এলডিসি থেকে উত্তরণ
চলতি
বছরের মার্চে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়
বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করবে জাতিসংঘের ইকোনমিক ও
সোশ্যাল কাউন্সিল। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। উন্নয়নশীল দেশে
পরিণত হতে ২০২১ সালের মধ্যে যে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে তা বাংলাদেশ
ইতিমধ্যেই অর্জন করেছে। শর্তগুলো হল- ১. মাথাপিছু আয় ১২৪২ মার্কিন ডলার;
বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ১৬১০ মার্কিন ডলার। ২. দেশের ৬৬ শতাংশ মানুষের
জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়া; বাংলাদেশ এটি ৭০ শতাংশে উন্নীত করেছে। ৩.
অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর না হওয়ার মাত্রা ৩০ শতাংশের নিচে থাকা; বাংলাদেশে তা
২৬ শতাংশ। কাজেই বলা যায়, ১৯৭৫ সাল থেকে এলডিসির তালিকায় থাকা বাংলাদেশ এখন
উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।
শর্তগুলো নির্ধারিত সময়ের আগেই পূরণ করায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ঘোষণা তিন
বছর আগেই আসছে। এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সাক্ষ্য দেয়, সন্দেহ নেই।
তবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হওয়ার পর বাংলাদেশকে কিছু কঠিন
বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। এর বহুমাত্রিক প্রভাব মোকাবেলা করতে হবে
আমাদের। যেমন- বাংলাদেশকে বিশ্ববাণিজ্যে বড় ধরনের প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে
হবে। প্রশ্ন হল, এজন্য আমরা কতটা প্রস্তুত? বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নিয়ম
অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশগুলো বাণিজ্যক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে
কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে- যেমন, শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা,
জিএসপি সুবিধা ইত্যাদি।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত
হওয়ার পর এসব সুবিধা আর পাবে না। তখন এলডিসির দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশকে
রফতানির ক্ষেত্রে ৬.৭ শতাংশ বেশি শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরকে
ভিত্তি ধরে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের সাম্প্রতিক
এক জরিপে বলা হয়েছে, রফতানি আয় ৫.৫ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে
পারে। ফলে মোট রফতানি আয় হতে ১.৫ বিলিয়ন থেকে ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
(প্রায় ১৮ হাজার ৪০ কোটি টাকা) হারাতে হবে বাংলাদেশকে। এছাড়া বেসরকারি
সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় প্রবেশের পর অতিরিক্ত হারে শুল্ক দেয়ার
কারণে বাংলাদেশ রফতানি হারাতে পারে ২.৭ বিলিয়ন ডলার। স্বভাবতই এটি দেশের
অর্থনীতির জন্য একটি সতর্কবার্তা। এ আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে উদ্ভূত
পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। এ লক্ষ্যে
সক্ষমতা অর্জনের জন্য যা যা করা দরকার, তা করতে হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী
বলেছেন, রফতানি বাণিজ্যের ওপর একটা চাপ তৈরি হবে এটা সত্য, কিন্তু সেটা
মোকাবেলার সক্ষমতা উদ্যোক্তাদের হয়েছে। বাস্তবতা হল, দেশে বাণিজ্য ও
বিনিয়োগের পরিবেশ এখনও ব্যবসাবান্ধব নয়। উদ্যোক্তাদের পদে পদে
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও হয়রানি মোকাবেলা করতে হয়। গ্যাস-বিদ্যুৎ-অবকাঠামোগত
সমস্যা এখনও প্রকট। কাজেই ব্যবসায়ীরা চাইলেই রাতারাতি সক্ষমতা বাড়াতে
পারবেন না। সেক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে সবধরনের সমর্থন দিতে হবে।
বিষয়টিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কোনো গাফিলতি যেন
না হয়। মনে রাখা দরকার, বিশ্ব বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারলে
উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্য গলার কাঁটা হয়ে
দাঁড়াতে পারে।
No comments