হিলারি-দীপু মনি বৈঠক ও সর্বনাশা টিফা চুক্তি -পররাষ্ট্রনীতি by ফরিদা আখতার
এই লেখা যখন লিখছি, তখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন। তিনি খুব ব্যস্ত। ঈদের আগেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পত্রিকার ছবিতে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ ও পৃথিবীর অন্যতম গরিব দেশের দুই নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাশাপাশি দেখে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। মনে হলো, এটা যেন খুবই কাঙ্ক্ষিত। দুজনেরই উত্থানের পেছনে নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের অবদান আছে, কারণ তাঁরা উচ্চপর্যায়ে নারীদের প্রতিনিধিত্ব চেয়েছেন। সমতার ক্ষেত্রে এটা একটা জরুরি শর্ত বটে। কিন্তু তাঁরা বর্তমানে নারীদের নয়, নিজ নিজ দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং সেটা করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে। একজন পুরুষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলে যা করতেন, তা-ই করছেন। আমাদের শুধু একটু বাড়তি প্রত্যাশা, নিজ দেশের স্বার্থ দেখার বিষয়টিতে নিজেকে ‘নারী’ হিসেবে উচ্চপর্যায়ে পৌঁছানোর পেছনে কোটি কোটি মানুষ যে সমর্থন দিয়েছে, তাদের কথা যেন মনে থাকে। তাদের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে কোনো আপস করা যাবে না।
আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দীপু মনির সফরের কথা পড়েছি। হিলারির সঙ্গে দীপু মনির বৈঠকে হিলারি বাংলাদেশের সম্মান রক্ষা করেছেন বলে মনে হয় না। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার করবেন বলে সংবাদ সম্মেলনে বললেন। ভালো কথা, কিন্তু কীভাবে সেটা হবে তার কোনো সদুত্তর নেই। বৈঠক হয়েছে মাত্র ৪৫ মিনিট। হিলারি আর ১৫ মিনিটও বসতে পারলেন না! এরই মধ্যে অনেক জরুরি বিষয়, যেমন—বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ দমন, টিফা চুক্তি, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কো-অপারেশন (এমসিসি) ফান্ড থেকে সহায়তা চাওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি বিষয় ১০ মিনিট করেও সময় পায়নি। হিলারি মার্কিন স্বার্থ ঠিকই বোঝেন, তিনি এমসিসি এবং বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের প্রশ্নে কোনো আশ্বাস দেননি; বরং শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, দুর্নীতিমুক্ত না হলে এমসিসির মতো ‘পবিত্র’ ফান্ডে হাত দেওয়া যাবে না, আর শুল্কমুক্ত হতে হলে সময় লাগবে। তিনি তো দেখা করেই ধন্য করে দিয়েছেন, আমাদের আর কী চাই? অন্যদিকে তাঁর নিজের স্বার্থের ব্যাপারে কানাকড়ি আদায় করতে ছাড়েননি। বাণিজ্যের কথা বলতেই কথা ঘুরিয়ে তিনি ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট—টিফার কথা আলোচনা হয়েছে বলে জানালেন। এই সেই টিফা চুক্তি যা এর আগে আরও নানা নামে, নানা ছলে আমাদের ওপর মার্কিন সরকার চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। মার্কিন সরকার পরিবর্তন হয়েছে, বাংলাদেশেও সরকার পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু মার্কিন স্বার্থরক্ষার বিষয়ে কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রথমেই একটা বিষয় বোঝা দরকার, সেটা হচ্ছে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার প্রশ্ন এবং টিফা আসলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়, শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। কাজেই ইতিমধ্যে এই বিষয়ে যা আলোচনা হয়েছে তা বাণিজ্যমন্ত্রী এবং প্রতিনিধিদের পর্যায়ে হয়েছে। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বাণিজ্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলছেন, তখন বুঝতে হবে, তাঁরা একটি আনুষ্ঠানিকতা করছেন মাত্র; মূল চুক্তির দেনদরবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেই হচ্ছে। বাংলাদেশে নতুন সরকার আসার পর টিফা চুক্তি নিয়ে কী আলোচনা হয়েছে তা অবশ্য জনগণ খুব একটা জানে না। সংসদেও আলোচনা হয়েছে কি না সন্দেহ আছে।
টিফা চুক্তির ড্রাফট ২০০৩ সালে অর্থাত্ বাংলাদেশে চারদলীয় জোট সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ বুশের আমলে হয়েছিল। সেই সময় এই চুক্তির বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ হয়েছিল। আমরা সম্মিলিত নারীসমাজও প্রতিবাদ করেছিলাম; কারণ আমরা বুঝেছিলাম, এর মধ্যে এমন অনেক ধারা আছে যা বিনিয়োগের খোলসে বাংলাদেশের সম্পদ লুণ্ঠনের পথ তৈরি করবে। কিন্তু ২০০৩ সালের প্রথম খসড়া টিফা চুক্তির পর আরও অনেক পরিবর্তন হয়ে ২০০৫ সালে একটি খসড়া দাঁড়িয়েছিল। বর্তমানে আবার ২০০৩ সালের খসড়ায় ফিরে গিয়ে আরও নতুন কিছু ধারা যোগ করা হয়েছে, যা তত্কালীন সরকার চূড়ান্ত আলোচনার সময় বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী ছিল বলে বাদ দিয়েছিল। বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত খুব সক্রিয়ভাবে বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে চুক্তি স্বাক্ষরের ঘোষণা প্রায় দিয়ে ফেলছেন; অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খুব আশ্বস্ত বোধ করছে না এই নতুন খসড়া নিয়ে। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিষ্কার বুঝতে পারছেন, এই চুক্তি বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করবে না, তাই তাঁরা নিজেরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চান না।
একটি মজার বিষয় লক্ষ করার মতো—যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কো-অপারেশন (এমসিসি) ফান্ড থেকে সহায়তা পেতে হলে দুর্নীতি বন্ধ করতেই হবে, দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকতেই হবে। টিফা চুক্তির বেলায়ও দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধ করার কথা আছে। কিন্তু ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ করার মতো বাজে ভাষা ব্যবহারের বিরুদ্ধে তত্কালীন আইন মন্ত্রণালয় ২০০৫ সালের বৈঠকে আপত্তি তুলেছিল। দি ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস-এর একটি প্রতিবেদনে (আগস্ট ২৯, ২০০৯) উল্লেখ করা হয়েছে, বেটসি স্টিলম্যান মার্কিন সরকারের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ঊর্ধ্বতন বাণিজ্যনীতি-বিষয়ক উপদেষ্টা, যিনি তৃতীয় বৈঠকে (২০০৫) অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, উভয় পক্ষ bribery and corruption(ঘুষ ও দুর্নীতি) শব্দ বাদ দিয়ে prevention of malpractice (অনিয়ম বন্ধ করা) যোগ করেছেন। কী সুন্দর কথা! অবশ্য বর্তমান সরকার দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধ করার ব্যাপারটি চুক্তিতে রাখলে বাংলাদেশের মান চলে যাবে বলে মনে করেন না। ভালো কথা, তাঁদের আপত্তি নেই।
কিন্তু কথা সেখানেই শেষ নয়, বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে মার্কিন সরকারের পাঠানো নতুন খসড়ায় এমন সব বিষয় যুক্ত করা হয়েছে যা এর আগে আলোচনায় বাদ দেওয়া হয়েছিল। এ পর্যন্ত ২০০৩, ২০০৪ এবং সর্বশেষ ২০০৫ সালে বৈঠক হয়েছে। নতুন খসড়ায় শ্রমিক, বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকার এবং পরিবেশের ধারাগুলো পুনঃসংযোজিত হয়েছে যা ২০০৫ সালে বাদ দেওয়া হয়েছিল। মার্কিন সরকার ২০০৩ সালের খসড়া ধরেই নতুন খসড়া তৈরি করেছে। অর্থাত্ মাঝখানে যা আলোচনা হয়ে কিছু বাদ দেওয়া হয়েছে, তা এখন আবার নিয়ে আসা হচ্ছে। এ নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খানের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একক কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবে। এবার যুক্তরাষ্ট্রে দীপু মনির হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে সাক্ষাত্, ওবামার সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক—এসব কি টিফা চুক্তির পথ সহজ করে দেবে? ভাব দেখে তো তা-ই মনে হচ্ছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন সেপ্টেম্বর মাসের ৭ থেকে ১০ তারিখে। তিনি মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন এবং বিতর্কিত দুটি ধারা ‘শ্রমিক ও বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকারের’ বিষয়টি নতুন খসড়া থেকে তুলে নেওয়ার দাবি জানান। এগুলো বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ‘অশুল্কজনিত’ বাধা বলে তিনি আখ্যায়িত করেন। বাণিজ্যের দিক থেকে দেখতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এককভাবেই শতকরা ৪০ ভাগ রপ্তানি হয়, যার মূল্য হচ্ছে বছরে চার বিলিয়ন ডলার (চার হাজার কোটি ডলার)। কিন্তু টিফা চুক্তি হলে এমন একটি বাজারে যুক্তরাষ্ট্র শ্রমিকের জন্য মায়াকান্না দেখিয়ে বাংলাদেশের হাত মোচড়াতে পারবে। এর আগে আমরা মার্কিন দেশে শিশুশ্রম নিয়ে সিনেটর হার্কিন বিলের কথা জানি, যা দিয়ে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। তা ছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অবাধ বাণিজ্যের জন্য উঠেপড়ে লাগা ধনী দেশগুলো গরিব দেশের ওপর বাণিজ্যসংক্রান্ত চাপ সৃষ্টির জন্য শ্রমের মান ও পরিবেশের কথা নিয়ে এল। তারা বলছে, যদি কোনো দেশের শ্রমের মানের ব্যাপারে আপত্তি থাকে তাহলে তাদের পণ্য বাজারে ঢুকতে দেওয়া হবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় এ বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ অনেক হয়েছে। তাই তারা এখন বহুপক্ষীয় না হোক, দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। শ্রমের মানের কথা শুনতে খুব ভালো লাগছে বটে, কিন্তু এটা করছে তারা তাদেরই স্বার্থে, গরিব দেশের স্বার্থে নয়, শ্রমিকের জন্যও নয়।
দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশের পোশাকশিল্পের মালিকেরা এই কথাটি বোঝেন না। তাঁরা শ্রমিককে এক টাকা ঠকাতে পারলেও খুশি। বিদেশ থেকে রপ্তানি-বাণিজ্যের ওপর শর্ত আরোপ হলে তার নাম হয় compliance, সেটা তাঁরা খুব মানতে পারেন। কিন্তু শ্রমিকেরা ন্যায্য মজুরি চাইলেই তাদের পুলিশ দিয়ে পিটুনি খাওয়াতে খুব ভালো লাগে। বাণিজ্যমন্ত্রী ঠিকই বুঝেছেন, শ্রমের মানের ধারাটি বাণিজ্যের ওপর অশুল্কজনিত বাধা ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে পোশাকশিল্পের মালিকের যেমন ক্ষতি হবে তমনি শ্রমিকেরও চাকরি হারানোর আশঙ্কা বাড়বে। অথচ খুব সহজেই শ্রমিকের দাবি মেনে মালিকেরা সুন্দর একটি পরিবেশ তৈরি করতে পারেন। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি যখন শুল্কমুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার চাইলেন তখন হিলারি ক্লিনটন কোনো আশ্বাস দেননি।
আরও ভয়াবহ হচ্ছে, ট্রিপস চুক্তির ধারা টিফায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া। এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মধ্যেও আমরা বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকার নিয়ে এমন চুক্তি করছি যা বহুপক্ষীয় চুক্তির দায় ছাড়িয়ে গিয়েছে। অথচ বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকার প্রতি দেশ কতটুকু মানবে, তার সীমা, রেয়াত ও কার কতটুকু দায়, সেই বিষয়ে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তিতে (বিশ্ব বাণিজ্য চুক্তি) পরিষ্কারই বলা আছে। এটা আছে Trade Related Aspect of Intellectual Property Rights (TRIPS) বা বাণিজ্যসংক্রান্ত বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকার অধ্যায়ে (পাক্ষিক চিন্তা, এপ্রিল, ১৯৯৪)। বহু বছর ধরে দর-কষাকষির পর সব রাষ্ট্র মিলে একটা বহুপক্ষীয় চুক্তি করেছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ বা স্বল্পন্নোত দেশগুলোকে(এলডিসি)-কে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এমন ধরনের চুক্তি করার বাধ্যবাধকতা থেকেও রেহাই দেওয়া হয়েছে। তাহলে এই ২০০৯ সালে কেন টিফায় ট্রিপস ঢুকবে? ট্রিপস হলে আমাদের দেশের প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর পেটেন্ট হয়ে যাবে অতি সহজে, তখন আমাদের করার কিছুই থাকবে না। গাছপালা, গরু-ছাগল, মাছ, জীব-অণুজীবসহ সব প্রাণের ওপর পেটেন্ট করার অধিকার তারা পেয়ে যাবে।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দীপু মনির সফরের কথা পড়েছি। হিলারির সঙ্গে দীপু মনির বৈঠকে হিলারি বাংলাদেশের সম্মান রক্ষা করেছেন বলে মনে হয় না। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার করবেন বলে সংবাদ সম্মেলনে বললেন। ভালো কথা, কিন্তু কীভাবে সেটা হবে তার কোনো সদুত্তর নেই। বৈঠক হয়েছে মাত্র ৪৫ মিনিট। হিলারি আর ১৫ মিনিটও বসতে পারলেন না! এরই মধ্যে অনেক জরুরি বিষয়, যেমন—বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ দমন, টিফা চুক্তি, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কো-অপারেশন (এমসিসি) ফান্ড থেকে সহায়তা চাওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি বিষয় ১০ মিনিট করেও সময় পায়নি। হিলারি মার্কিন স্বার্থ ঠিকই বোঝেন, তিনি এমসিসি এবং বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের প্রশ্নে কোনো আশ্বাস দেননি; বরং শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, দুর্নীতিমুক্ত না হলে এমসিসির মতো ‘পবিত্র’ ফান্ডে হাত দেওয়া যাবে না, আর শুল্কমুক্ত হতে হলে সময় লাগবে। তিনি তো দেখা করেই ধন্য করে দিয়েছেন, আমাদের আর কী চাই? অন্যদিকে তাঁর নিজের স্বার্থের ব্যাপারে কানাকড়ি আদায় করতে ছাড়েননি। বাণিজ্যের কথা বলতেই কথা ঘুরিয়ে তিনি ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট—টিফার কথা আলোচনা হয়েছে বলে জানালেন। এই সেই টিফা চুক্তি যা এর আগে আরও নানা নামে, নানা ছলে আমাদের ওপর মার্কিন সরকার চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। মার্কিন সরকার পরিবর্তন হয়েছে, বাংলাদেশেও সরকার পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু মার্কিন স্বার্থরক্ষার বিষয়ে কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রথমেই একটা বিষয় বোঝা দরকার, সেটা হচ্ছে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার প্রশ্ন এবং টিফা আসলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়, শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। কাজেই ইতিমধ্যে এই বিষয়ে যা আলোচনা হয়েছে তা বাণিজ্যমন্ত্রী এবং প্রতিনিধিদের পর্যায়ে হয়েছে। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বাণিজ্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলছেন, তখন বুঝতে হবে, তাঁরা একটি আনুষ্ঠানিকতা করছেন মাত্র; মূল চুক্তির দেনদরবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেই হচ্ছে। বাংলাদেশে নতুন সরকার আসার পর টিফা চুক্তি নিয়ে কী আলোচনা হয়েছে তা অবশ্য জনগণ খুব একটা জানে না। সংসদেও আলোচনা হয়েছে কি না সন্দেহ আছে।
টিফা চুক্তির ড্রাফট ২০০৩ সালে অর্থাত্ বাংলাদেশে চারদলীয় জোট সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ বুশের আমলে হয়েছিল। সেই সময় এই চুক্তির বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ হয়েছিল। আমরা সম্মিলিত নারীসমাজও প্রতিবাদ করেছিলাম; কারণ আমরা বুঝেছিলাম, এর মধ্যে এমন অনেক ধারা আছে যা বিনিয়োগের খোলসে বাংলাদেশের সম্পদ লুণ্ঠনের পথ তৈরি করবে। কিন্তু ২০০৩ সালের প্রথম খসড়া টিফা চুক্তির পর আরও অনেক পরিবর্তন হয়ে ২০০৫ সালে একটি খসড়া দাঁড়িয়েছিল। বর্তমানে আবার ২০০৩ সালের খসড়ায় ফিরে গিয়ে আরও নতুন কিছু ধারা যোগ করা হয়েছে, যা তত্কালীন সরকার চূড়ান্ত আলোচনার সময় বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী ছিল বলে বাদ দিয়েছিল। বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত খুব সক্রিয়ভাবে বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে চুক্তি স্বাক্ষরের ঘোষণা প্রায় দিয়ে ফেলছেন; অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খুব আশ্বস্ত বোধ করছে না এই নতুন খসড়া নিয়ে। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিষ্কার বুঝতে পারছেন, এই চুক্তি বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করবে না, তাই তাঁরা নিজেরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চান না।
একটি মজার বিষয় লক্ষ করার মতো—যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কো-অপারেশন (এমসিসি) ফান্ড থেকে সহায়তা পেতে হলে দুর্নীতি বন্ধ করতেই হবে, দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকতেই হবে। টিফা চুক্তির বেলায়ও দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধ করার কথা আছে। কিন্তু ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ করার মতো বাজে ভাষা ব্যবহারের বিরুদ্ধে তত্কালীন আইন মন্ত্রণালয় ২০০৫ সালের বৈঠকে আপত্তি তুলেছিল। দি ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস-এর একটি প্রতিবেদনে (আগস্ট ২৯, ২০০৯) উল্লেখ করা হয়েছে, বেটসি স্টিলম্যান মার্কিন সরকারের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ঊর্ধ্বতন বাণিজ্যনীতি-বিষয়ক উপদেষ্টা, যিনি তৃতীয় বৈঠকে (২০০৫) অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, উভয় পক্ষ bribery and corruption(ঘুষ ও দুর্নীতি) শব্দ বাদ দিয়ে prevention of malpractice (অনিয়ম বন্ধ করা) যোগ করেছেন। কী সুন্দর কথা! অবশ্য বর্তমান সরকার দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধ করার ব্যাপারটি চুক্তিতে রাখলে বাংলাদেশের মান চলে যাবে বলে মনে করেন না। ভালো কথা, তাঁদের আপত্তি নেই।
কিন্তু কথা সেখানেই শেষ নয়, বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে মার্কিন সরকারের পাঠানো নতুন খসড়ায় এমন সব বিষয় যুক্ত করা হয়েছে যা এর আগে আলোচনায় বাদ দেওয়া হয়েছিল। এ পর্যন্ত ২০০৩, ২০০৪ এবং সর্বশেষ ২০০৫ সালে বৈঠক হয়েছে। নতুন খসড়ায় শ্রমিক, বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকার এবং পরিবেশের ধারাগুলো পুনঃসংযোজিত হয়েছে যা ২০০৫ সালে বাদ দেওয়া হয়েছিল। মার্কিন সরকার ২০০৩ সালের খসড়া ধরেই নতুন খসড়া তৈরি করেছে। অর্থাত্ মাঝখানে যা আলোচনা হয়ে কিছু বাদ দেওয়া হয়েছে, তা এখন আবার নিয়ে আসা হচ্ছে। এ নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খানের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একক কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবে। এবার যুক্তরাষ্ট্রে দীপু মনির হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে সাক্ষাত্, ওবামার সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক—এসব কি টিফা চুক্তির পথ সহজ করে দেবে? ভাব দেখে তো তা-ই মনে হচ্ছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন সেপ্টেম্বর মাসের ৭ থেকে ১০ তারিখে। তিনি মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন এবং বিতর্কিত দুটি ধারা ‘শ্রমিক ও বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকারের’ বিষয়টি নতুন খসড়া থেকে তুলে নেওয়ার দাবি জানান। এগুলো বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ‘অশুল্কজনিত’ বাধা বলে তিনি আখ্যায়িত করেন। বাণিজ্যের দিক থেকে দেখতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এককভাবেই শতকরা ৪০ ভাগ রপ্তানি হয়, যার মূল্য হচ্ছে বছরে চার বিলিয়ন ডলার (চার হাজার কোটি ডলার)। কিন্তু টিফা চুক্তি হলে এমন একটি বাজারে যুক্তরাষ্ট্র শ্রমিকের জন্য মায়াকান্না দেখিয়ে বাংলাদেশের হাত মোচড়াতে পারবে। এর আগে আমরা মার্কিন দেশে শিশুশ্রম নিয়ে সিনেটর হার্কিন বিলের কথা জানি, যা দিয়ে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। তা ছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অবাধ বাণিজ্যের জন্য উঠেপড়ে লাগা ধনী দেশগুলো গরিব দেশের ওপর বাণিজ্যসংক্রান্ত চাপ সৃষ্টির জন্য শ্রমের মান ও পরিবেশের কথা নিয়ে এল। তারা বলছে, যদি কোনো দেশের শ্রমের মানের ব্যাপারে আপত্তি থাকে তাহলে তাদের পণ্য বাজারে ঢুকতে দেওয়া হবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় এ বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ অনেক হয়েছে। তাই তারা এখন বহুপক্ষীয় না হোক, দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। শ্রমের মানের কথা শুনতে খুব ভালো লাগছে বটে, কিন্তু এটা করছে তারা তাদেরই স্বার্থে, গরিব দেশের স্বার্থে নয়, শ্রমিকের জন্যও নয়।
দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশের পোশাকশিল্পের মালিকেরা এই কথাটি বোঝেন না। তাঁরা শ্রমিককে এক টাকা ঠকাতে পারলেও খুশি। বিদেশ থেকে রপ্তানি-বাণিজ্যের ওপর শর্ত আরোপ হলে তার নাম হয় compliance, সেটা তাঁরা খুব মানতে পারেন। কিন্তু শ্রমিকেরা ন্যায্য মজুরি চাইলেই তাদের পুলিশ দিয়ে পিটুনি খাওয়াতে খুব ভালো লাগে। বাণিজ্যমন্ত্রী ঠিকই বুঝেছেন, শ্রমের মানের ধারাটি বাণিজ্যের ওপর অশুল্কজনিত বাধা ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে পোশাকশিল্পের মালিকের যেমন ক্ষতি হবে তমনি শ্রমিকেরও চাকরি হারানোর আশঙ্কা বাড়বে। অথচ খুব সহজেই শ্রমিকের দাবি মেনে মালিকেরা সুন্দর একটি পরিবেশ তৈরি করতে পারেন। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি যখন শুল্কমুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার চাইলেন তখন হিলারি ক্লিনটন কোনো আশ্বাস দেননি।
আরও ভয়াবহ হচ্ছে, ট্রিপস চুক্তির ধারা টিফায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া। এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মধ্যেও আমরা বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকার নিয়ে এমন চুক্তি করছি যা বহুপক্ষীয় চুক্তির দায় ছাড়িয়ে গিয়েছে। অথচ বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকার প্রতি দেশ কতটুকু মানবে, তার সীমা, রেয়াত ও কার কতটুকু দায়, সেই বিষয়ে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তিতে (বিশ্ব বাণিজ্য চুক্তি) পরিষ্কারই বলা আছে। এটা আছে Trade Related Aspect of Intellectual Property Rights (TRIPS) বা বাণিজ্যসংক্রান্ত বুদ্ধিজাত সম্পত্তির অধিকার অধ্যায়ে (পাক্ষিক চিন্তা, এপ্রিল, ১৯৯৪)। বহু বছর ধরে দর-কষাকষির পর সব রাষ্ট্র মিলে একটা বহুপক্ষীয় চুক্তি করেছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ বা স্বল্পন্নোত দেশগুলোকে(এলডিসি)-কে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এমন ধরনের চুক্তি করার বাধ্যবাধকতা থেকেও রেহাই দেওয়া হয়েছে। তাহলে এই ২০০৯ সালে কেন টিফায় ট্রিপস ঢুকবে? ট্রিপস হলে আমাদের দেশের প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর পেটেন্ট হয়ে যাবে অতি সহজে, তখন আমাদের করার কিছুই থাকবে না। গাছপালা, গরু-ছাগল, মাছ, জীব-অণুজীবসহ সব প্রাণের ওপর পেটেন্ট করার অধিকার তারা পেয়ে যাবে।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
No comments