বীরাঙ্গনা ৭১ ॥ নির্যাতিত নারীরা চেয়েছিল নিজ আশ্রয়টুকু by মুনতাসীর মামুন
তিনি সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় এবং বাংলাদেশ
কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় তাদের সঙ্গে দেখা করেন এবং বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার
অনুরোধ করেন। কিন্তু আপনজন কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে তারা দেশ ত্যাগে অনড়
ছিলেন।
এদের ভেতর চৌদ্দ-পনেরো বছরের এক কিশোরীও ছিল।
নীলিমা ইব্রাহিম এই কিশোরীকে বলেছিলেন, ‘তুমি আমার বাড়িতে থাকবে, আমার
মেয়ের মতো।’ তবু সে রাজি হয়নি। বলেছে, ‘আপনি যখন থাকবেন না তখন কী হবে? যখন
লোকে জানবে পাকিস্তানীরা আমাকে স্পর্শ করেছে তখন সবাই আমাকে ঘৃণা করবে।’
নীলিমা ইব্রাহিম বলেছেন, ‘তুমি কী জান পাকিস্তানীরা তোমাকে নিয়ে কী করবে?’
মেয়েটি জবাব দিয়েছে, ‘জানি, ওরা আমাকে নিয়ে বিক্রি করে দেবে। কিন্তু ওখানে
কেউ আমাকে চিনবে না।’
নীলিমা ইব্রাহিমকে পুনর্বাসিত একজন বীরাঙ্গনা বলেছিলেন পরে: ‘আজ পথে পথে কত শহীদ মিনার, কত পথঘাট, কালভার্ট ও সেতু উৎসর্গিত হচ্ছে শহীদদের নামে। শহীদদের পিতা-মাতা-সন্তানরা কত রাষ্ট্রীয় সহায়তা সহানুভূতি শুধু নয় সম্মানও পাচ্ছে, কিন্তু আমরা কোথায়? একজন বীরাঙ্গানার নামে কি একটি সড়কের নামকরণ হয়েছে? তারা মরে কি শহীদ হয়নি? তাহলে এ অবিচার কেন? বিদেশে তো কত যুদ্ধবন্দী মহিলাকে দেখেছি। অনায়াসে তারা তাদের জীবনের কাহিনী বলে গেছেন হাসি ও অশ্রুর মিশ্রণে। তাহলে আমরা কেন অসম্মানের রজ্জুতে বাঁধা থাকব?’ এ কোন মানবাধিকারের মানদ-?”
আরেকজন তাঁকে বলেছিলেন ‘দেহে আপনার সঙ্গে লড়াইতে জিততে পারব কি না জানি না, তবে আপনি যদি বাঙালী মুসলমান ঘরের পুরুষ হন, আর আপনার বয়স যদি পঞ্চাশ পার হয়ে থাকে তাহলে মনোবলে আপনি আমার চেয়ে নিকৃষ্ট। কারণ একদিন আমি আপনাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম, আপনাদের আপাদমস্তক দৃষ্টিপাত করবার এবং দেহ ভেদ করে অন্তরের পরিচয় পাবার সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। এ দেশের মায়ের সন্তান যারা ছিল তারা হয় শহীদ, নয়তো গাজী। যুদ্ধকালে যারা খেয়ে পরে সুখে ছিলেন, তাদের আমি ঘৃণা করি, আজ এই ২৫ বছর পরও থুথু ছিটিয়ে দিই আপনাদের মুখে সর্বদেহে।... আমি তো বীরাঙ্গনাই ছিলাম। আপনারা বানাতে চেয়েছেন বারাঙ্গনা। তাই তো আপনারাও আমার কাছে কাপুরুষ, লোভী, ক্লীব, ঘৃণিত ও অপদার্থ জীব। আমি আজও বীরাঙ্গনা, আজও আমি আপনাদের করুণা করবার অধিকার রাখি।’
পূর্বোল্লিখিত এলেজান দুঃখ করে শাহরিয়ারকে বলেছিলেনÑ “সমাজে আমরা দাঁড়াতে পারিনি, খাড়াতে পারিনি, আমাদের দেশে। মানুষে আমাদের ভাল বলে না। আমরা ঘৃণ্য হয়ে গেছি। ঘৃণ্য হয়ে গেছি দেশবাসীর কাছে। টিউবওয়েলে পানি খেতে যাই, তাও খেতে দিতে চায় না। স্বামীকে কাজে নিতে চায় না। স্বামী এখন অকমর্ণ্য। আমার সঙ্গে ঘৃণার ঠেলায় কথাই কইতে চায় না। আমরা এ রকম পড়ে আছি। আমরা খুবই বিকারে পড়ে আছি। নদীতে মাছ যেমন হাবুডুবু করে ওরকম করতেছি আমরা।”
আসলে নির্যাতিতা নারীরা তেমন কিছু চায়নি সমাজের কাছে। তারা শুধু চেয়েছিল নিজ আশ্রয়টুকু অটুট থাকুক। সমাজ তাকে নিন্দিত চোখে না দেখুক। তাকে খানিকটা সম্মান দিক। পুনর্বাসন করেছিলেন এমন একটি মেয়ে দীর্ঘদিন পর বিদেশ থেকে ফিরে নীলিমা ইব্রাহিমের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। নানা কথার পর জানিয়েছিলেনÑ
“একটি মেয়ে তার জীবনে যা কামনা করে তার আমি সব পেয়েছি। তবুও মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে। কিসের অভাব আমার, আমি কি চাই? হ্যাঁ একটা জিনিস, একটি মুহূর্তের প্রত্যাশা মৃত্যু মুহূর্ত পর্যন্ত রয়ে যাবে। এ প্রজন্মের একটি তরুণ অথবা তরুণী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, বীরাঙ্গনা আমি তোমাকে প্রণতি করি, হাজার সালাম তোমাকে। তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা, ওই পতাকায় তোমার অংশ আছে। জাতীয় সঙ্গীতে তোমার কণ্ঠ আছে। এ দেশের মাটিতে তোমার অগ্রাধিকার। সেই শুভ মুহূর্তের আশায় বিবেকের জাগরণের মুহূর্তের পথ চেয়ে আমি বেঁচে রইব।”
ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ধর্ষিতা নারীদের প্রতীক হিসেবে এখন বিরাজ করছেন আমাদের মাঝে। তিনিও আক্ষেপ করে বলেছিলেনÑ
“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বীরাঙ্গনাদের সম্মানের সঙ্গে পুনর্বাসিত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। মাঝে মাঝে ভাবি একাত্তরে পাকিস্তানী সৈন্যদের যে নৃশংস পাশবিক চেহারা দেখেছি। আমাদের সমাজেও কি তাদের প্রতিচ্ছায়া নেই? আমাকে যারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল তারা এ দেশেরই মানুষ। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক বীরত্বের কথা শুনেছি। দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর সেই বীরত্ব দেখিনি। তাঁরা কেউ কথিত বীরাঙ্গনাদের পাশে এসে দাঁড়াননি। একাত্তরে যখন নারীরা পাকিস্তানীদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছিলেন, তখন তাদের পিতা, স্বামী, ভাই কিংবা পরিবারের অন্য পুরুষ সদস্যরা পালিয়ে গিয়েছেন অথবা হানাদার বাহিনীর হাতে জীবন দিয়েছেন। পালিয়ে যাওয়ার পথ জানা ছিল না, কিংবা রক্ষা করার মতো কেউ ছিল না বলেই তখন এত বেশি নারী পাকিস্তানীদের নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।’
১৯৭২ সালের সংবাদপত্রের কিছু প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, অনেকে ‘বীরাঙ্গনাদের জীবন সঙ্গিনী করতে আগ্রহী।’ প্রতিবেদক বেবী মওদুদ জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ ফেরত অনেকেই বীরাঙ্গনাদের গ্রহণ করতে রাজি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সেই সময় এ নিয়ে কাজ করছিল। পরিষদ এ রকমে অনেক চিঠি পাচ্ছিলেন।
একজন পত্র লেখক জানিয়েছেন, ‘তিনি লাঞ্ছিত মেয়েদের মধ্যে একজন এমএ শ্রেণীর মেয়েকে বিয়ে করে সুখী সংসার গড়তে প্রস্তুত আছেন। আরেকজন লিখেছেন, সংসারে তার একান্ত আপনজন বলতে কেউ নেই। তিনি একজন সঙ্গী চান তার ঈপ্সিত সঙ্গী হোক না লাঞ্ছিতা, হোক না অবাঞ্ছিতা, তিনি তাকে মনের মানুষ হিসেবে গ্রহণ করে নেবেন।’
একজন অধ্যাপকও জানিয়েছেন, তিনি চান খান সেনাদের অত্যাচারের শিকার একজন বীরাঙ্গনা মহিলাকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে। প্রতিবেদক আরো জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের বাইরে থেকেও চিঠি আসছে। চিঠি আসছে প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ থেকেও।’
ঐ সময় ছিল আবেগের। এবং আমরাও সেই সময় এই ধরনের আলোচনা শুনেছি। এ অধ্যায়টি লেখার সময় আমি আবারও বেবী মওদুদের সঙ্গে কথা বলে জানতে চাই, ঐ প্রতিবেদন কতটুকু আবেগনির্ভর, কতটুকু উৎসাহ প্রদানের জন্য এবং কতটুকুও বা সত্য? তিনি জানান, আবেগ হয়ত কিছুুটা থাকতে পারে কিন্তু এটা সত্য যে অনেকে বীরাঙ্গনাদের গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন এবং করেছিলেনও। তবে সে সংখ্যাটি খুব বেশি ছিল বলে মনে হয় না।
এই গ্রন্থে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের যে সব কেসস্টাডিগুলোর উল্লেখ করেছি, সেখানে নির্যাতিতদের একটি প্রশ্ন করা হয়েছে, যারা আপনার এমন করেছে তাদের প্রতি মনোভাব কী?
প্রত্যেকে নির্যাতকদের মৃত্যু কামনা করেছেন এবং এক বাক্যে বলেছিলেন, তাদের বিচার চাই।
সেই বিচার জিয়াউর রহমান, পরবর্তীকালে খালেদা জিয়া করতে দেননি। এদের বিচারের দাবিতে গত দুই দশক আবারও আন্দোলন হয়েছে। নির্যাতিতরাও এখন অনেকে প্রকাশ্যে বলেছেন তাঁরা বিচার চান। যেমন-শাহরিয়ারের চলচ্চিত্রে এলেজান বলেছিলেন ‘এর বিচার আমি চাই। এদের বিচারের জন্য আমি বাড়ির বাইর হয়েছি। আমি এতদিন ঘরে ছিলাম। থাকতে না পেরে বিচারের জন্য বাড়ির বাইর হয়েছি।”
ওউবারি মেনন বিজয়ের প্রায় আট মাস পর বাংলাদেশে এসেছিলেন। পুনর্বাসন কেন্দ্রে কয়েকজন ধর্ষিতার সঙ্গে আলাপও করেছিলেন। এ রকম একজনের সঙ্গে আলাপ করে তিনি যখন ফিরছেন তখন সেই মহিলা তাঁকে ডেকে বললেন, ‘দেখবেন ওই সব লোক যেন শাস্তি পায়, শাস্তি পায়, শাস্তি পায়।’সেই বহু প্রত্যাশিত বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। (চলবে)
নীলিমা ইব্রাহিমকে পুনর্বাসিত একজন বীরাঙ্গনা বলেছিলেন পরে: ‘আজ পথে পথে কত শহীদ মিনার, কত পথঘাট, কালভার্ট ও সেতু উৎসর্গিত হচ্ছে শহীদদের নামে। শহীদদের পিতা-মাতা-সন্তানরা কত রাষ্ট্রীয় সহায়তা সহানুভূতি শুধু নয় সম্মানও পাচ্ছে, কিন্তু আমরা কোথায়? একজন বীরাঙ্গানার নামে কি একটি সড়কের নামকরণ হয়েছে? তারা মরে কি শহীদ হয়নি? তাহলে এ অবিচার কেন? বিদেশে তো কত যুদ্ধবন্দী মহিলাকে দেখেছি। অনায়াসে তারা তাদের জীবনের কাহিনী বলে গেছেন হাসি ও অশ্রুর মিশ্রণে। তাহলে আমরা কেন অসম্মানের রজ্জুতে বাঁধা থাকব?’ এ কোন মানবাধিকারের মানদ-?”
আরেকজন তাঁকে বলেছিলেন ‘দেহে আপনার সঙ্গে লড়াইতে জিততে পারব কি না জানি না, তবে আপনি যদি বাঙালী মুসলমান ঘরের পুরুষ হন, আর আপনার বয়স যদি পঞ্চাশ পার হয়ে থাকে তাহলে মনোবলে আপনি আমার চেয়ে নিকৃষ্ট। কারণ একদিন আমি আপনাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম, আপনাদের আপাদমস্তক দৃষ্টিপাত করবার এবং দেহ ভেদ করে অন্তরের পরিচয় পাবার সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। এ দেশের মায়ের সন্তান যারা ছিল তারা হয় শহীদ, নয়তো গাজী। যুদ্ধকালে যারা খেয়ে পরে সুখে ছিলেন, তাদের আমি ঘৃণা করি, আজ এই ২৫ বছর পরও থুথু ছিটিয়ে দিই আপনাদের মুখে সর্বদেহে।... আমি তো বীরাঙ্গনাই ছিলাম। আপনারা বানাতে চেয়েছেন বারাঙ্গনা। তাই তো আপনারাও আমার কাছে কাপুরুষ, লোভী, ক্লীব, ঘৃণিত ও অপদার্থ জীব। আমি আজও বীরাঙ্গনা, আজও আমি আপনাদের করুণা করবার অধিকার রাখি।’
পূর্বোল্লিখিত এলেজান দুঃখ করে শাহরিয়ারকে বলেছিলেনÑ “সমাজে আমরা দাঁড়াতে পারিনি, খাড়াতে পারিনি, আমাদের দেশে। মানুষে আমাদের ভাল বলে না। আমরা ঘৃণ্য হয়ে গেছি। ঘৃণ্য হয়ে গেছি দেশবাসীর কাছে। টিউবওয়েলে পানি খেতে যাই, তাও খেতে দিতে চায় না। স্বামীকে কাজে নিতে চায় না। স্বামী এখন অকমর্ণ্য। আমার সঙ্গে ঘৃণার ঠেলায় কথাই কইতে চায় না। আমরা এ রকম পড়ে আছি। আমরা খুবই বিকারে পড়ে আছি। নদীতে মাছ যেমন হাবুডুবু করে ওরকম করতেছি আমরা।”
আসলে নির্যাতিতা নারীরা তেমন কিছু চায়নি সমাজের কাছে। তারা শুধু চেয়েছিল নিজ আশ্রয়টুকু অটুট থাকুক। সমাজ তাকে নিন্দিত চোখে না দেখুক। তাকে খানিকটা সম্মান দিক। পুনর্বাসন করেছিলেন এমন একটি মেয়ে দীর্ঘদিন পর বিদেশ থেকে ফিরে নীলিমা ইব্রাহিমের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। নানা কথার পর জানিয়েছিলেনÑ
“একটি মেয়ে তার জীবনে যা কামনা করে তার আমি সব পেয়েছি। তবুও মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে। কিসের অভাব আমার, আমি কি চাই? হ্যাঁ একটা জিনিস, একটি মুহূর্তের প্রত্যাশা মৃত্যু মুহূর্ত পর্যন্ত রয়ে যাবে। এ প্রজন্মের একটি তরুণ অথবা তরুণী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, বীরাঙ্গনা আমি তোমাকে প্রণতি করি, হাজার সালাম তোমাকে। তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা, ওই পতাকায় তোমার অংশ আছে। জাতীয় সঙ্গীতে তোমার কণ্ঠ আছে। এ দেশের মাটিতে তোমার অগ্রাধিকার। সেই শুভ মুহূর্তের আশায় বিবেকের জাগরণের মুহূর্তের পথ চেয়ে আমি বেঁচে রইব।”
ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ধর্ষিতা নারীদের প্রতীক হিসেবে এখন বিরাজ করছেন আমাদের মাঝে। তিনিও আক্ষেপ করে বলেছিলেনÑ
“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বীরাঙ্গনাদের সম্মানের সঙ্গে পুনর্বাসিত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। মাঝে মাঝে ভাবি একাত্তরে পাকিস্তানী সৈন্যদের যে নৃশংস পাশবিক চেহারা দেখেছি। আমাদের সমাজেও কি তাদের প্রতিচ্ছায়া নেই? আমাকে যারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল তারা এ দেশেরই মানুষ। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক বীরত্বের কথা শুনেছি। দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর সেই বীরত্ব দেখিনি। তাঁরা কেউ কথিত বীরাঙ্গনাদের পাশে এসে দাঁড়াননি। একাত্তরে যখন নারীরা পাকিস্তানীদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছিলেন, তখন তাদের পিতা, স্বামী, ভাই কিংবা পরিবারের অন্য পুরুষ সদস্যরা পালিয়ে গিয়েছেন অথবা হানাদার বাহিনীর হাতে জীবন দিয়েছেন। পালিয়ে যাওয়ার পথ জানা ছিল না, কিংবা রক্ষা করার মতো কেউ ছিল না বলেই তখন এত বেশি নারী পাকিস্তানীদের নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।’
১৯৭২ সালের সংবাদপত্রের কিছু প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, অনেকে ‘বীরাঙ্গনাদের জীবন সঙ্গিনী করতে আগ্রহী।’ প্রতিবেদক বেবী মওদুদ জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ ফেরত অনেকেই বীরাঙ্গনাদের গ্রহণ করতে রাজি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সেই সময় এ নিয়ে কাজ করছিল। পরিষদ এ রকমে অনেক চিঠি পাচ্ছিলেন।
একজন পত্র লেখক জানিয়েছেন, ‘তিনি লাঞ্ছিত মেয়েদের মধ্যে একজন এমএ শ্রেণীর মেয়েকে বিয়ে করে সুখী সংসার গড়তে প্রস্তুত আছেন। আরেকজন লিখেছেন, সংসারে তার একান্ত আপনজন বলতে কেউ নেই। তিনি একজন সঙ্গী চান তার ঈপ্সিত সঙ্গী হোক না লাঞ্ছিতা, হোক না অবাঞ্ছিতা, তিনি তাকে মনের মানুষ হিসেবে গ্রহণ করে নেবেন।’
একজন অধ্যাপকও জানিয়েছেন, তিনি চান খান সেনাদের অত্যাচারের শিকার একজন বীরাঙ্গনা মহিলাকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে। প্রতিবেদক আরো জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের বাইরে থেকেও চিঠি আসছে। চিঠি আসছে প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ থেকেও।’
ঐ সময় ছিল আবেগের। এবং আমরাও সেই সময় এই ধরনের আলোচনা শুনেছি। এ অধ্যায়টি লেখার সময় আমি আবারও বেবী মওদুদের সঙ্গে কথা বলে জানতে চাই, ঐ প্রতিবেদন কতটুকু আবেগনির্ভর, কতটুকু উৎসাহ প্রদানের জন্য এবং কতটুকুও বা সত্য? তিনি জানান, আবেগ হয়ত কিছুুটা থাকতে পারে কিন্তু এটা সত্য যে অনেকে বীরাঙ্গনাদের গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন এবং করেছিলেনও। তবে সে সংখ্যাটি খুব বেশি ছিল বলে মনে হয় না।
এই গ্রন্থে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের যে সব কেসস্টাডিগুলোর উল্লেখ করেছি, সেখানে নির্যাতিতদের একটি প্রশ্ন করা হয়েছে, যারা আপনার এমন করেছে তাদের প্রতি মনোভাব কী?
প্রত্যেকে নির্যাতকদের মৃত্যু কামনা করেছেন এবং এক বাক্যে বলেছিলেন, তাদের বিচার চাই।
সেই বিচার জিয়াউর রহমান, পরবর্তীকালে খালেদা জিয়া করতে দেননি। এদের বিচারের দাবিতে গত দুই দশক আবারও আন্দোলন হয়েছে। নির্যাতিতরাও এখন অনেকে প্রকাশ্যে বলেছেন তাঁরা বিচার চান। যেমন-শাহরিয়ারের চলচ্চিত্রে এলেজান বলেছিলেন ‘এর বিচার আমি চাই। এদের বিচারের জন্য আমি বাড়ির বাইর হয়েছি। আমি এতদিন ঘরে ছিলাম। থাকতে না পেরে বিচারের জন্য বাড়ির বাইর হয়েছি।”
ওউবারি মেনন বিজয়ের প্রায় আট মাস পর বাংলাদেশে এসেছিলেন। পুনর্বাসন কেন্দ্রে কয়েকজন ধর্ষিতার সঙ্গে আলাপও করেছিলেন। এ রকম একজনের সঙ্গে আলাপ করে তিনি যখন ফিরছেন তখন সেই মহিলা তাঁকে ডেকে বললেন, ‘দেখবেন ওই সব লোক যেন শাস্তি পায়, শাস্তি পায়, শাস্তি পায়।’সেই বহু প্রত্যাশিত বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। (চলবে)
No comments