দুই কারণে শপথ নেননি মির্জা ফখরুল: আসন শূন্য ঘোষণা
দুই
কারণে শপথ নেননি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। প্রথমত, দলের
মহাসচিব হিসেবে সংসদের বাইরে থেকে দায়িত্ব পালন ও দলের শীর্ষ নেতৃত্বের
সঙ্গে তৃণমূল নেতৃত্বের যোগসূত্র রক্ষার দায়িত্ব পালনকে অধিকতর
গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত ও শারীরিক অসুবিধার কারণে এক
সঙ্গে দুই দায়িত্ব পালনকে কঠিন মনে করছেন তিনি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান
এই ব্যাপারে প্রথমে একমত না হলেও তাকে বুঝিয়ে বলে রাজি করিয়েছেন মির্জা
ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল দৈনিক মানবজমিনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জোর দিয়ে
বলেছিলেন, তার এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হওয়ার কোন সুযোগ নেই। নিজে সংসদে না
যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও দলের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক এবং রাজনীতিতে এটাকে চমক ও
ইউটার্ন হিসেবে দেখছেন বিএনপি মহাসচিব। এদিকে তিনি যে আসন থেকে নির্বাচিত
হয়েছিলেন সন্ধ্যায় সেই বগুড়া-৬ আসন শূন্য ঘোষণা করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার
ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী। এখন সংসদে বিএনপি দলীয় এমপিদের নেতৃত্ব দেবেন দলের
যুগ্ম মহাসচিব চাপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচিত হারুনুর রশীদ।
সেই সঙ্গে প্রত্যাহার করা হবে ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের জাহিদুর রহমানের বহিষ্কারাদেশ।
সংসদে না যাওয়ার ব্যাপারে নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা করে দৈনিক মানবজমিনকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমার সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে দুইটি প্রধান কারণ আছে। একটি হচ্ছে, আমি মনে করছি যে- এই সময়ে সংসদের বাইরে থাকাটাই আমার জন্য বেশি প্রয়োজনীয়। বিশেষ করে আমার দলের যে উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ও তৃণমূল নেতৃবৃন্দের মধ্যে একটি যোগসূত্র রক্ষা করা এবং আমাদের নেতৃত্বের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করার দায়িত্বটা আমাকেই এখন পালন করতে হচ্ছে। এটা একটা প্রধান কারণ। আরেকটি হচ্ছে, আমার ব্যক্তিগত কিছু অসুবিধা আছে।
আমার শারীরিক অবস্থা, সবকিছু মিলিয়ে আমি সবসময় সময় দিতে পারব না। অনেক সময় দুটো দায়িত্ব পালন করা আমার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তো এই কারণেই আমি আপাতত সিদ্ধান্ত নিয়েছি সংসদে যাবো না। আর এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তার নিজের দিক থেকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সুযোগ না থাকলেও দলের সিদ্ধান্তে তার পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, আমার লিডার যিনি এখন আছেন চেয়ারপারসনের দায়িত্বে, তারেক রহমান, উনাকে জানিয়েই তো আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি তো এককভাবে সিদ্ধান্ত নিইনি। প্রথমে উনি রাজী হতে চাননি, পরে আমি তাকে বুঝিয়ে বলার পরে তিনি একমত হয়েছেন। বিএনপির সংসদে অংশগ্রহণ ও তার বিরত থাকার বিষয়টি রাজনীতিতে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন জানতে চাইলে মির্জা আলমগীর বলেন, দলের জন্য আমার মনে হয় যে প্রয়োজন ছিল এমন সিদ্ধান্তের। এর মধ্যদিয়ে অনেক রকমের ভুল বোঝাবুঝি দূর হবে। ভ্রান্ত ধারণা দূর হবে। আমি এমন একটি অবস্থায় থাকতে পারবো, যেখানে আমি দলকে আরও ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করতে পারবো।
সংসদে যাওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত দিলেও নিজে যাচ্ছেন না- এটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন জানতে চাইলে মির্জা আলমগীর বলেন, এটা তো বৃহত্তর স্বার্থে, দলীয় সিদ্ধান্তে। আমরা তো সংসদেই যাচ্ছি কৌশলগত কারণে। কৌশলগত কারণেই আমি বাইরে থাকছি। রাজনীতিতে বিএনপির কৌশল কি হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির মহাসচিব বলেন, রাজনীতিতে বিরোধী দলের রাজনীতি করার তেমন স্পেস নেই। সংসদে যেটুকু স্পেস আছে, সেটুকুকে আমরা কাজে লাগাতে চাই। একটা কথা সত্য যে, সংসদে যে চারজন বা পাঁচজন যখনই যাচ্ছেন, এতে করে তাদের একটি অফিসিয়াল অবস্থান তৈরি হয়। যাতে সবজায়গায় তারা কথা বলতে পারে এবং তাদের কথার একটি মূল্য থাকে।
দেশে যেমন, বাইরেও তেমন। এক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা তো আমাদের রাজনীতিতে প্রয়োজন। বিএনপির সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্তে দলে কেমন প্রভাব ফেলবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এখনও কথা বলিনি। এটা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে, তবে শেষ পর্যন্ত আশা করি এটা নিয়ে আপত্তি কারো থাকবে না। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তো সংসদে গেছি সংসদকে বৈধতা দেয়ার জন্য নয়। একথা আমরা পরিষ্কার করে বলেছি। যে নির্বাচনই হয়নি কোনো। ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছি, বৈধতাও দেইনি, সম্পূর্ণ কৌশলগত কারণে, গণতন্ত্রের ন্যূনতম স্পেস ব্যবহার করতে সেখানে গেছি। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সঙ্কটময় আখ্যায়িত করে মির্জা আলমগীর বলেন, এই মুহুর্তের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অত্যন্ত সংকটময়। আমার মনে হয় যে, এতটা খারাপ বোধহয় আর কখনো ছিল না। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ন্যূনতম পরিবেশ সেটাও এখানে নেই। বিরোধীদল হিসেবে যারা কাজ করছি তাদের প্রচণ্ড একটা চাপের মধ্যে আমাদের কাজ করতে হয়। প্রতিমুহূতের্হ গ্রেপ্তার, মামলা, কোর্টে যাওয়া- আমাদের নরম্যাল লাইফ বলতে তো এখন আর কিছু নেই। বিএনপি মহাসচিব বলেন, রাজনীতিতে শূন্য একটি অবস্থা তৈরি হয়ে গেছে। সেখানে আমাদের তিন চারজন মিলে পার্লামেন্টে গিয়ে কথাগুলো বলছে, সেগুলো কাজে দেবে বলে আমাদের মনে হয়। অন্তত সেটুকু আসতে হবে। রাজনীতিতে সেটা আসবে। আমার কাছে মনে হয় যে, এটা একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ হয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল দুইটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, দলের চেয়ারপারসনের সম্মতির ভিত্তিতে রাজনীতিতে ইউটার্ন করে সংসদে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত করেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
নতুন সিদ্ধান্তের পর স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচিত হিসেবে পাঁচজনকে শপথ নিতে বলেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানালেও শপথ না নেয়ার ব্যাপারে নিজের মনোভাবের কথাটি জানিয়ে দেন তিনি। শপথ নেয়ার ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অব্যাহত চাপের মধ্যেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন মির্জা আলমগীর। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় দলীয় সিদ্ধান্তে অন্যরা শপথ নেবেন এবং দলীয় কৌশলেই তিনি শপথগ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন। দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপে তিনি জানিয়েছেন, শপথ গ্রহণের ব্যাপারে সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় সিদ্ধান্তটি যখন প্রকাশ করা হয় তখন তিনি কৌশলগত কারণেই তার শপথ না নেয়ার বিষয়টি প্রকাশ করেননি। কারণ এতে গণমাধ্যমের ফোকাসটি সরে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি দলীয় ৬ জন বিজয়ীর একজন হলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপি শপথ নেয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে সংসদে দলীয় এমপিদের নেতৃত্ব দেয়ার কথা তার। কিন্তু তিনি শপথ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় চাপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি হারুনুর রশীদ সংসদে দলীয় এমপিদের নেতৃত্ব দেবেন।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দীর্ঘদিনের দাবি থেকে গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থে সরে এসে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। নানামুখী ছাড় দিয়ে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে তুলেছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলের বৃহত্তর প্ল্যাটফর্ম জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সঙ্গে সংলাপেও যোগ দিয়েছিল। কিন্তু দলের চেয়ারপারসনসহ কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তিসহ মেলেনি কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনী পরিবেশ। উল্টো ভোটের আগের রাতে প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে রাখাসহ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সেই সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয়েছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের টিকিটে বিজয়ী ৮ জন শপথ নেবেন না। কিন্তু গণফোরাম মনোনীত দুই বিজয়ী প্রার্থী শপথ নেয়। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এদিকে বিএনপির নির্বাচিতদের ওপর এলাকাবাসী এবং সরকারের তরফে চাপ বাড়তে থাকে দিনদিন। এক পর্যায়ে তারা বিষয়টি শীর্ষ নেতৃত্বের নজরে আনেন এবং নিজেরা কয়েকদফায় বৈঠক করেন। তখন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে তাদের ডেকে সতর্ক করা হয়।
চাপের মুখে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রথমে শপথ নেন ঠাকুরগাঁও-৩ থেকে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান। এই পর্যায়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে বহিষ্কারও করা হয়। কিন্তু তারপর ব্যাপক চাপের মুখে পড়েন অন্যরা। বিএনপি দলীয় এমপিদের বিশেষ কোথাও অবস্থান করিয়ে শপথ গ্রহণ করানো হবে এমন গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক মহলে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দুই এমপিকে ডাকা হয়। তারা বৈঠকে নিজেদের মনোভাব, চাপ, সংসদে গিয়ে কিভাবে ভূমিকা রাখা যায় সে ব্যাপারে যুক্তিসহ সার্বিক বিষয়গুলো শীর্ষ নেতৃত্বের সামনে তুলে ধরেন। এতদিন দলের স্থায়ী কমিটি শপথ গ্রহণ না করার ব্যাপারে অনঢ় থাকলেও সে বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর। তারই প্রেক্ষিতে তিনি দলের নানা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট নাগরিক, শুভাকাঙ্ক্ষিদের সঙ্গে আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন।
তারই প্রেক্ষিতে সোমবার বিকালে দলের চারজন এমপি শপথ নেন এবং সন্ধ্যার পর দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখানে তিনি বলেন- ‘ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং দেশনেত্রীর মুক্তির দাবিতে সংসদে কথা বলার সীমিত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংসদ ও রাজপথের সংগ্রামকে যুগপৎভাবে চালিয়ে যাওয়াকে আমরা যুক্তিযুক্ত মনে করছি। জাতীয় রাজনীতির এই সংকটময় জটিল প্রেক্ষিতে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা, মুক্তি এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের অংশ হিসেবে আমদের দল সংসদে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ দলের চার এমপির শপথ গ্রহণের পর এ নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মী এবং রাজনৈতিক মহলে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দলের অনেক নেতাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিএনপির জোটসঙ্গী এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম ও বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিজেদের অসন্তোষের কথা প্রকাশ করেন।
সেই সঙ্গে প্রত্যাহার করা হবে ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের জাহিদুর রহমানের বহিষ্কারাদেশ।
সংসদে না যাওয়ার ব্যাপারে নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা করে দৈনিক মানবজমিনকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমার সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে দুইটি প্রধান কারণ আছে। একটি হচ্ছে, আমি মনে করছি যে- এই সময়ে সংসদের বাইরে থাকাটাই আমার জন্য বেশি প্রয়োজনীয়। বিশেষ করে আমার দলের যে উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ও তৃণমূল নেতৃবৃন্দের মধ্যে একটি যোগসূত্র রক্ষা করা এবং আমাদের নেতৃত্বের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করার দায়িত্বটা আমাকেই এখন পালন করতে হচ্ছে। এটা একটা প্রধান কারণ। আরেকটি হচ্ছে, আমার ব্যক্তিগত কিছু অসুবিধা আছে।
আমার শারীরিক অবস্থা, সবকিছু মিলিয়ে আমি সবসময় সময় দিতে পারব না। অনেক সময় দুটো দায়িত্ব পালন করা আমার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তো এই কারণেই আমি আপাতত সিদ্ধান্ত নিয়েছি সংসদে যাবো না। আর এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তার নিজের দিক থেকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সুযোগ না থাকলেও দলের সিদ্ধান্তে তার পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, আমার লিডার যিনি এখন আছেন চেয়ারপারসনের দায়িত্বে, তারেক রহমান, উনাকে জানিয়েই তো আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি তো এককভাবে সিদ্ধান্ত নিইনি। প্রথমে উনি রাজী হতে চাননি, পরে আমি তাকে বুঝিয়ে বলার পরে তিনি একমত হয়েছেন। বিএনপির সংসদে অংশগ্রহণ ও তার বিরত থাকার বিষয়টি রাজনীতিতে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন জানতে চাইলে মির্জা আলমগীর বলেন, দলের জন্য আমার মনে হয় যে প্রয়োজন ছিল এমন সিদ্ধান্তের। এর মধ্যদিয়ে অনেক রকমের ভুল বোঝাবুঝি দূর হবে। ভ্রান্ত ধারণা দূর হবে। আমি এমন একটি অবস্থায় থাকতে পারবো, যেখানে আমি দলকে আরও ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করতে পারবো।
সংসদে যাওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত দিলেও নিজে যাচ্ছেন না- এটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন জানতে চাইলে মির্জা আলমগীর বলেন, এটা তো বৃহত্তর স্বার্থে, দলীয় সিদ্ধান্তে। আমরা তো সংসদেই যাচ্ছি কৌশলগত কারণে। কৌশলগত কারণেই আমি বাইরে থাকছি। রাজনীতিতে বিএনপির কৌশল কি হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির মহাসচিব বলেন, রাজনীতিতে বিরোধী দলের রাজনীতি করার তেমন স্পেস নেই। সংসদে যেটুকু স্পেস আছে, সেটুকুকে আমরা কাজে লাগাতে চাই। একটা কথা সত্য যে, সংসদে যে চারজন বা পাঁচজন যখনই যাচ্ছেন, এতে করে তাদের একটি অফিসিয়াল অবস্থান তৈরি হয়। যাতে সবজায়গায় তারা কথা বলতে পারে এবং তাদের কথার একটি মূল্য থাকে।
দেশে যেমন, বাইরেও তেমন। এক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা তো আমাদের রাজনীতিতে প্রয়োজন। বিএনপির সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্তে দলে কেমন প্রভাব ফেলবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এখনও কথা বলিনি। এটা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে, তবে শেষ পর্যন্ত আশা করি এটা নিয়ে আপত্তি কারো থাকবে না। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তো সংসদে গেছি সংসদকে বৈধতা দেয়ার জন্য নয়। একথা আমরা পরিষ্কার করে বলেছি। যে নির্বাচনই হয়নি কোনো। ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছি, বৈধতাও দেইনি, সম্পূর্ণ কৌশলগত কারণে, গণতন্ত্রের ন্যূনতম স্পেস ব্যবহার করতে সেখানে গেছি। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সঙ্কটময় আখ্যায়িত করে মির্জা আলমগীর বলেন, এই মুহুর্তের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অত্যন্ত সংকটময়। আমার মনে হয় যে, এতটা খারাপ বোধহয় আর কখনো ছিল না। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ন্যূনতম পরিবেশ সেটাও এখানে নেই। বিরোধীদল হিসেবে যারা কাজ করছি তাদের প্রচণ্ড একটা চাপের মধ্যে আমাদের কাজ করতে হয়। প্রতিমুহূতের্হ গ্রেপ্তার, মামলা, কোর্টে যাওয়া- আমাদের নরম্যাল লাইফ বলতে তো এখন আর কিছু নেই। বিএনপি মহাসচিব বলেন, রাজনীতিতে শূন্য একটি অবস্থা তৈরি হয়ে গেছে। সেখানে আমাদের তিন চারজন মিলে পার্লামেন্টে গিয়ে কথাগুলো বলছে, সেগুলো কাজে দেবে বলে আমাদের মনে হয়। অন্তত সেটুকু আসতে হবে। রাজনীতিতে সেটা আসবে। আমার কাছে মনে হয় যে, এটা একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ হয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল দুইটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, দলের চেয়ারপারসনের সম্মতির ভিত্তিতে রাজনীতিতে ইউটার্ন করে সংসদে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত করেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
নতুন সিদ্ধান্তের পর স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচিত হিসেবে পাঁচজনকে শপথ নিতে বলেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানালেও শপথ না নেয়ার ব্যাপারে নিজের মনোভাবের কথাটি জানিয়ে দেন তিনি। শপথ নেয়ার ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অব্যাহত চাপের মধ্যেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন মির্জা আলমগীর। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় দলীয় সিদ্ধান্তে অন্যরা শপথ নেবেন এবং দলীয় কৌশলেই তিনি শপথগ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন। দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপে তিনি জানিয়েছেন, শপথ গ্রহণের ব্যাপারে সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় সিদ্ধান্তটি যখন প্রকাশ করা হয় তখন তিনি কৌশলগত কারণেই তার শপথ না নেয়ার বিষয়টি প্রকাশ করেননি। কারণ এতে গণমাধ্যমের ফোকাসটি সরে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি দলীয় ৬ জন বিজয়ীর একজন হলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপি শপথ নেয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে সংসদে দলীয় এমপিদের নেতৃত্ব দেয়ার কথা তার। কিন্তু তিনি শপথ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় চাপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি হারুনুর রশীদ সংসদে দলীয় এমপিদের নেতৃত্ব দেবেন।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দীর্ঘদিনের দাবি থেকে গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থে সরে এসে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। নানামুখী ছাড় দিয়ে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে তুলেছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলের বৃহত্তর প্ল্যাটফর্ম জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সঙ্গে সংলাপেও যোগ দিয়েছিল। কিন্তু দলের চেয়ারপারসনসহ কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তিসহ মেলেনি কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনী পরিবেশ। উল্টো ভোটের আগের রাতে প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে রাখাসহ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সেই সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয়েছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের টিকিটে বিজয়ী ৮ জন শপথ নেবেন না। কিন্তু গণফোরাম মনোনীত দুই বিজয়ী প্রার্থী শপথ নেয়। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এদিকে বিএনপির নির্বাচিতদের ওপর এলাকাবাসী এবং সরকারের তরফে চাপ বাড়তে থাকে দিনদিন। এক পর্যায়ে তারা বিষয়টি শীর্ষ নেতৃত্বের নজরে আনেন এবং নিজেরা কয়েকদফায় বৈঠক করেন। তখন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে তাদের ডেকে সতর্ক করা হয়।
চাপের মুখে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রথমে শপথ নেন ঠাকুরগাঁও-৩ থেকে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান। এই পর্যায়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে বহিষ্কারও করা হয়। কিন্তু তারপর ব্যাপক চাপের মুখে পড়েন অন্যরা। বিএনপি দলীয় এমপিদের বিশেষ কোথাও অবস্থান করিয়ে শপথ গ্রহণ করানো হবে এমন গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক মহলে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দুই এমপিকে ডাকা হয়। তারা বৈঠকে নিজেদের মনোভাব, চাপ, সংসদে গিয়ে কিভাবে ভূমিকা রাখা যায় সে ব্যাপারে যুক্তিসহ সার্বিক বিষয়গুলো শীর্ষ নেতৃত্বের সামনে তুলে ধরেন। এতদিন দলের স্থায়ী কমিটি শপথ গ্রহণ না করার ব্যাপারে অনঢ় থাকলেও সে বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর। তারই প্রেক্ষিতে তিনি দলের নানা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট নাগরিক, শুভাকাঙ্ক্ষিদের সঙ্গে আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন।
তারই প্রেক্ষিতে সোমবার বিকালে দলের চারজন এমপি শপথ নেন এবং সন্ধ্যার পর দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখানে তিনি বলেন- ‘ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং দেশনেত্রীর মুক্তির দাবিতে সংসদে কথা বলার সীমিত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংসদ ও রাজপথের সংগ্রামকে যুগপৎভাবে চালিয়ে যাওয়াকে আমরা যুক্তিযুক্ত মনে করছি। জাতীয় রাজনীতির এই সংকটময় জটিল প্রেক্ষিতে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা, মুক্তি এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের অংশ হিসেবে আমদের দল সংসদে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ দলের চার এমপির শপথ গ্রহণের পর এ নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মী এবং রাজনৈতিক মহলে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দলের অনেক নেতাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিএনপির জোটসঙ্গী এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম ও বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিজেদের অসন্তোষের কথা প্রকাশ করেন।
No comments