সব সাথীরে খবর দে, রাজাকারের কবর দে...- তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে গোটা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে প্রতিবাদের মন্ত্র, তৈরি হয়েছে প্রতিবাদমঞ্চ by ফিরোজ মান্না,রহিম শেখ

ফেসবুক টুইটার প্রতিবাদের হাতিয়ার। প্রযুক্তির এসব মাধ্যম দিয়ে দেশে দেশে দাবি আদায়ের ঝড় উঠছে। আরব দুনিয়ায তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমেই স্বৈরশাসকদের ভিত কেঁপে উঠেছে।
কাউকে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। বাংলাদেশেও তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব শুরু হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম আজ প্রযুক্তির মাধ্যমে গোটা জাতিকে জাগিয়ে তুলেছে। এই জেগে ওঠা আগুনের লেলিহান শিখার মতো প্রতিবাদ ছড়িয়ে যাচ্ছে শহরে বন্দরে গ্রামে। তরুণ প্রজন্ম ফেসবুক টুইটার আর ব্লগের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে তুলেছে মিসরের তাহ্রীর স্কোয়ারের মতো শাহবাগ স্কোয়ার। এ শাহবাগ স্কোয়ার থেকে গোটা দেশে প্রতিবাদ মঞ্চ তৈরি হয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে মিসরের তারুণ্য জেগে ওঠা বিচারের রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে বিবেকের তাগিদে গত তিনদিন ধরে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছে। ‘ব্লগার এ্যান্ড এ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক’ নামের ফেসবুককেন্দ্রিক এ গ্রুপটি টানা প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিবাদ কর্মসূচীতে বিএনপি জামায়াত বাদে দেশের সব শ্রেণী পেশার মানুষ সংহতি প্রকাশ করছেন। দিন রাত হাজার হাজার মানুষ স্লোগান আর গণসঙ্গীতে মেতে রয়েছে। একইভাবে সারাদেশেই এমন প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন হচ্ছে। এই প্রতিবাদের মূলে রয়েছে ফেসবুক, টুইটার, ব্লগসহ তথ্য প্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যম। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে দেশে ফেসবুক টুইটার আর ব্লগের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। হাজার হাজার মানুষ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। ব্লগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি জানাচ্ছেন। দেশের তরুণ সমাজ এ মহান কাজটি করে যাচ্ছে। বিবেকের তাগিদে অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার তরুণদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন সমাজের সব শ্রেণী পেশার মানুষ। এতে তরুণ প্রজন্ম আরও অনুপ্রাণিত হচ্ছে। শাহবাগ স্কোয়ারে না গেলে তারুণ্যের উদ্যম যে কী, তা বোঝা যাবে না।
তথ্য প্রযুক্তিবিদরা বলেন, দেশে দেশে ইন্টারনেট এখন অধিকার আদায়ের বড় মধ্যম হয়ে দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ইন্টারনেটের মাধ্যমে গণঅন্দোলন হয়েছে। এতে যুগের পর যুগ শাসনকারী শাসকরা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও ফেসবুক বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বিশ্বের পরাক্রমশালী দেশের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও তাঁর নিজের ফেসবুকের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার কাজ চালিয়েছেন। তিনি তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিবর্তন চেয়েছেন। ভারতের হাইকোর্ট গুগলের অডিও-ভিডিও প্রকাশ ও দেখার ওয়েবসাইট ইউটিউব এবং সামাজিক যোগাযোগের সাইট অরকুট বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। চীনে তো গুগলের পুরো কর্মকা- এক বছর বন্ধ করে রাখা হয়। পরে সে দেশে সার্চ ইঞ্জিন হিসাবে চালু করা হয় ‘বাইডু’। চীনা জনগণের জন্য বাইডু ব্যবহার করা ছিল বাধ্যতামূলক। তখন হাজার হাজার ‘এ্যাক্সেস ওয়ে’ দিয়ে ইউটিউব ও ফেসবুক চীনের তরুণ প্রজন্ম ব্যবহার করেছে। ভারত সরকারের সমালোচনা জন্য ৩৫৮টি বিষয় অপসারণ করতে সার্চইঞ্জিন গুগল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। গুগল কর্তৃপক্ষ ভারতের ৫১ ভাগ অনুরোধ রক্ষা করেছে মাত্র। কিন্তু এই ৫১ ভাগও বিভিন্ন এ্যাক্সসেস ওয়েতে ইউজাররা দেখতে পেরেছেন। উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান পল এ্যাসেঞ্জ তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছেন। মার্কিনীদের কোটি কোটি গোপন দলিল ফাঁস করে দিয়েছেন তিনি।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলেন, সামাজিক নেটওয়ার্কি সাইটগুলো মানুষকে কাছে টেনে নিয়েছে। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ওয়েব সার্চইঞ্জিনগুলোকে ব্যবহার করছে আমাদের মেধাবী তরুণ-তরুণীরা। উল্টো দিকে যুদ্ধাপরীদের পক্ষেও একটি গ্রুপ তথ্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে। তারা প্রতিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে গ্রাম থেকে শুরু করে বিশ্বকে এক সুতায় বেঁধে দিয়েছে। চাইলেই ব্রিটিশ মিউজিয়াম, পেন্টাগন, নাসাসহ দুনিয়ার তাবদ তথ্য মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে হাজির করা সম্ভব হচ্ছে। এখন আর গ্রাম শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধতা নেই। তথ্য সমুদ্রে সব একাকার হয়ে গেছে। সীমানা পেরিয়ে মুহূর্তেই চলে যাওয়া যায় পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে। বন্ধুকে জানা, জানানো, নিজের ভার্চুয়াল জগত তৈরি করে ইন্টারনেট মানুষের জন্য আলাদা একটি জগত তৈরি করেছে। মানুষ এই কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিনের ব্যবহার্য এসব সাইট বা সেবামাধ্যমগুলোর মধ্যে রয়েছে গুগল, জি-মেইল, ইয়াহু, ইয়াহু-মেইল, হটমেইল, ফেসবুক, মাইস্পেস, টুইটার ইত্যাদি। এছাড়া মনের ভাবনাগুলো খুব সহজে প্রকাশের জন্য ব্লগ সাইটগুলো নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ফেসবুক টুইটার আর ব্লগে লাখ লাখ মানুষ তাদের মন্তব্য লিখছেন। তারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। তারা বলছেন, সময় হয়েছে যুদ্ধে যাওয়ার!! আর এই যুদ্ধে না গেলে আমি হব রাজাকার!! কাদেরকে ফাঁসি দাও, না হয় আমাকে ফাঁসি দাও। একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার রায়ের পর এমন প্রতিক্রিয়া লিখেছেন তার ওয়ালে। ব্লগ-ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে ক্ষোভের সঙ্গে তরুণদের গর্জে ওঠার আহ্বান জানাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। শাহবাগে যেমন ক্ষোভের আগুন জ্বলছে, তেমনি জ্বলছে এসব সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে। এক কথায় বলা যায়, ফেসবুক, ব্লগ এখন উত্তাল। স্ট্যাটাস, মন্তব্য এবং ব্লগের লেখায় জ্বলছে আগুন। কাদের মোল্লার রায়ের পর থেকে যারা মঙ্গলবার শাহবাগ যায়নি তারাই ফেসবুকে হাজারো তরুণের জমায়েত দেখে নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি। ছুটে গেছেন শাহবাগে।
কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে যারা ফেসবুকে একের পর এক স্ট্যাটাস লিখছেন তাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। এক তরুণ ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘মিছিলে স্লোগানে...বিক্ষোভে...গানে কবিতায়...এসো ভাই এসো বোন, গড়ে তুলি আন্দোলন...পক্ষ নিলে রক্ষা নাই...কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই।’ আরেকজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘সব সাথীরে খবর দে, রাজাকারের কবর দে’। জনতার জাগরণে রাজাকারের বিচার সময়ের ব্যাপার...বিচার মানে কি যাবজ্জীবন...না...মানি না, ফাঁসি ছাড়া ঘরে ফিরব না। আরেকজন ফেসবুক ব্যবহারকারী তীব্র ক্ষোভ নিয়ে তার দেয়ালে লিখেছেন, ‘মাননীয় আদালত, আপনি আল্লাহতালার প্রতিনিধি হিসেবে বিচারকের আসনে বসেন। নিজেকে হত্যা করতে রাজি, তবুও আপনার অবমাননা করব না। খুব জানতে মন চায়, ইউর অনার, কেন এমন হলো? সরকারকে ইঙ্গিত করে অন্য একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, পক্ষ নিলে রক্ষা নাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই।’
যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন এমন বয়সী ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যাও কম নয়। তাদের এমনকি একজন লিখেছেন, একাত্তরে রাজাকার-আলবদরদের হাতে জীবন দিয়েছিল যে ৩০ লাখ মানুষ, সম্ভ্রম হারিয়েছিল যে দুই লাখ মা-বোন, তারা আজ আমার বুকের ভেতর থেকে উঠে এসে বলছে, যা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আজ তুই, তোরা সবাই ৩২ লক্ষবার নিজের মুখে থুতু দে, থুতু দে, থুতু দে!! কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়ায় ফেসবুকে ক্ষোভের সঙ্গে অনেকেই স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তাদের সেই স্ট্যাটাসে মন্তব্য করেছেনও অনেকে। একজনের প্রতিক্রিয়া ছিল এমন, ‘আমি রায় অবমাননা করলাম, আমারে ফাঁসি দিন। আমার জন্ম এ দেশে না হলেই ভাল হতো।’ প্রিয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আরেকজনের মন্তব্য, ‘বাংলাদেশের আর কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোন পার্থক্য রইল না, ইতিহাস একদিন তা-ই বলবে।
ফেসবুকের পাশপাশি বিভিন্ন ব্লগেও ক্ষোভের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকে। কাদের মোল্লার রায়ের পর থেকে ব্লগে হাজারো স্ট্যটাস লিখেছেন ব্লগাররা। এক ব্লগার বলছিলেন, আমি কাঁদতে আসিনি, এসেছি ফাঁসির দাবি নিয়ে। রাজাকারের ফাঁসি চাই, বাংলার বুকে হাঁসি চাই। সব রাজাকার নিপাত যাক, বাংলা এবার মুক্তি পাক। বাংলা মা তোর ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই। আরেকজন ব্লগার তার ব্লগে লিখেছেন, শাহবাগ এখন প্রজন্ম চত্বর! মুক্তিযুদ্ধের প্রিয় প্রজন্ম চত্বর! শুধু কসাই কাদের মোল্লা না, মুক্তিযুদ্ধের এই বাংলায় কোন রাজাকার, তাদের আ-াবাচ্চাদের স্থান নেই। দেশের মানুষ এই খুনীদের ফাঁসি চায়, শুধু ফাঁসি, আর স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ-আন্তর্জাতিক বিচারের নামে যারা যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বাঁচাতে-ছত্রছায়া দেবার বাহানা- কৌশল করেছে-করছে, প্রিয় প্রজন্মের এই বিদ্রোহ এই প্রতিবাদ তাদের সবার বিরুদ্ধে। এ আগুন ছড়িয়ে যাবে সবখানে। আমরা জিতবই।
ফেসবুক, ব্লগ ও টুইটারের পাশাপাশি সক্রিয় ছিল অনলাইনে প্রতিক্রিয়া। তরুণ থেকে শুরু করে সব বয়সী নারী-পুরুষ অনলাইনে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ক্ষোভের সঙ্গে। অনলাইন প্রতিক্রিয়ায় একজন লিখেছেন, ‘যাবজ্জীবন? আহা! কি মধু মধু! কার ইশারায় শত শত মানুষ হত্যার রায় যাবজ্জীবন হয়? জানতে চাই!!! লজ্জা হইতেছে আমার, এ দেশ আমাদের সঙ্গে ছলনা করতে নিলে প্রতিটি ছলনার হিসাব কড়ায়-গ-ায় বুঝায়া দেয়া হবে!!’ আরেকজন লিখেছেন, ‘এক মুক্তিযোদ্ধা রায় শোনার পর ট্রাইব্যুনাল চত্বরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তিনি বললেন, যে দলটি স্বাধীনতায় দেশের নেতৃত্ব দিয়েছিল, তারাই যুদ্ধাপরাধের বিচারে জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। মুক্তিযোদ্ধা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধকে চরম অপমান করেছে। এখন আমরা বাড়ি ফিরব কোন্ মুখে? রাজাকারের ফাঁসি হয়নি ঘৃণ্য রাজনৈতিক স্বার্থে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের স্বেচ্ছায় ফাঁসি বরণের সময় এসেছে।’ এমন হাজার হাজার মন্তব্য ফেসবুক টুইটার ও ব্লগে লিখছেন কুখ্যাত কাদের মোল্লা ওরফে কসাই কাদের মোল্লার বিচারে সংক্ষুব্ধ মানুষ।

No comments

Powered by Blogger.