কালি-মাখা মেঘ ওপারে আঁধার by সুলাইমান সাদী
আষাঢ়ের
প্রথম দিন। বৃষ্টি দিয়েই বর্ষাকে আমন্ত্রণ জানাল প্রকৃতি। ঝিরিঝিরি
বৃষ্টির ছাটে বর্ষার প্রথম ভোরটি ছিল অপরূপ। আকাশ জুড়ে খেলেছে মেঘেরা।
ফাঁকে ফাঁকে সোনালি সূর্য। শেষ গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপের পর হঠাৎ প্রকৃতির
এ শান্তিময় আয়োজন সত্যিই স্রষ্টাকে মনে করায়।
মনে পড়ে কবিগুরুর আষাঢ় কবিতাটিও— নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে/ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে...
কবিগুরু রবীন্দ্রণাথ ঠাকুরের অমোঘ এ ডাক কি সত্যিই বৃষ্টির দিনে ঘরে বসে থাকার আহবান? পাড়ার ছেলেরা কি তাই মনে করে? বর্ষার প্রথম বৃষ্টি কে না উপভোগ করতে চায়?
পাড়ার শিশু-কিশোর, ঘরের ষোড়শী যুবতী, নতুন বিয়ে করা জামাই-বউ, ষাটোর্ধ্ব দাদা-দাদু; সবার ভেতরেই আষাঢ়ের বর্ষা নামিয়ে দেয় প্রাণের চঞ্চল ধারা। সবাই কবিগুরুর ঘরের বাইরে যাওয়ার নিষেধের বেড়া ভেঙে মেতে উঠতে চায় রিনিঝিনি বর্ষার উচ্ছ্বাসে।
কবিগুরু কেন, কেউই কারো নিষেধ মানে না বর্ষার আগমনী উৎসবে মেতে উঠতে। ঋতু বদলের অশুভ লক্ষণের কথা জেনেও ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ বাঁধায় অনেকে। জ্বরের ঘোরে টিনের চালের নিচে বৃষ্টির ঝুমঝুম বাজনা কতটা মধুর, যারা উপভোগ করেনি তাদের জীবনই বৃথা।
প্রতিবছরই বর্ষা এসে ধুয়ে মুছে দেয় আমাদের প্রকৃতি পরিবেশ। ধুয়ে দেয় আমাদের ভেতরে জমে থাকা বেদনার জঞ্জালও। বর্ষার বৃষ্টিমুখরতা জীবনে ফিরিয়ে আনে নতুন করে বাঁচার ভরসা। সজীব প্রকৃতিতে আরো সতেজ করে তোলে যাপনের উদ্যম।
বর্ষায় বিশেষ করে গ্রামের মানুষের কাজকর্ম কম থাকায় দিন কাটে বিভিন্ন ঘরোয়া খেলা, গল্পস্বল্প, পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর আয়োজনে। আর এসব আয়োজনকে আরো জমিয়ে তোলে বর্ষার ফলেরা।
ফলের ঋতু গ্রীষ্ম হলেও বর্ষার ফলেরও বাহার কম নয়। জৈষ্ঠ্যের পাকা আম, কাঠাল আর লিচুর দাপট শেষ হতেই শুরু হয় ফলের মহড়া। পেয়ারা, লটকন, আমড়া, জাম্বুরা, জামরুল, ডেউয়া, কামরাঙা, কাউ ও গাবের মতো বিচিত্র স্বাদের ফলগুলো বর্ষার মাহাত্ম্য যেন আরো বাড়িয়ে তোলে। রূপবতী ঋতুরানী বর্ষা হয়ে ওঠে রসেরও রাজকুমারী।
বোশেখের ঝড়ে আম কুড়াতে যেমন সুখ, আষাঢ়ের বৃষ্টিতে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে জাম জাম্বুরা কুড়ানোর আনন্দও ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বিশেষ করে আধা কাঁচা জাম্বুরা দিয়ে বৃষ্টিমুখর উঠোনে ফুটবল খেলার আনন্দ তো ধরে রাখার মতোই নয়।
ফলের পাশাপাশি ফুলের সাজও কম নয় বর্ষায়। বর্ষায় বিলের পদ্ম আর শাপলা ফুল না তুললে তো উৎসবই জমে না। এছাড়া ঘাসফুল, দোলনচাঁপা, সুখদর্শন, দোপাটি আর স্পাইডার লিলির মতো সুন্দর ফুলগুলো এ ঋতুর সেরা উপহার।
সবার আগে বর্ষার আগমনের জানান দেয় কদম ফুল। তাই বর্ষা এলেই এ ফুলের কথা উঠে আসে সবার আগে। গাছে গাছে ছেয়ে যায় সাদা কদম। ফুটে চালতা ফুলও। কবিরা এসব নিয়ে লিখেছেন কত ছন্দ।
বর্ষা ছড়া আর কবিতারও ঋতু। আবহমান বাংলার কবিকুল ছঋতুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছড়া-কবিতা লিখেছেন বর্ষা নিয়ে। কবিগুরু রবীন্দ্রণাথ ঠাকুর আরো যেমন বলছেন—
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,/আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,
কালি-মাখা মেঘে ওপারে আঁধার/ঘনিছে দেখ্ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলছেন—
আজিও তেমনি করি/আষাঢ়ের মেঘ ঘনায়ে এসেছে/ভারত-ভাগ্য ভরি।
আকাশ ভাঙিয়া তেমনি বাদল/ঝরে সারাদিনমান।
দিন না ফুরাতে দিনের সূর্য/মেঘে হলো অবসান।
কবি ফররুখ আহমদের সেই মিষ্টি ছড়াটি তো এখনো লেগে আছে ঠোঁটে—
বৃষ্টি এল কাশবনে/জাগল সাড়া ঘাসবনে/বকের সারি কোথা রে/লুকিয়ে গেল বাঁশবনে।
নদীতে নাই খেয়া যে,/ডাকল দূরে দেয়া যে,/কোন সে বনের আড়ালে/ফুটল আবার কেয়া যে।
আড়ম্বরপূর্ণ এ ঋতুর বিড়ম্বনাও কিন্তু কম নয়। বর্ষা নিয়ে প্রায় সব কবিরই উচ্ছ্বাস আর প্রসংশা প্রশ্নাতীত হলেও একজন তরুণ কবিকে বর্ষা নিয়ে কবিতা রচনাকারী কবিদের সমালোচনা করতেও দেখেছিলাম। তার মতে বর্ষা নাকি মনমরা করে দেয় মানুষকে। থামিয়ে দেয় জীবনের গতি। আটকে ফেলে জনজীবনের স্রোত।
কথাগুলো খারাপ শোনালেও এর সত্যতা কোনো অংশে কম নয়। বিশেষ করে নাগরিক জীবন অচল হয়ে পড়ে প্রায় এ ঋতুতে। হাজার হাজার মানুষের চাকরি, ব্যবসা, কাজকর্মে মারাত্মক ব্যঘাত ঘটে বৃষ্টি-বিড়ম্বনায়।
নাগরিক জীবন এমনিতে যান্ত্রিক গতিতে চলার পরও অভাবের শেষ থাকে না, তার ওপর পুরো একটা মৌসুম যদি গাঁয়ের কৃষকদের মতো বসে শুয়ে কাটাতে হয় তাহলে তো অচলাবস্থা তৈরি হবেই।
শুধু তাই নয়, বর্ষার পানির সঙ্গে অনেক সময় নানা রোগ, জীবণু, মহামারি ইত্যাদিও হানা দেয়। প্রকৃতিতে একধরনের ভেজা ভেপসা ভাব ধরে যায়। এতে জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি, যক্ষ্মা ছাড়াও বিভিন্ন ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হয় অনেকে।
তাই বর্ষার আনন্দ ভালোভাবে উপভোগ করতে হলে এ মৌসুমে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যগত নিয়ম মেনে চলতে হবে। নিজের ঘরবাড়ি, আশপাশ সবসময় পরিস্কার পারিচ্ছন্ন রেখে মৌসুমটা কাটাতে পারলে আনন্দে কোনো রকমের ঘাটতি পড়ার কথা নয়। শুধু প্রয়োজন একটু সচেতনতার।
মনে পড়ে কবিগুরুর আষাঢ় কবিতাটিও— নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে/ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে...
কবিগুরু রবীন্দ্রণাথ ঠাকুরের অমোঘ এ ডাক কি সত্যিই বৃষ্টির দিনে ঘরে বসে থাকার আহবান? পাড়ার ছেলেরা কি তাই মনে করে? বর্ষার প্রথম বৃষ্টি কে না উপভোগ করতে চায়?
পাড়ার শিশু-কিশোর, ঘরের ষোড়শী যুবতী, নতুন বিয়ে করা জামাই-বউ, ষাটোর্ধ্ব দাদা-দাদু; সবার ভেতরেই আষাঢ়ের বর্ষা নামিয়ে দেয় প্রাণের চঞ্চল ধারা। সবাই কবিগুরুর ঘরের বাইরে যাওয়ার নিষেধের বেড়া ভেঙে মেতে উঠতে চায় রিনিঝিনি বর্ষার উচ্ছ্বাসে।
কবিগুরু কেন, কেউই কারো নিষেধ মানে না বর্ষার আগমনী উৎসবে মেতে উঠতে। ঋতু বদলের অশুভ লক্ষণের কথা জেনেও ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ বাঁধায় অনেকে। জ্বরের ঘোরে টিনের চালের নিচে বৃষ্টির ঝুমঝুম বাজনা কতটা মধুর, যারা উপভোগ করেনি তাদের জীবনই বৃথা।
প্রতিবছরই বর্ষা এসে ধুয়ে মুছে দেয় আমাদের প্রকৃতি পরিবেশ। ধুয়ে দেয় আমাদের ভেতরে জমে থাকা বেদনার জঞ্জালও। বর্ষার বৃষ্টিমুখরতা জীবনে ফিরিয়ে আনে নতুন করে বাঁচার ভরসা। সজীব প্রকৃতিতে আরো সতেজ করে তোলে যাপনের উদ্যম।
বর্ষায় বিশেষ করে গ্রামের মানুষের কাজকর্ম কম থাকায় দিন কাটে বিভিন্ন ঘরোয়া খেলা, গল্পস্বল্প, পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর আয়োজনে। আর এসব আয়োজনকে আরো জমিয়ে তোলে বর্ষার ফলেরা।
ফলের ঋতু গ্রীষ্ম হলেও বর্ষার ফলেরও বাহার কম নয়। জৈষ্ঠ্যের পাকা আম, কাঠাল আর লিচুর দাপট শেষ হতেই শুরু হয় ফলের মহড়া। পেয়ারা, লটকন, আমড়া, জাম্বুরা, জামরুল, ডেউয়া, কামরাঙা, কাউ ও গাবের মতো বিচিত্র স্বাদের ফলগুলো বর্ষার মাহাত্ম্য যেন আরো বাড়িয়ে তোলে। রূপবতী ঋতুরানী বর্ষা হয়ে ওঠে রসেরও রাজকুমারী।
বোশেখের ঝড়ে আম কুড়াতে যেমন সুখ, আষাঢ়ের বৃষ্টিতে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে জাম জাম্বুরা কুড়ানোর আনন্দও ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বিশেষ করে আধা কাঁচা জাম্বুরা দিয়ে বৃষ্টিমুখর উঠোনে ফুটবল খেলার আনন্দ তো ধরে রাখার মতোই নয়।
ফলের পাশাপাশি ফুলের সাজও কম নয় বর্ষায়। বর্ষায় বিলের পদ্ম আর শাপলা ফুল না তুললে তো উৎসবই জমে না। এছাড়া ঘাসফুল, দোলনচাঁপা, সুখদর্শন, দোপাটি আর স্পাইডার লিলির মতো সুন্দর ফুলগুলো এ ঋতুর সেরা উপহার।
সবার আগে বর্ষার আগমনের জানান দেয় কদম ফুল। তাই বর্ষা এলেই এ ফুলের কথা উঠে আসে সবার আগে। গাছে গাছে ছেয়ে যায় সাদা কদম। ফুটে চালতা ফুলও। কবিরা এসব নিয়ে লিখেছেন কত ছন্দ।
বর্ষা ছড়া আর কবিতারও ঋতু। আবহমান বাংলার কবিকুল ছঋতুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছড়া-কবিতা লিখেছেন বর্ষা নিয়ে। কবিগুরু রবীন্দ্রণাথ ঠাকুর আরো যেমন বলছেন—
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,/আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,
কালি-মাখা মেঘে ওপারে আঁধার/ঘনিছে দেখ্ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলছেন—
আজিও তেমনি করি/আষাঢ়ের মেঘ ঘনায়ে এসেছে/ভারত-ভাগ্য ভরি।
আকাশ ভাঙিয়া তেমনি বাদল/ঝরে সারাদিনমান।
দিন না ফুরাতে দিনের সূর্য/মেঘে হলো অবসান।
কবি ফররুখ আহমদের সেই মিষ্টি ছড়াটি তো এখনো লেগে আছে ঠোঁটে—
বৃষ্টি এল কাশবনে/জাগল সাড়া ঘাসবনে/বকের সারি কোথা রে/লুকিয়ে গেল বাঁশবনে।
নদীতে নাই খেয়া যে,/ডাকল দূরে দেয়া যে,/কোন সে বনের আড়ালে/ফুটল আবার কেয়া যে।
আড়ম্বরপূর্ণ এ ঋতুর বিড়ম্বনাও কিন্তু কম নয়। বর্ষা নিয়ে প্রায় সব কবিরই উচ্ছ্বাস আর প্রসংশা প্রশ্নাতীত হলেও একজন তরুণ কবিকে বর্ষা নিয়ে কবিতা রচনাকারী কবিদের সমালোচনা করতেও দেখেছিলাম। তার মতে বর্ষা নাকি মনমরা করে দেয় মানুষকে। থামিয়ে দেয় জীবনের গতি। আটকে ফেলে জনজীবনের স্রোত।
কথাগুলো খারাপ শোনালেও এর সত্যতা কোনো অংশে কম নয়। বিশেষ করে নাগরিক জীবন অচল হয়ে পড়ে প্রায় এ ঋতুতে। হাজার হাজার মানুষের চাকরি, ব্যবসা, কাজকর্মে মারাত্মক ব্যঘাত ঘটে বৃষ্টি-বিড়ম্বনায়।
নাগরিক জীবন এমনিতে যান্ত্রিক গতিতে চলার পরও অভাবের শেষ থাকে না, তার ওপর পুরো একটা মৌসুম যদি গাঁয়ের কৃষকদের মতো বসে শুয়ে কাটাতে হয় তাহলে তো অচলাবস্থা তৈরি হবেই।
শুধু তাই নয়, বর্ষার পানির সঙ্গে অনেক সময় নানা রোগ, জীবণু, মহামারি ইত্যাদিও হানা দেয়। প্রকৃতিতে একধরনের ভেজা ভেপসা ভাব ধরে যায়। এতে জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি, যক্ষ্মা ছাড়াও বিভিন্ন ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হয় অনেকে।
তাই বর্ষার আনন্দ ভালোভাবে উপভোগ করতে হলে এ মৌসুমে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যগত নিয়ম মেনে চলতে হবে। নিজের ঘরবাড়ি, আশপাশ সবসময় পরিস্কার পারিচ্ছন্ন রেখে মৌসুমটা কাটাতে পারলে আনন্দে কোনো রকমের ঘাটতি পড়ার কথা নয়। শুধু প্রয়োজন একটু সচেতনতার।
No comments