কে. জি. মুস্তাফা এক অনুসরণীয় সাংবাদিকের মহাপ্রয়াণ by মুহম্মদ শফিকুর রহমান

কে. জি. মুস্তাফা, আমাদের প্রিয় কে. জি. ভাই চলে গেলেন শুক্রবার রাতে। রবিবার আমরা তাঁকে শেষ বিদায় জানালাম। মৃত্যু অমোঘ। কেউ তাকে এড়াতে পারে না।
কোনদিন পারবেও না। তবু কিছু কিছু মৃত্যু আছে যা মেনে নেয়া যায় না। মনে হয় এ মৃত্যুটি না হলেই ভাল হতো। সাংবাদিকতা, প্রগতিশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতি অঙ্গনে কে. জি. মুস্তাফা ছিলেন বিশাল অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আমাদের প্রজন্মের কাছে ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এবং কে. জি. ভাইদের দেখেই সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলাম এবং এখনও আছি। আমার মতো আমাদের প্রজন্মের আরও অনেকে। বস্তুত কে. জি. ভাইদের মতো মানুষদের দেখে যেমন আত্মশক্তি পেয়েছি এবং জীবনের কোন পরাজয়কে পরাভব মনে করিনি, আজও করছি না।
গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছি মধ্য ষাটে। লক্ষ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দু'একখানা সার্টিফিকেট যোগাড় করতে পারলে চাকরিবাকরির ব্যবস্থা যেমন হবে, তেমনি সমাজের উঁচু তলায় উঠতে পারব। তা ছাড়া আমি চাঁদপুরের যে গ্রাম থেকে এসেছি সেটি নিহায়তই অজপাড়াগাঁ। চাঁদপুর শহরে আসতে হলে সুদিনে অন্তত তিন মাইল হেঁটে ট্রেন ধরতে হতো। বছরের ৬ মাস বর্ষা থাকত (তখন চাঁদপুর সেচ প্রকল্প হয়নি) এবং নৌকা ছাড়া কোন বিকল্প ছিল না। সেই গাঁয়ের ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি_ ভেতরে ভেতরে একটা অহংবোধ কাজ করছিল। কিন্তু যখন রাজনীতি, সাংবাদিকতা, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্যের কিংবদন্তিতুল্য মানুষদের দেখলাম, তখনই জীবনের সত্যিকার মানে বুঝতে লাগলাম।
ষাটের দশকে সাংবাদিকতা জগতে আবদুস সালাম, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, শহীদ সিরাজউদ্দিন হোসেন, কে. জি. মুস্তাফা, আসফ-উদ-দৌলা, এবিএম মূসা, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, এমআর আখতার মুকুল, ফয়েজ আহমেদ, বাহাউদ্দীন চৌধুরী, তোয়াব খান, সন্তোষ গুপ্ত, নির্মল সেন প্রমুখকে দূর থেকে চিনতে শুরু করি। এঁরা সবাই আবার বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের মানুষ ছিলেন। প্রথম তিনজনকে, অর্থাৎ আবদুস সালাম, মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু ভাই বলে ডাকতেন, বাকিদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তুই তুমির। এঁদের মধ্যে আবার কে. জি. মুস্তাফা, সিরাজউদ্দিন হোসেন, আসফ-উদ-দৌলা বঙ্গবন্ধুর ক্লাসমেট ছিলেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। সে সম্পর্কটি বঙ্গবন্ধু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রক্ষা করে চলেছেন।
কে. জি. ভাইর সঙ্গে খুব বেশি যে মিশতে পেরেছি তা নয়। যে ক'দিন মিশেছি মুগ্ধ হয়েছি। তা ছাড়া যেদিন জানলাম কে. জি. ভাই বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ সেদিন তাঁকে আরও বেশি আপন মনে হলো। সরাসরি তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল '৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। আমি তখন জাতীয় প্রেসকাবের সাধারণ সম্পাদক। কে. জি. ভাই ইরাক থেকে দেশে ফিরে এলেন এবং তাঁর প্রেসকাব সদস্যপদ পুনরুজ্জীবনের জন্য আমাকে টেলিফোন করলেন। আমি বললাম আপনার বাসার ঠিকানাটা দিন, আমি এসে দরখাস্তটা নিয়ে নেব, আপনার আসার দরকার পড়বে না। কিন্তু কে. জি. ভাই কিছুতেই বাসার ঠিকানা দিলেন না। নিজেই চলে এলেন। মাথাভর্তি ধবধবে সাদা চুল, সৌম্যকান্তির একজন মানুষ, যাঁকে দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে। কে. জি. ভাই নিজে এসে সদস্যপদ পুনরুজ্জীবিত করে গেলেন। আমাকে বার বারই 'আপনি' বলছিলেন। আমি যত অনুরোধ করেছি কিন্তু কে. জি. ভাই আপনি থেকে তুমিতে নামেননি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
কে. জি. ভাই ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে সাংবাদিকতা জীবন পর্যন্ত পাকিস্তানী শাসকদের রোষানলে ছিলেন এবং বার বার গ্রেফতার হয়েছেন। হুলিয়া মাথায় নিয়ে বেড়িয়েছেন; কিন্তু একটি মুহূর্তের জন্যও আদর্শচ্যুত হননি। এর কারণ একদিকে ছিল বামপন্থী রাজনীতির যোগ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সর্বোপরি তৎকালীন পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান। এসবই তৎকালীন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর ভাল লাগেনি।
আমাদের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত পছন্দে ইরাকে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সে দায়িত্ব পালন থেকে সরে ইরাকেই সাংবাদিকতা করেন বেশ কিছুদিন। দেশে ফিরে এসে আবার লেখালেখি শুরু করেন। দৈনিক আজাদ, সংবাদ, অবজারভার এবং ইরাকের একটি পত্রিকার (নাম জানা নেই) অভিজ্ঞতা ও সাংবাদিকতার প্রতি নিষ্ঠা, পাণ্ডিত্য এবং তথ্যবহুল লেখাগুলো অল্প দিনেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শেষবারের মতো মুক্তকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ পত্রিকাটি একটি রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে বের হয় এবং এ কারণে পত্রিকাটির নিয়োগ যথাযথ না হওয়ায় কে. জি. ভাই ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেয়েছিলেন। তবু ক্লান্ত হননি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাংবাদিকতা করে গেছেন। শেষবার অসুস্থ হবার আগ পর্যন্ত দৈনিক জনকণ্ঠে কে. জি. ভাইর কলামটি ছিল আমাদের অর্ধশতাব্দীর ঘটনাবহুল ইতিহাস। যার ওপর গবেষণা করা যায়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ'-এর নামে আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী ধারায় দেশকে নিয়ে যাবার যে চক্রান্ত শুরু করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান, তখন আমরা যারা বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করি, এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাধ্য হই। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পৰের ফোরাম গঠন করি। সে সময় যে ক'জন মুরবি্ব আমাদের বুদ্ধি, পরামর্শ এবং নৈতিক শক্তি যুগিয়েছেন কে. জি. ভাই তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কে. জি. ভাই ছাড়াও এবিএম মূসা, ফয়েজ আহমদ, এমআর আখতার মুকুল, বজলুর রহমান, সন্তোষ গুপ্ত প্রমুখ আমাদের সহযোগিতা দিয়েছেন; এবং আমরা জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসনের মধ্যেও একটি শক্তিশালী ফোরাম হিসেবে স্বাধীনতার পৰে কাজ করেছি। কাউকে তোয়াক্কা করতে হয়নি।
মুকুল ভাই, বজলুর রহমান, সন্তোষ গুপ্ত আগেই চলে গেছেন। শুক্রবার চলে গেলেন কে. জি. ভাই। আমাদের নৈতিক ও আদর্শিক শক্তি যোগানোর মানুষগুলো একে একে চলে যাচ্ছেন। আমরাও যাব একদিন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বললে বলতে হয় : "সবচেয়ে পুরাতন কথা, সবচেয়ে গভীর ক্রন্দন 'যেতে নাহি দিব / হায়, তবু যেতে দিতে হয়' তবু চলে যায়।"
আল্লাহ পাকের দরবারে তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করি।
ঢাকা-১৫.০৩.১০
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.