ফাঁসি চাই কাদের মোল্লাদের ॥ প্রয়োজনে আইন সংশোধন করুন- স্বদেশ রায়

রাজাকার কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি এখন বাংলাদেশের ষোলকোটি মানুষের দাবি। এ দাবি এখন আর কয়েকটি সংগঠন বা কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নয়।
আর শুধু যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা নয়, সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবি এখন ষোলকোটি মানুষের প্রাণের দাবি, অস্তিত্বের দাবি, ঐতিহ্যের দাবি। নতুন প্রজম্ম স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তারা আর রাজাকারদের নিয়ে এক সঙ্গে বসবাস করতে রাজি নয়। তারা এখন সম্পূর্ণরূপে একটি রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশে বাস করতে চায়। আর সে কারণে সারাদেশের রাজপথে তরুণ প্রজম্ম নেমে এসেছে। আর তাদের আহ্বানে নেমে এসেছে গোটা জাতি। মানুষের এ দাবি উপেক্ষা করার কোন উপায় এখন আর কারও নেই। এখন সব থেকে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কীভাবে আসবে? তরুণ প্রজম্ম আইনের শাসনে বিশ্বাসী। তারা আইনের বাইরে যেতে চায় না যেমন এক পাও তেমনি তারা তাদের জীবনের বিনিময়ে হলেও শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে চায় রাজাকার কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসি দিয়ে। সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি নিশ্চিত করে। কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পর পরই সরকার গোটা দেশের প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝতে পেরেছে এ রায়ে জনগণ খুশি নয়। অন্য সকল সংগঠন ও সাধারণ মানুষের মতো সরকারী দলও জানিয়েছে তারা এ রায়ে খুশি নয়। তারপর থেকে মানুষের দাবির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সরকার আইনী প্রক্রিয়ায় এগুচ্ছে। ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করবে।
সরকার আপীল করবে ঠিকই, কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী আইন ১৯৭৩-এর বিধান অনুযায়ী আসামি পক্ষের জন্যে সুযোগ রাখা হয়েছে বেশি। এমনকি বর্তমান সরকার আইন সংশোধন যতটুকু করেছে সেখানেও আসামির জন্যে সুযোগ বেশি। হয়ত হতে পারে সরকার মনে করেছে চল্লিশ বছর পরে এ বিচার হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মহল যেন মনে না করে সরকার কোন প্রতিহিংসার বশে নামমাত্র বিচার করছে। বরং তারা যেন দেখতে পায় আসামিদের মানবাধিকার রক্ষার সব ধরনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। যার ফল গিয়ে দাঁড়িয়েছে আসামি ট্রাইব্যুনাল থেকে যে কোন সাজা পেলেই সে সুপ্রীমকোর্টে আপীল করার সুযোগ পাচ্ছে। অন্যদিকে আসামি কোনরূপ কোন সাজা পেলে বাদী আর ওই মামলা নিয়ে সুপ্রীমকোর্টে আপীল করার সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে যে একটি অভিযোগে কাদের মোল্লা খালাস পেয়েছে ওই অভিযোগ ছাড়া অন্য অভিযোগগুলো নিয়ে সরকার সুপ্রীমকোর্টে আপীল করতে পারছে না। আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী আইন ১৯৭৩ এর এই ধারা সম্পূর্ণভাবে বাদীকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এমনকি আমাদের সংবিধানের মূল চেতনার বিপরীতে এই ধারা। কারণ, আমাদের সংবিধান স্পষ্ট বলেছে সব ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্যে সমান অধিকার দেবে। তাই আসামি ট্রাইব্যুনালের রায়ে সন্তুষ্ট না হলে আপীল করার সুযোগ পাবে আর বাদী সন্তুষ্ট না হলে আপীল করার সুযোগ পাবে না এটা হতে পারে না। বাদীকে এ সুযোগ দিতেই হবে। আর এ জন্যে যদি প্রয়োজনে আইনের এই অংশটুকু সংশোধন করে নিতে হয় তাহলে সেটা অবিলম্বে সংশোধন করতে হবে। যেহেতু আমাদের এই সংসদ সর্বসম্মতক্রমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অনুমোদন দিয়েছে তাই এ সংসদের মাধ্যমে আইনের এই অংশটুকু বদল করা সময়ের ব্যাপার মাত্র এবং বর্তমান সংসদের উচিত হবে বিষয়টি নিয়ে কালক্ষেপণ না করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া।
বর্তমান সংসদে যারা সংসদ সদস্য তাদের ভেতর একটি বড় অংশ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তারপরে জাতির পিতার সন্তান ও জাতীয় নেতাদের সন্তান এই সংসদের সদস্য। তাই তাদের কাছে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে না এই মামলার বাদী রাষ্ট্র হলেও ক্ষতিগ্রস্ত কে? এবং সেই নাগরিকগণ কেন জীবন দিয়েছিল এসব কুলাঙ্গার যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগিতায় ও তাদের হাতে। তারা আজকের এই সংসদ, এই দেশ, এই স্বাধীনতা চেয়েছিল বলেই কিন্তু তাদের প্রাণ দিতে হয়েছিল। আর তাদের প্রাণের বিনিময়ে, তাদের আব্রু হারানোর বিনিময়ে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করি। ১৯৭১ সালের ষোলই ডিসেম্বর ৩.৪১ মিনিটের পর থেকেই এই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেবার নৈতিক ও আইনগত অধিকার এ দেশ ও জাতি অর্জন করেছে। কারণ এটা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ীর নৈতিক ও আইনগত অধিকার। সেদিন যদি আমরা পরাজিত হতাম, তারা কি এমনি ৪১ বছর অপেক্ষা করত বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিন আহমদ থেকে শুরু করে তোফায়েল আহমদ ও মইনউদ্দিন খান বাদলের বিচার করতে। তারা ৪১ ঘণ্টাও অপেক্ষা করত না। তাই এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা, শাস্তি দেয়া যেমন আমাদের নৈতিক ও আইনগত অধিকার তেমনি বিজয়ীর অধিকারও। আর এই অধিকার প্রয়োগ কেন করা হচ্ছে? করা হচ্ছে কারণ তারা আমার অস্তিত্বের বিরোধিতা করেছিল, তারা আমার পিতাকে, ভাইকে হত্যা করেছিল আমার মা ও বোনের ইজ্জত নিয়েছিল, তাদের হত্যা করেছিল। এ কারণেই জাতি তাদের বিচার করছে।
তাই শুধু কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসি নয়, ভবিষ্যতে সব যুদ্ধাপরাধী যাতে উপযুক্ত শাস্তি পায়। জাতি স্বস্তি পায়, সত্যি তারা বিচার করতে পেরেছে এই স্বস্তিটুকু যাতে পায় তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত যাতে আপীলের সমান সুযোগ পায় তার জন্যে এ আইন অবিলম্বে সংশোধন করতে হবে। এবং সংসদ সদস্যদের সে কাজ করতে হবে। কারণ, আমাদের প্রতি মুহূর্তে মনে রাখতে হবে, এ জাতির প্রজম্ম থেকে প্রজম্মে যে রক্তধারা প্রবাহিত হবে তাদের ধমনী দিয়ে সেটা শহীদের রক্ত, মুক্তিযোদ্ধার রক্ত। তাই যারা সংসদে আছেন তাদের শরীরে শহীদের রক্তধারা যে ডাক দেয় সেই ডাকই তাকে শুনতে হবে।
এমনকি আমাদের বিচারক, আমাদের আইনজীবী সকলের মনে রাখা উচিত আর দশটি দেশের মতো আমরা আমাদের আইনগুলো কেবল কালো অক্ষরে দেখব না? আমরা আমাদের সংবিধান কেবল কালো অক্ষরে পড়ব না। বরং আমরা যখনই আমাদের আইনগুলো দেখব, আইনগুলো প্রণয়ন করব, আমরা আমাদের সংবিধানের অক্ষরগুলো পড়ব তখনই আমরা যেন বুকের ভেতর চেতনার আগুনটি জ্বালিয়ে নেই। তখন আমরা ঠিকই দেখতে পাব আমাদের সংবিধান এবং সংবিধান থেকে উৎসরিত সকল আইন লাল অক্ষরে লেখা। এ সংবিধান শহীদের রক্তে তৈরি। তাই এটা অন্য দশটি দেশের সংবিধানের মতো কালো অক্ষরে নয়। রক্ত জবার মতো টকটকে লাল রক্তের অক্ষরে লেখা আমাদের সংবিধান।
আমাদের বিচারপতিদেরও কালো অক্ষরে সংবিধান ও সংবিধান থেকে উৎসরিত কোন আইন দেখার সুযোগ নেই। বিচারককেও তার বিচারের আসনে বসেও দেখতে হবে সংবিধানের লাল অক্ষর। কারণ, আমাদের সংবিধানের মাতা শহীদের রক্ত। তাই এই সংবিধানের অধীনে কোন্ আইনে যাদের হাতে আমার পিতা, আমার ভাই, আমার বোন শহীদ হয়েছে, যাদের হাতে আমার মা আব্রু হারিয়েছে তাদের কম সাজা দেবার কোন সুযোগ নেই। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নির্ধারিত হয়ে আছে তাদের শাস্তি মৃত্যুদ-। আর কিছু নয়।

No comments

Powered by Blogger.