বন্ধু বিদায় by বাহাউদ্দীন চৌধুরী

বিশিষ্ট সাংবাদিক, কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদ খোন্দকার গোলাম মুস্তাফা আর নেই। তিনি অকালপ্রয়াত হয়েছেন বলা যাবে না। পরিণত বয়সেই চলে গেছেন। তবু সব প্রিয়জনের মৃত্যুকেই আপনজনের কাছে অকালমৃত্যু বলেই মনে হয়।
পরিচিত মহলে তিনি কেজি নামেই খ্যাত ছিলেন। তিনি একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক ছিলেন। তিনি আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের অন্যতম ছিলেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরে তিনি, ডক্টর মুস্তাফা নূরুল ইসলাম, ডক্টর জনসন নামে খ্যাত খান শামসুর রহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ মোহাম্মদ আলী, মাহবুব জামাল জাহেদী আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিলেন। আমরা সকলেই একই রাজনৈতিক মতবাদ মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলাম। এর মধ্যে কেজি ও আমি সক্রিয়ভাবে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যোগ দেই। আমরা দু'জনই ভাষা আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করি। রাজনৈতিক কারণে কেজি মুস্তাফা ও আমি দীর্ঘদিন কারাবাস করি। তিনি ছিলেন সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক গগনের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।
বর্তমান বাংলাদেশে তিনি ও হাসানুজ্জামান খান ছিলেন প্রবীণতম সাংবাদিক। সাংবাদিকতায় তাঁরা সর্বজ্যেষ্ঠ। প্রয়াত ওবায়েদুল হক বয়সে অনেক বড় হলেও তাঁর সাংবাদিকতার জীবন এই দু'জনের থেকে কম ছিল। এই দু'জন সাংবাদিক ভারত-বিভাগ পূর্বকাল থেকে সাংবাদিকতা পেশায় ছিলেন। তাঁরা উভয়েই কলকাতায় ১৯৪৬ সালে সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন। কেজি মুস্তাফা কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় থেকেই সাংবাদিকতা পেশায় আসেন। ইসলামিয়া কলেজে তিনি ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাহচর্য পান। পরবর্তী সময়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রিয়জন ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। সঙ্গে সাংবাদিকতাও চালিয়ে যান। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনের সময়ে তিনি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। সেই আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্ব ছিল বামপন্থীদের হাতে। বামপন্থীদের সংস্পর্শে এসে সেই সময়েই তিনি কমিউনিস্ট রাজনীতিতে জড়িত হন। সে হিসেবে তিনি ছিলেন আমার কমরেড। ভাষা আন্দোলনে তাঁর অবদান অবশ্যই স্মরণীয়। এছাড়া অন্য সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের শীর্ষ সাংবাদিক নেতা ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন পাকিস্তান ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টের সভাপতি ছিলেন। একজন বাঙালী হয়েও এই পদে নির্বাচিত হয়ে সমগ্র পাকিস্তানের সাংবাদিকদের নেতৃত্ব প্রদান তাঁর যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণ করে। তিনি সমগ্র পাকিস্তানে কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। সেই আমলে সাংবাদিকদের ওয়েজ বোর্ড গঠন ও বেতন বৃদ্ধিতে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে। এই দেশপ্রেমিক দক্ষ সাংবাদিকের তিরোধানে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের অপূরণীয় ৰতি হয়েছে। সারাজীবন তিনি বাঙালীর স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ে তিনি অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। বন্ধু, তোমাকে জানাই সশ্রদ্ধ তসলিম।
লেখক : ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও সাবেক সচিব।

No comments

Powered by Blogger.