‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নীতিই হবে দেশের জাতীয় চেতনার মূল মশাল
অনুষ্ঠানে ফজলে এলাহী আকবর বলেন, ফাউন্ডেশন ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (এফএসডিএস) লক্ষ্য হচ্ছে- জাতীয় সংহতি ও অগ্রগতির স্বার্থে সবার মধ্যে সহযোগিতা ও সংযোগ বৃদ্ধি করা। তিনি বলেন, একই লক্ষ্য নিয়ে দেশে আরও কিছু চিন্তন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের মূল দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় চেতনার মশাল প্রজ্বলিত করার মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নীতি অবলম্বন করা। প্রতিষ্ঠানের প্রধান মনোযোগ হবে জাতীয় নিরাপত্তা, বেসামরিক ও সামরিক খাতের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তুলতে সহযোগিতা করা।
তিনি বলেন, স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশের জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে নিজেদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন বাংলাদেশের মানুষ। বিগত দশকে উল্লেখযোগ্য মানবাধিকার লঙ্ঘন, ব্যাপক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং সীমাহীন দুর্নীতিসহ ১৫ বছরে অসংখ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে এই দেশ। ওই সময়ের মধ্যে কেবল লোক দেখানো নির্বাচন হয়েছে, যাতে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাসীনদের পুতুলে পরিণত করা হয়।
ফজলে এলাহী আকবর বলেন, ২০২৩ সালের ২৮শে অক্টোবর বিরোধী দলগুলোর সমাবেশে নির্মম ক্র্যাকডাউন করার পর দেশের রাজনীতির ওপর এক অতিপ্রাকৃতিক ভারী নীরবতা নেমে আসে। ওই ক্র্যাকডাউনের মাধ্যমে বিরোধী দলগুলোর অসংখ্য নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাসন তার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে চেয়েছিল। তারা টানা চতুর্থবার শব্দটিকে নিজেদের জন্য সুরক্ষিত করে দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে একধরনের ক্লেপটোক্র্যাটিক (চোরতন্ত্র) ব্যবস্থায় রূপান্তর করে। জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয় নিজেদের সীমাহীন নিপীড়ন।
এই দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কথা উল্লেখ করে এফএসডিএস-এর চেয়ারম্যান বলেন, ওই দমন-পীড়নীয় আবহাওয়া ছাত্রদের ক্রোধ এবং সংকল্পকে জাগিয়ে তোলে, ফলে তারা রাস্তায় নেমে আসে। পরিবর্তনের লক্ষ্যে তারা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মুখোমুখি হন। তাদের ওই সম্মিলিত প্রয়াশই জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নামে পরিচিতি পেয়েছে। এর মাধ্যমে তারা দেশে ন্যায়বিচার এবং গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। তৃণমূলের এই আন্দোলন কেবল তরুণ-তরুণীদের সাহসকেই তুলে ধরছে না বরং পুরো জাতির মধ্যে একধরনের সামষ্টিক আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছে। এর মাধ্যমে দেশের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট যোগ হয়েছে।
ফজলে এলাহী আকবর বলেন, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বিস্তৃত ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে বেশ গতিশীল অবস্থায় রয়েছে। এই ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা পেতে সাউথ এশিয়ান এসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন (সার্ক) এবং বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল, টেকনিকাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমস্টেক)কে পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি আরও প্রবল হয়েছে। এই সংস্থাগুলো আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে দেশের প্রচেষ্টাও অবিচ্ছেদ্য। এর পাশাপাশি উন্নয়ন এবং নিরাপত্তার লক্ষ্য অর্জনে আসিয়ানের মতো প্ল্যাটফরমগুলোর সঙ্গে সক্রিয় থাকাও আমাদের জন্য অপরিহার্য।
সাবেক ওই জেনারেল বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তার বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ), দ্য গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) এবং ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) মতো সংস্থাগুলোর সঙ্গেও কাজ করছে বাংলাদেশ। এসব সহযোগী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার কূটনৈতিক সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করছে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নিজেদের প্রয়োজনীয় অবস্থান সৃষ্টি করছে। এক্ষেত্রে আমাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলো আরও বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও সমপ্রসারিত করার জন্য আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বাজারে প্রবেশের উদ্যোগ নেয়া দরকার বলে মনে করেন ফজলে এলাহী আকবর। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বাজার বৈচিত্র্যপূর্ণ করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য বঙ্গোপসাগর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, কারণ, এটি বৈশ্বিক বাণিজ্য ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি কৌশলগত সামুদ্রিক অঞ্চল। এর প্রাকৃতিক সম্পদ ও গুরুত্বপূর্ণ শিপিং রুটগুলোর প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। এটা বাংলাদেশকে আঞ্চলিক সামুদ্রিক নিরাপত্তায় প্রধান অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন ফজলে এলাহী আকবর। তিনি বলেন, জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার ভিত্তিতে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখা অপরিহার্য। যা আমাদের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগের মূল ভিত্তি হতে পারে। দুঃখজনকভাবে, আমাদের রাজনৈতিক আলোচনায় এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি প্রায়ই উপেক্ষিত হয়েছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক বাণিজ্য ও সুরক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক অঞ্চল হচ্ছে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী- বেঙ্গল উপসাগর। এই অঞ্চলের কৌশলগত তাৎপর্য রয়েছে। এর প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বাণিজ্যিক রুটের প্রতি বৈশ্বিক আগ্রহ রয়েছে। সুতরাং এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক সামুদ্রিক বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া কূটনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত সম্পর্কের মেরুদণ্ড গড়ে তুলতেও উল্লিখিত বিষয়ে জোর দিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভূমিকার বেশ প্রশংসা করেন ফজলে এলাহী আকবর। তিনি বলেন, আমাকে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে হাজার হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। এই সংযোগ বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থানকে দৃঢ় করে এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও সুরক্ষার প্রতি তার প্রতিশ্রুতির সাক্ষ্য দেয়। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং শান্তি ধরে রাখতে আমাদের শান্তিরক্ষী বাহিনীর অভিজ্ঞতাগুলো ব্যবহার করতে পারি।
ফজলে এলাহী আকবর মনে করেন অভ্যন্তরীণভাবে বাংলাদেশের ওপর নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। তিনি বলেন, উল্লেখযোগ্যভাবে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল, চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস (সিএইচটি) অঞ্চলে চলমান উত্তেজনা, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং বিভিন্ন রূপে সন্ত্রাসবাদের বিভিন্ন হুমকির ফলে দেশের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ ঘনীভূত হয়েছে। আজ আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি, কেননা এই চ্যালেঞ্জগুলোকে চিহ্নিত করে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এসব পদক্ষেপ দেশ এবং দেশের বাইরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের সতর্কতা দাবি করে। জাতীয় সুরক্ষা এবং আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা উভয়ের জন্যই এ বিষয়গুলো উত্থাপন করা বেশ জরুরি।
তিনি বলেছেন, এসব সমস্যা ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেশের নেতৃত্বকে সহায়তা করাই এফএসডিএসের লক্ষ্য। এই সংস্থার কার্যক্রম হবে নির্দলীয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং স্থিতিস্থাপক। যার কেন্দ্রবিন্দু থাকবে উন্নত গবেষণা ও বিশ্লেষণ। বিভিন্ন জরিপের মাধ্যমে এগুলো পরিচালিত হবে। প্রচেষ্টা হিসেবে এফএসডিএস সমাজের সকল স্তর এবং বিভাগের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে বলে উল্লেখ করেছেন ফজলে এলাহী আকবর।
সাবেক ওই সেনাকর্মকর্তা বলেন, এমন পরিস্থিতিতে আমরা বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং বৈদেশিক নীতি আরও সুসংহত ও বিস্তৃতি করা প্রয়োজন। যেন জাতীয় স্বার্থ এবং ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নীতি, সুরক্ষা, শান্তি, কূটনীতি এবং উন্নয়নের ধারা সংযুক্ত থাকবে। দেশ পরিচালনায় আমাদের গৌরবময় অতীতে প্রতিরক্ষা এবং কূটনীতির সফলতা ঐতিহাসিকভাবে পরীক্ষিত। এফএসডিএস এই ঐতিহাসিক সফলতাকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে।
সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের জন্য সত্যিকারের কার্যকর এবং টেকসই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া লালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন ফজলে এলাহী আকবর। তিনি বলেন, আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের জন্য সত্যিকারের কার্যকর এবং টেকসই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া লালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এটি সুশাসন এবং নিরাপত্তার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে এবং এটা মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদার নীতিকে সম্মান করবে। এ ছাড়া গণতন্ত্রের সাধনায় রাজনৈতিক সংগ্রাম-আন্দোলন এবং ত্যাগের প্রতি আমি গভীরভাবে সহানুভূতিশীল। ঐতিহাসিক ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান’ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের জন্য লক্ষ্যের প্রতি ব্যাপকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ।
No comments