কবি by নেয়ামতউল্যাহ
রুবেল হয়েছে ক্লাবের সভাপতি; তাও
শিশু-কিশোর ক্রীড়া সংগঠন। পরিচিত শিশুরা রুবেলের নাম শুনলেই ভয় পায়; দেখলে
গোপনে লুকায়; বৃদ্ধরা রুবেলের নাম শুনে লুঙ্গি নষ্ট করে; যুবক-কিশোর
রাস্তার বাইরে অযথাই সাইড দিতে গিয়ে গর্তে পড়ে। রুবেল রাজনৈতিক দলের
অস্ত্রধারী ক্যাডার; সে-ই এখন পাড়ার ক্লাব সভাপতি; ভাবতেই আতংক! রুবেলকে
দেখলেই মানুষ অযথা নতুন নতুন গল্প তৈরি করে; অনেক হাসি-ঠাট্টা মেশানো,
চটকদার।
ক্লাব সভাপতি হয়ে অভিষেক অনুষ্ঠানে স্টেডিয়ামে কনসার্টের আয়োজন করেছে রুবেল; সঙ্গে ভূরি ভোজ ও ভূরি পানিয়ের। পানীয় শুধু উঁচু লেবেলের মানুষের, যারা ভগবানের মস্তক থেকে সমাজে পয়দা হয়েছেন। এ উঁচু লেবেলের মানুষের মধ্যে কিছু সুশিল রয়েছেন; যারা সংস্কৃতিচর্চা করেন; সিদ্ধিতে দম দেন; ইদানীং বাবা সেবন করে নিজেকে নিশাচর প্রাণী করে তুলে সৃষ্টি ছাড়া সংস্কৃতিবান মনে করছেন।
যাই হোক কনসার্টের মাইকিংয়ে বলা হয়েছে ঢাকা থেকে আগত শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। তাই দর্শকের ভিড়। উঁচু লেবেলের সঙ্গে যারা সুশিল রয়েছেন তার মধ্যে ব্রাহ্মণীয় আছেন, তাদের একজন আমাদের সবার প্রিয় ননী গোপাল চক্রবর্তী; লোকে বলে ননীবাবু। উনি দেব-দেবতা,ধর্ম মানেন না; মানেন না গরু এবং ছাগলের জাত; সব তিনি এক ছুরিতে কেটে, রাঁধেনও এক চুলোয়। এক চুলায় যখন রাঁধা তখন এক পেটে যেতে কেন বাধা। বলুন! ওর কাছে শুনতে পেলাম ঢাকা থেকে যিনি গান গাইতে এসেছেন তিনি আড়ালের গান পরিবেশন করেন, যে কথা কেউ বলে না; অথবা শুনতে পছন্দ করেন কিন্তু মানতে দারুণ নারাজ। ঢাকা থেকে আগত ব্যান্ডের নাম দেউরক্যা ব্যান্ড শিল্পি।
কনসার্ট শুরু হল নির্ধারিক সময়ে; প্রথমে যে গানটি হল- সেটি তথাকথিত রাজনীতিবিদ, সমাজের অনাচার, অন্যায় এসব নিয়ে; গানের কথা অসাধারণ। দর্শকদের মনে কি রকম সাড়া দিল, কি দিল না, তা নাইবা বললাম। বিনে পয়সায় গান শোনানোর একটা সুবিধা আছে, তা হল, শিল্পি যা শোনাবে, তাই শুনতে হবে। কিছু শ্রোতা সব সময় প্রতিবাদী, কিছু শ্রোতা ওই দেউরক্যা শিল্পিদের গানই শুনতে গিয়েছিল; তারা আরও শোনার জন্য শিল্পিদের উৎসাহিত করল; কিছু দর্শক উল্টো কাজ করে বসল। তারা দেউরক্যা শিল্পিদের উদ্দেশে ভুয়া, বাড়িত যান, উকুন, এডি যাইয়্যা ডাকাত গান, টান দিছেননি জাতীয় মন্তব্য করল। এ একটু উশৃংখল নাচা-গানা দেখার জন্য এ সুযোগে আয়োজক গোষ্ঠী তাদের চেলাদের দিয়ে কটূক্তি কর্ম সম্পাদনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। বেফাঁস চেলাদের নিয়োজিত করল দর্শক সারিতে, মঞ্চের পেছনে, আশপাশে; চেলাদের কটূক্তি সীমাছাড়া হলে উপস্থাপক; (যিনি উপস্থাপক না ক্যানভাচার, তাই সন্দেহ হতে লাগল) পড়ে সদ্য হওয়া সভাপতি ও সংস্কৃতিসেবী ননীবাবু উশৃংখল দর্শকদের না থামিয়ে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললেন, ঢাকা থেকে আগত শিল্পীদের ধন্যবাদ! দর্শক চাইলে পরে আরও গান শোনাবেন দেউরক্যা ব্যান্ড শিল্পিরা।
কি আর করা আড়ালের শিল্পিরা মঞ্চের আড়ালে চলে গেলেন।
২.
পর্দার ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, ঢাকা থেকে আসা শিল্পী ধামাকা-২০ অর্ধনগ্না বসে আছে (বিশ কি বিষ বলতে পারব না; তবে একবার দেখলে দারুণ সেঁদিয়ে শরীরের পরতে পরতে উত্তেজনা সৃষ্টি করে)। বের হয়ে আসা ছাড়া উপায় নেই। দর্শক সারিতে বসলে মঞ্চে আসেন শিল্পী ললিতা। একজন দর্শক-শ্রোতা বললেন দ্যা ... খ! কি বড় নাবিডা, খাইতো ইচ্ছা করে। অনেকে যাত্রার নায়িকাদের দেখে যেমন শিস বাজায়, তেমনি শিস বাজালেন। ললিতা প্রথমে এসেই গাইলেন, তুমি বাসর রাতে দিয়োনাকে বাত্তি নিবাইয়্যা ... আর দর্শক শ্রোতাদের বাঁধ ভাঙা উল্লাশ। যেন আকাশ ভেঙে যাবে। রাতের পাখিরা ঘুম ভেঙে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে; যেমন এলাকায় কোনো বিপদ হলে, আগুন লাগলে কিম্বা ঝড় এলে পাখিরা বেরিয়ে পড়ে। মেতে ওঠে রাতের ভোলা।
৩. যারা আড়ালের গান গায়; সত্তার গান গায়; জীবনের গান গায়; সেই দেউরক্যা ব্যান্ড দলের শিল্পিরা বেরিয়ে এলেন; তাদের সঙ্গে কিছু দর্শক বেরিয়ে এলেন সড়কে। দলের সঙ্গে ছিলেন শিল্পি দলের রুমেন, তিনি বললেন, আপনারা আসছেন কেন?
দলের সোহাগ বললেন,আপনারা গান শোনা ছেড়ে এলেন কেন? ওরা কি মনে করবে বলুন তো!
শিল্পির দলের আরেক সঙ্গী বললেন, আমরাতো গাইতে জানি না।
সঙ্গী বাহাউদ্দিন বলল,আমরা আপনাদের গান শুনতে আইছিলাম। আপনাদের গান আমার পছন্দ। আমরা কবির কবিতা আবৃত্তিরও খুব ভক্ত।
কবি নব্বই দশকের নামকরা কবি অতুল; যার চারটি বই এরই মধ্যে বেশ নাম করেছেন। কবি এখনও চোখ মুছছেন; তিনি শিল্পিদের এ অপমান সহ্য করতে পারেননি। শিল্পিদের পদ্ম বললেন, আমরা যার আমন্ত্রণে এসেছি, সেই ননীবাবু কোথায়?
সঙ্গের কেউ কেউ হেসে উঠলেন। আমাদের ভোলার একজন বললেন, তিনি এ সময়ে এখানে উপস্থিত থাকবেন না। পরে এসে দুই পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইবেন। কবি ননীবাবু সম্পর্কে কোনো মন্তব্য না করে বলেন,যা হওয়ার, হয়েছে, চলেন আমরা বাসায় যাই। মানুষ গুলা এমনই।
৪.
পরের দিন কবি, বাহাউদ্দিন, রুমেন, সোহাগ এবং ঢাকা থেকে আসা ব্যান্ড দলের সব মাঝের চরে গেলেন। তুলাতুলি খেয়াঘাটে পৌঁছানোর পরই দেখা হল মদনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের সঙ্গে। তিনি কৃষকদের বিনা অর্থে সার দেয়ার জন্য একটি নৌকায় সারবোঝাই করছেন; আরেকটি নৌকা সাজানো হচ্ছে চেয়ারম্যান ও তদন্ত কর্মকর্তা যাওয়ার জন্য। সেখানে কয়েকটি চেয়ার আছে; আছে দুটি ছাতা। চেয়ারম্যান রুস্তম ফরাজী কবি দলের সবাইকে সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন। বাড়তি আপ্যায়নের জন্য কিছু চিপস, চানাচুর ভাজা ও মিনারেল ওয়াটার নিলেন। চেয়ারম্যান কবিকে খুব সম্মান করতেন; কবির সম্মানেই তার সঙ্গীদের সম্মান করছেন। এক সময় ট্রলার ছাড়ল। শীতের আমেজ, ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। নদীতে জালের আধিক্য নেই; মাঝে মাঝে নৌকার তলা বেধে যাচ্ছে ডুবোচরে। সেই ফাঁকে সবার একটু শীতল জল ছুঁয়ে দেখা। আর অসাধারণ তৃপ্তি ...! শিল্পীরা স্বাদগ্রহণ করছে প্রকৃতির। ট্রলারের ধপ-ধপ শব্দের সঙ্গে কখনও গিটারে টান, কখনও মন্দিরাতে টুং টাং; বাঁশিতেও সুর তুলছে কেউ। শিল্পীদের সঙ্গে কবির কথা হচ্ছিল নানা বিষয় নিয়ে। আর প্রশ্ন করছিল, ওদের কি এটা করা ঠিক হয়েছে? দর্শক শ্রোতা না নিত, দুঃখ ছিল না। প্রশ্নের জবাবে কবি গাইলেন ওরা আছিল অজাত কুজাত! সুজাত আছিল আমার তরে। দুঃখ বাড়ল সেই খানে সই, আমার জাতের অবিচারে।
কবি ঢাকার শিল্পী ও তার ভক্তকুল নিয়ে যে চরে যাচ্ছেন সে চরের নাম মদনপুর, লোকে ডাকে মাঝের চর। কবি বলেন, ম্যাঘনার মাঝে পলি পড়ে চর পড়ায় লোকে এরে মাঝের চর কয়, এহানে যারা আশ্রয় নিছে হেরাসব মূল ভূখণ্ড থেকে আইছে; হেরা আশ্রয়হীন। তাগো জমি ঘর বংশ মর্যাদা সবই ম্যাঘনা ভাইঙ্গা নিছে। যদি আবার ম্যাঘনা সে জমি-জিরাত ফিরায়া দেয়, সেহানে চোখ যাইব জোতদারের; সব মিল্লা লড়াই কইর্যা আদায় করত হবে; তার লাইগ্যা থাকতে হয় লাডি-টিয়ার শক্তি। অ্যার লাইগ্যা বহু বছর পর যদিও ম্যাঘনা বাপ-দাদার জমি-জিরাত ফিরায়ে দেয়, সেটাও আর ফেরত পাওয়া যায় না। বড় কঠিন হয়ে পড়ে, শিল্পী। কবি চলতি-আঞ্চলিত ভাষা মিলিয়ে কথা বলছেন খুব শব্দ করে। তাও এক কথা বারবার বলতে হচ্ছে শিল্পিদের বারবার প্রশ্নে। কারণ নৌকার ইঞ্জিনের শব্দটা খুবই বিকট।
রুমেন ও বাহাউদ্দিন উঁচু গলায় গান গাইছিল। কিন্তু শোনা যাচ্ছিল না। কবি বলেন, কি গান গাও! এমন কপাল শোনাও যায় না, শব্দযন্ত্র গ্রামডারেও খাইয়্যা ফেলছে।
রুমেন বলে, আমরা ট্রলার আর বাথরুম শিল্পী। আমরা নিজেরা গাই, নিজেরা শুনি। আপনেরা শুনবেন ট্রলার ধ্বনী। কবি বলেন, বাহ! কেমন কাব্য করে কইলা।
বাহাউদ্দিন বলে, ওস্তাদ! আমনের লগে থাকতে থাকতে এমন হইছে কবি বলেন, তুমি এট্টু বেশিই কও! আমরা সবাই হেসে উঠি।
নৌকা মাঝের চরের কাছে চলে এসেছে। চোখে আসে ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর। তাও উঁচু সাইক্লোন সেল্টারের মতো। শিল্পীরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, ঘরগুলো এমন মাচার মতো উঁচু কেন!
কবি বলেন, এ্যহানে বছরের পেরায় ছয় মাস জোয়ারের পানিতে সব ডুইব্যা থাহে। পথঘাট চিনায় না, হুদা পানি আর পানি; এর লাইগ্যা খর দিয়া তৈরি ঘরগুলো ওঠে মাচার ওপর; নিচে থাহে গরু-বাছুর, উপরে থাহে মানুষ, জোয়ারেরসুম সোতে দোল খায়।
এটা কি করে সম্ভব! শিল্পীর গলায় অবাক বিস্ময়।
কবি মুচকি হেসে বলে, এই দ্যাশে সব সম্ভব। হোনলে আরও অবাক হইবা, ওই ছোট্ট মাচার মাইধ্যে পাঁচ-ছয়ডা পোলাইন লইয়্যা এ্যট্টা পরিবার বাস করে। অনেকসুম বাপে পোলারে বিয়া করাইয়্যা বউ আনে, মাইয়্যা বিয়া দিয়া জামাই আনে; পোলা-বউ, জামাই-মাইয়্যা একপাশে, অন্যপাশে শ্বশুর-শাশুড়ি ফরজ কাম করে, এ্যর নাম জীবন।
শিল্পী আরও অবাক হয়ে বলে, দুটো দম্পতিই হয়তো একসঙ্গে সেক্স করে?
অবশ্যই, হেইডাই তো কইলাম। কবির উত্তর।
যান্ত্রিক বিকট শব্দের মধ্যে কথা বলতে বলতে ট্রলারটি মধুপুরা আশ্রয়ণ প্রকল্পে এসে পড়েছে তখন সূর্য তেতে উঠেছে। আচমকা শব্দটা কমে যাওয়ায় সবার চোখ যায় গুচ্ছ ঘরের দিকে। এতক্ষণ ছিল ঘন সবুজের ক্ষেত। বোরোর আবাদ চরে কৃষকদের মধ্যে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করে। বাধে জোতদারের উত্তেজনা। চরে একটু বাজার মতো বসলেই একটা হোটেল বসে। সেখানে জেনারেটরে রাতে টিভি-ভিসিডিতে বাংলা সিনেমা প্রদর্শিত হয়। কোনো টিকিট নেই। ক্রেতারা ছবি দেখে আর জিলাপি খায়, আঙ্গুলি খায়, সঙ্গে চা। বেজে যায় রাত বারো। তার পর মাঠ ভেঙে, খাল ভেঙে নদী সাঁতরে কুঁড়েতে ফেরে। বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে মাচায় ওঠে। আশ্রয়ণ প্রকল্পে যারা বসত করে তাদের অবশ্য এমন সমস্যা নেই, শুধু দুর্যোগ ছাড়া। তাও ক্ষেত-খাল নদী ভাঙতে হয়।
ঘাটে ট্রলার ভিড়তেই শতশত শিশু ছেলেমেয়ে তাদের দেখতে আসে। তাদের শরীরে ধুলো কাঁদার পোশাক। মাথার চুল জট বাঁধা, পরনের হাপ প্যান্টটিও ময়লা। কারও গায়ে অবশ্য গেঞ্জি আছে। তাও ময়লা হয়ে গেছে । কবি এ চরে অনেক এসেছে। অপরিচিত কেউ চরে এলে, কোথা থেকে অতিথি পাখির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে শিশুরা দেখতে আসে। কবি শিল্পীদের উদ্দেশ করে বলেন, আমনাগো বরণ করতে শিশুর দল আইছে; শুধু আমনেরা না... গো, নতুন কেউ আইলে ওরা তারে বরণ করে নেয়; এইডা অগো নিয়ম; অগো কোনো চাহিদা-পত্র নাই, বিমিতে কিচ্ছু দিত অইব না।
নৌকার সবাই ভাঙন সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উঠছে চরায়। প্রায় আধা মাইল মেঠোপথ হেঁটে শিল্পীর দল পৌঁছাল মধুপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে। মধুপুর মদন পুরের একটি গ্রামের নাম; বড় মিঠা নাম; এক সময় এ গাঁয়ের অনেক জৌলুস ছিল; ভোলার অনেক বড় মিয়ার জন্মু এ গাঁয়ে। শিল্পীদের প্রধান, যার মেয়েদের মতো লম্বা চুল তিনি বললেন, অনেক দিন পর মেঠো পথ দিয়ে হাঁটছি।
শিল্পী দল যখন হাঁটছিল তখন মেঠোপথে হাজার হাজার পোকা হাঁটছিল। এ পোকা ফসলের ক্ষেত ছাপা করে দিয়েছে। এ জন্য চরের কৃষকের মনে আনন্দ নেই। তারা রাতে ঘুমাতে পারছে না। পোকা এসে তাদের চুলে, কানে, বালিশে বেয়ে বেয়ে উঠছে। শরীরে উঠলে পুরো শরীর শিরশির করে ওঠে। ভুল করে হাত চলে যায় পোকার গায়ে। পোকাগুলো এমন নরম, একটু চাপ পড়লেই গলে যায়। মেখে যায় গতরে। কাঁটাগুলো গেঁথে যায় শরীরে। চুলকে ওঠে শরীর; আর ঘিন ঘিন। ওয়াক! থু! পেট ভরে বমি হয় কারও। ভাত তরকারি রান্না করে রাখলে সকালে উঠে দেখে পানি ভাতের মধ্যে ভেসে ভেসে পোকা; তরকারির মধ্যে পোকা থাকে চিংড়ি মাছের মতো। চরের মানুষেরা অজান্তে অনেক পোকা খেয়ে ফেলেছে; স্ত্রীর বুক হাতরালে পোকা; বুকের দুধ খেতে গেলে শিশুর মুখে পোকা চলে যায়; শিশুকে বুকের মধ্যে আগলে রাখার সেকি আপ্রাণ চেষ্টা মায়ের! পোকায়-পোকায় জর্জরিত। এ যেন মহামারী আকার ধারণ করেছে। শিল্পী দলের সঙ্গে যখন চেয়ারম্যান যাচ্ছিল, তখন তাকে কৃষকরা এসে পোকার সমস্যাগুলো বলছিল, আর কাঁদছিল। চেয়ারম্যান এসব কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছেন। আর বলছেন, যাও মিয়া! যাও! কি করুম, চিন্তা নাই আল্লাহ সব ঠিক কইর্যা দিব। চরের মানুষের সমস্যাপূর্ণ সব ঘটনা শুনে কবির মন খারাপ হয়ে যায়। কৃষকদের দুখের কথা আবারও মন দিয়ে শুনলেন। তার বন্ধু বড় কৃষি কর্মকর্তা, তার সঙ্গে মোবাইলে কথা বললেন; এবং কৃষকদের সমস্যা সমাধানের জন্য একজন কৃষি কর্মকর্তা আসবেন বললেন। আর কৃষকরা সকলে, সমস্বরে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! তারা কবির জন্যও দোয়া করলেন; চেয়ারম্যানের জন্য দোয়া করলেন।
মাঝের চরের মাঝের উঠানে গানের আসর বসল। সূর্য মাথার ওপর। চেয়ারম্যান সবাইকে গানের আসরে আসতে বললেন। মাটির বিছানায় শতশত শিশু বসে পড়ল। অন্য কেউই এল না। শিল্পীরা বসলেন ধানের খড় বিছিয়ে। তবে যখন গান শুরু হল, তখন নারী-পুরুষের ভিড় বাড়ল। সবাই তন্মুয় হয়ে শুনছে। এ গান তাদের কাছে নতুন কিন্তু তাদেরই কথা, এটা তারা বুঝতে পারল। গানের মধ্যে রং চা এলো, সঙ্গে ঘরে ভাজা মুড়ি। গান গায়, চা খায়। এমনি করে পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলতে শুরু করেছে।
এমন সময় এক বৃদ্ধ হাঁপাতে হাঁপাতে চেয়ারম্যানের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে, বলেন, ও চেয়ারম্যান সাব! ও চেয়ারম্যান সাব! আইজ দুই দিন ধইর্যা আঁর পোয়াতি মাইয়্যার প্যাট ব্যদনা ওঠছে, কিন্তুক কিছুতে কিছু অইতাছে না, কি করুম বোজদাছিনা, চরে ডাকতোর নাই। লোকটা তখনও হাঁপাচ্ছে, চেয়ারম্যানের পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়েছে। চেয়ারম্যান সবার দিকে তাকায় আর পা ঝাড়ি দিয়ে বলেন, আরে করও কি! করও কি! তোমার মাইয়্যার প্যাট ব্যদনা ওটছে আমি কি করুম! আমি কি ডাক্তার না কবিরাজ? সদর হাসপাতালে লইয়্যা যাও।
চেয়ারম্যান সাব ট্যাহা নাই, বৃদ্ধ লোকটা তখনও কাঁদতে থাকে। নৌকা ভাড়া করে সেই বৃদ্ধ আর তার প্রসূতী মেয়েকে ভোলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হল। সঙ্গে পাঠানো হল দুজন চৌকিদার আর চরের জ্যেষ্ঠা দাইকে।
চরবাসীর পক্ষ থেকে প্রবীণ মনতাজ পাটওয়ারী বললেন, আমনেরা আমাগো মেহমান, সরম করে ক্যামনে কই, দুগা ডাইল ভাত খাইয়্যা যাইতেন যদি ...! আমগো কষ্ট কোনো দিন দূর অইব কিনা জানি না, তয় গান হুনাইয়্যা আমগো মন ভালা কইর্যা দিছেন। আমনেরা দুরপেরকাল খালি প্যাডে যাইবেন এইডা ভালা দ্যাহাইব না। কি দিয়া আমনেগো খেদমত করুম কন! শিল্পী, কবি এবং বেড়ানি দল মুখ চাওয়া চাওই করছেন। কি করবেন! কি করে ফেলবেন মুরব্বির কথা। কবি বললেন, মুরব্বি এত করে যখন কইতাছেন...
সূর্য মাথার ওপর থেকে যখন পশ্চিমে চলে যাচ্ছিল, সেই ফাঁকে ঘন কালো মেঘ ঢেকে যায় আকাশ; কারুর তা খেয়াল থাকে না। ভাত খেয়ে গান শুরু হল; আবার সেখানে চা মুড়ি এলো; গান চলতে থাকে।
শেষ
সেদিন কতক্ষণ গান চলেছে. জানি না; কবির দেউরক্যা ব্যান্ড শিল্পী দল কখন চর থেকে এসেছে, তাও জানি না; চরে গেলে চরবাসীর মুখে শোনা যায়, সেদিন নাকি চরাচরে তুমুল বর্ষণ হয়েছিল; অনেক বাজ পড়েছিল; সেদিনের মুষল বৃষ্টিতে গজব ফসল পোকা চিরতরে হারিয়ে গেছে; নদীতে প্রচুর মাছ পড়েছিল; কবি-শিল্পী আছে কি নেই কিচ্ছু আসে যায় না চরবাসীর; মদনপুরবাসী তাদের মনে রেখেছে।
(গল্পের চরিত্রগুলো পরিচিত হলেও কাল্পনিক)
ক্লাব সভাপতি হয়ে অভিষেক অনুষ্ঠানে স্টেডিয়ামে কনসার্টের আয়োজন করেছে রুবেল; সঙ্গে ভূরি ভোজ ও ভূরি পানিয়ের। পানীয় শুধু উঁচু লেবেলের মানুষের, যারা ভগবানের মস্তক থেকে সমাজে পয়দা হয়েছেন। এ উঁচু লেবেলের মানুষের মধ্যে কিছু সুশিল রয়েছেন; যারা সংস্কৃতিচর্চা করেন; সিদ্ধিতে দম দেন; ইদানীং বাবা সেবন করে নিজেকে নিশাচর প্রাণী করে তুলে সৃষ্টি ছাড়া সংস্কৃতিবান মনে করছেন।
যাই হোক কনসার্টের মাইকিংয়ে বলা হয়েছে ঢাকা থেকে আগত শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। তাই দর্শকের ভিড়। উঁচু লেবেলের সঙ্গে যারা সুশিল রয়েছেন তার মধ্যে ব্রাহ্মণীয় আছেন, তাদের একজন আমাদের সবার প্রিয় ননী গোপাল চক্রবর্তী; লোকে বলে ননীবাবু। উনি দেব-দেবতা,ধর্ম মানেন না; মানেন না গরু এবং ছাগলের জাত; সব তিনি এক ছুরিতে কেটে, রাঁধেনও এক চুলোয়। এক চুলায় যখন রাঁধা তখন এক পেটে যেতে কেন বাধা। বলুন! ওর কাছে শুনতে পেলাম ঢাকা থেকে যিনি গান গাইতে এসেছেন তিনি আড়ালের গান পরিবেশন করেন, যে কথা কেউ বলে না; অথবা শুনতে পছন্দ করেন কিন্তু মানতে দারুণ নারাজ। ঢাকা থেকে আগত ব্যান্ডের নাম দেউরক্যা ব্যান্ড শিল্পি।
কনসার্ট শুরু হল নির্ধারিক সময়ে; প্রথমে যে গানটি হল- সেটি তথাকথিত রাজনীতিবিদ, সমাজের অনাচার, অন্যায় এসব নিয়ে; গানের কথা অসাধারণ। দর্শকদের মনে কি রকম সাড়া দিল, কি দিল না, তা নাইবা বললাম। বিনে পয়সায় গান শোনানোর একটা সুবিধা আছে, তা হল, শিল্পি যা শোনাবে, তাই শুনতে হবে। কিছু শ্রোতা সব সময় প্রতিবাদী, কিছু শ্রোতা ওই দেউরক্যা শিল্পিদের গানই শুনতে গিয়েছিল; তারা আরও শোনার জন্য শিল্পিদের উৎসাহিত করল; কিছু দর্শক উল্টো কাজ করে বসল। তারা দেউরক্যা শিল্পিদের উদ্দেশে ভুয়া, বাড়িত যান, উকুন, এডি যাইয়্যা ডাকাত গান, টান দিছেননি জাতীয় মন্তব্য করল। এ একটু উশৃংখল নাচা-গানা দেখার জন্য এ সুযোগে আয়োজক গোষ্ঠী তাদের চেলাদের দিয়ে কটূক্তি কর্ম সম্পাদনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। বেফাঁস চেলাদের নিয়োজিত করল দর্শক সারিতে, মঞ্চের পেছনে, আশপাশে; চেলাদের কটূক্তি সীমাছাড়া হলে উপস্থাপক; (যিনি উপস্থাপক না ক্যানভাচার, তাই সন্দেহ হতে লাগল) পড়ে সদ্য হওয়া সভাপতি ও সংস্কৃতিসেবী ননীবাবু উশৃংখল দর্শকদের না থামিয়ে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললেন, ঢাকা থেকে আগত শিল্পীদের ধন্যবাদ! দর্শক চাইলে পরে আরও গান শোনাবেন দেউরক্যা ব্যান্ড শিল্পিরা।
কি আর করা আড়ালের শিল্পিরা মঞ্চের আড়ালে চলে গেলেন।
২.
পর্দার ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, ঢাকা থেকে আসা শিল্পী ধামাকা-২০ অর্ধনগ্না বসে আছে (বিশ কি বিষ বলতে পারব না; তবে একবার দেখলে দারুণ সেঁদিয়ে শরীরের পরতে পরতে উত্তেজনা সৃষ্টি করে)। বের হয়ে আসা ছাড়া উপায় নেই। দর্শক সারিতে বসলে মঞ্চে আসেন শিল্পী ললিতা। একজন দর্শক-শ্রোতা বললেন দ্যা ... খ! কি বড় নাবিডা, খাইতো ইচ্ছা করে। অনেকে যাত্রার নায়িকাদের দেখে যেমন শিস বাজায়, তেমনি শিস বাজালেন। ললিতা প্রথমে এসেই গাইলেন, তুমি বাসর রাতে দিয়োনাকে বাত্তি নিবাইয়্যা ... আর দর্শক শ্রোতাদের বাঁধ ভাঙা উল্লাশ। যেন আকাশ ভেঙে যাবে। রাতের পাখিরা ঘুম ভেঙে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে; যেমন এলাকায় কোনো বিপদ হলে, আগুন লাগলে কিম্বা ঝড় এলে পাখিরা বেরিয়ে পড়ে। মেতে ওঠে রাতের ভোলা।
৩. যারা আড়ালের গান গায়; সত্তার গান গায়; জীবনের গান গায়; সেই দেউরক্যা ব্যান্ড দলের শিল্পিরা বেরিয়ে এলেন; তাদের সঙ্গে কিছু দর্শক বেরিয়ে এলেন সড়কে। দলের সঙ্গে ছিলেন শিল্পি দলের রুমেন, তিনি বললেন, আপনারা আসছেন কেন?
দলের সোহাগ বললেন,আপনারা গান শোনা ছেড়ে এলেন কেন? ওরা কি মনে করবে বলুন তো!
শিল্পির দলের আরেক সঙ্গী বললেন, আমরাতো গাইতে জানি না।
সঙ্গী বাহাউদ্দিন বলল,আমরা আপনাদের গান শুনতে আইছিলাম। আপনাদের গান আমার পছন্দ। আমরা কবির কবিতা আবৃত্তিরও খুব ভক্ত।
কবি নব্বই দশকের নামকরা কবি অতুল; যার চারটি বই এরই মধ্যে বেশ নাম করেছেন। কবি এখনও চোখ মুছছেন; তিনি শিল্পিদের এ অপমান সহ্য করতে পারেননি। শিল্পিদের পদ্ম বললেন, আমরা যার আমন্ত্রণে এসেছি, সেই ননীবাবু কোথায়?
সঙ্গের কেউ কেউ হেসে উঠলেন। আমাদের ভোলার একজন বললেন, তিনি এ সময়ে এখানে উপস্থিত থাকবেন না। পরে এসে দুই পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইবেন। কবি ননীবাবু সম্পর্কে কোনো মন্তব্য না করে বলেন,যা হওয়ার, হয়েছে, চলেন আমরা বাসায় যাই। মানুষ গুলা এমনই।
৪.
পরের দিন কবি, বাহাউদ্দিন, রুমেন, সোহাগ এবং ঢাকা থেকে আসা ব্যান্ড দলের সব মাঝের চরে গেলেন। তুলাতুলি খেয়াঘাটে পৌঁছানোর পরই দেখা হল মদনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের সঙ্গে। তিনি কৃষকদের বিনা অর্থে সার দেয়ার জন্য একটি নৌকায় সারবোঝাই করছেন; আরেকটি নৌকা সাজানো হচ্ছে চেয়ারম্যান ও তদন্ত কর্মকর্তা যাওয়ার জন্য। সেখানে কয়েকটি চেয়ার আছে; আছে দুটি ছাতা। চেয়ারম্যান রুস্তম ফরাজী কবি দলের সবাইকে সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন। বাড়তি আপ্যায়নের জন্য কিছু চিপস, চানাচুর ভাজা ও মিনারেল ওয়াটার নিলেন। চেয়ারম্যান কবিকে খুব সম্মান করতেন; কবির সম্মানেই তার সঙ্গীদের সম্মান করছেন। এক সময় ট্রলার ছাড়ল। শীতের আমেজ, ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। নদীতে জালের আধিক্য নেই; মাঝে মাঝে নৌকার তলা বেধে যাচ্ছে ডুবোচরে। সেই ফাঁকে সবার একটু শীতল জল ছুঁয়ে দেখা। আর অসাধারণ তৃপ্তি ...! শিল্পীরা স্বাদগ্রহণ করছে প্রকৃতির। ট্রলারের ধপ-ধপ শব্দের সঙ্গে কখনও গিটারে টান, কখনও মন্দিরাতে টুং টাং; বাঁশিতেও সুর তুলছে কেউ। শিল্পীদের সঙ্গে কবির কথা হচ্ছিল নানা বিষয় নিয়ে। আর প্রশ্ন করছিল, ওদের কি এটা করা ঠিক হয়েছে? দর্শক শ্রোতা না নিত, দুঃখ ছিল না। প্রশ্নের জবাবে কবি গাইলেন ওরা আছিল অজাত কুজাত! সুজাত আছিল আমার তরে। দুঃখ বাড়ল সেই খানে সই, আমার জাতের অবিচারে।
কবি ঢাকার শিল্পী ও তার ভক্তকুল নিয়ে যে চরে যাচ্ছেন সে চরের নাম মদনপুর, লোকে ডাকে মাঝের চর। কবি বলেন, ম্যাঘনার মাঝে পলি পড়ে চর পড়ায় লোকে এরে মাঝের চর কয়, এহানে যারা আশ্রয় নিছে হেরাসব মূল ভূখণ্ড থেকে আইছে; হেরা আশ্রয়হীন। তাগো জমি ঘর বংশ মর্যাদা সবই ম্যাঘনা ভাইঙ্গা নিছে। যদি আবার ম্যাঘনা সে জমি-জিরাত ফিরায়া দেয়, সেহানে চোখ যাইব জোতদারের; সব মিল্লা লড়াই কইর্যা আদায় করত হবে; তার লাইগ্যা থাকতে হয় লাডি-টিয়ার শক্তি। অ্যার লাইগ্যা বহু বছর পর যদিও ম্যাঘনা বাপ-দাদার জমি-জিরাত ফিরায়ে দেয়, সেটাও আর ফেরত পাওয়া যায় না। বড় কঠিন হয়ে পড়ে, শিল্পী। কবি চলতি-আঞ্চলিত ভাষা মিলিয়ে কথা বলছেন খুব শব্দ করে। তাও এক কথা বারবার বলতে হচ্ছে শিল্পিদের বারবার প্রশ্নে। কারণ নৌকার ইঞ্জিনের শব্দটা খুবই বিকট।
রুমেন ও বাহাউদ্দিন উঁচু গলায় গান গাইছিল। কিন্তু শোনা যাচ্ছিল না। কবি বলেন, কি গান গাও! এমন কপাল শোনাও যায় না, শব্দযন্ত্র গ্রামডারেও খাইয়্যা ফেলছে।
রুমেন বলে, আমরা ট্রলার আর বাথরুম শিল্পী। আমরা নিজেরা গাই, নিজেরা শুনি। আপনেরা শুনবেন ট্রলার ধ্বনী। কবি বলেন, বাহ! কেমন কাব্য করে কইলা।
বাহাউদ্দিন বলে, ওস্তাদ! আমনের লগে থাকতে থাকতে এমন হইছে কবি বলেন, তুমি এট্টু বেশিই কও! আমরা সবাই হেসে উঠি।
নৌকা মাঝের চরের কাছে চলে এসেছে। চোখে আসে ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর। তাও উঁচু সাইক্লোন সেল্টারের মতো। শিল্পীরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, ঘরগুলো এমন মাচার মতো উঁচু কেন!
কবি বলেন, এ্যহানে বছরের পেরায় ছয় মাস জোয়ারের পানিতে সব ডুইব্যা থাহে। পথঘাট চিনায় না, হুদা পানি আর পানি; এর লাইগ্যা খর দিয়া তৈরি ঘরগুলো ওঠে মাচার ওপর; নিচে থাহে গরু-বাছুর, উপরে থাহে মানুষ, জোয়ারেরসুম সোতে দোল খায়।
এটা কি করে সম্ভব! শিল্পীর গলায় অবাক বিস্ময়।
কবি মুচকি হেসে বলে, এই দ্যাশে সব সম্ভব। হোনলে আরও অবাক হইবা, ওই ছোট্ট মাচার মাইধ্যে পাঁচ-ছয়ডা পোলাইন লইয়্যা এ্যট্টা পরিবার বাস করে। অনেকসুম বাপে পোলারে বিয়া করাইয়্যা বউ আনে, মাইয়্যা বিয়া দিয়া জামাই আনে; পোলা-বউ, জামাই-মাইয়্যা একপাশে, অন্যপাশে শ্বশুর-শাশুড়ি ফরজ কাম করে, এ্যর নাম জীবন।
শিল্পী আরও অবাক হয়ে বলে, দুটো দম্পতিই হয়তো একসঙ্গে সেক্স করে?
অবশ্যই, হেইডাই তো কইলাম। কবির উত্তর।
যান্ত্রিক বিকট শব্দের মধ্যে কথা বলতে বলতে ট্রলারটি মধুপুরা আশ্রয়ণ প্রকল্পে এসে পড়েছে তখন সূর্য তেতে উঠেছে। আচমকা শব্দটা কমে যাওয়ায় সবার চোখ যায় গুচ্ছ ঘরের দিকে। এতক্ষণ ছিল ঘন সবুজের ক্ষেত। বোরোর আবাদ চরে কৃষকদের মধ্যে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করে। বাধে জোতদারের উত্তেজনা। চরে একটু বাজার মতো বসলেই একটা হোটেল বসে। সেখানে জেনারেটরে রাতে টিভি-ভিসিডিতে বাংলা সিনেমা প্রদর্শিত হয়। কোনো টিকিট নেই। ক্রেতারা ছবি দেখে আর জিলাপি খায়, আঙ্গুলি খায়, সঙ্গে চা। বেজে যায় রাত বারো। তার পর মাঠ ভেঙে, খাল ভেঙে নদী সাঁতরে কুঁড়েতে ফেরে। বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে মাচায় ওঠে। আশ্রয়ণ প্রকল্পে যারা বসত করে তাদের অবশ্য এমন সমস্যা নেই, শুধু দুর্যোগ ছাড়া। তাও ক্ষেত-খাল নদী ভাঙতে হয়।
ঘাটে ট্রলার ভিড়তেই শতশত শিশু ছেলেমেয়ে তাদের দেখতে আসে। তাদের শরীরে ধুলো কাঁদার পোশাক। মাথার চুল জট বাঁধা, পরনের হাপ প্যান্টটিও ময়লা। কারও গায়ে অবশ্য গেঞ্জি আছে। তাও ময়লা হয়ে গেছে । কবি এ চরে অনেক এসেছে। অপরিচিত কেউ চরে এলে, কোথা থেকে অতিথি পাখির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে শিশুরা দেখতে আসে। কবি শিল্পীদের উদ্দেশ করে বলেন, আমনাগো বরণ করতে শিশুর দল আইছে; শুধু আমনেরা না... গো, নতুন কেউ আইলে ওরা তারে বরণ করে নেয়; এইডা অগো নিয়ম; অগো কোনো চাহিদা-পত্র নাই, বিমিতে কিচ্ছু দিত অইব না।
নৌকার সবাই ভাঙন সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উঠছে চরায়। প্রায় আধা মাইল মেঠোপথ হেঁটে শিল্পীর দল পৌঁছাল মধুপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে। মধুপুর মদন পুরের একটি গ্রামের নাম; বড় মিঠা নাম; এক সময় এ গাঁয়ের অনেক জৌলুস ছিল; ভোলার অনেক বড় মিয়ার জন্মু এ গাঁয়ে। শিল্পীদের প্রধান, যার মেয়েদের মতো লম্বা চুল তিনি বললেন, অনেক দিন পর মেঠো পথ দিয়ে হাঁটছি।
শিল্পী দল যখন হাঁটছিল তখন মেঠোপথে হাজার হাজার পোকা হাঁটছিল। এ পোকা ফসলের ক্ষেত ছাপা করে দিয়েছে। এ জন্য চরের কৃষকের মনে আনন্দ নেই। তারা রাতে ঘুমাতে পারছে না। পোকা এসে তাদের চুলে, কানে, বালিশে বেয়ে বেয়ে উঠছে। শরীরে উঠলে পুরো শরীর শিরশির করে ওঠে। ভুল করে হাত চলে যায় পোকার গায়ে। পোকাগুলো এমন নরম, একটু চাপ পড়লেই গলে যায়। মেখে যায় গতরে। কাঁটাগুলো গেঁথে যায় শরীরে। চুলকে ওঠে শরীর; আর ঘিন ঘিন। ওয়াক! থু! পেট ভরে বমি হয় কারও। ভাত তরকারি রান্না করে রাখলে সকালে উঠে দেখে পানি ভাতের মধ্যে ভেসে ভেসে পোকা; তরকারির মধ্যে পোকা থাকে চিংড়ি মাছের মতো। চরের মানুষেরা অজান্তে অনেক পোকা খেয়ে ফেলেছে; স্ত্রীর বুক হাতরালে পোকা; বুকের দুধ খেতে গেলে শিশুর মুখে পোকা চলে যায়; শিশুকে বুকের মধ্যে আগলে রাখার সেকি আপ্রাণ চেষ্টা মায়ের! পোকায়-পোকায় জর্জরিত। এ যেন মহামারী আকার ধারণ করেছে। শিল্পী দলের সঙ্গে যখন চেয়ারম্যান যাচ্ছিল, তখন তাকে কৃষকরা এসে পোকার সমস্যাগুলো বলছিল, আর কাঁদছিল। চেয়ারম্যান এসব কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছেন। আর বলছেন, যাও মিয়া! যাও! কি করুম, চিন্তা নাই আল্লাহ সব ঠিক কইর্যা দিব। চরের মানুষের সমস্যাপূর্ণ সব ঘটনা শুনে কবির মন খারাপ হয়ে যায়। কৃষকদের দুখের কথা আবারও মন দিয়ে শুনলেন। তার বন্ধু বড় কৃষি কর্মকর্তা, তার সঙ্গে মোবাইলে কথা বললেন; এবং কৃষকদের সমস্যা সমাধানের জন্য একজন কৃষি কর্মকর্তা আসবেন বললেন। আর কৃষকরা সকলে, সমস্বরে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! তারা কবির জন্যও দোয়া করলেন; চেয়ারম্যানের জন্য দোয়া করলেন।
মাঝের চরের মাঝের উঠানে গানের আসর বসল। সূর্য মাথার ওপর। চেয়ারম্যান সবাইকে গানের আসরে আসতে বললেন। মাটির বিছানায় শতশত শিশু বসে পড়ল। অন্য কেউই এল না। শিল্পীরা বসলেন ধানের খড় বিছিয়ে। তবে যখন গান শুরু হল, তখন নারী-পুরুষের ভিড় বাড়ল। সবাই তন্মুয় হয়ে শুনছে। এ গান তাদের কাছে নতুন কিন্তু তাদেরই কথা, এটা তারা বুঝতে পারল। গানের মধ্যে রং চা এলো, সঙ্গে ঘরে ভাজা মুড়ি। গান গায়, চা খায়। এমনি করে পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢলতে শুরু করেছে।
এমন সময় এক বৃদ্ধ হাঁপাতে হাঁপাতে চেয়ারম্যানের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে, বলেন, ও চেয়ারম্যান সাব! ও চেয়ারম্যান সাব! আইজ দুই দিন ধইর্যা আঁর পোয়াতি মাইয়্যার প্যাট ব্যদনা ওঠছে, কিন্তুক কিছুতে কিছু অইতাছে না, কি করুম বোজদাছিনা, চরে ডাকতোর নাই। লোকটা তখনও হাঁপাচ্ছে, চেয়ারম্যানের পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়েছে। চেয়ারম্যান সবার দিকে তাকায় আর পা ঝাড়ি দিয়ে বলেন, আরে করও কি! করও কি! তোমার মাইয়্যার প্যাট ব্যদনা ওটছে আমি কি করুম! আমি কি ডাক্তার না কবিরাজ? সদর হাসপাতালে লইয়্যা যাও।
চেয়ারম্যান সাব ট্যাহা নাই, বৃদ্ধ লোকটা তখনও কাঁদতে থাকে। নৌকা ভাড়া করে সেই বৃদ্ধ আর তার প্রসূতী মেয়েকে ভোলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হল। সঙ্গে পাঠানো হল দুজন চৌকিদার আর চরের জ্যেষ্ঠা দাইকে।
চরবাসীর পক্ষ থেকে প্রবীণ মনতাজ পাটওয়ারী বললেন, আমনেরা আমাগো মেহমান, সরম করে ক্যামনে কই, দুগা ডাইল ভাত খাইয়্যা যাইতেন যদি ...! আমগো কষ্ট কোনো দিন দূর অইব কিনা জানি না, তয় গান হুনাইয়্যা আমগো মন ভালা কইর্যা দিছেন। আমনেরা দুরপেরকাল খালি প্যাডে যাইবেন এইডা ভালা দ্যাহাইব না। কি দিয়া আমনেগো খেদমত করুম কন! শিল্পী, কবি এবং বেড়ানি দল মুখ চাওয়া চাওই করছেন। কি করবেন! কি করে ফেলবেন মুরব্বির কথা। কবি বললেন, মুরব্বি এত করে যখন কইতাছেন...
সূর্য মাথার ওপর থেকে যখন পশ্চিমে চলে যাচ্ছিল, সেই ফাঁকে ঘন কালো মেঘ ঢেকে যায় আকাশ; কারুর তা খেয়াল থাকে না। ভাত খেয়ে গান শুরু হল; আবার সেখানে চা মুড়ি এলো; গান চলতে থাকে।
শেষ
সেদিন কতক্ষণ গান চলেছে. জানি না; কবির দেউরক্যা ব্যান্ড শিল্পী দল কখন চর থেকে এসেছে, তাও জানি না; চরে গেলে চরবাসীর মুখে শোনা যায়, সেদিন নাকি চরাচরে তুমুল বর্ষণ হয়েছিল; অনেক বাজ পড়েছিল; সেদিনের মুষল বৃষ্টিতে গজব ফসল পোকা চিরতরে হারিয়ে গেছে; নদীতে প্রচুর মাছ পড়েছিল; কবি-শিল্পী আছে কি নেই কিচ্ছু আসে যায় না চরবাসীর; মদনপুরবাসী তাদের মনে রেখেছে।
(গল্পের চরিত্রগুলো পরিচিত হলেও কাল্পনিক)
No comments