স্বপ্নের বিজয় দিবস ২০২০ by গোলাম মাওলা রনি
২০১৫
সালের বিজয় দিবসটি হয়তো বিগত দিনগুলোর মতোই গতানুগতিক হবে। একদল লোক
বলবেন- তারাই সবকিছু করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং বিজয় কেবল আমাদেরই
শ্রমলব্ধ ফসল- এমনতর কথা বলা শেষ হওয়ার সাথে সাথে অন্য দল হৈ-হুল্লোড় করে
উঠবেন এবং বলবেন- বিজয়ে ওদের কোনো কৃতিত্ব নেই। ওরা তো শুধু গলাবাজি করেছে
এবং সুবিধাজনক স্থানে থেকে আরাম আয়েশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ করেছি আমরা।
অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে লড়েছি। শত্রুর হাতে বন্দী হয়েছি- তাদের গুলি, বোমা
গ্রেনেডে হারিয়েছি আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব এবং সহযোদ্ধাদের। নিজেরা যেমন
আহত হয়েছি, তেমনি মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে শত্রুসেনাদের শিকারে পরিণত
হয়েছিল পরিবারের আপনজনেরা। হারিয়েছি পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্ত্রী এবং কন্যা।
পরিবারের তরুণী ও কিশোরীরা নিগ্রহের শিকার হতে হতে কেউ কেউ তো মারাই গেল,
অপমানে কেউবা করল আত্মহত্যা। যারা বেঁচে রইল তারা বীরাঙ্গনা হিসেবে
সমাজসংসারের করুণার পাত্রী হয়ে একটি দুর্বিষহ জীবন বেছে নিলো। কাজেই আমাদের
সামনে যারা মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় এবং স্বাধীনতা নিয়ে গলাবাজি করে তাদের কাছে
প্রশ্ন- তোমরা কোন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলে এবং কয়টা শত্রুসৈন্য ও রাজাকারের
মুখোমুখি হয়েছিল? তোমরা কি খালি হাতে বাঁশের লাঠি নিয়ে যুদ্ধ করেছিলে,
নাকি অস্ত্রশস্ত্র কিছু ছিল? তোমাদের পরিবারের কেউ কি শত্রুসৈন্য কিংবা
তাদের সহযোগীদের দ্বারা হতাহত কিংবা নিগ্রহের শিকার হয়েছিল- যদি উত্তর হয়
হ্যাঁ, তবে বলো তাদের নাম কী? আর উত্তর যদি হয় না, তবে বলো- সত্যি করে বলো,
আল্লাহর ওয়াস্তে তোমাদের মরহুম বাবা-মায়ের নামে শপথ করে বলো, মহান
মুক্তিযুদ্ধের দুর্বিষহ নয়টি মাস কোথায় ছিলে এবং বিজয়ের এই দিনে অর্থাৎ
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিনটিতে কোথায় ছিলে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পরস্পরবিরোধী দু’টি পক্ষ গত ৪০ বছর ধরে যেমন উপরিউক্ত কথাবার্তা বলে আসছেন, তেমনি একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, সমর্থন ও সহযোগিতা তো করেইনি বরং বিরোধিতা করেছে। তবে এ কথা সত্য, দেশের বেশির ভাগ মানুষ মনেপ্রাণে শত্রুসেনাদের ঘৃণা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন করতেন। অন্য দিকে, শত্রুসেনাদের সাহায্যকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সক্রিয় লোকজনের সংখ্যা, সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি বিত্ত-বৈভব মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনায় তাদের জনসমর্থন ছিল খুবই সীমিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন কিছু নিরপেক্ষ মানুষ ছিলেন, তদ্রুপ স্বাধীন বাংলাদেশেও নিরপেক্ষ মানুষের অভাব নেই। ফলে আমাদের বিজয় দিবস নিয়ে ২০১৫ সালেও চার শ্রেণীর মানুষের চার ধরনের প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সরাসরি সম্মুখসমরে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা, দেশে-বিদেশে নিরাপদ আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং আরাম-আয়েশে থাকা কথিত মুক্তিযোদ্ধা, নিরাপদ ব্যক্তিরা এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা যেভাবে বিভক্তি সৃষ্টি করে আসছে, তা যেন আগামী দিনে না হয় সে জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বর্তমান প্রজন্মের একজন যুবক হিসেবে মনে করি, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম যারা ১৯৭১ সালের পর জন্মেছেন, তারা সবাই বাংলাদেশকে ভালোবাসেন অন্তরের অন্তস্তল থেকে। তারা কোনো অবস্থাতেই দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং বিজয় দিবস নিয়ে কোনো বিতর্ক, দোষারোপ কিংবা বিভক্তি দেখতে চান না। তারা চান প্রতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দের বার্তা। মহান বিজয় দিবসের আনন্দ সবার মাঝে সর্বজনীনভাবে বিলিয়ে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রকে অবশ্যই কতগুলো পদক্ষেপ নিতে হবে। আমার মতে, নিম্নলিখিত বিষয়গুলো যথানিয়মে আগামী পাঁচটি বছর প্রতিপালিত হলে আমরা ২০২০ সালে একটি সফল, সম্ভাবনাময় এবং স্বপ্নের বিজয় দিবস পালন করতে পারব-
এক. চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করার জন্য বিপ্লবী নেতা মাও সেতুং এবং দেং জিয়াও পিং যেভাবে সাংস্কৃতিক বিপ্লব সফল করেছিলেন, তদ্রুপ আমাদের দরকার একটি যুগান্তকারী সাংস্কৃতিক বিপ্লব। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ঐতিহ্য, ধর্মীয় রীতিনীতি, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং বিনোদনকে মাথায় রেখে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপরেখা প্রণীত হবে যাতে ১৬ কোটি মানুষ নির্দ্বিধায় দেশ-মাতৃকাকে ভালোবাসতে পারে। দেশকে অন্তর থেকে যারা ভালোবাসতে এবং শ্রদ্ধা করতে পারবেন না, তাদের কাছে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের কোনো মূল্য নেই।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সফল করার জন্য যুদ্ধকালীন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময়কার গান, কবিতা, গল্প, নাটক, যাত্রাপালা, কথিকা ইত্যাদি যেমন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস-শক্তি জোগাত, তেমনি জনসাধারণকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলত। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও আমরা যখন সেই সুরলহরী এবং কথামালা শুনি, তখন নিজের অজান্তে কখন যে একাত্তরের রণাঙ্গনে চলে যাই, তা টেরই পাই না। কাজেই আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং বিজয় নিয়ে যত দিন পর্যন্ত জনপ্রিয় সুরসঙ্গীত, কাব্য, গীতিনাট্য, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি রচিত না হবে, ততদিন পর্যন্ত বিজয় উৎসবকে সর্বজনীন করা যাবে না।
সরকারি মদদপুষ্ট কবি-সাহিত্যিক কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মীদের টাকা-পয়সা এবং উৎকোচ দিয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্ভব নয়। এ জন্য রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের কৌশল রপ্ত করতে হবে। ভারত, চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া, কিউ বা, ভেনিজুয়েলা প্রভৃতি রাষ্ট্রের সফল সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ইতিহাস জানতে হবে এবং তারা যেভাবে ও যাদের মাধ্যমে বিপ্লবের সূচনা করেছিল সেভাবে আমাদেরও শুরু করতে হবে। মানুষ যখন বাঙালি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের গৌরব এবং কীর্তিগাথা হৃদয়ে ধারণ করতে পারবে, তখন বাংলাদেশের পতাকা, মাটি, বাতাস, আলো, পানি, বনবনানী, পাখপাখালি এবং শষ্যক্ষেত্র মনমস্তিষ্কে দেশপ্রেমের জোয়ার সৃষ্টি করবে।
দুই. বিজয়ের আনন্দ সর্বজনীন করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ধাপটি হলো অর্থনৈতিক বিজয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ধনী হওয়া কিংবা যেকোনোভাবে টাকা উপার্জনকে অর্থনৈতিক বিজয় বলা যায় না। রাষ্ট্র যখন তার ব্যয় নির্বাহের জন্য স্বাধীন, সার্বভৌম আর স্বাবলম্বী হবে তখন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিজয় সূচিত হবে। এ ক্ষেত্রে জনমতের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে কিংবা অন্যান্য দেশ সন্দেহের চোখে দেখে, এ রূপ কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করে রাষ্ট্র কোনো দিন প্রশংসিত হতে পারবে না। অন্য দিকে, জনগণ যখন তার কর্ম, আয়, রোজগার এবং জীবনযাপন সম্পর্কে মোটামুটি সন্তুষ্ট থাকবে তখন থেকে অথনৈতিক বিজয় সূচিত হবে।
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা ও ব্যবস্থা রাষ্ট্র এবং এ দেশের জনগণের জন্য মোটেই সম্মানজনক এবং আনন্দদায়ক নয়। আমাদের জাতীয় আয়ের বিরাট অংশই ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম, অত্যাচার, চুরি, লুণ্ঠন, রাহাজানি, দখল, মিথ্যাচার ও অবিচার দ্বারা অর্জিত, কালো টাকা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কালো টাকার মালিকপক্ষ, এই টাকার জোগানদাতা এবং সংরক্ষণকারী- সবাই এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশে অমানবিক ও অনৈতিক জীবনযাপন করে। এই শ্রেণীর লোকেরা উন্মত্ত হয়ে উল্লাস করতে পারে কিন্তু বিজয়ীর বেশে আনন্দ করতে পারে না। তারা সবসময় গভীর আতঙ্ক নিয়ে একটি সর্বনাশের আশঙ্কায় দিন যাপন করে।
দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনের দ্বিতীয় সমস্যা হলো অনৈতিক বিলিবণ্টন এবং নিয়মবহির্ভূত প্রতিযোগিতা। ক্ষমতাবানেরা সবসময় যোগ্য ও মেধাবী লোকদের বঞ্চিত এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিজেরাই ভোগ করে থাকে। ব্যক্তি খাতের মেধাবী ও উদ্যমীরা এই অবস্থায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। যোগ্যরা অযোগ্যদের দিয়ে শাসিত এবং প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হন। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। দেশের তৃতীয় সমস্যা হলো অসম্মানজনক পেশা এবং অমর্যাদাকর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আয় উপার্জন। দেশের প্রায় সোয়া কোটি লোক বিভিন্ন দেশে মানবেতর পরিবেশে খাটছে। দেশের প্রায় পঞ্চাশ লাখ শ্রমিক মানবেতর পরিবেশে বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করছে। কুলি, মজুর, রিকশাচালক, ড্রাইভার হেলপার, মিস্ত্রিসহ আরো প্রায় এক কোটি লোক কাজ করতে গিয়ে কর্মপরিবেশের অভাবে প্রায় প্রতিদিনই বঞ্চিত, অপমানিত ও ধিকৃত হচ্ছে। সুতরাং তিন কোটি শ্রমজীবী মানুষের ১২ কোটি হাত-পা দ্বারা অর্জিত টাকা পয়সার প্রতি পরতে লুকায়িত থাকে সীমাহীন বেদনা, অপমান আর কষ্ট। সেই অর্থের ওপর দাঁড়িয়ে কেবল শয়তান অথবা নির্বোধই উল্লাস করতে পারে।
পৃথিবীর অনুকরণীয় দেশগুলো তাদের নাগরিকদের পেশা, কর্মপরিবেশ এবং আয় উপার্জন সম্মানজনক করার কাজে সফলতা অর্জনের পরপরই অর্থনৈতিক বিজয় লাভ করেছে। মরুর বুকে ছাগল চরানোর রাখাল, কোনো বেদুইন কিংবা দুর্জনের সেবাদাসী হওয়া এবং ফুটপাথে বসা দর্জির চেয়ে কম মূল্যে জামা কাপড় সেলাইয়ের মাধ্যমে টাকা উপার্জন করে অর্থনৈতিক বিজয় অর্জন অসম্ভব।
তিন. সামাজিক শৃঙ্খল ছাড়া কোনো জনগোষ্ঠী বিজয় উৎসব পালন করতে পারে না। আমাদের দেশে বর্তমান সামাজিক শৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন আজ বুমেরাং হয়ে গেছে। ক্ষমতাধরদের মদদে আজ দুর্বৃত্ত, লম্পট, অসৎ প্রকৃতির অশিক্ষিতরা সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ছোটরা বড়দের অপমান করছে। শিক্ষিতজনেরা অশিক্ষিতদের দুয়ারে ধরণা দিতে বাধ্য হচ্ছে জীবন বাঁচানোর তাগিদে। সৎলোকেরা মাথা নিচু করে চলছে এবং অসৎরা বীরদর্পে হেঁটে বেড়াচ্ছে। সৎকর্ম করতেও লোকজন ভয় পাচ্ছে। অন্য দিকে, মন্দ কর্মের জন্য পুরস্কার নিশ্চিত হওয়ায় দিবালোকে যত্রতত্র এর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ কেবল জেন্ডার বৈশিষ্ট্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। অরুচিকর পোশাক পরিধান এবং মন্দ কর্মে নারী-পুরুষ একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে সমাজকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে।
সামাজিক শৃঙ্খলার প্রথম অধিক্ষেত্র হলো পরিবার। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পরিবার প্রথা এখন ধ্বংসের শেষ প্রান্তে। সামাজিক রীতিনীতি নেই বললেই চলে। কাউকে সালাম জানানো, মুরব্বিদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন, জ্ঞানী-গুণী এবং পদস্থদের সম্মান ও নেতাদের সমীহ করার সৌজন্য আজ আর অবশিষ্ট নেই। ধর্মীয় রীতিনীতি, সম্প্রীতি, বিশ্বাস, পারস্পরিক আস্থা ইত্যাদি উঠে গেছে। মারামারি, হানাহানি, কলহবিবাদ, অপরকে দোষ দেয়া এবং হেয় করার প্রবৃত্তি আমাদের সমাজকে অক্টোপাসের মতো গ্রাস করেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং সুশীলসমাজ আজ প্রায় অবলুপ্ত। অন্য দিকে, একজন মানুষ যে ব্যক্তিগতভাবে ভালো হবেন এবং ভালো থাকবেন সেই সুযোগ ও সম্ভাবনার দ্বারগুলো ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের সামাজিক জীবনে শুরু হয়েছে ঘোর অমানিশার এক কঠিন কালো রাত- যা অতিক্রম না করে বিজয়ের আনন্দ উপভোগ অসম্ভব।
সামাজিক সম্প্রীতির চমৎকার উদাহরণ গড়ে তুলেছে উন্নত বিশ্ব। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, ভুটান ও ইরান স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রথার মাধ্যমে প্রতিটি জনপদে অনুসরণযোগ্য স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ যদি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা এবং আনুকূল্যে স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে, তবেই আমাদের বিজয় দিবসের আনন্দ সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়বে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পরস্পরবিরোধী দু’টি পক্ষ গত ৪০ বছর ধরে যেমন উপরিউক্ত কথাবার্তা বলে আসছেন, তেমনি একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, সমর্থন ও সহযোগিতা তো করেইনি বরং বিরোধিতা করেছে। তবে এ কথা সত্য, দেশের বেশির ভাগ মানুষ মনেপ্রাণে শত্রুসেনাদের ঘৃণা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন করতেন। অন্য দিকে, শত্রুসেনাদের সাহায্যকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সক্রিয় লোকজনের সংখ্যা, সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি বিত্ত-বৈভব মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনায় তাদের জনসমর্থন ছিল খুবই সীমিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন কিছু নিরপেক্ষ মানুষ ছিলেন, তদ্রুপ স্বাধীন বাংলাদেশেও নিরপেক্ষ মানুষের অভাব নেই। ফলে আমাদের বিজয় দিবস নিয়ে ২০১৫ সালেও চার শ্রেণীর মানুষের চার ধরনের প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সরাসরি সম্মুখসমরে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা, দেশে-বিদেশে নিরাপদ আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং আরাম-আয়েশে থাকা কথিত মুক্তিযোদ্ধা, নিরাপদ ব্যক্তিরা এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা যেভাবে বিভক্তি সৃষ্টি করে আসছে, তা যেন আগামী দিনে না হয় সে জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বর্তমান প্রজন্মের একজন যুবক হিসেবে মনে করি, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম যারা ১৯৭১ সালের পর জন্মেছেন, তারা সবাই বাংলাদেশকে ভালোবাসেন অন্তরের অন্তস্তল থেকে। তারা কোনো অবস্থাতেই দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং বিজয় দিবস নিয়ে কোনো বিতর্ক, দোষারোপ কিংবা বিভক্তি দেখতে চান না। তারা চান প্রতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দের বার্তা। মহান বিজয় দিবসের আনন্দ সবার মাঝে সর্বজনীনভাবে বিলিয়ে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রকে অবশ্যই কতগুলো পদক্ষেপ নিতে হবে। আমার মতে, নিম্নলিখিত বিষয়গুলো যথানিয়মে আগামী পাঁচটি বছর প্রতিপালিত হলে আমরা ২০২০ সালে একটি সফল, সম্ভাবনাময় এবং স্বপ্নের বিজয় দিবস পালন করতে পারব-
এক. চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করার জন্য বিপ্লবী নেতা মাও সেতুং এবং দেং জিয়াও পিং যেভাবে সাংস্কৃতিক বিপ্লব সফল করেছিলেন, তদ্রুপ আমাদের দরকার একটি যুগান্তকারী সাংস্কৃতিক বিপ্লব। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ঐতিহ্য, ধর্মীয় রীতিনীতি, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং বিনোদনকে মাথায় রেখে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপরেখা প্রণীত হবে যাতে ১৬ কোটি মানুষ নির্দ্বিধায় দেশ-মাতৃকাকে ভালোবাসতে পারে। দেশকে অন্তর থেকে যারা ভালোবাসতে এবং শ্রদ্ধা করতে পারবেন না, তাদের কাছে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের কোনো মূল্য নেই।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সফল করার জন্য যুদ্ধকালীন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময়কার গান, কবিতা, গল্প, নাটক, যাত্রাপালা, কথিকা ইত্যাদি যেমন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস-শক্তি জোগাত, তেমনি জনসাধারণকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলত। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও আমরা যখন সেই সুরলহরী এবং কথামালা শুনি, তখন নিজের অজান্তে কখন যে একাত্তরের রণাঙ্গনে চলে যাই, তা টেরই পাই না। কাজেই আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং বিজয় নিয়ে যত দিন পর্যন্ত জনপ্রিয় সুরসঙ্গীত, কাব্য, গীতিনাট্য, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি রচিত না হবে, ততদিন পর্যন্ত বিজয় উৎসবকে সর্বজনীন করা যাবে না।
সরকারি মদদপুষ্ট কবি-সাহিত্যিক কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মীদের টাকা-পয়সা এবং উৎকোচ দিয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্ভব নয়। এ জন্য রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের কৌশল রপ্ত করতে হবে। ভারত, চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া, কিউ বা, ভেনিজুয়েলা প্রভৃতি রাষ্ট্রের সফল সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ইতিহাস জানতে হবে এবং তারা যেভাবে ও যাদের মাধ্যমে বিপ্লবের সূচনা করেছিল সেভাবে আমাদেরও শুরু করতে হবে। মানুষ যখন বাঙালি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের গৌরব এবং কীর্তিগাথা হৃদয়ে ধারণ করতে পারবে, তখন বাংলাদেশের পতাকা, মাটি, বাতাস, আলো, পানি, বনবনানী, পাখপাখালি এবং শষ্যক্ষেত্র মনমস্তিষ্কে দেশপ্রেমের জোয়ার সৃষ্টি করবে।
দুই. বিজয়ের আনন্দ সর্বজনীন করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ধাপটি হলো অর্থনৈতিক বিজয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ধনী হওয়া কিংবা যেকোনোভাবে টাকা উপার্জনকে অর্থনৈতিক বিজয় বলা যায় না। রাষ্ট্র যখন তার ব্যয় নির্বাহের জন্য স্বাধীন, সার্বভৌম আর স্বাবলম্বী হবে তখন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিজয় সূচিত হবে। এ ক্ষেত্রে জনমতের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে কিংবা অন্যান্য দেশ সন্দেহের চোখে দেখে, এ রূপ কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করে রাষ্ট্র কোনো দিন প্রশংসিত হতে পারবে না। অন্য দিকে, জনগণ যখন তার কর্ম, আয়, রোজগার এবং জীবনযাপন সম্পর্কে মোটামুটি সন্তুষ্ট থাকবে তখন থেকে অথনৈতিক বিজয় সূচিত হবে।
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা ও ব্যবস্থা রাষ্ট্র এবং এ দেশের জনগণের জন্য মোটেই সম্মানজনক এবং আনন্দদায়ক নয়। আমাদের জাতীয় আয়ের বিরাট অংশই ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম, অত্যাচার, চুরি, লুণ্ঠন, রাহাজানি, দখল, মিথ্যাচার ও অবিচার দ্বারা অর্জিত, কালো টাকা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কালো টাকার মালিকপক্ষ, এই টাকার জোগানদাতা এবং সংরক্ষণকারী- সবাই এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশে অমানবিক ও অনৈতিক জীবনযাপন করে। এই শ্রেণীর লোকেরা উন্মত্ত হয়ে উল্লাস করতে পারে কিন্তু বিজয়ীর বেশে আনন্দ করতে পারে না। তারা সবসময় গভীর আতঙ্ক নিয়ে একটি সর্বনাশের আশঙ্কায় দিন যাপন করে।
দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনের দ্বিতীয় সমস্যা হলো অনৈতিক বিলিবণ্টন এবং নিয়মবহির্ভূত প্রতিযোগিতা। ক্ষমতাবানেরা সবসময় যোগ্য ও মেধাবী লোকদের বঞ্চিত এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিজেরাই ভোগ করে থাকে। ব্যক্তি খাতের মেধাবী ও উদ্যমীরা এই অবস্থায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। যোগ্যরা অযোগ্যদের দিয়ে শাসিত এবং প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হন। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। দেশের তৃতীয় সমস্যা হলো অসম্মানজনক পেশা এবং অমর্যাদাকর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আয় উপার্জন। দেশের প্রায় সোয়া কোটি লোক বিভিন্ন দেশে মানবেতর পরিবেশে খাটছে। দেশের প্রায় পঞ্চাশ লাখ শ্রমিক মানবেতর পরিবেশে বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করছে। কুলি, মজুর, রিকশাচালক, ড্রাইভার হেলপার, মিস্ত্রিসহ আরো প্রায় এক কোটি লোক কাজ করতে গিয়ে কর্মপরিবেশের অভাবে প্রায় প্রতিদিনই বঞ্চিত, অপমানিত ও ধিকৃত হচ্ছে। সুতরাং তিন কোটি শ্রমজীবী মানুষের ১২ কোটি হাত-পা দ্বারা অর্জিত টাকা পয়সার প্রতি পরতে লুকায়িত থাকে সীমাহীন বেদনা, অপমান আর কষ্ট। সেই অর্থের ওপর দাঁড়িয়ে কেবল শয়তান অথবা নির্বোধই উল্লাস করতে পারে।
পৃথিবীর অনুকরণীয় দেশগুলো তাদের নাগরিকদের পেশা, কর্মপরিবেশ এবং আয় উপার্জন সম্মানজনক করার কাজে সফলতা অর্জনের পরপরই অর্থনৈতিক বিজয় লাভ করেছে। মরুর বুকে ছাগল চরানোর রাখাল, কোনো বেদুইন কিংবা দুর্জনের সেবাদাসী হওয়া এবং ফুটপাথে বসা দর্জির চেয়ে কম মূল্যে জামা কাপড় সেলাইয়ের মাধ্যমে টাকা উপার্জন করে অর্থনৈতিক বিজয় অর্জন অসম্ভব।
তিন. সামাজিক শৃঙ্খল ছাড়া কোনো জনগোষ্ঠী বিজয় উৎসব পালন করতে পারে না। আমাদের দেশে বর্তমান সামাজিক শৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন আজ বুমেরাং হয়ে গেছে। ক্ষমতাধরদের মদদে আজ দুর্বৃত্ত, লম্পট, অসৎ প্রকৃতির অশিক্ষিতরা সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ছোটরা বড়দের অপমান করছে। শিক্ষিতজনেরা অশিক্ষিতদের দুয়ারে ধরণা দিতে বাধ্য হচ্ছে জীবন বাঁচানোর তাগিদে। সৎলোকেরা মাথা নিচু করে চলছে এবং অসৎরা বীরদর্পে হেঁটে বেড়াচ্ছে। সৎকর্ম করতেও লোকজন ভয় পাচ্ছে। অন্য দিকে, মন্দ কর্মের জন্য পুরস্কার নিশ্চিত হওয়ায় দিবালোকে যত্রতত্র এর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ কেবল জেন্ডার বৈশিষ্ট্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। অরুচিকর পোশাক পরিধান এবং মন্দ কর্মে নারী-পুরুষ একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে সমাজকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে।
সামাজিক শৃঙ্খলার প্রথম অধিক্ষেত্র হলো পরিবার। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পরিবার প্রথা এখন ধ্বংসের শেষ প্রান্তে। সামাজিক রীতিনীতি নেই বললেই চলে। কাউকে সালাম জানানো, মুরব্বিদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন, জ্ঞানী-গুণী এবং পদস্থদের সম্মান ও নেতাদের সমীহ করার সৌজন্য আজ আর অবশিষ্ট নেই। ধর্মীয় রীতিনীতি, সম্প্রীতি, বিশ্বাস, পারস্পরিক আস্থা ইত্যাদি উঠে গেছে। মারামারি, হানাহানি, কলহবিবাদ, অপরকে দোষ দেয়া এবং হেয় করার প্রবৃত্তি আমাদের সমাজকে অক্টোপাসের মতো গ্রাস করেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং সুশীলসমাজ আজ প্রায় অবলুপ্ত। অন্য দিকে, একজন মানুষ যে ব্যক্তিগতভাবে ভালো হবেন এবং ভালো থাকবেন সেই সুযোগ ও সম্ভাবনার দ্বারগুলো ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের সামাজিক জীবনে শুরু হয়েছে ঘোর অমানিশার এক কঠিন কালো রাত- যা অতিক্রম না করে বিজয়ের আনন্দ উপভোগ অসম্ভব।
সামাজিক সম্প্রীতির চমৎকার উদাহরণ গড়ে তুলেছে উন্নত বিশ্ব। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, ভুটান ও ইরান স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রথার মাধ্যমে প্রতিটি জনপদে অনুসরণযোগ্য স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ যদি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা এবং আনুকূল্যে স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে, তবেই আমাদের বিজয় দিবসের আনন্দ সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়বে।
No comments