রাজনৈতিক বাণিজ্য-চক্র by শুভময় মৈত্র
কমলেন্দু
ধরের লেখা ‘ভারতীয় রাজনীতির বিপণন’ দু’টি ভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক দলিল।
বইটির প্রথমভাগ প্রকাশিত হয়েছিল প্রায় তিন দশক আগে, ১৯৯০-তে। সেই অংশটুকু
রেখে, তার সঙ্গে পরবর্তী সময়ের কথা যোগ করে, সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বইটির
পরিবর্ধিত সংস্করণ। বইটি লেখার উদ্দেশ্য সোজা কথায় পেশ করা হয়েছিল প্রথম
পর্বের ভূমিকাতেই— “একটি স্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে বইটি লেখা। আজকের ভারতীয়
রাজনীতি কীভাবে পণ্য বিপণনের পদ্ধতিতে পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে তা প্রমাণ
করা।” অঙ্কের ভাষায় প্রমাণের শুরুতে কিছু স্বীকার্য (পসটুলেট) থাকে। সেটি
থেকে ধাপে ধাপে আঙ্কিক যুক্তিসহকারে প্রমাণ করতে হয় বিভিন্ন উপপাদ্য এবং
অনুসিদ্ধান্ত। যেমনটা আমরা দেখি ইউক্লিডের জ্যামিতিতে। সমাজবিদ্যা বা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রমাণ সেভাবে আসে না। সেখানে যুক্তিগুলো সামাজিক এবং
রাজনৈতিক, আর দাবির অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকে পরিসংখ্যান। অর্থাৎ এখানে
যুক্তিগুলো মেনে নেওয়ার মতো হলেও, বিশ্বাসযোগ্য হলেও, সবসময়েই একটু জায়গা
থাকে একমত না হওয়ার। আর লেখক সুযোগ খোঁজেন একই মত বারবার বিভিন্ন শব্দবন্ধে
প্রকাশ করে নিজের বক্তব্যকে জোরালো করে তোলার। গবেষণামুখী এই বইটিতেও সেই
ধারা বর্তমান।
ভারতীয় রাজনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকা পুঁজিবাদের কথা অত্যন্ত সাবলীলতার সঙ্গে পেশ করেছেন লেখক। সেই নিরিখে রাজনীতি যে একটি পণ্য, তা যথেষ্ট প্রত্যয়ের সঙ্গে ব্যক্ত করা হয়েছে, পেশ করা হয়েছে এ দেশে সেই বিমূর্ত পণ্য বিপণনের ধারাবিবরণী। এই বইটির আলোচনায় রাজনীতিকে বিমূর্ত (অ্যাবস্ট্র্যাক্ট) বলা যেতেই পারে। কারণ, তার বিভিন্ন রূপ বাজারে কেনাবেচা হয়, যদিও বিষয়টির মূল অবয়ব অস্তিত্বহীন। হয়তো আর কিছুদিন পরে এই ধরনের আলোচনা হবে যে, “চলুন তো আজ বিকেলে সিটি সেন্টারে গিয়ে কিছুটা ডানপন্থী রাজনীতি বিক্রি করে আসি”, কিংবা “আজ সন্ধ্যায় কি যাদবপুর থেকে অল্প অতিবাম রাজনীতি কিনে আনা সম্ভব?” তবে চেতনার ততটা উত্তরণ আমাদের সমাজে এখনও ঘটেনি। রাজনীতি তাই পণ্য হিসেবে বিক্রিত অথবা বিকৃত হয় পরোক্ষভাবে। কমলেন্দুবাবুর বইটির প্রচ্ছদে সেই কারণেই বোধ হয় এদিক-ওদিক ছড়ানো আছে কিছু শব্দ, যেমন ওপরের দিকে ‘নীতি’, ‘আদর্শ’, ‘নৈতিকতা’, ‘সততা’ আর নীচে ‘উত্তর-সত্য’ কিংবা ‘রাজনৈতিক বাণিজ্য চক্র’। ভারতীয় রাজনীতির পণ্যায়নের প্রেক্ষাপটে মাথার শব্দগুলোর গুণগত মান বিচার করা হয়েছে যুক্তি অথবা পরিসংখ্যান দিয়ে।
কী-কী বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে বইটিতে? অতীতে লিখিত অংশটির শুরুতে লেখক অনেকটা জায়গা নিয়ে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, কেন তিনি রাজনীতিকে পণ্য বলছেন। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে এসেছে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনৈতিক দল বা নেতা-নেত্রীদের সম্পর্ক। পরের অধ্যায়েই ভারতের আর্থসামাজিক রেখাচিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি সারণি ২-তে (পৃ. ২৮) সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর সম্পদের পরিমাণ পেশ করেছেন। বিভিন্ন তথ্যের সাহায্যে লেখক উপলব্ধি করাতে চেয়েছেন যে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক পথচলা মূলত একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে এবং সেখানেই পণ্য হিসেবে রাজনীতির বিপণন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে ভারতীয় পণ্য-বাজারের বিপণন আর প্রচারের প্রসঙ্গ। এখানে কিন্তু মূল বক্তব্য পণ্যের বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত। আমেরিকা এবং তার মিত্র দেশগুলোর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লেখক জানিয়েছেন (পৃ. ৩৮, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ), “সেসমস্ত দেশে শুধু পণ্য বিকোবার জন্য বিপণন বা বিজ্ঞাপনের নিত্যনতুন চমক তার বাহারি মোড়ক তৈরি হচ্ছে না, সেখানকার রাজনীতিও অনেকদিন আগে থেকেই বিপণন আর বিজ্ঞাপনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।” এখানে কিছুটা সমালোচনার পরিসর আছে। প্রথম কথা হল এই বিবৃতিটি রাজনীতিকে পণ্য হিসেবে দেখানোর জন্যে সম্পূর্ণ নয়। জীবনের প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই রাজনীতি জড়িয়ে থাকে, ফলে তা বিপণন কিংবা বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও থাকবে। সুতরাং এক্ষেত্রে আলোচনার সাপেক্ষে অনুসিদ্ধান্তের বিষয়টি ততটা পরিষ্কার নয়। দ্বিতীয়ত বাক্যটি দু’-তিনবার পড়লে এটাও বোঝা যাবে যে, ব্যকরণগত কিছু সমস্যা আছে এখানে। বইটিতে এই ধরনের বাক্য কিংবা মুদ্রণপ্রমাদ কম হলেও খুঁটিয়ে পড়লে তা কখনও কখনও চোখে পড়ে। বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আর দু’-একটি বিষয় উত্থাপন করা জরুরি। পৃষ্ঠা সতেরোর শেষ বাক্যে লেখা হয়েছে “রাজনীতিতে পুঁজির এই বিনিয়োগ থেকে পুঁজিবাদীদের যে মুনাফা আসে তা অর্থ, প্রতিপত্তি, সম্মান ও অন্যান্য উপকরণের মাধ্যমে ফিরে আসে।” একই বাক্যে দু’বার ‘আসে’ শব্দটি ব্যবহার না করে প্রথম ‘আসে’-টিকে বাদ দিলে হয়তো ভাল শোনাত।
বইটির তৃতীয় পরিচ্ছেদ ‘ভারতীয় রাজনীতির বিপণনে রাজনৈতিক সাইবারনেটিকস’। ভারতের আর্থসামাজিক পটভূমিতে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির প্রাসঙ্গিকতা অত্যন্ত গভীরতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই অধ্যায়ে। লেখক প্রযুক্তিকে কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন এখানে। আশির দশকে এ রাজ্যের বামপন্থীদের মতটাও এমনই ছিল যে, মানুষের কাজ কেড়ে নেবে গণকযন্ত্র। সে মত গ্রহণযোগ্য নয়। তবে রাজনৈতিক সাইবারনেটিকস কেন এবং কীভাবে বিপণন ব্যবস্থার অংশীদার হয়ে উঠেছে, তা নির্ভুল যুক্তিসহকারে আলোচিত হয়েছে। যে-জায়গায় লেখকের প্রশংসা প্রাপ্য, তা হল সাইবারনেটিকস নিয়ে তিনি আলোচনা শুরু করেছেন নব্বইয়ের দশকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার যে-অসাধারণ উন্নতি আমরা এখন দেখছি, সেদিকে কিন্তু প্রায় তিরিশ বছর আগেই দিকনির্দেশ করেছেন গ্রন্থকার। আজকের দিনে প্রযুক্তির বিষয়ে সবাই যতটা সড়গড়, সেই সময় কিন্তু বিষয়টা নিয়ে জনগণ ততটা অবহিত ছিল না।
প্রথম পর্বের পরবর্তী অধ্যায় ‘ভারতীয় রাজনীতিতে ভাবমূর্তির বিপণন’। এই অংশটি বেশ দীর্ঘ এবং অনেক ক্ষেত্রেই সুখপাঠ্য। এই পরিচ্ছেদের শুরুর দিকেই উঠে এসেছে গাঁধীজিকে নিয়ে আলোচনা। লেখক মনে করিয়ে দিয়েছেন “জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বা তারও কম সময়ে গান্ধিজিই গণআন্দোলন আর জাতীয় কংগ্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাঁর কথাই শেষ কথা।” পণ্য এখানে রাজনীতি নয়, ভাবমূর্তি। আর কীভাবে তা রাজনীতির আঙিনায় সুযোগ বুঝে বেচা হয়, তাই নিয়ে যথেষ্ট আকর্ষক আলোচনা আছে বইটির এই পর্যায়ে। এই পর্বে এবং তার পরের অধ্যায় ‘উপসংহারের বদলে’-তে আছে বেশ কিছু সেই সময়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সে সব সাদাকালো ছবি এবং প্রচার দেখলে বোঝা যায় তখন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব হয়তো ছিল আজকের মতোই, তবে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে আগ্রাসী মনোভাব কিছুটা কম ছিল। বিজেপির পথ চলার শুরু সেই সময়টায়।
প্রায় তিন দশক পরে পুনঃপ্রকাশিত বইটির দ্বিতীয় অংশটি নতুনভাবে লেখা। ‘কথামুখ’ নাম দেওয়া সূচনায় লেখক পরবর্তী চারটি অধ্যায়ের প্রতি সংক্ষেপে আলোকপাত করেছেন। সেই অধ্যায়গুলি হল ‘ভারতীয় রাজনীতির বিপণনে ল্যাংটা’, ‘ভারতের উন্নয়ন অর্থনীতিতে দারিদ্র’, ‘ভারতীয় রাজনীতির বাণিজ্যচক্র ও কমপ্যাশনেট গণতন্ত্র থেকে মাস্কুলার গণতন্ত্রে উত্তরণ’ এবং ‘ভারতীয় রাজনীতির বিপণনে গণমাধ্যমের ভূমিকা’। উপসংহারে ‘উত্তর-সত্য’ সংক্রান্ত আলোচনা। এই পর্যায়ের প্রথম অধ্যায়ে যেমন গাঁধীজির কাজকর্মের সমালোচনা আছে, তার চেয়েও অনেক বেশি নিন্দা করা হয়েছে তাঁর উত্তরসূরি কংগ্রেসের নেতানেত্রীদের। তবে ‘নেকেড ফকির’ গোছের দু’টি শব্দের অনুকরণে ‘ল্যাংটা’ শব্দটি ব্যবহার না করলেই বোধ হয় ভাল শোনাত। বাম রাজনীতির আলোচনায় এই ভাগে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো পরিসংখ্যান ১৭৫ পৃষ্ঠায় সারণি ১-এ। সেখানে দেওয়া আছে বিভিন্ন লোকসভা নির্বাচনে সিপিআই এবং সিপিএমের প্রাপ্ত ভোটের অংশ। পুরো সারণিটা ছোট করে টুকে দেওয়ার লোভ সংবরণ করা কঠিন— ৬.৪% (১৯৫০), ৯.৬% (১৯৬০), ৮.৪% (১৯৭০), ৮.৮% (১৯৮০), ৭.৬% (১৯৯০), ৭.০% (২০০৪), ৩.৯% (২০০৯), ২.৬% (২০১৪)। সংসদীয় গণতন্ত্রে বাম রাজনীতির পক্ষে জনমত এভাবে কমার বিপদ নিয়ে আরও বিশদে আলোচনা করার ক্ষেত্র প্রস্তুত। কারণ, ২০১৯-এর লোকসভায় এই ভোট শতাংশ আরও কমার সম্ভাবনা আছে।
পরের অধ্যায়ে প্রচুর পরিসংখ্যান সহকারে পেশ করা হয়েছে উন্নয়ন অর্থনীতির নামে কীভাবে দারিদ্রকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে দেশজুড়ে। লেখক যথার্থই বলেছেন, “পরিণতিতে ভারতের এক বিপুলসংখ্যক দেশবাসীর জীবন-জীবিকা গভীর থেকে গভীরতর সংকটের মুখোমুখি।” তবে লেখক যখন এই বই শেষ করছেন, সেই সময়েই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে বেশ বড় মাপের কৃষক আন্দোলন। বামেদের ভোট হয়তো তাতে বাড়বে না, তবে বিজেপি, কংগ্রেস বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে বারবার ঘোষণা করতে হচ্ছে কৃষকদের জন্য বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্প। যদিও তার বাস্তবায়ন গভীর জলে। পরের পরিচ্ছেদে ভারতীয় রাজনীতির বাণিজ্যিক চক্র বোঝাতে গিয়ে লেখক প্রশ্ন করেছেন, “দেশবাসীর কোনো মৌলিক সমস্যার সমাধান না হলেও প্রতি বছর এই নির্বাচনপ্রক্রিয়া ধারাবাহিকভাবে কেন চলছে?” এ প্রশ্ন সহজ, উত্তর জানা, আর সে উত্তরই মনোযোগ সহকারে আর-একবার বিশদে ফিরে দেখেছেন কমলেন্দুবাবু। প্রসঙ্গক্রমেই এসেছে দরদি গণতন্ত্র থেকে পেশিবহুল গণতন্ত্রের কথা। এসেছে নির্বাচনের খরচ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের গোচরে থাকা কিছু পরিসংখ্যান। রাজনীতির বিপণনে গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা ব্যক্ত হয়েছে এরপর। অন্তর্জালে ভাসিয়ে দেওয়া অসত্য সংবাদের সুনামি নিয়ে যথার্থ আলোচনা করেছেন লেখক। সবশেষে ব্যাখ্যা করা হয়েছে পোস্ট-ট্রুথ অথবা উত্তর-সত্যের কথা। সত্য নয়, অতিদ্রুত অন্তর্জালের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অর্ধসত্যই এখন বিশ্বজুড়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী। এই প্রসঙ্গে ব্রেক্সিট কিংবা ‘অচ্ছে দিন’-এর গুলিয়ে যাওয়া আধসেদ্ধ সত্যের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক। তাঁর হতাশা ফুটে উঠেছে একেবারে শেষে— “বর্তমান রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের স্তরে যে পরিবেশ বিরাজমান সেখানে গণতান্ত্রিক মুক্তচিন্তা গড়ে উঠতে পারে না।”
বইটির অন্তিম প্রচ্ছদে লেখা হয়েছে, “রাজনীতি ও রাজনৈতিক শব্দযুগলের মধ্যেই জড়িয়ে আছে অর্থবহ নীতি ও নৈতিক শব্দ দুটি। সমাসে পূর্বপদে ও উত্তরপদে বর্ণ যুক্ত না হলে ‘রাজ’ অর্থহীন শব্দ মাত্র।” লেখক হয়তো একবার মনে করিয়ে দিতে পারতেন যে, রাজনীতি রাজার নীতি নয়, বরং নীতির রাজা। তবে তাঁর বাম মনোভাব এ বইয়ে সুস্পষ্ট। তাই হয়তো ‘রাজ’ তাঁর কাছে অর্থহীন। বেশ অনেকটা সময় ধরে ভারতের রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল এই বইটি, রাজনীতিতে যারা উৎসাহী তাদের কাছে অবশ্যপাঠ্য। বিশেষ করে এই লোকসভা নির্বাচনের আবহে তো বটেই। বইয়ের শেষে আছে নির্ঘণ্ট। সেই তালিকায় আমলাশোলের পরেই আছে আমেরিকা। নমো অ্যাপের পরেই নাগপুর পেরিয়ে নাথুরাম গডসে। রাজীব গাঁধী, রাশিয়া, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ আর রাহুল গাঁধী পরপর। একেবারে শেষের দিকে হাজি মস্তান, হার্দিক পটেল, হিন্দুস্থান থমসন, হিন্দুস্থান ইউনিলিভার আর হিন্দু মহাসভা পর্যায়ক্রমে এক নতুন রাজনীতির দিশা দেখায়। নির্ঘণ্টে সব রাজনৈতিক চরিত্র এবং শব্দ মিলেমিশে একাকার। সেটাই আমাদের দেশজ রাজনীতির আসল রূপ। সেই রাজনীতি যে পণ্য হিসেবে মুনাফা লুটবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। সব মিলিয়ে তাই বইটা দু’বার পড়তে মন্দ লাগল না।
ভারতীয় রাজনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকা পুঁজিবাদের কথা অত্যন্ত সাবলীলতার সঙ্গে পেশ করেছেন লেখক। সেই নিরিখে রাজনীতি যে একটি পণ্য, তা যথেষ্ট প্রত্যয়ের সঙ্গে ব্যক্ত করা হয়েছে, পেশ করা হয়েছে এ দেশে সেই বিমূর্ত পণ্য বিপণনের ধারাবিবরণী। এই বইটির আলোচনায় রাজনীতিকে বিমূর্ত (অ্যাবস্ট্র্যাক্ট) বলা যেতেই পারে। কারণ, তার বিভিন্ন রূপ বাজারে কেনাবেচা হয়, যদিও বিষয়টির মূল অবয়ব অস্তিত্বহীন। হয়তো আর কিছুদিন পরে এই ধরনের আলোচনা হবে যে, “চলুন তো আজ বিকেলে সিটি সেন্টারে গিয়ে কিছুটা ডানপন্থী রাজনীতি বিক্রি করে আসি”, কিংবা “আজ সন্ধ্যায় কি যাদবপুর থেকে অল্প অতিবাম রাজনীতি কিনে আনা সম্ভব?” তবে চেতনার ততটা উত্তরণ আমাদের সমাজে এখনও ঘটেনি। রাজনীতি তাই পণ্য হিসেবে বিক্রিত অথবা বিকৃত হয় পরোক্ষভাবে। কমলেন্দুবাবুর বইটির প্রচ্ছদে সেই কারণেই বোধ হয় এদিক-ওদিক ছড়ানো আছে কিছু শব্দ, যেমন ওপরের দিকে ‘নীতি’, ‘আদর্শ’, ‘নৈতিকতা’, ‘সততা’ আর নীচে ‘উত্তর-সত্য’ কিংবা ‘রাজনৈতিক বাণিজ্য চক্র’। ভারতীয় রাজনীতির পণ্যায়নের প্রেক্ষাপটে মাথার শব্দগুলোর গুণগত মান বিচার করা হয়েছে যুক্তি অথবা পরিসংখ্যান দিয়ে।
কী-কী বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে বইটিতে? অতীতে লিখিত অংশটির শুরুতে লেখক অনেকটা জায়গা নিয়ে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, কেন তিনি রাজনীতিকে পণ্য বলছেন। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে এসেছে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনৈতিক দল বা নেতা-নেত্রীদের সম্পর্ক। পরের অধ্যায়েই ভারতের আর্থসামাজিক রেখাচিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি সারণি ২-তে (পৃ. ২৮) সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর সম্পদের পরিমাণ পেশ করেছেন। বিভিন্ন তথ্যের সাহায্যে লেখক উপলব্ধি করাতে চেয়েছেন যে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক পথচলা মূলত একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে এবং সেখানেই পণ্য হিসেবে রাজনীতির বিপণন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে ভারতীয় পণ্য-বাজারের বিপণন আর প্রচারের প্রসঙ্গ। এখানে কিন্তু মূল বক্তব্য পণ্যের বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত। আমেরিকা এবং তার মিত্র দেশগুলোর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লেখক জানিয়েছেন (পৃ. ৩৮, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ), “সেসমস্ত দেশে শুধু পণ্য বিকোবার জন্য বিপণন বা বিজ্ঞাপনের নিত্যনতুন চমক তার বাহারি মোড়ক তৈরি হচ্ছে না, সেখানকার রাজনীতিও অনেকদিন আগে থেকেই বিপণন আর বিজ্ঞাপনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।” এখানে কিছুটা সমালোচনার পরিসর আছে। প্রথম কথা হল এই বিবৃতিটি রাজনীতিকে পণ্য হিসেবে দেখানোর জন্যে সম্পূর্ণ নয়। জীবনের প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই রাজনীতি জড়িয়ে থাকে, ফলে তা বিপণন কিংবা বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও থাকবে। সুতরাং এক্ষেত্রে আলোচনার সাপেক্ষে অনুসিদ্ধান্তের বিষয়টি ততটা পরিষ্কার নয়। দ্বিতীয়ত বাক্যটি দু’-তিনবার পড়লে এটাও বোঝা যাবে যে, ব্যকরণগত কিছু সমস্যা আছে এখানে। বইটিতে এই ধরনের বাক্য কিংবা মুদ্রণপ্রমাদ কম হলেও খুঁটিয়ে পড়লে তা কখনও কখনও চোখে পড়ে। বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আর দু’-একটি বিষয় উত্থাপন করা জরুরি। পৃষ্ঠা সতেরোর শেষ বাক্যে লেখা হয়েছে “রাজনীতিতে পুঁজির এই বিনিয়োগ থেকে পুঁজিবাদীদের যে মুনাফা আসে তা অর্থ, প্রতিপত্তি, সম্মান ও অন্যান্য উপকরণের মাধ্যমে ফিরে আসে।” একই বাক্যে দু’বার ‘আসে’ শব্দটি ব্যবহার না করে প্রথম ‘আসে’-টিকে বাদ দিলে হয়তো ভাল শোনাত।
বইটির তৃতীয় পরিচ্ছেদ ‘ভারতীয় রাজনীতির বিপণনে রাজনৈতিক সাইবারনেটিকস’। ভারতের আর্থসামাজিক পটভূমিতে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির প্রাসঙ্গিকতা অত্যন্ত গভীরতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই অধ্যায়ে। লেখক প্রযুক্তিকে কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন এখানে। আশির দশকে এ রাজ্যের বামপন্থীদের মতটাও এমনই ছিল যে, মানুষের কাজ কেড়ে নেবে গণকযন্ত্র। সে মত গ্রহণযোগ্য নয়। তবে রাজনৈতিক সাইবারনেটিকস কেন এবং কীভাবে বিপণন ব্যবস্থার অংশীদার হয়ে উঠেছে, তা নির্ভুল যুক্তিসহকারে আলোচিত হয়েছে। যে-জায়গায় লেখকের প্রশংসা প্রাপ্য, তা হল সাইবারনেটিকস নিয়ে তিনি আলোচনা শুরু করেছেন নব্বইয়ের দশকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার যে-অসাধারণ উন্নতি আমরা এখন দেখছি, সেদিকে কিন্তু প্রায় তিরিশ বছর আগেই দিকনির্দেশ করেছেন গ্রন্থকার। আজকের দিনে প্রযুক্তির বিষয়ে সবাই যতটা সড়গড়, সেই সময় কিন্তু বিষয়টা নিয়ে জনগণ ততটা অবহিত ছিল না।
প্রথম পর্বের পরবর্তী অধ্যায় ‘ভারতীয় রাজনীতিতে ভাবমূর্তির বিপণন’। এই অংশটি বেশ দীর্ঘ এবং অনেক ক্ষেত্রেই সুখপাঠ্য। এই পরিচ্ছেদের শুরুর দিকেই উঠে এসেছে গাঁধীজিকে নিয়ে আলোচনা। লেখক মনে করিয়ে দিয়েছেন “জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বা তারও কম সময়ে গান্ধিজিই গণআন্দোলন আর জাতীয় কংগ্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাঁর কথাই শেষ কথা।” পণ্য এখানে রাজনীতি নয়, ভাবমূর্তি। আর কীভাবে তা রাজনীতির আঙিনায় সুযোগ বুঝে বেচা হয়, তাই নিয়ে যথেষ্ট আকর্ষক আলোচনা আছে বইটির এই পর্যায়ে। এই পর্বে এবং তার পরের অধ্যায় ‘উপসংহারের বদলে’-তে আছে বেশ কিছু সেই সময়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সে সব সাদাকালো ছবি এবং প্রচার দেখলে বোঝা যায় তখন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব হয়তো ছিল আজকের মতোই, তবে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে আগ্রাসী মনোভাব কিছুটা কম ছিল। বিজেপির পথ চলার শুরু সেই সময়টায়।
প্রায় তিন দশক পরে পুনঃপ্রকাশিত বইটির দ্বিতীয় অংশটি নতুনভাবে লেখা। ‘কথামুখ’ নাম দেওয়া সূচনায় লেখক পরবর্তী চারটি অধ্যায়ের প্রতি সংক্ষেপে আলোকপাত করেছেন। সেই অধ্যায়গুলি হল ‘ভারতীয় রাজনীতির বিপণনে ল্যাংটা’, ‘ভারতের উন্নয়ন অর্থনীতিতে দারিদ্র’, ‘ভারতীয় রাজনীতির বাণিজ্যচক্র ও কমপ্যাশনেট গণতন্ত্র থেকে মাস্কুলার গণতন্ত্রে উত্তরণ’ এবং ‘ভারতীয় রাজনীতির বিপণনে গণমাধ্যমের ভূমিকা’। উপসংহারে ‘উত্তর-সত্য’ সংক্রান্ত আলোচনা। এই পর্যায়ের প্রথম অধ্যায়ে যেমন গাঁধীজির কাজকর্মের সমালোচনা আছে, তার চেয়েও অনেক বেশি নিন্দা করা হয়েছে তাঁর উত্তরসূরি কংগ্রেসের নেতানেত্রীদের। তবে ‘নেকেড ফকির’ গোছের দু’টি শব্দের অনুকরণে ‘ল্যাংটা’ শব্দটি ব্যবহার না করলেই বোধ হয় ভাল শোনাত। বাম রাজনীতির আলোচনায় এই ভাগে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো পরিসংখ্যান ১৭৫ পৃষ্ঠায় সারণি ১-এ। সেখানে দেওয়া আছে বিভিন্ন লোকসভা নির্বাচনে সিপিআই এবং সিপিএমের প্রাপ্ত ভোটের অংশ। পুরো সারণিটা ছোট করে টুকে দেওয়ার লোভ সংবরণ করা কঠিন— ৬.৪% (১৯৫০), ৯.৬% (১৯৬০), ৮.৪% (১৯৭০), ৮.৮% (১৯৮০), ৭.৬% (১৯৯০), ৭.০% (২০০৪), ৩.৯% (২০০৯), ২.৬% (২০১৪)। সংসদীয় গণতন্ত্রে বাম রাজনীতির পক্ষে জনমত এভাবে কমার বিপদ নিয়ে আরও বিশদে আলোচনা করার ক্ষেত্র প্রস্তুত। কারণ, ২০১৯-এর লোকসভায় এই ভোট শতাংশ আরও কমার সম্ভাবনা আছে।
পরের অধ্যায়ে প্রচুর পরিসংখ্যান সহকারে পেশ করা হয়েছে উন্নয়ন অর্থনীতির নামে কীভাবে দারিদ্রকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে দেশজুড়ে। লেখক যথার্থই বলেছেন, “পরিণতিতে ভারতের এক বিপুলসংখ্যক দেশবাসীর জীবন-জীবিকা গভীর থেকে গভীরতর সংকটের মুখোমুখি।” তবে লেখক যখন এই বই শেষ করছেন, সেই সময়েই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে বেশ বড় মাপের কৃষক আন্দোলন। বামেদের ভোট হয়তো তাতে বাড়বে না, তবে বিজেপি, কংগ্রেস বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে বারবার ঘোষণা করতে হচ্ছে কৃষকদের জন্য বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্প। যদিও তার বাস্তবায়ন গভীর জলে। পরের পরিচ্ছেদে ভারতীয় রাজনীতির বাণিজ্যিক চক্র বোঝাতে গিয়ে লেখক প্রশ্ন করেছেন, “দেশবাসীর কোনো মৌলিক সমস্যার সমাধান না হলেও প্রতি বছর এই নির্বাচনপ্রক্রিয়া ধারাবাহিকভাবে কেন চলছে?” এ প্রশ্ন সহজ, উত্তর জানা, আর সে উত্তরই মনোযোগ সহকারে আর-একবার বিশদে ফিরে দেখেছেন কমলেন্দুবাবু। প্রসঙ্গক্রমেই এসেছে দরদি গণতন্ত্র থেকে পেশিবহুল গণতন্ত্রের কথা। এসেছে নির্বাচনের খরচ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের গোচরে থাকা কিছু পরিসংখ্যান। রাজনীতির বিপণনে গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা ব্যক্ত হয়েছে এরপর। অন্তর্জালে ভাসিয়ে দেওয়া অসত্য সংবাদের সুনামি নিয়ে যথার্থ আলোচনা করেছেন লেখক। সবশেষে ব্যাখ্যা করা হয়েছে পোস্ট-ট্রুথ অথবা উত্তর-সত্যের কথা। সত্য নয়, অতিদ্রুত অন্তর্জালের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অর্ধসত্যই এখন বিশ্বজুড়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী। এই প্রসঙ্গে ব্রেক্সিট কিংবা ‘অচ্ছে দিন’-এর গুলিয়ে যাওয়া আধসেদ্ধ সত্যের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক। তাঁর হতাশা ফুটে উঠেছে একেবারে শেষে— “বর্তমান রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের স্তরে যে পরিবেশ বিরাজমান সেখানে গণতান্ত্রিক মুক্তচিন্তা গড়ে উঠতে পারে না।”
বইটির অন্তিম প্রচ্ছদে লেখা হয়েছে, “রাজনীতি ও রাজনৈতিক শব্দযুগলের মধ্যেই জড়িয়ে আছে অর্থবহ নীতি ও নৈতিক শব্দ দুটি। সমাসে পূর্বপদে ও উত্তরপদে বর্ণ যুক্ত না হলে ‘রাজ’ অর্থহীন শব্দ মাত্র।” লেখক হয়তো একবার মনে করিয়ে দিতে পারতেন যে, রাজনীতি রাজার নীতি নয়, বরং নীতির রাজা। তবে তাঁর বাম মনোভাব এ বইয়ে সুস্পষ্ট। তাই হয়তো ‘রাজ’ তাঁর কাছে অর্থহীন। বেশ অনেকটা সময় ধরে ভারতের রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল এই বইটি, রাজনীতিতে যারা উৎসাহী তাদের কাছে অবশ্যপাঠ্য। বিশেষ করে এই লোকসভা নির্বাচনের আবহে তো বটেই। বইয়ের শেষে আছে নির্ঘণ্ট। সেই তালিকায় আমলাশোলের পরেই আছে আমেরিকা। নমো অ্যাপের পরেই নাগপুর পেরিয়ে নাথুরাম গডসে। রাজীব গাঁধী, রাশিয়া, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ আর রাহুল গাঁধী পরপর। একেবারে শেষের দিকে হাজি মস্তান, হার্দিক পটেল, হিন্দুস্থান থমসন, হিন্দুস্থান ইউনিলিভার আর হিন্দু মহাসভা পর্যায়ক্রমে এক নতুন রাজনীতির দিশা দেখায়। নির্ঘণ্টে সব রাজনৈতিক চরিত্র এবং শব্দ মিলেমিশে একাকার। সেটাই আমাদের দেশজ রাজনীতির আসল রূপ। সেই রাজনীতি যে পণ্য হিসেবে মুনাফা লুটবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। সব মিলিয়ে তাই বইটা দু’বার পড়তে মন্দ লাগল না।
No comments