থিয়েটার এক্সিবিশন শেক্সপিয়ার সপ্তক by রুবাইয়াৎ আহমেদ
ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের কারণে বিশ্বের সর্বত্র উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাটক ও সাহিত্যকর্মগুলোর বিস্তার ঘটেছে সত্য, তবে তাঁকে টিকে যেতে হয়েছে নিজের অসামান্য সৃষ্টির মহিমাতেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন তাঁর গানে মানুষের মনের প্রায় প্রতিটি আবেগ প্রকাশ করেছেন অপূর্ব সৃজন ক্ষমতায়, নাটকে শেক্সপিয়ার অনেকটা একই রকম কাণ্ড ঘটিয়েছেন। মানুষের ইন্দ্রিয়জাত নানা টানাপোড়েন আর আবেগ তার সংলাপের আর ঘটনার মধ্য দিয়ে তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। আর এ কারণেই এতকাল পরও মহান এই নাট্যস্রষ্টার দৃশ্যকাব্যগুলো সমসাময়িক পাঠ উতরে যায়। তাঁর বিশিষ্টতা কিংবা গ্রহণযোগ্যতা ঠিক এ কারণেই প্রশ্নাতীত। স্বল্পায়ুর এই মানুষটির অন্তর্ধানের চার শ বছর পূর্ণ হলো ২৩ এপ্রিল। বিশ্বের অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশেও তাঁর প্রয়াণের চার শতক পালিত হয়েছে। ঢাকা থিয়েটার ও যুক্তরাজ্যের গ্রেআই থিয়েটারের যৌথ নির্মাণ ডিফারেন্ট ‘রোমিও ও জুলিয়েট’ তাঁর স্মরণে মঞ্চায়িত হয় ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায়। প্রযোজনাটির বিশেষ দিক হচ্ছে, প্রতিবন্ধী তরুণ-তরুণীরাই এতে অভিনয় করেছেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করে ‘শেক্সপিয়ার কার্নিভাল’। তাতে বিভিন্ন দলের অংশগ্রহণে শেক্সপিয়ারের বিভিন্ন নাটকের অংশবিশেষ মঞ্চায়নের পাশাপাশি সেমিনার এবং বাবুল বিশ্বাসের নির্মাণে বাংলাদেশে শেক্সপিয়ার চর্চার ওপর প্রদর্শিত হয় একটি তথ্যচিত্র। এসব আয়োজনের পাশে ব্যতিক্রমী একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন তরুণ নির্দেশক ও শিক্ষক সুদীপ চক্রবর্তী। ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রত্যক্ষÿ সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের তৃতীয়বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সুদীপ শেক্সপিয়ারের নানা স্বাদের সাতটি নাটকের অংশবিশেষ নিয়ে নির্মাণ করেন ‘শেক্সপিয়ার সপ্তক’। এ ক্ষেত্রে তিনি বেছে নেন ম্যাকবেথ, ওথেলো, হ্যামলেট, অ্যা মিড সামার নাইটস ড্রিম, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট, টেমিং অব দ্য শ্রু, অ্যাজ ইউ লাইক ইট নাটকগুলোর অংশবিশেষ। নাট্যাংশগুলোতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন আহসানুল, সবুজ, মারিয়া, সজীব, সাদিয়া, মনিরুজ্জামান, তামান্না, আশরাফুল, রাগিব, নুসরাত, রাসেল, প্রণব, জাবির, লতিফুল, কীর্তি, মাসুমা, তারিকুল ও শামীম। ২৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে তখন আমরা জড়ো হয়েছি অনেকেই। আকাশে থোকা থোকা মেঘ আর তার ফাঁকে গোলগাল চাঁদ। এই প্রদর্শনী সম্পর্কে আগেই বিভিন্ন তথ্য জেনে যাওয়ায় মনে জাগছে নানা প্রশ্ন। কেন এখন শেক্সপিয়ার? কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনা না করে কেনইবা অংশবিশেষের মঞ্চায়ন, একই মঞ্চে না করে ভিন্ন ভিন্ন ঘেরাটোপে কেন? আর এই সময়ে শেক্সপিয়ার কতটুকু প্রাসঙ্গিক? এসব মাথায় নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে প্রবেশ করি মিলনায়তনে। এই নাট্য প্রদর্শনীর অভিযাত্রা শুরু হয় হ্যামলেট দিয়ে। একটি ছোট্ট ঘরে প্রবেশের পর সামান্য আয়তনে একজন মাত্র অভিনেতা শুরু করেন অভিনয়। পিতার মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে নিজের স্বগোতোক্তি ছিল এই অংশের মঞ্চায়নে। এরপর অপর একটি কক্ষে ঢুকি আমরা। সেখানে শুরু হয় টেমিং অব দ্য শ্রু। হাস্যরসাত্মক এই নাট্যের একটি অংশের মঞ্চায়ন করেন দুজন অভিনয়শিল্পী। দর্শকের মাঝে মৃদু হাসির রোল। আমরা আবার পরিভ্রমণশীল হয়ে উঠি। ব্রিটিশ কাউন্সিলের মূল মিলনায়তনে তখন শুরু হয় রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট। দুটি চরিত্র উপস্থাপন করেন চারজন অভিনয়শিল্পী। পশ্চিমা নৃত্যের আঙ্গিকে রোমিও এবং জুলিয়েটের পারস্পরিক আকর্ষণের একটি চিত্রায়ণ ছিল এই অংশে। একই মঞ্চে এরপর শুরু হয় ওথেলো। চমৎকার অথচ সীমিত আয়োজনে প্রতীকী ঢঙে ডেসডিমোনার হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যটি রূপায়িত হয়েছে। এরপর আমরা এসে দাঁড়াই লাইব্রেরির খোলা আয়তনে। সেখানে শুরু হয় অ্যা মিড সামার নাইটস ড্রিম নাটকের অংশ। প্রকৃতির সঙ্গে আধুনিকতা এবং এক ধরনের ইল্যুশনের যৌথ বিনির্মাণ এই অংশ। শেষদিকে সেলফির প্রসঙ্গ শেক্সপিয়ারের অভিযোজন ক্ষমতাকে স্পষ্ট করে দেয়। একই ভাবে এরপর উদ্ভাসিত হয় ম্যাকবেথ নাটকের অংশ। যদিও সীমিত পরিসরে সামান্য অংশ নিয়েই মঞ্চায়ন, তবু সুদীপের ইতিপূর্বের নির্মাণ ম্যাকবেথকে কি ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে এবারকার সৃজন? পরিভ্রমণশীল দর্শক অতঃপর ব্রিটিশ কাউন্সিলের বাগানে খোলা জায়গায় গিয়ে জড়ো হলেন। শুরু হলো অ্যাজ ইউ লাইক ইট। ঘাটু গানের আদলে বরিশাল ও ঢাকাইয়া ভাষার মিশ্রণে নির্মিত এই নাট্যাংশটি দর্শকদের দিয়েছে প্রভূত আনন্দ। অধিকাংশ নাট্যাংশের ক্ষেত্রে চরিত্রে পশ্চিমারীতির পোশাক থাকলেও এই নাট্যে দেশজ; সেই সঙ্গে সমকালীন পোশাকের মিশ্রণ ছিল। সংগীতের ক্ষেত্রে এতে ব্যবহৃত হয়েছে দেশজ সুর। অন্যগুলোর ক্ষেত্রে পশ্চিমা আদলেই। সেট বলতে কয়েকটি নাট্যাংশে শুধু টেবিল ও চেয়ার। অন্য সবগুলো খোলা মঞ্চে। শুধু রঙিন কাপড়ে সেটের প্রয়োজন ঘুচিয়ে দেওয়া। প্রায় সবেÿক্ষেত্রেই আলোর সীমিত ব্যবহার। সুন্দর আর গোছানো আয়োজন। কিন্তু মাথার মধ্যে যে প্রশ্নগুলো ঘুরছিল তার উত্তর খুঁজে পেলাম কি? কথা বলি সুদীপের সঙ্গে। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে সেসব প্রশ্নের উত্তর। শেক্সপিয়ার ধ্রুপদি নাট্যকার। রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি—ইত্যাকার বিষয় নিয়ে রচিত তাঁর নাটক সমকালকে ছাড়িয়ে সর্বকালের হয়ে উঠেছে বলেই আজও তাঁর সৃষ্টিকে নানাভাবে নিয়ে আসা হয় মঞ্চে। যেহেতু নাট্যকলার শিক্ষার্থীদের একাডেমিক প্রযোজনার অংশ এটি, সে কারণেই নতুন জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত করার লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতেই নির্বাচিত হয়েছে নাট্যাংশগুলো। সুদীপ বলেন, এটি একটি থিয়েটার এক্সিবিশন। দর্শক যেন এক আবহ থেকে অন্য আবহে গিয়ে নতুনত্বের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন, সে জন্যই একই মঞ্চে না করে ভিন্ন ভিন্ন আয়তনে নাট্যাংশগুলোর মঞ্চায়ন।
No comments