ভূ-রাজনীতি এবং বাংলাদেশের নির্বাচন by মুবাশ্বের হাসান ও আরিল্ড এঙ্গেলসেন রুড

সাধারণভাবেই নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা একমত যে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এই নির্বাচনে প্রতি ছয়টির মধ্যে পাঁচটিরও বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছে ক্ষমতাসীন দল। অন্যদিকে, নির্বাচনী প্রচারণা বা নির্বাচন চলাকালীনও বিরোধীদের কোথাও দেখা যায় নি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল মারাত্মক অনিয়ম দেখতে পেয়েছে। তারা তদন্তে দেখতে পেয়েছে ৫০টি আসনের মধ্যে ৪৭টিতে এমন অনিয়ম হয়েছে। নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ, মাস আগে এসব অনিয়মের বেশির ভাগ ঘটানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদেরকে ফৌজদারি অভিযোগে গ্রেপ্তার। এ ছাড়া ঋণখেলাপির অভিযোগে মনোনয়নপত্র গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানানো।
এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে আইনের ভেতরে থেকেই। কিন্তু সুস্পষ্টভাবে এই আইন প্রয়োগ করা হয়েছে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ভিত্তিতে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের ফল নিয়ে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। বিস্ময়ের বিষয় হলো, ২০০৬ সালের নির্বাচনী আইন ‘ম্যানিপুলেশনের’ সময়ে যেসব ঘটনা ঘটেছিল এবার তা একইরকম ছিল না। ওই সময় এতে জড়িত ছিল অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি শক্তিগুলো। তাদের সমর্থনের ফলে বাস্তবে একটি অভ্যুত্থান ঘটে (যা তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে পরিচিত)। ওই সময়ের সঙ্গে বর্তমান প্রতিক্রিয়া বিপরীতমুখী। ২০০৬ সালের অভিজ্ঞতাকে মনে রেখে আমরা প্রশ্ন রেখেছিলামÑ কেন ২০১৮ সালের বিতর্কিত ও ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনকে পশ্চিমা অনেক উদার গণতান্ত্রিক দেশসহ বাংলাদেশের মূল বিদেশি অংশীদাররা মেনে নিলেন।
আমাদের বিশ্লেষণ যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে তা হলো, যখন ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার গতিধারা দ্রুত পূর্বমুখী রূপ নিয়েছে এই নির্বাচন হয়েছে ঠিক সেই সময়ে। গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু ভোটের জন্য বিদেশিদের যে চাপ তা খর্ব হয়েছে এ জন্য যে, অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো বহিঃদেশীয় মিত্রদের কাছ থেকে নিজেদের মুক্ত হিসেবে দেখেছে। যখন জনপ্রিয় একনায়ক ভারত ও ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিক ও একনায়ক চীন ক্ষমতার মূল ব্রোকার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তখন গণতান্ত্রিক পশ্চিমারা তাদের প্রভাবকে দুর্বল করেছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অবস্থা থেকে দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা। তাই বৈদেশিক মূল অংশীদারদের কাছে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের চেয়ে স্থিতিশীলতা এই মুহূর্তে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ যদি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে তাহলে তার বহুবিধ প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়বে এ অঞ্চলে।
নির্বাচন
২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এতে ভূমিধস বিজয় পায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে বিজয় পায়। এই মহাজোট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে গঠন করা হয়েছে। নির্বাচনে এমন বিজয়ের মধ্য দিয়ে তিনি টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসেছেন। অন্যদিকে, প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের ঘোরবিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি জোট ছোট আরো কিছু রাজনৈতিক দল সঙ্গে নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচন করেছে। উপরন্তু আরো ছিল কিছু ধর্মভিত্তিক ও বামপন্থি দল।
তারা সবাই নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচন দাবি করেছে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। তাদের অভিযোগ, নির্বাচনের ফল কারচুপিতে রাষ্ট্রীয় এজেন্সিগুলোকে ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগ। ঐক্যফ্রন্ট ও এর শরিক দলগুলো জাতীয় সংসদে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যদিও একজন অথবা দুজন নির্বাচিত এমপি এই সিদ্ধান্ত অমান্য করতে পারেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাচনে বহুবিধ অনিয়ম তুলে ধরেছে। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতমূলক আচরণ। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের সহায়তায় রাতভর ব্যালটে বাক্স ভর্তি করা। ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন ও রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষকে জেলে আটকে রাখা।
সরকার এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে যথার্থভাবেই নিজেকে নিরাপদ করেছে। এমনকি একজন মন্ত্রী টিআইবিকে বিএনপি সংশ্লিষ্ট একটি থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে অভিহিত করেছেন। বাস্তবে, একটি নতুন নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আর বিরোধীরা টলটলায়মান। দুর্নীতির অভিযোগে কারাবন্দি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গত ১২ বছর লন্ডনে নির্বাসনে রয়েছেন তার ছেলে ও রাজনৈতিক উত্তরসূরি। তাকে একটি হাই-প্রোফাইল রাজনৈতিক হত্যাকা-ে সম্প্রতি যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনার আরেক শত্রু, জামায়াতে ইসলামী প্রায় বিলুপ্ত। এ দলটির বেশকিছু শীর্ষনেতাকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে হয়তো ফাঁসি দেয়া হয়েছে না হয় যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে। অন্যরা পালিয়ে গেছেন। পশ্চিমা দেশগুলোতে নির্বাসনে বসবাস করছেন। কয়েক শত নেতাকর্মীকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। আবার অনেককে ‘এনকাউন্টারে’ হত্যা করা হয়েছে। তাই কার্যত কোনো সক্রিয় বিরোধী দল না থাকায় সরকার আরেকটি পূর্ণ মেয়াদ নিরেটভাবে ক্ষমতায় থাকবে। কারণ, ঐক্যফ্রন্ট নেতারা জাতীয় সংসদ বর্জন করছেন। শেখ হাসিনা তার সাবেক মিত্র জাতীয় পার্টিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বিদেশি প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের মূল বিদেশি অংশীদারদের নির্বাচন নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় ভিন্নতা রয়েছে। কিন্তু কেউই সিরিয়াসলি প্রতিবাদ জানায় নি (নির্বাচন নিয়ে)। এটা ২০০৬ সালের পুরো বিপরীত ঘটনা। ওই সময় ক্ষমতায় অব্যাহতভাবে থাকা নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন বিএনপি উন্মুক্তভাবে নির্বাচনী আইনকে ‘ম্যানিপুলেট’ করেছিল। ওই সময় আওয়ামী লীগ ও অন্যদের রাজপথের উত্তাল প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রতিরোধে তারা পুলিশ ও নিজস্ব নেতাকর্মীদের ব্যবহার করেছিল। ওই সময় ‘ম্যানিপুলেশন’ ও সহিংসতার ফলে পশ্চিমা শক্তিগুলো, বাংলাদেশে জাতিসংঘ এবং ভারতীয় কর্মকর্তারা তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন এটা সবার জানা। এ জন্যই তারা বাংলাদেশের বাহিনীগুলোকে পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেছিলেন এবং একটি বেসামরিক অভ্যুত্থানে সমর্থন দিয়েছিলেন। ওই  বেসামরিক অভ্যুত্থান হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার একটি আনুষ্ঠানিকতা। এই অনির্বাচিত বেসামরিক সরকার একটি বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্যাপকভাবে বিচার বিভাগ থেকে সমর্থন পেয়েছিল।
এ ছাড়া তাদেরকে সমর্থন করেছিল পশ্চিমা শক্তিগুলো, জাতিসংঘ ও ভারত। এ অবস্থার অবসান হয় দুই বছর পর তখনই যখন তারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে সম্মত হয়।
তারপর যে নির্বাচন আসে তাতে একটি সুস্পষ্ট বিজয় অর্জন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। তারপর তিনি জাতীয় সংসদে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তখনকার বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ধারা বাতিল করেন। এর ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করতে বিএনপি ও তার মিত্র জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে বাধ্য করে। তাদের নির্বাচন বর্জনের ফলে আওয়ামী লীগকে আরো বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করে। তাদের ১৫০ জন এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
আবার খুব কম পশ্চিমা দেশ ২০১৪ সালে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিল। বিরোধী দল দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা সরকারি সম্পদ ও বেসামরিক লোকজনের ওপর পেট্রোলবোমা হামলা চালিয়েছিল বাছবিচারহীনভাবে। ফলে কোনো বিদেশি সরকারই নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানায় নি। বিরোধীরা নতুন নির্বাচন ডাকলে তাতে সুবিধা পেতে পারতেন। কিন্তু তাতে রাজপথের সহিংসতা বেড়ে যেত। তাই যা যেমন ছিল তা তেমনই থাকতে দেয়া হয়। আস্তে আস্তে আওয়ামী লীগ সফলতার সঙ্গে নিজেকে দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদেরকে দৃঢ় সমর্থন রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা, বিচার বিভাগ ও একটি বাহিনীর পক্ষ থেকে।
এতে তারা এমন একটি শক্তি অর্জন করে যে, তারা ২০১৮ সালের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে। এর বিরোধিতা করার মতো কোনো রাষ্ট্রীয় শক্তি ছিল না। পক্ষান্তরে তাদের বেশির ভাগকেই নির্বাচনের ফল নিয়ে সন্তুষ্ট হতে দেখা গেছে। বিদেশি শক্তির মধ্যে চীন, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রগুলো থেকে দ্রুত শেখ হাসিনার বিজয়কে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমা শক্তিগুলো প্রতিক্রিয়া দেয়ার ক্ষেত্রে ছিল সতর্ক, কিন্তু শত্রুভাবাপন্ন নয়। তারা নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদিও চাপাকণ্ঠে বলা হয়েছে যে, নির্বাচনে অনিয়ম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করে দেখার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
ভূ-রাজনীতি
পশ্চিমা শক্তিগুলোর তরফ থেকে কড়া প্রতিবাদের যে অভাব তাতে খুব পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, বাংলাদেশ এখন দ্রুত বিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটে অবস্থান করছে। ভূ-রাজনৈতিক আন্তর্জাতিক দৃশ্যপটে বড় কোনো ‘প্লেয়ার’ নয় বাংলাদেশ। তাতে তার জনসংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন। এখানকার জনসংখ্যা দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় অর্ধেক। জায়ান্ট দেশগুলো, বাণিজ্যিক ব্লকগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। জাহাজ চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ রুটগুলো থেকে বিবেচ্য দূরত্বে এককোণায় অবস্থান করছে এই দেশটি। তা সত্ত্বেও এর কিছু গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে চীন ও অন্যান্য শক্তির ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে।
এখানে বাজার ও উৎপাদন প্রাণকেন্দ্রের প্রতিনিধিত্ব করে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি। বঙ্গোপসাগরে রয়েছে এর আকর্ষণীয় গ্যাস রিজার্ভ। কারখানা, সড়ক, বন্দর ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে এরই মধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করছে চীন। সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদারের দিক থেকে ভারতকে টপকে গেছে চীন। ২০১৮ সালে যখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ১০০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছে, তখন ২০২১ সাল শেষ হওয়ার আগে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য হবে ৩০০০ কোটি ডলারÑ এমনটা বলা হচ্ছে। চীনের স্বার্থকে অতিরিক্ত হিসেবে দেখা উচিত নয়। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বিশাল। কিন্তু তা হলো ঋণে নেয়া অর্থ। শ্রীলঙ্কান সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসে যেমনটা উপভোগ করেছেন তার থেকে কিছুটা আলাদা শেখ হাসিনার শাসন ও বেইজিংয়ের মধ্যকার সম্পর্ক। ভারতের প্রতি বাংলাদেশের নৈকট্য বাংলাদেশকে বেইজিংয়ের মনোযোগে আকৃষ্ট করেছে। যদিও শ্রীলঙ্কার মতো বেশি কৌশলগত অবস্থানে নেই সে।
ভারতের জন্য, বাংলাদেশ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার ‘ইস্টার্ন পলিসির’ জন্য বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে যাওয়ার করিডোর হলো বাংলাদেশের ঠিক উত্তরে ‘চিকেন নেক’ বলে পরিচিত করিডোর অথবা বাংলাদেশ ভূ-খ-ের ভেতর দিয়ে। বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্কের অধীনে ভারত বাংলাদেশের ভূ-ভাগে ট্রানজিট ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ট্রানজিট সুবিধা পেয়েছে। এটা ভারতের জন্য বড় পাওয়া। আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদের ইতি ঘটানো হলো আরো একটি বিষয়। ঢাকায় একটি শত্রুভাবাপন্ন শাসকগোষ্ঠী দিল্লি চাইবে না। আবার বর্তমানে চীনের প্রস্তাবগুলোর প্রতি ঢাকার সতর্ক অবস্থানও ভালোভাবে দেখা হচ্ছে।
একটি আকর্ষণীয় বিষয় হলো ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও যৌথ মহড়ায় সেনাবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমন্বিত মহড়ায় নৌবাহিনীর সহযোগিতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব উদ্যোগে একটি অভিন্ন লক্ষ্য সৃষ্টি হয়েছে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দৃষ্টি দুই দেশের সীমান্ত থেকে বিস্তৃত হয়েছে অধিক পরিমাণে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও পারস্পরিক সমর্থনের দিকে। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এসেছেন বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশ তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে। এতে সশস্ত্র বাহিনীকে দেশের জাতীয় সীমান্ত থেকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় দৃষ্টি কেড়েছে।
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে খর্ব করার জন্য বঙ্গোপসাগর ‘জিও স্ট্রাটেজিক’ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার অবস্থানগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। নির্বাচনের পরে খবরে বলা হয়েছে যে, শেখ হাসিনা সরকারের কাছে সম্প্রতি অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ তার সশস্ত্র বাহিনীর শতকরা ৮০ ভাগ অস্ত্র কিনে থাকে। চীনের এই প্রাধান্য বিস্তারকে অস্থিতিশীল করে দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এমন উদ্যোগ হয়ে থাকতে পারে। উপরন্তু সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ একটি মিত্র হলো বাংলাদেশ। এ ছাড়াও চীন যখন বাংলাদেশে সেতু, বন্দর ও বিভিন্ন কারখানায় বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করছে তখন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভঙ্গ করা কোনো টেকসই ও দূরদর্শী ভাবনা হতে পারে না। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে ভারতেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তা এতটাই যে, নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন উপদেষ্টাকে এ সম্পর্কে নয়াদিল্লির কাছে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে। তাকে বলতে হয়েছে যে, এ নিয়ে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। ঢাকার অবস্থান হলো, চীন হলো বাংলাদেশের শুধু উন্নয়ন অংশীদার। তবে, এর পাশাপাশি অস্ত্র ও চীনে তৈরি সাবমেরিন কিনেছে বাংলাদেশ। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ’-এ যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকার কাছে কৌশলটি পরিষ্কার। তারা চীনের প্রস্তাবের সঙ্গে ভারতীয় প্রভাবের ভারসাম্য করবে।
স্থিতিশীলতা
পশ্চিমা শক্তিধররা ব্যক্তিগতভাবে এবং জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকে তাদের গুরুত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা (পাইভোটাল রোল) রাখছে। এসব করে তারা গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নমূলক বাজেট ও বিপুল সংখ্যক বেসরকারি সংগঠনের জন্য অর্থায়নে ভূমিকা রাখছিল। এই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ভারত ও চীন এখন বড় ব্যবসায়ী অংশীদার। উন্নয়ন বিষয়ক তহবিল আসছে এশিয়ার আধিপত্য আছে এমন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক অথবা ভারত ও চীন থেকে ঋণ হিসেবে। প্রাচ্যে ভূ-রাজনৈতিক শক্তিগুলোর পটপরিবর্তন ঘটছে। এর মধ্যে আছে পরস্পরবিরোধী উন্নয়ন বিষয়ক ইস্যু। চীন ও ভারত শুধু অর্থনৈতিক জায়ান্টই নয়, দুটি দেশই কর্তৃত্বপরায়ণতার দিকে ঝুঁকেছে অথবা জনপ্রিয় কর্তৃত্বপরায়ণতার দিকে ধাবিত।
রাজনৈতিক এই প্রবণতা প্রতিবেশী দেশগুলোকে গণতান্ত্রিক হওয়া থেকে বেশি স্থিতিশীল হওয়ার উৎসাহ যোগাবে। পশ্চিমাদের প্রভাবের যে ভিত্তি তার আদর্শগত ভিত্তি দুর্বল হয়ে গেছে। পশ্চিমারা যে দুর্বল হয়ে গেছে তার পরিষ্কার ইঙ্গিত মেলে নির্বাচনের বিরুদ্ধে নামমাত্র প্রতিবাদ জানানোর মাধ্যমে, যেটা করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা সন্তুষ্ট নয়, তবে তারা যদি কড়া প্রতিবাদ জানায় তাহলে তার সঙ্গে তাল সামলানোর হাতিয়ার তাদের নেই। তাই আগে তারা যে শক্তি দিয়ে কথা বলতো, পশ্চিমাদের গণতন্ত্রের পক্ষে ধাক্কা দেয়ার সেই অবস্থা থেকে তারা এখন অনেক দূরে।
বাংলাদেশের নতুন যেসব বৈদেশিক অংশীদার আছেন সেখানে গণতন্ত্রকে প্রাধান্য দেয়া হয় না। অগ্রাধিকার দেয়া হয় স্থিতিশীলতাকে। বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক  রাজনীতিতে তার বহুবিধ প্রভাব পড়বে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। তখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭ কোটি। এখন জনসংখ্যা ১৬ কোটির উপরে। তাই বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে তাতে ভারতের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। যদি একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ উচ্চমাত্রায় ভারসাম্যহীন থাকে এবং যেসব রেকর্ডসংখ্যক বাংলাদেশি অবৈধভাবে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রবেশের চেষ্টা করছে, তাদের সেই সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে একটি স্থিতিশীল ও শক্তিশালী সরকার সহায়ক।
এরপর অবশ্যই আসে বিশ্বব্যাপী জিহাদিদের কথা। তাদের কেউ কেউ তাদের নিজস্ব সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশিদের প্রতি যুদ্ধ শুরুর আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদের প্রতি এমন আহ্বান জানানো হয়েছে যারা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সংগঠিত হচ্ছেন। আরো আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের এত বিপুল সংখ্যক উপস্থিতির কারণে বৈশ্বিক জিহাদে সদস্য সংগ্রহের একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা হয়ে উঠতে পারে তা। অন্ততপক্ষে রোহিঙ্গা বিদ্রোহকে শক্তিশালী করতে পারে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে সহানুভূতিশীলরাও রয়েছে।
বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার গুরুত্ব অনুধাবন করে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতার দর কষাকষি করেছে বেশি। বাইরের অংশীদারদের কাছে শেখ হাসিনা নিজেকে উপস্থাপন করেছেন তাদের সুরক্ষার জন্য উত্তম পছন্দ হিসেবে। একই সঙ্গে তিনি সফলতার সঙ্গে তাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন যে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশ অস্থিতিশীল হবে।
উপসংহার
তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কি? একটি সম্ভাব্য দৃশ্যপট এমন হতে পারে যে, নিজেদেরকে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত করতে এবং বিরোধীদের মুছে ফেলতে যতটা সময় লাগবে ততদিন ক্ষমতায় থাকবে আওয়ামী লীগ। মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক সমতার মতো বিষয় থাকবে চাপে, যদিও পশ্চিমারা ভিন্নমতাবলম্বী ও সমালোচকদের অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে যাবে। যা হোক, শেখ হাসিনার বয়স হচ্ছে। তার বয়স এখন ৭১ বছর। তার নিজের দলে তিনি এমন শক্তিধর নেত্রী, যার বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যখন সময় আসবে তখন তার স্থানে কে আসবেন তা পরিষ্কার নয়। দলটির ভেতরে চিড় ধরার ইতিহাস আছে। বিরোধী দল দুর্বল হয়ে যাওয়ায় দলের ভেতরে সংঘাতের ইঙ্গিত ক্রমশ দৃশ্যমান।
(অনলাইন ই-ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)

No comments

Powered by Blogger.