সবুজ অরণ্যের ডাক by ফেরদৌসী খানম লাকী

গত দু’দিন ধরে এ গানের কলিটি মনে খুব ঘুরঘুর করছিল। কারণ সবুজ অরণ্য আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আর সে কারণেই ২৫ ডিসেম্বর সকাল ৭.১৫ মি. বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম আবদুল গণি রোডে অবস্থিত অফিসের উদ্দেশে।
তখনও সূর্যের মুখ হালকা কুয়াশায় ঢাকা। অনেকেই আলস্য ভেঙ্গে ঘুম থেকে ওঠেনি। প্রায় ৩০ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম অফিসে। ওখানে বড় বড় দুটি বাস, মাইক্রো আর কয়েকটি কার অপেক্ষা করছিল সকলকে নিয়ে সেই সবুজ অরণ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ঢাকা শহরের এই কোলাহল ছেড়ে যানজট, বিপন্ন আবহাওয়া ছেড়ে আমরা কয়েক ঘণ্টার জন্য হারিয়ে যাব ঘন সবুজ অরণ্যে। যেখানে রয়েছে নির্মল বাতাস। প্রশস্ত রাস্তা যাতে মনের মতো করে মাইলের পর মাইল হেঁটে বেড়ানো যায় কোন প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই। আর লেকের পাড়ে বসে শাপলা-পদ্মের দোলা দেখব। নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াব, লেকের জলের নির্মল বাতাস প্রাণ ভরে নেব আর কয়েক ঘণ্টার জন্য মনটাকে হালকা করে নেব যত জটিলতা থেকে।
সকাল ৯টার ভিতরে সকলেই উপস্থিত হলেন অফিস চত্বরে। অনেকেই এর মধ্যে সকালের নাস্তা সেরে নিলেন। কেউবা গাড়িতে বসে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। মেন্যু ছিল পরটা, সবজি, ডিম, মিষ্টি আর যার যার জন্য আলাদা পানির বোতল। এবার ৯.১৫ মি. ডাক এলো নির্দিষ্ট বাসে ওঠার জন্য। আমি, রেহানা আপা, আবু আহমেদ সাহেব, রফিক সাহেব এবং প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সহকর্মীরা সকলেই এক বাসে উঠে বসলাম। ৯.২৫ মি. বাস ছেড়ে দিল নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে অর্থাৎ গাজীপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশে। গাড়ির ড্রাইভারও সিড়িতে গান বাজিয়ে দিলেন-‘একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে...।’ সত্যিই তখন চারদিকে কুয়াশার পর্দা সরে সোনার মিষ্টি রোদ্দুর দেখা দিয়েছে। আমরাও পুরনো ঢাকাকে যেন নতুনভাবে দেখতে দেখতে যানজটের ধাক্কা খেতে খেতে এগিয়ে চললাম সেই সবুজ অরণ্যের টানে।
ঢাকা ছেড়ে টঙ্গীতে এসে পৌঁছলাম। ইট, কাঠ, পাথরের শহর ছেড়ে ভেবেছিÑযাক বাঁচলাম। কিন্তু না, সেখানেও গড়ে উঠেছে আরেক নগর আরেক শহর। পরিবর্তন ধীরে ধীরে নয়, বেশ দ্রুতই হচ্ছে। তবুও মাঝেমধ্যে ধানক্ষেত দেখলাম। দেখলাম গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি। বেশ দীর্ঘ যানজটের পর অবশেষে এসে পৌঁছলাম বাংলাদেশ জাতীয় উদ্যানের প্রধান ফটকে।
জাতীয় উদ্যানের ফটকটি বেশ কারুকার্যময়। দু’পাশে দু’টি হাতির মূর্তি নক্সা করা, যেন হাতি শুড় উঁচিয়ে নগরবাসীদের অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত হয়ে বলছেÑ‘স্বাগতম, হে নগরবাসী আমাদের অরণ্যে অতিথি হয়ে আসবার জন্য।’ আমরাও সোজা বাস নিয়ে ঢুকে গেলাম প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে। ফটকের দারোয়ানের সাহায্য নিয়ে এগিয়ে গেল ড্রাইভার ভিআইপি ‘অর্কিড’ কটেজের দিকে। আর দু’তিন মিনিটের মাথায় আমরা গন্তব্যে চলে এলাম। পথে দেখলাম এ রকম অনেক ভাগ করা সুন্দর নামে জায়গা চিহ্নিত করা রয়েছে। তার মধ্যে কাঞ্চন, চম্পা, মালঞ্চ নাম মনে পড়ছে। ‘অর্কিড’ কটেজের দোতলা বাংলোর সামনে এসে বাস থামল। আস্তে আস্তে সবাই বাস থেকে নেমে এলাম। দেখলাম আমাদের কিছুক্ষণ আগেই এসে পৌঁছেছেন আমাদের মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয় বিচারপতি আবদুল মতিন ও তার পরিবারবর্গ। প্রাক্তন চেয়ারম্যান বিচারপতি গৌর গোপাল সাহা, মাননীয় সদস্য মহোদয় বিনয় ভূষণ তালুকদার ও প্রাক্তন সদস্য নরেশ চন্দ্র ঘোষ। আমি ও রেহানা আপা চেয়ারম্যান মহোদয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের সালাম জানালাম। দেখলাম আরও এসেছেন বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালের সদস্য মহোদয়গণ। আর এসেছেন আমাদের সম্মানিত রেজিস্ট্রার শাহানা হক সিদ্দিকা। আরও আছেন সম্মানিত আইনজীবিগণ ও তাদের পরিবারবর্গ।
‘অর্কিড কটেজ’-এর উপর তলায় বেশ সুন্দর ব্যবস্থা। চারদিকে খোলামেলা। তিনটি বাথরুম সংলগ্ন বেডরুম, ডাইনিং চারদিকে ব্যালকনি। কটেজটি আমার খুব পছন্দ হলো। গভীর অরণ্যের মাঝে এ রকম একটি কটেজ সত্যিই রোমাঞ্চকর। কটেজের পশ্চিমের ব্যালকনিতে দাঁড়ালে দেখায় এক পাশে লেক চলে গিয়েছে। বাঁধানো ঘাট সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেই ‘বোটের’ ব্যবস্থা রয়েছে। ইচ্ছেমতো লেকের জলে নৌকায় ভাসা যায়। রয়েছে সিমেন্টের তৈরি গোলাকার টেবিল চারপাশে বেঞ্চি। বিকেলের নরম আলোয় ওখানে বসে চা/কফি খেতে পারলে বেশ মজা হতো। ‘কটেজ’-এর অপর পাশে দেখা যায় গভীর অরণ্য। বিশাল লম্বা লম্বা গাছ যেমনÑগজারী, মেহগনি আর ইউক্যালিপটাসের ছাড়াছড়ি। কটেজের সামনের বারান্দায় দাঁড়ালে দেখা যায় মসৃণ পিচঢালা পথ চলে গিয়েছে অনেক দূর। ওখানে বসে থেকে কারও আসার প্রতীক্ষায় বসে সময় কাটানো যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এছাড়াও বেশ পরিচ্ছন্ন খোলামেলা জায়গা রয়েছে নিচে। আর ওখানে বাচ্চারা এসেই ক্রিকেট খেলা শুরু করেছে। এরপর নিচে এলাম গরম গরম চা খেতে। চা পান শেষে আমি, রেহানা আপা আর আবু আহমেদ সাহেব বেরিয়ে পড়লাম গভীর অরণ্যের সৌন্দর্য আহরণে। সামনে এগিয়ে কিছু ছবি তুললাম। যেতে যেতে একটি টং দোকান দেখা গেল। ওখানে অনেকেই বসে চা, বিস্কিট, পান খাচ্ছে। আমরা যেহেতু কিছুক্ষণ আগেই চা পান করেছি তাই আমরা দাঁড়ালাম না। সামনে এগুতেই আরও সহকর্মী আবদুর রহিম, মোখলেস সাহেব, মাসুদ সাহেবের সাথে দেখা হলো। আমরা সবাই মিলে এগোতে লাগলাম সামনের দিকে, ওখানে ৮ তলা টাওয়ার রয়েছে জানা গেল। তার পাশেই বাঁশ দিয়ে রাস্তায় বাধা দেয়া রয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানাল ওদিকে যাওয়া উচিত হবে না, কারণ ছিনতাইয়ের ভয় রয়েছে। তাই আমরা উল্টোদিকে হাঁটতে লাগলাম। দেখলাম বনের লালমাটি অনেকটাই দেবে গেছে। তার প্রমাণ পুরনো বেঞ্চিগুলো মাটি থেকে অনেক উপরের দিকে। তাহলে বনের মাটি নিচের দিকে দেবে যাচ্ছে। শীতের ঝরা পাতা মাড়িয়ে অরণ্যে আমরা ধীরে ধীরে এগোতে থাকলাম। দেখলাম অনেক বছরের ছাউনিগুলো বেশ অপরিচ্ছন্ন। মনে হলো এখানে দেখভাল করার লোকজন কম। শীতের কুয়াশার আবরণে আর ধুলায় গাছগুলোর পাতাও কেমন সবুজ থেকে কালচে রং ধারণ করেছে। আকাশছোঁয়া গাছগুলো দেখে মনে হলো আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি। ফাঁকে ফাঁকে জংলা গাছগুলোতে বুনো ফুল দেখতে পাব ভেবেছিলাম, কিন্তু অতিরিক্ত শীতে বোধহয় সব স্থবির হয়ে রয়েছে। ভেবেছিলাম জায়গায় জায়গায় বুনো ফুলের ঝাড় দেখব কিংবা কটেজের সামনে ফুলের বাগান দেখব। দেখব ফুলের ওপর প্রজাপতির ওড়াওড়ি আর ছেলেবেলার মতো আবৃতি করবÑ
‘যতবড় হোক ইন্দ্রধনু সে সুদূর আকাশে আঁকা,
আমি ভালবাসি মোর ধরণীর প্রজাপতিটির পাখা।’
কিন্তু সব স্বপ্নই কি আর সত্যি হয়! আমরা এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে, রাস্তায় দেখা হলো সহকর্মী রফিক সাহেবের সাথে এবং আরও দু’জন এ্যাডভোকেটকে নিয়ে দেখলাম বনের পাশেই দুটি দোতলা স্টাফ কোয়ার্টার। বেশ নিরিবিলি। আমার খুব কৌতূহল হলো গভীর অরণ্যে তারা কিভাবে থাকেন তা জানতে। রাতের পরিবেশই বা কেমন হয়। অনেক প্রশ্ন অনেক অনুভব নিয়ে আরও এগোলাম। রয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা। দু’টাকা টিকেট কেটে ঢুকতে হয়। ওখানে রয়েছে পনেরটি হরিণ, কচ্ছপ, একটি বড় লেজওয়ালা মুরগি। তাই কোন আকর্ষণ মনে হলো না। পাশেই লেকের পাড়ের বেঞ্চিতে বসলাম। দেখলাম শীতকাল বলেই লেকের পানি কমে গেছে। সিঁড়িগুলোও অব্যবহৃত। আমার মনে হলো ‘জাতীয় উদ্যান’টি আজ বড় বেশি অবহেলার শিকার। কারণ আরও দু’তিনবার এসেছি, কিন্তু এমন অব্যবহৃত অবহেলার দৃশ্য চোখে পড়েনি। তবে কি বিভিন্ন জায়গায় নতুন পিকনিক স্পট বা নতুন নতুন রাইডের আকর্ষণে সবাই আজ ন্যাশনাল পার্ককে বাদ দিয়ে সেখানেই ছুটছে? তবে আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। দেখলাম অনেকেই ঘোড়ায় চড়ছে ঘোড়ার গাড়ীতেও বনের চারদিকে ঘুরে আসছে। সবাই যার যার দল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অরণ্যের প্রাকৃতিক দৃশ্য আহরণের জন্য।
প্রায় দুপুর ২টা। আমরা সবাই ‘অর্কিড কটেজ’-এ ফিরে গেলাম। জোহর নামাজের পর শুরু হলো ‘বনভোজন’ পর্ব। কটেজের নিচতলায় সুন্দর ডাইনিংয়ের ব্যবস্থা। আমরা সহকর্মীরা একসঙ্গে বসে গেলাম। পোলাও, মুরগির রোস্ট, খাসীর রেজালা, সবজি, বোরহানী, সালাদ সহযোগে খাবার পর্ব শেষ হলো। তারপর শুরু হলো পরের পর্ব। অর্থাৎ কেউ কেউ গান গাইলেন, নাচলেন। তারপর শুরু হলো গেম পর্ব। এ গেম পর্ব উপস্থাপনায় ছিলেন সহকর্মী রফিকুল ইসলাম। বাচ্চাদের মোরগ লড়াই, মহিলাদের মিউজিক্যাল চেয়ার, আকর্ষণীয় পর্ব ছিল মাননীয় সদস্য (জেলা জজ) মহোদয়দের ও যুগ্ম সচিব মহোদয়দের হাঁড়িভাঙ্গা। এতে বেশ হাস্য কৌতুকের সৃষ্টি হয়েছিল। আরও বেশি আকর্ষণীয় ছিল রশি টানাটানি খেলা। দু’পাশে দু’জন চেয়ারম্যান, এ্যাডভোকেটগণ ও যুগ্ম সচিবদ্বয়। এ খেলাও উপভোগ্য ছিল। এরপর শুরু হলো পুরস্কার বিতরণ পর্ব। এ্যাডভোকেট তাহির হোসেন ভূঁইয়ার উপস্থাপনায় মাননীয় চেয়ারম্যান বিচারপতি আবদুল মতিন ও প্রাক্তন চেয়ারম্যান মহোদয় গৌর গোপাল সাহা পুরস্কার বিতরণ করেন। পুরস্কার বিতরণ শেষে মাইকে সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো। বেলা প্রায় গোধূলিলগ্ন, কুয়াশার চাঁদর আবার ঢেকে দিচ্ছে তার বনভূমিকে, তাই আমাদের বিদায়ের পালা। সবাই আগের মতোই যার যার বাসে উঠে বসলাম।
বিকেল ৫টা। শেষবারের মতো চারদিকে তাকিয়ে সবুজ অরণ্যকে দেখে নিলাম। আর ভাবলাম, আজ সারাদিন কি ভালই না কাটল। আর ভাবলাম এই সুন্দর দিনটির আয়োজন করা এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরসহ আমাদের ‘অতিথি’ করার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি। এ জন্য ধন্যবাদ জানাই প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী সর্বজনাব এ্যাডভোকেট আবদুর রহিম, এ্যাডভোকেট সফিকুল ইসলাম, এ্যাডভোকেট ড. আবদুর রহিম, এ্যাডভোকেট তাহির হোসেন ভূঁইয়া, এ্যাডভোকেট স্বপন কুমার আইচ, এ্যাডভোকেট আবদুল কাদির মিঞা, এ্যাডভোকেট সুজিত কুমার ভৌমিক, এ্যাডভোকেট মো. ওয়াহিদুজ্জামান ও এ্যাডভোকেট আবু বকর চৌধুরী।
অবশেষে গাড়ি চলতে শুরু করল ‘জাতীয় উদ্যানের’ ফটক পেরিয়ে দ্রুত ঢাকার দিকে। তখন সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশের লালসূর্যটা অস্ত যাচ্ছে। কুয়াশার চাদর চারদিকে অন্ধকার করে ফেলল। হিম এড়াতে গাড়ির জানালার গ্লাসটি ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিলাম আর মনে মনে আবৃত্তি করলাম
‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ঠ, কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নব সভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী
দাও সেই তপোবন, পুণ্যচ্ছায় রাশি।

No comments

Powered by Blogger.