সৌদি বিচার প্রক্রিয়া: জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়, অতঃপর শিরশ্ছেদ

সৌদি আরবে সরকারবিরোধী অথবা সংখ্যালঘু নিরাপরাধ ব্যক্তিদের কাছে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের মধ্য দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ভয়াবহ বাস্তবতা উঠে এসেছে সিএনএন-এর এক অনুসন্ধানে। ক’দিন আগে রিয়াদের পক্ষ থেকে যে ৩৭ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ২৫ জনের বিচার কার্যক্রমের নথি হাতে পেয়েছে ওই মার্কিন সংবাদমাধ্যম। নথিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১১ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে। সরকারবিরোধী প্রতিবাদে অংশ নেওয়া ১৪ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী গড়ে তোলার কথিত অপরাধে। শিরশ্ছেদের শিকার ওই ব্যক্তিদের অধিকাংশই শিয়া মুসলিম।
গত ২৩ এপ্রিল (মঙ্গলবার) সৌদি আরব ৩৭ জন ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। রিয়াদ, মক্কা, মদিনা, সংখ্যালঘু শিয়া অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চল প্রদেশ ও প্রধানত সুন্নি অধ্যুষিত অঞ্চল কাসিমে এ শিরশ্ছেদ করা হয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর একজনকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। অন্যদের প্রতি সতর্কবাণী হিসেবে এ দৃশ্য প্রদর্শন করা হয়। দেশটির সরকারি সংবাদ সংস্থা এসপিএর খবর অনুযায়ী, সন্ত্রাসবাদে জড়ানো, চরমপন্থী মতাদর্শ পোষণ, দুর্নীতি এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য সন্ত্রাসী সেল গঠনের কারণে তাদের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে।
২০১৬ সালে শুরু হওয়া তিনটি বিচারিক নথিতে ওই ৩৭ জনের মধ্যে ২৫ জনের তথ্য পেয়েছে সিএনএন। আদালতের নথি বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিরেশ্ছেদর শিকার হওয়া ব্যক্তিদের অনেকেই নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে আদালতের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানিয়েছিলেন। জবানবন্দিতে তারা দাবি করেছিলে, নির্যাতনাকারীরাই তাদের স্বীকারোক্তি লিখে দিয়েছিল। কেউ কেউ জিজ্ঞাসাবাদ কালে নির্যাতনের প্রমাণ তুলে ধরেন। দণ্ড কার্যকর হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন মুনির আল-আদম নামের ২৭ বছর বয়সী একজন। তিনি শারীরিকভাবে অন্ধ ও বধির। প্রাণভিক্ষার আবেদনে তিনি বলেন, ‘স্বীকারোক্তির লেখা আমার নয়। আমি কোনো স্বীকারোক্তি লিখিনি। এই অপবাদ জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তা নিজ হাতে লিখেছেন।’
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, শিরশ্ছেদ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন অপ্রাপ্তবয়স্ক। সর্বকনিষ্ঠের নাম আব্দুল কারিম আল-হাওয়াজ। তাঁর বিরুদ্ধে ১৬ বছর বয়সে সহিংস বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। আল-হাওয়াজের মৃত্যুদণ্ডাদেশের খবরে কড়া সমালোচনা করে জাতিসংঘ। একই সঙ্গে তাঁর মুক্তিতে সৌদি সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। আরেক অপ্রাপ্তবয়স্কের নাম মুজতবা আল-সুয়েকাত। বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার অভিযোগে ২০১২ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। মুজতবা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্টার্ন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে চেয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার উদ্দেশে দাম্মাম বিমানবন্দরে এলে তিনি গ্রেপ্তার হন।
অবশ্য বিচার নিয়ে এসব নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি দেশটির সরকার। তবে এক সরকারি কর্মকর্তা শিরশ্ছেদের দিন সিএনএনকে বলেন, অনেক আগে থেকেই সৌদি আরব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। যারা সন্ত্রাস ছড়ায়, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় এবং আমাদের মূল্যবোধ নষ্ট করে, তাদের কোনো ছাড় নেই। যাদের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে, তাঁদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছিল এবং তাঁরা সেখানে দোষী সাব্যস্ত হন।’
সৌদি বার্তা সংস্থা এসপিএর তথ্য অনুযায়ী, এই ৩৭ জনকে নিয়ে সৌদি আরবে এ বছর অন্তত ১০০ জনের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসাব অনুযায়ী গত বছর শিরশ্ছেদ করা হয় ১৪৯ জনের।

No comments

Powered by Blogger.