জীবন্ত ইতিহাস কে.জি. by মুস্তাফা আতাউস সামাদ
সবার প্রিয় ও বিখ্যাত সাংবাদিক কে.জি.
মুস্তাফা ছিলেন মূলত একজন রাজনৈতিক মানুষ। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন
তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক।
সংবাদের তখন
দৈন্যদশা চলছিল। সে সময়ে ঐ প্রতিষ্ঠানে যাঁরা কাজ করতেন তাঁরা হয় বামপন্থী
রাজনীতির টানে না হয় বেকার অপবাদ ঘোচাবার জন্য তা করতেন বলে আমার বিশ্বাস।
দৈনিক পত্রিকায় আমার প্রথম চাকরি সংবাদে। আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল আমাদের
বন্ধু দেওয়ান আব্দুর রশীদ, আমারই পীড়াপীড়িতে। তখন আমার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত
পিতাকে আশ্বস্ত করার প্রয়োজন ছিল যে, আমারও চাকরি পাওয়া সম্ভব। কে.জি.
মুস্তফা সাহেব ও আমরা নয়া পল্টনে কাছাকাছি দুটো বাড়িতে থাকতাম। তিনি প্রথমে
বিশ্বাস করতে চাননি যে, আমি সত্যিসত্যিই খবরের কাগজে কাজ করতে চাই। কিন্তু
আমি নাছোড়বান্দা হয়ে বসে থাকায় তিনি প্রশ্ন করলেন, চাকরি পাবার দু'মাস পর
বেতন দেয়া হবে, তাও ভেঙ্গে ভেঙ্গে সে শর্তে আমি কাজ করতে রাজি কিনা। আমি
মরিয়া। তাই বললাম, রাজি। তখন তিনি আমাকে টেস্ট দিতে বললেন। পরীৰা নিলেন
তারা ভাই (জনাব ফওজুল করিম)। নামকা ওয়াস্তে একটা খবর_পাকিস্তানের সামরিক
শাসক ও প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান রাওয়ালপিন্ডি থেকে পেশোয়ার
সফরে যাবেন বার্তা সংস্থার পাঠানো ইংরেজীতে দু-তিন প্যারাগ্রাফের একটা
আইটেম_ অনুবাদ করতে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সুপারিশে কে.জি. মুস্তাফা সাহেব
আমাকে শিৰানবিসের চাকরি দিলেন। ওখানে কাজ করার সময়ই জানলাম, পত্রিকার মালিক
জনাব আহমেদুল কবির ও সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী দু'জনই বামপন্থী। এখানে
আরও আছেন সুপরিচিত কমিউনিস্ট রণেশ মিত্র। তিনি সম্পাদকীয় লিখতেন। তবে
সংবাদপত্র জগতের বাইরেও তাঁর সুনাম ছিল বিখ্যাত কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের
উর্দু কবিতা বাংলায় অনুবাদ করার জন্য। তখনই শুনলাম যে কে.জি. মুস্তাফা
সাহেবও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। আর ঐ দলটি তখন নিষিদ্ধ থাকায় কমিউনিস্টদের
আইয়ুবের পুলিশ ঘনঘন জেলে ঢোকাত। কে.জি. মুস্তাফা সাহেব তাঁর ব্যতিক্রম
ছিলেন না। এভাবে তাঁর জীবন 'অস্থিতিশীল' হওয়ায় প্রায়ই সংসারের হাল ধরতে হতো
তাঁর স্ত্রী আমাদের সাবেরা আপাকে। তিনি সে সময় সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে
শিক্ষকতা করতেন। আমার বোন জাহানারা হক তাঁর সহকর্মী ছিলেন। আমার স্ত্রীও
তাঁর ছাত্রী ছিলেন। সাবেরা আপা রেডিও এবং মঞ্চে অভিনয় করতেন। কে.জি.
মুস্তাফা সাহেবের সংগ্রামী জীবনের কারণে সাবেরা আপাকেও সংগ্রাম করতে হয়েছে
অনেক। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় কে.জি. মুস্তাফা
সাহেবকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে। তখন একবার আমাদের বন্ধু হলিডে পত্রিকার
নির্বাহী সম্পাদক আসলামের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। একটানা কারফিউর
দরুন তিনদিন ও দুই রাত একসঙ্গে ছিলাম আমরা। শেষ দিকে ঘরে খাবার ছিল না।
কে.জি. মুস্তাফা সাহেব ততদিনে আমারও 'কে.জি. ভাই' হয়ে গিয়েছিলেন। যুদ্ধের
মধ্যে কে.জি. ভাইয়ের সঙ্গে আমার যখন দেখা হয় তখন তিনি একটা বুক বাইন্ডিং
কারখানার ম্যানেজার_এই মর্মে প্রত্যায়িত আইডেন্টিটি কার্ড নিয়ে চলাফেরা
করতেন।
কে.জি. ভাই সংবাদে থাকতে থাকতেই একবার গ্রেফতার হলেন। তিনি মুক্তি পাবার পর মূসা ভাই (জনাব এবিএম মূসা) তাঁকে তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় নিয়ে আসেন। মূসা ভাই ছিলেন অবজারভারের বার্তা সম্পাদক। জনাব আব্দুস সালাম সম্পাদক এবং জনাব হামিদুল হক চৌধুরী মালিক। এঁদের সবারই নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ ছিল। কারও সঙ্গে অন্যের রাজনীতির মিল ছিল না। তবে মূসা ভাই ও কে.জি. ভাই দু'জনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভক্ত ছিলেন। ষাটের দশকের প্রথম দিকে মূসা ভাইয়ের নেতৃত্বে অবজারভার পত্রিকা কী খবর পরিবেশনায় কী মুদ্রণ শৈলীতে আধুনিকতার পথে চলছিল। সে সময় যাঁদের সহযোগিতা তাঁর খুবই কাজে লেগেছিল তাদের মধ্যে কে.জি. ভাই অন্যতম। কে.জি. ভাই ছিলেন অবজারভারের চীফ সাব এডিটর। দায়িত্ব ও ক্ষমতার দিক থেকে বার্তা সম্পাদকের পরই তাঁর স্থান। পাকিস্তানের সরকার বিরোধী পত্রিকাগুলোর মধ্যে অবজারভার প্রথম কাতারের হওয়ায় মূসা ভাই ও কে.জি. ভাই ঝুঁকির মধ্যে থাকতেন। অবজারভারের সব 'অপকীর্তির' নন্দ ঘোষ ছিলেন তাঁরা। যেন, অবাজারভারের খবরের পাতাগুলোতে সরকারের কুকর্মের যত খবর বের হতো তার সবটাই হতো তাঁদের নির্দেশে।
কে.জি. ভাই, মূসা ভাই, ইত্তেফাকের সিরাজ ভাই (শহীদ সিরাজউদ্দিন হোসেন), প্রয়াত সিরাজুল হোসেন খান, শহীদুল্লাহ ভাই (শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার), প্রয়াত মোজাম্মেল হক ও শহীদ খোন্দকার আবু তালেব, নির্মল সেন এঁরা তখন আরেক রকম সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিলেন সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা হিসেবে। এ সংগ্রামের অর্ধেকটা ছিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য কারণ পাকিস্তানের সেনা শাসক আইয়ুব খান ও তার অনুগত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর মোনেম খান প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স নামে একটি কালাকানুন ও জননিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে সত্য খবর না ছাপতে ও মিথ্যা সরকারী ভাষ্য প্রকাশ করতে বাধ্য করতেন। তাঁরা বিভিন্ন পত্রিকাকে জরিমানা করেছিলেন ও ইত্তেফাক বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ সময় সাংবাদিক ইউনিয়ন যে রাজপথের আন্দোলন করে তাতে সকলকে সম্পৃক্ত করতে সৰম হয়। এমন কী দৈনিক আজাদ পত্রিকার মালিক বৃদ্ধ মৌলানা আকরম খানও একটি প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেন (তাঁর জন্য একটি মোটর গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল)। সাংবাদিকদের বাকি অর্ধেকটা সংগ্রাম ছিল চাকরি নিশ্চয়তা বিধান ও বেতন বোর্ডের মাধ্যমে ন্যায্য বেতন-ভাতা পাবার ব্যবস্থা করার জন্য। ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সকল সাংবাদিক মিলে পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন গঠন করেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে কে.জি. ভাই এই ইউনিয়নের সেক্রেটারি জেনারেল হন। তারপর হন এই ফেডারেল ইউনিয়নের সভাপতি। তিনি ঐ দ্বিতীয় পদটিতে থাকার সময় ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে, অন্তর্বর্তীকালীন ভাতার দাবিতে পাকিস্তান জুড়ে সাংবাদিকরা ধর্মঘট করে। কে.জি. ভাই ছিলেন এই আন্দোলনের নেতা।
তবে শুরুতেই যে মন্তব্য করেছিলাম, অর্থাৎ কে.জি. ভাই ছিলেন মূলত একজন রাজনৈতিক মানুষ, ফিরে আসি সেই বিষয়টিতে। অফিসে তিনি পেশাদার সাংবাদিক কিন্তু কাজের সময়টা বাদ দিয়ে বাকি সময়টা তাঁর কাটতো রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তাভাবনায়। বহু খবরের মধ্যে থেকে গুরুত্বপূর্ণগুলো তিনি বাছাই করতে পারতেন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। বাছাই করা খবরগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মানদণ্ডে বা প্রেক্ষিতে যেগুলো জরুরী বিবেচনা করতেন সেগুলোকে প্রাধান্য দিতেন কাগজের পাতায়। আমি অবজারভারে রিপোর্টার হিসেবে তাঁর অধীনে বহু বছর কাজ করেছি। আমি কোন দলের সদস্য ছিলাম না, আজও নই, কিন্তু কে.জি. ভাই ও মূসা ভাইয়ের কাজ দেখে ও তাঁদের সঙ্গে কাজ করে রাজনীতির অনেক কিছু শিখেছি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যকরী পরিষদের সদস্য, যুগ্ম সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করার সময়ও দেখেছি আমাদের বৈঠকগুলোতে তৎকালীন রাজনীতির যে মূল্যায়ন করতে হতো তখন কে.জি. ভাইয়ের তীক্ষ বিশ্লেষণ আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করত। শহীদুল্লাহ কায়সার ভাই পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে প্রতিটি বৈঠকে কে.জি. ভাই, মূসা ভাই ও সিরাজ ভাইকে হাজির রাখতেন এবং অবধারিতভাবে সবার কথা শেষ হলে কে.জি. ভাইকে আহ্বান করতেন, 'এবার তুমি বলো।'
১৯৭০-এর নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ, কিন্তু এই সব ক'টি আসনই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। আর জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেল তাঁর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। কে.জি. ভাই তখন বললেন, যেহেতু পাকিস্তানে তখন সেনা শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন চলছে সে তার শাসনকর্তার আসন ধরে রাখার জন্য এদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবে। তাই তিনি স্বনামধন্য সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খানের ইংরেজী সাপ্তাহিক পত্রিকা হলিডে-তে লিখলেন, Mujib and Bhutto should unite to get military rule withdrawn now. (সামরিক শাসন এখনই প্রত্যাহার করিয়ে নেয়ার জন্য মুজিব ও ভুট্টোর একতাবদ্ধ হওয়া উচিত।) লেখাটি হলিডের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রধান নিবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল বলে মনে পড়ছে। সম্ভবত এর শিরোনামও ছিল, Mujib and bhutto unite to defeat martial law সামরিক আইনের শাসনকে পরাজিত করার জন্য মুজিব-ভুট্টো এক হও।) বাস্তবে তাঁর ইচ্ছা পূরণ হলো না কিন্তু তাঁর বিশ্লেষণ যে ঠিক ছিল অর্থাৎ মুজিব-ভুট্টো ঐক্য না হওয়ায় পাকিস্তান থেকে সামরিক শাসন উঠল না তাও সত্য প্রমাণিত হয়েছিল।
১৯৭০-এর মার্চ মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলার সময় প্রথমে ইয়াহিয়া খান এলেন আলোচনার নাটক করতে। তারপর এলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। পরিস্থিতি বোঝার জন্য এই ভুট্টো সাহেব বাঙালীদের অনেকের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন। সাংবাদিক নেতা হিসেবে তিনি কে.জি. ভাইকেও ডেকেছিলেন। সেই আলোচনায় তিনি ভূট্টোকে বলেছিলেন, If you cannot accept Sheikh Mujib’s 6-point demand then please agree to the peaceful partition of Pakistan. (আপনি যদি শেখ মুজিবের ছয় দফা দাবি মেনে নিতে না পারেন তাহলে শান্তিপূর্ণভাবে পাকিস্তানের বিভক্তি মেনে নিন।' উত্তরে ভুট্টো বলেছিলেন, 'আপনি উন্মাদ হয়ে গেছেন।' ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় কে.জি. ভাই সৎ পরামর্শ দিয়েছিলেন কিন্তু ভুট্টো-ইয়াহিয়া সেসব কথা শুনতে রাজি না হওয়ায় ঠিকই পাকিস্তান ভাগ হলো, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হলো তবে তা এক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে।
কে.জি. ভাই চিরকালের জন্য চলে গেলেন। আমরা জীবন্ত ইতিহাস হারালাম। এখানে উল্লেখ করি যে, কে.জি. ভাই একজন সাংবাদিক নেতা হিসেবে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সফর করেছিলেন এবং তিনি প্রথমে লেবাননে ও পরে ইরাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে রক্তাক্ত মধ্যপ্রাচ্যকেও খুব কাছে থেকে দেখেছিলেন। কে.জি. ভাইকে ভক্তিভরে স্মরণ করি এবং আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তাঁর সঙ্গে আজ তাঁর অগ্রজ খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসকে শ্রদ্ধা সহকারে স্মরণ করি।
তিনি 'ভাসানী যখন ইউরোপে' নামক বিখ্যাত গ্রন্থের লেখক। বইটি আছে ও আশা করি থাকবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তিনি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সিঁড়ির নিচে যে চমৎকার বইয়ের দোকান দিয়েছিলেন সেটি আজ আর নেই। তিনি দোকানটার নাম দিয়েছিলেন Papyrus (প্যাপিরাস)।
কে.জি. ভাই ও সাবেরা আপার পুত্র সাবির মুস্তাফা বর্তমানে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস রেডিও'র বাংলা বিভাগের সম্পাদক। আশা করি তিনিও সাংবাদিক হিসেবে পিতার মতোই সফল হবেন।
কে.জি. ভাই সংবাদে থাকতে থাকতেই একবার গ্রেফতার হলেন। তিনি মুক্তি পাবার পর মূসা ভাই (জনাব এবিএম মূসা) তাঁকে তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় নিয়ে আসেন। মূসা ভাই ছিলেন অবজারভারের বার্তা সম্পাদক। জনাব আব্দুস সালাম সম্পাদক এবং জনাব হামিদুল হক চৌধুরী মালিক। এঁদের সবারই নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ ছিল। কারও সঙ্গে অন্যের রাজনীতির মিল ছিল না। তবে মূসা ভাই ও কে.জি. ভাই দু'জনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভক্ত ছিলেন। ষাটের দশকের প্রথম দিকে মূসা ভাইয়ের নেতৃত্বে অবজারভার পত্রিকা কী খবর পরিবেশনায় কী মুদ্রণ শৈলীতে আধুনিকতার পথে চলছিল। সে সময় যাঁদের সহযোগিতা তাঁর খুবই কাজে লেগেছিল তাদের মধ্যে কে.জি. ভাই অন্যতম। কে.জি. ভাই ছিলেন অবজারভারের চীফ সাব এডিটর। দায়িত্ব ও ক্ষমতার দিক থেকে বার্তা সম্পাদকের পরই তাঁর স্থান। পাকিস্তানের সরকার বিরোধী পত্রিকাগুলোর মধ্যে অবজারভার প্রথম কাতারের হওয়ায় মূসা ভাই ও কে.জি. ভাই ঝুঁকির মধ্যে থাকতেন। অবজারভারের সব 'অপকীর্তির' নন্দ ঘোষ ছিলেন তাঁরা। যেন, অবাজারভারের খবরের পাতাগুলোতে সরকারের কুকর্মের যত খবর বের হতো তার সবটাই হতো তাঁদের নির্দেশে।
কে.জি. ভাই, মূসা ভাই, ইত্তেফাকের সিরাজ ভাই (শহীদ সিরাজউদ্দিন হোসেন), প্রয়াত সিরাজুল হোসেন খান, শহীদুল্লাহ ভাই (শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার), প্রয়াত মোজাম্মেল হক ও শহীদ খোন্দকার আবু তালেব, নির্মল সেন এঁরা তখন আরেক রকম সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিলেন সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা হিসেবে। এ সংগ্রামের অর্ধেকটা ছিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য কারণ পাকিস্তানের সেনা শাসক আইয়ুব খান ও তার অনুগত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর মোনেম খান প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স নামে একটি কালাকানুন ও জননিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে সত্য খবর না ছাপতে ও মিথ্যা সরকারী ভাষ্য প্রকাশ করতে বাধ্য করতেন। তাঁরা বিভিন্ন পত্রিকাকে জরিমানা করেছিলেন ও ইত্তেফাক বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ সময় সাংবাদিক ইউনিয়ন যে রাজপথের আন্দোলন করে তাতে সকলকে সম্পৃক্ত করতে সৰম হয়। এমন কী দৈনিক আজাদ পত্রিকার মালিক বৃদ্ধ মৌলানা আকরম খানও একটি প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেন (তাঁর জন্য একটি মোটর গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল)। সাংবাদিকদের বাকি অর্ধেকটা সংগ্রাম ছিল চাকরি নিশ্চয়তা বিধান ও বেতন বোর্ডের মাধ্যমে ন্যায্য বেতন-ভাতা পাবার ব্যবস্থা করার জন্য। ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সকল সাংবাদিক মিলে পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন গঠন করেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে কে.জি. ভাই এই ইউনিয়নের সেক্রেটারি জেনারেল হন। তারপর হন এই ফেডারেল ইউনিয়নের সভাপতি। তিনি ঐ দ্বিতীয় পদটিতে থাকার সময় ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে, অন্তর্বর্তীকালীন ভাতার দাবিতে পাকিস্তান জুড়ে সাংবাদিকরা ধর্মঘট করে। কে.জি. ভাই ছিলেন এই আন্দোলনের নেতা।
তবে শুরুতেই যে মন্তব্য করেছিলাম, অর্থাৎ কে.জি. ভাই ছিলেন মূলত একজন রাজনৈতিক মানুষ, ফিরে আসি সেই বিষয়টিতে। অফিসে তিনি পেশাদার সাংবাদিক কিন্তু কাজের সময়টা বাদ দিয়ে বাকি সময়টা তাঁর কাটতো রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তাভাবনায়। বহু খবরের মধ্যে থেকে গুরুত্বপূর্ণগুলো তিনি বাছাই করতে পারতেন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। বাছাই করা খবরগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মানদণ্ডে বা প্রেক্ষিতে যেগুলো জরুরী বিবেচনা করতেন সেগুলোকে প্রাধান্য দিতেন কাগজের পাতায়। আমি অবজারভারে রিপোর্টার হিসেবে তাঁর অধীনে বহু বছর কাজ করেছি। আমি কোন দলের সদস্য ছিলাম না, আজও নই, কিন্তু কে.জি. ভাই ও মূসা ভাইয়ের কাজ দেখে ও তাঁদের সঙ্গে কাজ করে রাজনীতির অনেক কিছু শিখেছি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যকরী পরিষদের সদস্য, যুগ্ম সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করার সময়ও দেখেছি আমাদের বৈঠকগুলোতে তৎকালীন রাজনীতির যে মূল্যায়ন করতে হতো তখন কে.জি. ভাইয়ের তীক্ষ বিশ্লেষণ আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করত। শহীদুল্লাহ কায়সার ভাই পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে প্রতিটি বৈঠকে কে.জি. ভাই, মূসা ভাই ও সিরাজ ভাইকে হাজির রাখতেন এবং অবধারিতভাবে সবার কথা শেষ হলে কে.জি. ভাইকে আহ্বান করতেন, 'এবার তুমি বলো।'
১৯৭০-এর নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ, কিন্তু এই সব ক'টি আসনই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। আর জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেল তাঁর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। কে.জি. ভাই তখন বললেন, যেহেতু পাকিস্তানে তখন সেনা শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন চলছে সে তার শাসনকর্তার আসন ধরে রাখার জন্য এদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবে। তাই তিনি স্বনামধন্য সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খানের ইংরেজী সাপ্তাহিক পত্রিকা হলিডে-তে লিখলেন, Mujib and Bhutto should unite to get military rule withdrawn now. (সামরিক শাসন এখনই প্রত্যাহার করিয়ে নেয়ার জন্য মুজিব ও ভুট্টোর একতাবদ্ধ হওয়া উচিত।) লেখাটি হলিডের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রধান নিবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল বলে মনে পড়ছে। সম্ভবত এর শিরোনামও ছিল, Mujib and bhutto unite to defeat martial law সামরিক আইনের শাসনকে পরাজিত করার জন্য মুজিব-ভুট্টো এক হও।) বাস্তবে তাঁর ইচ্ছা পূরণ হলো না কিন্তু তাঁর বিশ্লেষণ যে ঠিক ছিল অর্থাৎ মুজিব-ভুট্টো ঐক্য না হওয়ায় পাকিস্তান থেকে সামরিক শাসন উঠল না তাও সত্য প্রমাণিত হয়েছিল।
১৯৭০-এর মার্চ মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলার সময় প্রথমে ইয়াহিয়া খান এলেন আলোচনার নাটক করতে। তারপর এলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। পরিস্থিতি বোঝার জন্য এই ভুট্টো সাহেব বাঙালীদের অনেকের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন। সাংবাদিক নেতা হিসেবে তিনি কে.জি. ভাইকেও ডেকেছিলেন। সেই আলোচনায় তিনি ভূট্টোকে বলেছিলেন, If you cannot accept Sheikh Mujib’s 6-point demand then please agree to the peaceful partition of Pakistan. (আপনি যদি শেখ মুজিবের ছয় দফা দাবি মেনে নিতে না পারেন তাহলে শান্তিপূর্ণভাবে পাকিস্তানের বিভক্তি মেনে নিন।' উত্তরে ভুট্টো বলেছিলেন, 'আপনি উন্মাদ হয়ে গেছেন।' ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় কে.জি. ভাই সৎ পরামর্শ দিয়েছিলেন কিন্তু ভুট্টো-ইয়াহিয়া সেসব কথা শুনতে রাজি না হওয়ায় ঠিকই পাকিস্তান ভাগ হলো, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হলো তবে তা এক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে।
কে.জি. ভাই চিরকালের জন্য চলে গেলেন। আমরা জীবন্ত ইতিহাস হারালাম। এখানে উল্লেখ করি যে, কে.জি. ভাই একজন সাংবাদিক নেতা হিসেবে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সফর করেছিলেন এবং তিনি প্রথমে লেবাননে ও পরে ইরাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে রক্তাক্ত মধ্যপ্রাচ্যকেও খুব কাছে থেকে দেখেছিলেন। কে.জি. ভাইকে ভক্তিভরে স্মরণ করি এবং আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তাঁর সঙ্গে আজ তাঁর অগ্রজ খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসকে শ্রদ্ধা সহকারে স্মরণ করি।
তিনি 'ভাসানী যখন ইউরোপে' নামক বিখ্যাত গ্রন্থের লেখক। বইটি আছে ও আশা করি থাকবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তিনি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সিঁড়ির নিচে যে চমৎকার বইয়ের দোকান দিয়েছিলেন সেটি আজ আর নেই। তিনি দোকানটার নাম দিয়েছিলেন Papyrus (প্যাপিরাস)।
কে.জি. ভাই ও সাবেরা আপার পুত্র সাবির মুস্তাফা বর্তমানে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস রেডিও'র বাংলা বিভাগের সম্পাদক। আশা করি তিনিও সাংবাদিক হিসেবে পিতার মতোই সফল হবেন।
No comments