প্রকৃতির মাঝে সজীব নেপালের থারু গোষ্ঠী by বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী
বাংলা
চলচ্চিত্রে প্রায়ই চৌধুরী সাহেবের ভয়ে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খায়!
বাংলাদেশে চৌধুরী বংশের অর্থবিত্ত, সামাজিক অবস্থান, প্রভাব ও প্রতাপকে
বোঝাতে রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয় এটি। মজার ব্যাপার হলো, নেপালে প্রকৃতির খুব
কাছাকাছি বসবাস করা এবং পুরোপুরি কৃষিনির্ভর, নিরীহ ও সাধারণ একটি গোষ্ঠীর
নাম ‘থারু’, যাদের প্রধান বংশের নাম ‘চৌধুরী’। থারু জনগোষ্ঠী প্রধানত
পাঁচটি উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত। এগুলো হলো– রানা, কাঠারিয়া, ডাংগাঊরা, কচিলা ও
মেখ। তাদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগের বংশ পদবী ‘চৌধুরী’।
কৃষিকাজ, মৎস্য ও বন্যপ্রাণী শিকারের জন্য নানান উপকরণ |
নেপালের
আকাশছোঁয়া বিশাল বিশাল পাহাড়ে ঝিম ধরা নিস্তব্ধতা। এর সঙ্গে খরস্রোতা
পাহাড়ি নদীর স্রোতের গুঞ্জরনের রেশ কাটতে না কাটতেই চোখ আটকে যায় সবুজ মাঠ ও
উপত্যকায়, যা তরাই ও মধ্য তরাই অঞ্চল। এটিই নেপালের সবচেয়ে বড় সমতল ভূমি
বা উপত্যকা। এখানেই প্রকৃতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে থাকা থারু গোষ্ঠীর
বসবাস। কৃষিপ্রধান এই মানুষদের রয়েছে মুগ্ধ করার মতো চমৎকার ইতিহাস ও
ঐতিহ্য। নেপালের তরাই ও মধ্য তরাই অঞ্চল এবং ভারতের উত্তরাখণ্ড,
উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে প্রায় ২১ লাখ থারুর বসবাস। তাদের প্রায় ৮০ ভাগের অধিক
বসবাস করে নেপালে।
থারুদের প্রাচীন ও সবচেয়ে বড় বাসস্থান মধ্য তরাইয়ের দাং উপত্যকা তৈরি নিয়ে রয়েছে চমৎকার এক কিংবদন্তি। থারু বিশ্বাস অনুযায়ী, দাং উপত্যকা পানিতে প্লাবিত ছিল। থারুদের গুরু বাবা (ধর্মীয় নেতা) একটি পদ্মপাতা দাং উপত্যকার পানিতে ভাসিয়ে দেন। এরপর সেখান থেকে নতুন পদ্ম গাছ তৈরি হয় এবং গাছের শিকড়ে সৃষ্টি হয় কেঁচো। এই কেঁচো থেকে তৈরি হলো পবিত্র মাটি ও ভূমি। সেই ভূমিতে আস্তে আস্তে গাছপালা সৃষ্টি হলো এবং পশু-পাখি অবাধে বিচরণ শুরু করলো। এরপর গুরুবাবা তার অনুসারী থারুদের দাং উপত্যকায় বসবাসের জন্য পাঠিয়ে দিলেন।
থারুদের প্রাচীন ও সবচেয়ে বড় বাসস্থান মধ্য তরাইয়ের দাং উপত্যকা তৈরি নিয়ে রয়েছে চমৎকার এক কিংবদন্তি। থারু বিশ্বাস অনুযায়ী, দাং উপত্যকা পানিতে প্লাবিত ছিল। থারুদের গুরু বাবা (ধর্মীয় নেতা) একটি পদ্মপাতা দাং উপত্যকার পানিতে ভাসিয়ে দেন। এরপর সেখান থেকে নতুন পদ্ম গাছ তৈরি হয় এবং গাছের শিকড়ে সৃষ্টি হয় কেঁচো। এই কেঁচো থেকে তৈরি হলো পবিত্র মাটি ও ভূমি। সেই ভূমিতে আস্তে আস্তে গাছপালা সৃষ্টি হলো এবং পশু-পাখি অবাধে বিচরণ শুরু করলো। এরপর গুরুবাবা তার অনুসারী থারুদের দাং উপত্যকায় বসবাসের জন্য পাঠিয়ে দিলেন।
কৃষিকাজ, মৎস্য ও বন্যপ্রাণী শিকারের জন্য নানান উপকরণ |
থারুরা
গুচ্ছ গুচ্ছভাবে গ্রামে বসবাস করে। প্রতিটি গ্রামে আছে একজন গ্রামপ্রধান,
যিনি ‘মাহাটন’ নামে পরিচিত। একেকটি থারু পরিবারের গৃহপ্রধান (যাদের
গারধুরিয়া বলে) একসঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে একজন জ্ঞানী, সাহসী ও দক্ষ
গ্রামপ্রধান নির্বাচন করেন। নির্বাচনের দিন গ্রামে নাচ-গানের দারুণ
উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। ঘরবাড়িগুলো নতুনভাবে সাজানোর পাশাপাশি সবার
মাঝে নতুন চালের ভাতের সঙ্গে নানান শাকসবজি, শামুক ও কাঁকড়া সিদ্ধ পরিবেশন
করা হয়।
পায়ের খড়ম, থারু পোশাক পরা লেখক ও বিয়ের পালকী |
গ্রামপ্রধান
নির্বাচনের কিছুদিন পর প্রথা অনুযায়ী থারু পুরুষরা শিকারে বের হয়। শিকারের
দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর থারু পুরুষ ভাতের তৈরি বিয়ার (যা ‘আন্দিক
জার’ নামে প্রচলিত) পান করে। এরপর থারু শৌর্য-বীর্যের প্রতীক হিসেবে মাথায়
জড়িয়ে নেয় সাদা রঙের কাপড়। গাছ বা বুনো ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে এবং গাছে চড়ে
থারুরা তীর-ধনুক, বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ও বর্শা দিয়ে শিকার করে থাকে। সারাদিন
বনে ঘুরে বনমোরগ, ইঁদুর, বেজী, গিরগিটি, বন্য শুঁকর ইত্যাদি শিকার করে
বিকেলে বাড়ি ফেরা হয় তাদের। সন্ধ্যায় উৎসবমুখর পরিবেশে পরিবারের সবাই মিলে
শিকার করা পাখি বা প্রাণীর পেকওয়া বা ঝোল রান্না করে খায় তারা। থারুদের
অত্যন্ত প্রিয় ভাতের বিয়ারও সঙ্গে থাকে। প্রাকৃতিকভাবে ফসল উৎপাদন, মাছ
ধরা, বণ্যপ্রাণী শিকার ও বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে থারুরা জীবিকা নির্বাহ
করে।
কৃষিকাজ, মৎস্য ও বন্যপ্রাণী শিকারের জন্য নানান উপকরণ |
থারুদের
খাদ্য সংস্কৃতিতে রয়েছে চমৎকার বৈচিত্র্য। আঠালো ভাতের নাম আন্দিক। আর
ঢীক্রি হলো চালের আটার ডোকে বাষ্পের সাহায্যে সেদ্ধ করে বানানো সসেজ। এর
সঙ্গে ধনিয়ার গুঁড়ো, টক চাটনি, ডাল ও তরকারির ঝোল দিয়ে খেতে বেশ ভালো লাগে
তাদের। আর সঙ্গে যদি থাকে চিকন সুগন্ধি চালের ভাতের বিয়ার, তাহলে তো কথাই
নেই! থারুরা এই বিয়ার পানের মাধ্যমে সারাদিনের শক্তি সঞ্চয় করে। চাটনি ও
জিরা-ধনিয়া গুঁড়োসহ পাহাড়ি নদীর আসালা মাছ ভাজি ও মোরগ বা মুরগি আর কবুতরের
পেকওয়া তাদের ভীষণ পছন্দের খাবার। এর পাশাপাশি থারুরা শামুক ও কাঁকড়া
সেদ্ধ খেতে ভীষণ ভালোবাসে।
ঢীক্রি ও আসালা মাছ ভাজা (ধনিয়া গুঁড়োসহ পরিবেশনা) |
থারু
সম্প্রদায়ের বাড়িগুলো সাধারণত মাটি, গোবর, বাঁশ, কাঠ, ছন ও পোড়া মাটির
টালী দিয়ে তৈরি হয়। সোনালি বা মাটি রঙের বাড়িগুলো দেখতে খুব সুন্দর।
থারুদের পোশাক পরিচ্ছদ ও গয়না খুবই সাধারণ। তারা সাদা রঙের কাপড় পরতে বেশ
স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ঐতিহাসিকভাবে থারুরা কাঠের তৈরি জুতা ব্যবহার করতো।
প্রথা টিকিয়ে রাখতে এখনও অনেক থারু কাঠের তৈরি জুতা ব্যবহার করে।
থারুরা প্রথাগত নিয়মে বিয়ের বন্ধনে জড়ায়। বেশ কয়েকদিন ধরে উৎসবমুখর পরিবেশে চলতে থাকে আনুষ্ঠানিকতা। এ সময় বর-কনে সাদা রঙের ঐতিহ্যবাহী থারু পোশাক পরে। বিয়ের পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে বর ও কনেকে গলায় ঘাসের মালা রাখতে হয়। ঘরগুরুয়া বা পুরোহিতের উপস্থিতিতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। যে চুলায় বর ও কনের জন্য সরিষার তেল দিয়ে বিভিন্ন রান্না হবে, তাতে আগুন জ্বালিয়ে সরিষার তেল ও ঘাসে মন্তর পড়ে পবিত্র করে বিয়ের কাজ শুরু করেন পুরোহিত। বিয়ের পর কনে পালকিতে চড়ে বরের বাড়িতে যায়।
থারুরা প্রথাগত নিয়মে বিয়ের বন্ধনে জড়ায়। বেশ কয়েকদিন ধরে উৎসবমুখর পরিবেশে চলতে থাকে আনুষ্ঠানিকতা। এ সময় বর-কনে সাদা রঙের ঐতিহ্যবাহী থারু পোশাক পরে। বিয়ের পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে বর ও কনেকে গলায় ঘাসের মালা রাখতে হয়। ঘরগুরুয়া বা পুরোহিতের উপস্থিতিতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। যে চুলায় বর ও কনের জন্য সরিষার তেল দিয়ে বিভিন্ন রান্না হবে, তাতে আগুন জ্বালিয়ে সরিষার তেল ও ঘাসে মন্তর পড়ে পবিত্র করে বিয়ের কাজ শুরু করেন পুরোহিত। বিয়ের পর কনে পালকিতে চড়ে বরের বাড়িতে যায়।
পাহাড়ি মোরগের পেকওয়া (রন্ধন প্রস্তুতি ও ধনিয়া, জিরা গুঁড়োসহ পরিবেশনা) |
নেপালের
মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬ দশমিক ৬ ভাগ হচ্ছে থারু জনগোষ্ঠী। তাদের আছে
প্রবঞ্চনা ও কষ্টের এক দীর্ঘ আখ্যান, যেখানে পাওয়া যাবে সহজ সরল থারুদের
প্রতারিত হওয়া আর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প।
তরাই ও মধ্য তরাইয়ের বিশাল বনাঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রচণ্ড প্রকোপ ছিল। সেখানে অন্য কোনও জনগোষ্ঠী বাস করতে চাইতো না। তৎকালীন শাসকেরা সহজ-সরল, দরিদ্র থারুদের ওই অঞ্চলে বসবাসের জন্য পাঠিয়ে দিতো। একপর্যায়ে থারুরা কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে বন থেকে ঝোপঝাড় কমিয়ে চাষযোগ্য সমতল ভূমি তৈরি করতে সক্ষম হয়। ফলে পর্যায়ক্রমে ম্যালেরিয়াবাহী মশার পরিমাণও কমে আসে। তখন শাসকেরা ওই জমিগুলো থারুদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নেপালের রাজপরিবারের সদস্যদের, সরকারি ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের উপহার হিসেবে দেওয়া শুরু করে। ফলে থারুদের বসবাসের জায়গা ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসে।
তরাই ও মধ্য তরাইয়ের বিশাল বনাঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রচণ্ড প্রকোপ ছিল। সেখানে অন্য কোনও জনগোষ্ঠী বাস করতে চাইতো না। তৎকালীন শাসকেরা সহজ-সরল, দরিদ্র থারুদের ওই অঞ্চলে বসবাসের জন্য পাঠিয়ে দিতো। একপর্যায়ে থারুরা কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে বন থেকে ঝোপঝাড় কমিয়ে চাষযোগ্য সমতল ভূমি তৈরি করতে সক্ষম হয়। ফলে পর্যায়ক্রমে ম্যালেরিয়াবাহী মশার পরিমাণও কমে আসে। তখন শাসকেরা ওই জমিগুলো থারুদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নেপালের রাজপরিবারের সদস্যদের, সরকারি ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের উপহার হিসেবে দেওয়া শুরু করে। ফলে থারুদের বসবাসের জায়গা ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসে।
থারুদের বাদ্যযন্ত্র |
পাশাপাশি
থারুদের ওপর চলে ‘কামাইয়া নামে’ একধরনের পদ্ধতির প্রয়োগ। এর মাধ্যমে
দরিদ্র থারুরা ভূমির মালিকদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে একবছর কাজ করার সুযোগ পেতো।
এরপর প্রতিবছর মাঘি উৎসবে নতুন করে চুক্তি করতে হতো। এভাবে প্রতিবছর
মূলধনের (থারু ভাষায় বলে সংকি) ওপর সুদের পরিমাণ বাড়তেই থাকতো, যা কখনও
দরিদ্র থারুরা শোধ করতে পারতো না। ফলে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম ঋণের
বোঝা কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়াতো।
দীর্ঘদিন কষ্টভোগের পর একপর্যায়ে থারুরা কামাইয়া পদ্ধতির বিরুদ্ধে জোরালো দাবি তোলে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে নেপালি সংবিধানে কামাইয়া পদ্ধতি বন্ধের বিষয়ে ধারা সংযুক্ত করা হয়। অবশেষে ২০০২ সালে নেপালি রাজার অধীন সংসদ থারু জনগোষ্ঠীকে ‘কামাইয়া মুক্ত’ হিসেবে ঘোষণা করে।
প্রকৃতির সঙ্গে বৈচিত্র্য নিয়ে মিশে থাকা সহজ-সরল মনের থারুরা তাদের সারল্য ও ঐতিহ্য ধরে রেখে এগিয়ে চলুক।
>>>লেখক: ফার্মাসিস্ট ও সমাজকর্মী
দীর্ঘদিন কষ্টভোগের পর একপর্যায়ে থারুরা কামাইয়া পদ্ধতির বিরুদ্ধে জোরালো দাবি তোলে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে নেপালি সংবিধানে কামাইয়া পদ্ধতি বন্ধের বিষয়ে ধারা সংযুক্ত করা হয়। অবশেষে ২০০২ সালে নেপালি রাজার অধীন সংসদ থারু জনগোষ্ঠীকে ‘কামাইয়া মুক্ত’ হিসেবে ঘোষণা করে।
প্রকৃতির সঙ্গে বৈচিত্র্য নিয়ে মিশে থাকা সহজ-সরল মনের থারুরা তাদের সারল্য ও ঐতিহ্য ধরে রেখে এগিয়ে চলুক।
>>>লেখক: ফার্মাসিস্ট ও সমাজকর্মী
থারু সম্প্রদায়ের বাড়ি |
No comments