দুশ্চিন্তার নাম তাসকিন
আবাহনী থেকে তাসকিন আহমেদের জন্য পরামর্শ, ‘মন খুলে বল কর। তোর চাকিং হয় না।’ খুবই স্বাভাবিক। ২০ লাখ টাকা দামের খেলোয়াড়। তাঁর কাছ থেকে ক্লাব তো সেরাটা নিতে চাইবেই! মিরপুরে মাঠের বাইরে থেকে যে একজন ক্লাব কর্মকর্তা পরশু ‘মার চাক, মার চাক’ বলে তাঁকে ‘উৎসাহ’ দিতে চাইলেন, তাসকিনও মনে হয় তাতে সাড়াই দিলেন, ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের চলমান সংস্কৃতিতে সেটা নিয়েও বলার কিছু নেই। এখানে নৈতিকতার চেয়ে ক্লাবের স্বার্থই বড়। কিন্তু তাসকিনের জন্য কোনটা বড়? ২০ লাখ টাকা, নাকি সামনে পড়ে থাকা অনন্ত ভবিষ্যৎ? হঠাৎ অ্যাকশন বদলে এক-দুইটা ‘ফাউ’ উইকেট তুলে নেওয়ার চেষ্টা, নাকি ত্রুটিপূর্ণ বোলিং অ্যাকশন শোধরানো? বাংলাদেশের ক্রিকেটে তাসকিনের মতো পেসার খুব বেশি আসেনি। চাইলেই তিনি পারেন ভবিষ্যৎটাকে সোনার হরফে লিখতে। কিন্তু ২১ বছর বয়সী তাসকিনকে কে বোঝাবে সেটা! জাতীয় দলের বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিকের প্রেসক্রিপশনে তাসকিনের অ্যাকশন শোধরানোর কাজ করছেন বিসিবির বোলিং কোচ মাহবুব আলী। এ নিয়ে তিন সেশন কাজ হয়েছে। তাতে নাকি উন্নতির লক্ষণও সুস্পষ্ট। কিন্তু ২২ এপ্রিল প্রিমিয়ার লিগ শুরু হওয়ার পর কাল পর্যন্ত আর কোনো কাজ হয়নি। শারীরিকভাবেই দুটি একসঙ্গে করা কঠিন হয়ে যায় তাসকিনের জন্য। লিগ চলাকালে সেটা কতটা ভালোভাবে হবে, তা নিয়েও তাই সংশয় আছে। তাসকিন অবশ্য কাল বললেন, ‘আমার তেমন সমস্যা হচ্ছে না। পুনর্বাসনের কাজ চলছে। পরশুই (কাল) আবার সেশন আছে।’ কিন্তু একই সঙ্গে বোলিং অ্যাকশন শোধরানো আর খেলা চালিয়ে যাওয়া কতটা যুক্তিসংগত? উদাহরণ চোখের সামনেই। তাসকিনের সঙ্গেই অবৈধ অ্যাকশনের দায়ে বোলিং নিষেধাজ্ঞায় পড়েছেন আরাফাত সানি। অ্যাকশন শোধরানোর কাজও দুজনে শুরু করেছেন একসঙ্গে। স্পিন কোচ রুয়ান কালপাগের অনুপস্থিতিতেও সানি সেটা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিয়মিত বোলিং ফুটেজ পাঠিয়ে কোচকে জানাচ্ছেন তাঁর সর্বশেষ অবস্থা। সবচেয়ে বড় কথা, ‘প্লেয়ার ড্রাফটে’ শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব তাঁকে দলে নিলেও এবারের লিগে এখন পর্যন্ত কোনো ম্যাচ খেলেননি সানি। ক্লাবের চাপ থাকা সত্ত্বেও অ্যাকশন পুরোপুরি ঠিক হওয়া পর্যন্ত খেলতে চাচ্ছেনও না। আরেক বাঁহাতি স্পিনার আবদুর রাজ্জাকের উদাহরণও টানা যায় এখানে। খেলা দূরের কথা, ২০০৯-এ বোলিং অ্যাকশন শোধরানোর সময় এতটাই নিভৃতে চলে গিয়েছিলেন যে, তাঁকে কেউ খুঁজেই পায়নি। কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের সঙ্গে বিকেএসপি আর খুলনায় হয়েছিল রাজ্জাকের পুনর্বাসন। তাসকিনের প্রতি এই অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের পরামর্শ, ‘ও যদি সত্যিই অ্যাকশন ঠিক করতে চায়, তাহলে তার আগে না খেলাই ভালো। কারণ, ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ওকে পুরোনো অ্যাকশনেই বল করতে হবে। তা ছাড়া এ রকম সময়ে মনের ওপর চাপ থাকে। বোলিং খারাপ হয়ে আত্মবিশ্বাসও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।’ অ্যাকশন শোধরানোর প্রক্রিয়াটা বোলারদের জন্য বড় একটা পরীক্ষাই। রানআপ থেকে শুরু করে বল ডেলিভারি দেওয়া পর্যন্ত অনেক ছোটখাটো জিনিসে আনতে হয় পরিবর্তন। পুরোপুরি রপ্ত করার আগে খেলায় সেগুলো প্রয়োগ করলে সবই এলোমেলো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। একই সঙ্গে খেলা ও অ্যাকশন পরিবর্তনের কাজ চললে কোনোটাই পরিপূর্ণভাবে তো হয়ই না, উল্টো ত্রুটি শোধরানোর প্রক্রিয়া হয়ে যেতে পারে দীর্ঘ। এমনকি নতুন সমস্যা যুক্ত হয়ে কাজটা আরও কঠিন হয়ে যেতে পারে। হুমকির মধ্যে পড়তে পারে খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার। নামি ক্রিকেট কোচ নাজমুল আবেদীন সরাসরিই বলছেন, ‘দুটো কাজ একসঙ্গে করা টেকনিক্যালিই সম্ভব নয়। দুটোর যেকোনো একটি করতে হবে। ও (তাসকিন) যদি পুনর্বাসনের কাজ করে, তাহলে ধারাবাহিকভাবে সেটাই করে একটা জায়গায় আসতে হবে। যখন বুঝবে সব ঠিক আছে, তারপর খেলায় যেতে পারে। আর সে যদি খেলা চালিয়ে যেতে চায়, তাহলে খেলা শেষ হওয়ার পর পুনর্বাসনের কাজ করতে হবে। দুটি কাজ একসঙ্গে মোটেই করা উচিত নয়। খেলোয়াড়ের জন্য সেটা কনফিউজিং হতে পারে।’ বিসিবির পরিচালক ও আবাহনীর কোচ খালেদ মাহমুদেরও একই মত, ‘দুটো একসঙ্গে করলে সেটা সাংঘর্ষিক হতে পারে।’ কিন্তু তিনি ক্লাবের চাকরি করেন। কোচ ক্লাবের দিকটাই আগে দেখবেন, সেটাই স্বাভাবিক। মাহমুদের তাই মত, ‘প্রিমিয়ার লিগ শেষ করেই পুনর্বাসনের কাজ করা উচিত তাসকিনের। সে জন্য তার হাতে তখন যথেষ্ট সময়ও থাকবে।’ বলটা এখন তাসকিনের কোর্টে—টাকা বড় নাকি ভবিষ্যৎ?
No comments