কাশবন আমার মা, অস্তিম গন্তব্য_ সবুজের মাঝে মেঠোপথ- নির্মলেন্দু গুণের পৈত্রিক বাড়ি এখন 'ডিজিটাল গ্রাম'

'আমার একটি ছোট্ট সুন্দর গ্রাম ছিল। তার নামটিও ছিল ভারি সুন্দর_ কাশতলা। হয়তো এক সময় কাশফুলের খুব প্রাচুর্য ছিল ঐ গ্রামে। আমি কবিত্ব করে তার নাম পাল্টে রেখেছিলাম কাশবন, ভালবেসে প্রেমিক যেমন তার প্রেমিকার নাম পাল্টে রাখে।
সেই আমার প্রথম কবিতা...।' নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণের এক গ্রাম কাশতলা। আর দশটি গ্রামের মতোই শান্ত, সুনিবিড়, ছায়াঢাকা, পাখি ডাকা। জন্মের অধিকার নিয়ে, মাতৃবৎ ভালবেসে কবি নির্মলেন্দু গুণ পাল্টে দিয়েছেন তাঁর গ্রামের নাম। কাশতলার পরিচয় এখন 'কাশবন'। শুধু কবিই নন, কবির গ্রামবাসীও নিজেদের 'কাশবন' এর বাসিন্দা হিসাবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। এর মধ্য দিয়ে কবির কবিত্বকেও সম্মান জানান তারা।
কবির মা কবিকে 'জন্ম দিয়ে মরে গিয়েছিলেন মাকড়সার মতো'। মাকে ছাড়াই কবি কাশবনে কাটিয়েছেন তাঁর শৈশব-কৈশোরের ষোলটি বছর। তাই কাশবনই কবির মা। মাকে যেমন ভালবাসে সন্তানেরা, কবিও কাশবনকে ভালবাসেন তেমন করে। নাগরিক কোলাহল ছেড়ে প্রায়ই চলে আসেন মায়ের কাছে, নাড়ির টানে। কবির ভাষায় 'কাশবনই আমার অনত্মিম গনত্মব্য'। কাশবনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন কবি নির্মলেন্দু গুণের। এর বাস্তবায়নও শুরু করেছেন তিনি। স্বৈরশাসনের পর ১৯৯১ সালে 'কুমির প্রতীক' নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন কবি। কিন্তু হেরে যান দুর্ভাগ্যক্রমে (কবির ভাষা বিপুল বিক্রমে)। সেবার এলাকার জন্য একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন তিনি। নির্বাচনে হারলে প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যান সবাই। কিন্তু নির্মলেন্দু গুণ ভোলেননি। কারণ কবি না জিতলেও অনেকেই তাকে ভোট দিয়েছিল। তাই নির্বাচনের পরপরই নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন 'কাশবন বিদ্যানিকেতন'। শান্তিনিকেতনের অনুকরণে রাখা হয় এর নাম। বর্তমানে বারহাট্টা উপজেলার একটি অন্যতম প্রধান উচ্চ বিদ্যালয় এটি। কবি জানান, অতীতে সেখানে একটি মিডল ইংলিশ স্কুল ছিল। কবির ঠাকুরদাদা স্বর্গীয় রামসুন্দর গুণ ছিলেন এর প্রতিষ্ঠা। এরপর পঞ্চাশের দশকে ঝড়ে স্কুলঘরটি বিধ্বস্ত হলে কিছুদিন কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ষাটের দশকে কবির পিতা সুখেন্দু গুণ, যোগীশাসন গ্রামের হরেন্দ্র সরকার ও যশমাধব গ্রামের রফিজ খান প্রমুখ ঘরটি মেরামত করে আবার নবোদ্যমে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। কবি নিজেও কিছুদিন অবৈতনিক শিক ছিলেন সেটির। কিন্তু একসময় তাও বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যালয়টি পুনপ্রতিষ্ঠা করে কবি তাঁর পরিবারের উত্তরাধিকারের দায় কিছুটা হলেও বহন করতে পেরেছেন।
কিন্তু শুধু বিদ্যালয় দিয়েই কি হয়? শিক্ষার আলো ছড়াতে চাই সমৃদ্ধ পাঠাগার। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে চাই কম্পিউটার, ইন্টারনেটসহ আরও অনেক কিছু। তাই কাশবন বিদ্যানিকেতনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসাবে কবি গত বছর বিদ্যালয় সংলগ্ন নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার। নাম রেখেছেন ঠাকুরদাদার নামে_ 'রামসুন্দর পাঠাগার'। নির্মলেন্দু গুণ জানান, গত বছর পাওয়া 'জেমকন সাহিত্য পুরস্কার'-এর দু'লাখ টাকার পুরোটাই ব্যয় করেছেন স্বপ্নের পাঠাগারটির জন্য। ২৫ ফুট বাই ২২ ফুট জায়গার ওপর আধাপাকা-টিনশেড ঘরটিতে এখন শোভা পাচ্ছে দু'হাজারের ওপর বই। এছাড়া পাঠাগারের দেয়ালের শোভা বর্ধন করছে নির্মলেন্দু গুণের আঁকা ছবি 'মোনালিসা' ও 'রঙের জাতক'। সম্প্রতি এ দুটিসহ বেশ কিছু ছবি নিয়ে ঢাকায় একক চিত্রপ্রদর্শনী করেছিলেন কবি। রামসুন্দর পাঠাগারে আরও রয়েছে বিভিন্ন সময়ে কবির পাওয়া অসংখ্য পুরস্কারের ক্রেস্ট, সনদ ও দুর্লভ মুহূর্তের ছবি। প্রবেশ দরজার একপাশে রেখেছেন রামসুন্দর গুণের মু্যরাল। সম্প্রতি বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সহযোগিতায় পাঠাগারে স্থাপন করা হয়েছে ইন্টারনেট সংযোগসহ একটি কম্পিউটার। ফলে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে পাঠাগারটির কার্যক্রম।
কাশবন বিদ্যানিকেতনের শিার্থীরা পাঠাগারের বই নিয়ে পড়ছে। এলাকার তরুণ-তরুণীরা প্রতিদিন বই পড়ার পাশাপাশি কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে সেখানে। বলা যায়_ কবি নির্মলেন্দু গুণের কাশবন এখন 'ডিজিটাল গ্রাম'। কবির চেষ্টা এবং আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে কাশবন জড়িয়ে গেছে গোটা বিশ্বের আন্তজালে।
বিদ্যালয় ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠার পর পাঠাগারের সামনে একটি পুকুর কেটেছেন কবি। শীঘ্রই সেখানে শান বাঁধানো ঘাট নির্মাণ করা হবে। পুকুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঠোপথ। দু'পাশে সবুজ ফসলের মাঠ। মাঝে মধ্যেই নগরের ব্যসত্মতা ছেড়ে সেখানে ছুটে যান কবি।

No comments

Powered by Blogger.