব উন্মোচন হল, ওরা অবাক বিস্ময়ে আমার মাথার হাড়ের ভিতর তাকিয়ে আছে। অবিশ্বাস্য, অসম্ভব এই জাতীয় কিছু প্রতিক্রিয়া দিয়ে দিয়ে ওরা হয়রান হয়ে গেল, পরস্পরকে আলিঙ্গন করতে ভুলে গেল, কিংবা কি জানি ওদের পৃথিবীতে বোধ হয় আলিঙ্গন টালিঙ্গন নেই! আমি দেখছি মানুষ আসলে মানতেই চায় না তার সীমাবদ্ধতা। এই মানতে না চাওয়াই তার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা। পাললিক শীলায় লেপটে থাকা আমার মাথার কি একটা অংশ হাতে নিয়ে তারা পাগল হয়ে আছে। আমি বলতে চাইছি হে আমার কোটি প্রজন্মের উত্তরসূরী, কেন এত অবাক হচ্ছ। তোমাদের এই গ্রহে কি কোনো অজানা নেই! সব জেনে বসে আছ! ওরা আমার কথা শুনতে পায়, কিন্তু বুঝতে পারে সামান্যই। আমার টেম্পোরাল লোব খুঁজে পেয়েছ, মানে কি আমার সব জেনে বসে আছ! আমার ব্যক্তিগত বলে কিছু রাখনি! তবে কি এই সভ্যতা সে রকম, যেখানে নারী বা পুরুষ নেই, সবাই দুই জননের অধিকারী! কারো কোনো দৈহিক বাহাদুরি নেই, শক্তি দেখানোর ব্যাপার নেই!
কিন্তু তোমরা আমার সব যে জেনে গেলে, কি হবে আমার! আমি আসলে ইচ্ছে করেই সংসার থেকে পালিয়েছিলাম, সেটা জেনে এত হাসছ কেন! কত পরাধীন ছিলাম সংসারের সদস্যদের কাছে, সমাজের কাছে। বলেকয়ে পালানোর কোনো পথ ছিল না। আর পালিয়ে তো কোথাও যাবার জায়গা ছিল না। মেয়েদের নিজের বলে কিছু থাকতে নেই, সে যুগ যে! তো একটা উছিলা খুঁজছিলাম, বিধাতা দিলেন। আমার বিধাতা শব্দটা তারা বুঝতে সময় নিচ্ছিল, আলোচনা করছিল। আমি আকাশের কথা বললাম সেখানে কেউ একজন নিয়ন্ত্রণ করছেন। এবার তারা বুঝল। এভাবে অবশ্য অনেক কিছুই বোঝাতে হয়েছে। বেশিরভাগ কথা তো ওখানে ধরা ছিল, আমারগুলো। ও পাশের কথাগুলো আমার নিউরণে ততটা পরিষ্কার গাথা নেই।—খাবার নিয়ে কী হয়েছিল? কিংবা আরো আরো প্রশ্ন, আমি শুনতে পাই কিন্তু দেখতে পাই সামান্য। শুনছি যে বলছি, আসলে সেটা আমার আন্দাজ, যে আমি খাবার নিয়ে একটা প্রশ্ন পাব ওদের কাছ থেকে। নয় কেন! এটা তো জানা কথা। খাওয়ার খোটা, পরার খোটা, উপার্জন করতে না পারার খোটা, বাবা-মায়ের প্রচুর টাকা পয়সা না থাকার খোটা, সবই তো শুনতে হয়েছে। কিন্তু সত্য, আমি কিচ্ছু হজম করিনি। না হজম হওয়ার যে কী উপকারিতা, এই তো প্রথম পেলুম! কে আর আমার মত কোটি কোটি বছর পর এমন এক ভীন মানুষের মুখোমুখি হয়ে সওয়াল-জবাব করেছে, নির্ভয়ে!
একটা প্রশ্নই হয়ত করে, কী খাওয়া হতো। আমি বলি ভাত, আমরা ভেতো বাঙালি। আমার কথা ওরা বুঝতে পারে, বুঝে অয় অয় বলে। মানে ঠিক আছে বা ঠিক বুঝতে পেরেছি। আমি যা শুনতে পাই তার কিছুই বুঝতে পারি না। কিন্তু কোনো কারণে ওদের বিস্ময়ের কারণগুলোর একটু সুরাহা করতে মন চাইল। আমি কোন কালের তারা কোন কালের এ এক বিশাল ধাঁধাঁ। আমি কোনো কারণ ছাড়াই বলতে চাইলাম, আমার কিছু আগে রবীন্দ্রনাথ, লালন ছিলেন, আমার শেখ মুজিবের যুগ। শুনে ওরা আবার আ আ আ করতে লাগল, মানে ওরা এই নামগুলো জানে। আমি বললাম আমরা ভাত খেতাম, তাই ভাতের খোটা দিত। আমরা কাপড় পরতাম তাই কাপড়ের খোটা দিত। আমাদের বেঁচে থাকতে টাকার দরকার হত, তাই টাকার খোটা দিত। আমরা এসবে খুব কষ্ট পেতাম, হৃদয় থেকে অভিশাপ আসত, কিন্তু ওদের কিছুই হত না। আমাদের অভিশাপে ওরা আরো শক্তিশালী হত। ওরা জোর করে আমাদের সন্তান ধারনে বাধ্য করত, সন্তান থাকলে শক্ত হয় বাঁধন যে। সন্তানহীনের কোনো মূল্য নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের সব কথা শুনতে হত।
ওরা মনে হয় এতক্ষণে সবই বুঝে ফেলেছে। আর আ আ আ করে যাচ্ছে।
ওরা আমায় জাদুঘরে নিয়ে যাবে, সেখানে আজ পর্যন্ত কোনো জ্যান্ত টেম্পোরাল লোব রাখতে পারেনি। আমিই প্রথম। আমি বলি আপনারা এই আবিষ্কারের জন্য কি নোবেল প্রাইজ পাবেন? শুনে ওরা খিক খিক করে হাসে, হাসিতে একধরনের কৃত্রিমতা ছেয়ে থাকে। আমার মনে হয় ওরা নোবেলের নাম জানলেও জানতে পারে কিন্তু সে বড় হাস্যকর একটা বস্তু বলে জানে।
আমায় যখন মাটির নিচের কোনো একটা ল্যাবে নিয়ে যাচ্ছে তখন মনে হল একটা কথা বলা জরুরি, মানে বলে রাখা ভালো। বললাম আমি কিন্তু নারী, আমার স্মৃতিশক্তি তাই পুরুষদের তুলনায় অনেক তীক্ষ্ণ।
তারা এবার একটা জোরে হাসি দিল, সেই খিক খিক নয়, কিছুটা সুন্দর। বলে, তাই তো তোমার সবকিছু অটুট, ঘ্রাণ, শ্রবণ, কথাবলা, দেখা, দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি, সব। আর তুমি সত্যি পৃথিবীর সুন্দরতম মানুষ।
আহ্ টেম্পোরাল লোব সজাগ ছিল ভাগ্যিস, তাইতো এই অনুমোদন পেলুম!
No comments