প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও ভাষা আন্দোলন by সরদার সিরাজুল ইসলাম
যুবলীগ ও ধর্মঘট সমর্থন করেছিল। দীর্ঘ
দু’মাস সফল ধর্মঘট চলার পরে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন দাবি মেনে নেয়ার
প্রতিশ্রুতি এবং ধর্মঘটজনিত কারণে শিক্ষকদের ওপর কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
নেয়া হবে না বলে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল হামিদ পত্রিকয়ায় বিবৃতি
দিলে শিক্ষকরা ২ জুন ধর্মঘট প্রত্যাহার করে।
কিন্তু সরকার শিক্ষকদের কোন দাবিই পূরণ করেননি।
১৯৫১ সালের ৬ এপ্রিল ময়মনসিংহের আলফা সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম
ছাত্রলীগের এক বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সহ-সভাপতি
শামসুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করে
সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান। সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা সরকারী নির্যাতন
বন্ধ, বাজেটে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য পাওনা ছাড়াও বিনা বিচারে আটক বিশেষ
করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করা হয়। ১৯৫১ সালের ২৫
মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক সভায় কেন্দ্রীয় সাংবিধান
সভা ও পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার
দাবিতে একটি স্মারকলিপি প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন
হাবিবুর রহমান শেলী। ১১ এপ্রিল স্মারকলিপিটি পাঠানো হয় যাতে স্বাক্ষর
করেন, কর্মপরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল মতিন। এরপর কর্মপরিষদের ১২ এপ্রিল বদিউর
রহমানের ও ১৭ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্ব দুটি সভা হয়। উপস্থিত
ছিলেন আব্দুল মতিন, বদিউর রহমান, সালেহউদ্দিন, রুহুল আমীন চৌধুরী প্রমুখ।
এতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, পাকিস্তান সংবিধান সভার পূর্ব বঙ্গীয় কিছু
সংখ্যক সদস্যের কাছে টেলিগ্রামযোগে অনুরোধ জানানো হবে যাতে তারা
রাষ্ট্রভাষা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের দ্বারা প্রেরিত স্মারকলিপি
সম্পর্কে পার্লামেন্টে শর্ট নোটিশ প্রশ্ন উত্থাপন করেন। “নুরুল আমীন, ফজলুল
হক, নুর আহম্মদ মিঞা, ইব্রাহিম খান, হাবিবুল্লাহ বাহার, মিঞা ইফতেখার
উদ্দিন, শওকত হায়াত খান প্রমুখের কাছে টেলিগ্রাম পাঠানো হয়।
১৯৫১ সালের ২০ এপ্রিল সংখ্যার পেশোয়ার থেকে প্রকাশিত খাইবার মেল পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাকে পাকিস্তানের সরকারী ভাষারূপে গ্রহণ করার দাবি জানানো হয়। পূর্ব বাংলা সরকার ১৯৫১ সালে ২০ জন শিক্ষাবিদকে নিয়ে পূর্ববাংলা শিক্ষা সংস্কার কমিটি নামে একটি কমিটি নিযুক্ত করে। এই কমিটি মাতৃভাষার মাধমে শিক্ষাদানের সুপারিশ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকার আরবিতে মুসলিম ছাত্রদের হাতেখড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তা কার্যকরী করার জন্য শিক্ষা জেলা কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া শিশুরা প্রথম ও ২য় শ্রেণীতে আরবি অক্ষর পরিচয় শিক্ষা, তৃতীয় শ্রেণীতে আমপাড়া ও ধর্ম ও ওপর শ্রেণীতে উর্দু বাধ্যতামূলক বিষয় করার নির্দেশ দেয়া হয়।
১৯৫১ সালের ২৬ এপ্রিল মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কমিটির সভায় পূর্ববাংলার সম্পদ অপহরণ প্রতিরোধে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি, ৪ বছরের মধ্যেও সংবিধান প্রণয়নের ব্যর্থতার সমালোচনা, ১৯৫২ সালের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন, নিরাপত্তা আইন বাতিল ও শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির দাবি করে প্রস্তাব গৃহীত হয়।
১৯৫১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এক ইশতেহারে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পূর্ববাংলার সর্বত্র রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠনের আহ্বান জানানো হয়। ১৯৫১ সালের শেষ দিকে পূর্ববাংলার সংকট এমনি পর্যায়ে চলে যায় যে, ১৯৫১ সালের নবেম্বর মাসে পূর্ব বাংলা পরিষদের আটজন মুসলিম লীগ সদস্য সংসদীয় দল থেকে পদত্যাগ করেন। এরা হচ্ছেনÑ ফরিদ আহম্মদ চৌধুরী, আহাম্মদ কবির চৌধুরী, কবির আহম্মদ চৌধুরী, আলী আহম্মদ চৌধুরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলী আহম্মদ খাঁন, প্রাক্তন মন্ত্রী কুষ্টিয়ার শামসুদ্দিন আহম্মদ, বরিশালের চৌধুরী আরিফ এবং নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলী। এদের সম্মানে ১৪ নবেম্বর (১৯৫১) ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বার এ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক রফিকুদ্দিন চৌধুরী। নুরুল আমীন সরকারের কুশাসনের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করার প্রত্যয়ে এবং নুরুল আমীন কর্তৃক জনগণের বিশ্বাস ভঙ্গ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, পাটনীতি, বেকার সমস্যা, দারিদ্র্য, লবণ, চিনি, কাপড়, তেল, কয়লাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি, বিনা বিচারে আটক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বন্দীদের আটকের মেয়াদ অর্ডিন্যান্স দ্বারা বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণেই পদত্যাদ করেন বলে উল্লেখ করা হয়। উল্লেখ্য, ১৯৫১ সালের নবেম্বর মাসে পূর্ববাংলা পরিষদে জননিরাপত্তা আইনের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য একটি অর্ডিন্যান্স পেশ করা হয়। এই অর্ডিন্যান্সটির উদ্দেশ্য ছিল, ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বিশেষ করে প্রগতিশীল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক করে রাখা। সে সময় শেখ মুজিব জেলে ছিলেন ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে। আওয়ামী লীগ এই অর্ডিন্যান্সটির তীব্র প্রতিবাদ করে। ১৯৫১ সালের ২ নবেম্বর আরমানীটোলা ময়দানে ওই অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য কফিলউদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অর্ডিন্যান্সটিকে মন্ত্রী নিরাপত্তা আইন, অফিসার নিরাপত্তা আইন, শাসক দল নিরাপত্তা আইন ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করা হয়। এই অর্ডিন্যান্সটির বিরুদ্ধে ছাত্র, শিক্ষক বুদ্ধিজীবীরাও সোচ্চার ছিল। তা সত্ত্বেও এর মেয়াদ ১৯৫৩ সালের ১ অক্টোবর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।
(ক্রমশ.)
১৯৫১ সালের ২০ এপ্রিল সংখ্যার পেশোয়ার থেকে প্রকাশিত খাইবার মেল পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাকে পাকিস্তানের সরকারী ভাষারূপে গ্রহণ করার দাবি জানানো হয়। পূর্ব বাংলা সরকার ১৯৫১ সালে ২০ জন শিক্ষাবিদকে নিয়ে পূর্ববাংলা শিক্ষা সংস্কার কমিটি নামে একটি কমিটি নিযুক্ত করে। এই কমিটি মাতৃভাষার মাধমে শিক্ষাদানের সুপারিশ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকার আরবিতে মুসলিম ছাত্রদের হাতেখড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তা কার্যকরী করার জন্য শিক্ষা জেলা কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া শিশুরা প্রথম ও ২য় শ্রেণীতে আরবি অক্ষর পরিচয় শিক্ষা, তৃতীয় শ্রেণীতে আমপাড়া ও ধর্ম ও ওপর শ্রেণীতে উর্দু বাধ্যতামূলক বিষয় করার নির্দেশ দেয়া হয়।
১৯৫১ সালের ২৬ এপ্রিল মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কমিটির সভায় পূর্ববাংলার সম্পদ অপহরণ প্রতিরোধে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি, ৪ বছরের মধ্যেও সংবিধান প্রণয়নের ব্যর্থতার সমালোচনা, ১৯৫২ সালের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন, নিরাপত্তা আইন বাতিল ও শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির দাবি করে প্রস্তাব গৃহীত হয়।
১৯৫১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এক ইশতেহারে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পূর্ববাংলার সর্বত্র রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠনের আহ্বান জানানো হয়। ১৯৫১ সালের শেষ দিকে পূর্ববাংলার সংকট এমনি পর্যায়ে চলে যায় যে, ১৯৫১ সালের নবেম্বর মাসে পূর্ব বাংলা পরিষদের আটজন মুসলিম লীগ সদস্য সংসদীয় দল থেকে পদত্যাগ করেন। এরা হচ্ছেনÑ ফরিদ আহম্মদ চৌধুরী, আহাম্মদ কবির চৌধুরী, কবির আহম্মদ চৌধুরী, আলী আহম্মদ চৌধুরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলী আহম্মদ খাঁন, প্রাক্তন মন্ত্রী কুষ্টিয়ার শামসুদ্দিন আহম্মদ, বরিশালের চৌধুরী আরিফ এবং নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলী। এদের সম্মানে ১৪ নবেম্বর (১৯৫১) ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বার এ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক রফিকুদ্দিন চৌধুরী। নুরুল আমীন সরকারের কুশাসনের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করার প্রত্যয়ে এবং নুরুল আমীন কর্তৃক জনগণের বিশ্বাস ভঙ্গ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, পাটনীতি, বেকার সমস্যা, দারিদ্র্য, লবণ, চিনি, কাপড়, তেল, কয়লাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি, বিনা বিচারে আটক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বন্দীদের আটকের মেয়াদ অর্ডিন্যান্স দ্বারা বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণেই পদত্যাদ করেন বলে উল্লেখ করা হয়। উল্লেখ্য, ১৯৫১ সালের নবেম্বর মাসে পূর্ববাংলা পরিষদে জননিরাপত্তা আইনের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য একটি অর্ডিন্যান্স পেশ করা হয়। এই অর্ডিন্যান্সটির উদ্দেশ্য ছিল, ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বিশেষ করে প্রগতিশীল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক করে রাখা। সে সময় শেখ মুজিব জেলে ছিলেন ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে। আওয়ামী লীগ এই অর্ডিন্যান্সটির তীব্র প্রতিবাদ করে। ১৯৫১ সালের ২ নবেম্বর আরমানীটোলা ময়দানে ওই অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য কফিলউদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অর্ডিন্যান্সটিকে মন্ত্রী নিরাপত্তা আইন, অফিসার নিরাপত্তা আইন, শাসক দল নিরাপত্তা আইন ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করা হয়। এই অর্ডিন্যান্সটির বিরুদ্ধে ছাত্র, শিক্ষক বুদ্ধিজীবীরাও সোচ্চার ছিল। তা সত্ত্বেও এর মেয়াদ ১৯৫৩ সালের ১ অক্টোবর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।
(ক্রমশ.)
No comments