তারুণ্যে প্রকম্পিত শাহবাগ স্কয়ার ॥ ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি
কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’অমর
একুশের সেই কালজয়ী কবিতা ধ্বনিত হচ্ছে মানুষের মুখে মুখে। শাহবাগ স্কয়ারের
পাশ ঘেঁষে একুশে বইমেলার যাত্রাপথ।
অন্য পাশে রমনার
পার্কসহ আশপাশের গাছে গাছে আমের মুকুল। এসেছে নতুন পাতার সময়। বসন্তের
আগমনে নতুন বারতা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে প্রকৃতি। রক্তাক্ত শিমুল আর পলাশ
ফোটার প্রস্তুতিও চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। সকল
আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত এ স্থান। তাই প্রকৃতি আর একুশের চেতনার
সঙ্গে শাহবাগের হাজার হাজার তরুণসহ আবাল বৃদ্ধবনিতার বিদ্রোহ যেন এখন মিলে
মিলে একাকার। প্রকৃতিও যেন বলছে তোমরা এগিয়ে যাও। সংগ্রামে অবিচল থাক। নতুন
করে গড়ে তোল এ সমাজ। এ প্রজন্মের সঙ্গে হবে নতুনের মিতালী। যা ইতিহাস
স্বর্ণাক্ষরে আগলে রাখবে আজীবন।
এখন দেশজুড়ে প্রতিবাদের নাম শাহবাগ। এখান থেকে নতুন করে দেশ রক্ষার ডাক দেয়া হচ্ছে। মুক্তিকামী মানুষের বিপ্লবী স্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছে রাজপথ। গোটা রাজধানীবাসীর একটাই ঠিকানা তা হলো শাহবাগ। এখানে আসছেন মুক্তিযোদ্ধা, কিশোরী থেকে শুরু করে অবুঝ শিশুও। নেমেছে নতুন প্রজন্মের বাধ ভাঙ্গা ঢল। তারুণ্যের জোয়ার। সৃষ্টি হয়েছে গণজাগরণের। সব মিলিয়ে পায়ে পায়ে মানুষের স্রোত এখন ‘শাহবাগ স্কয়ার’-এর দিকে। ’৭১-এর ঘাতক কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়ায় বুক ফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ মিরপুরের আলোকদী গ্রামের কেউ কেউ। এখানে গৃহিণীরা আসছেন সন্তানদের জন্য রান্না করা খাবার নিয়ে। শহীদ মিনার তৈরি করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন অনেকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচী পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন।
এখানে সংহতি জানাতে আসছেন সর্বস্তরের মানুষ। মুহূর্তের মধ্যে দীর্ঘ ব্যানার পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে প্রতিবাদী মানুষের রাজাকারদের প্রতি ঘৃণাভরা মন্তব্যে। আগুন দেয়া হচ্ছে রাজাকারদের কুশপুতুলে। থুতু আর জুতো ছুড়ে ধিক্কার জানানো হচ্ছে রাজাকারদের ঘৃণাস্তম্ভে। প্রজেক্টরে দেখানো হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। অবিরাম চলছে প্রতিবাদী স্লোগান, গান আর কবিতা। ঢাক, ঢোল, করতালসহ নানা সরঞ্জামের বাদ্যবাজনার তালে তালে চলছে কাদের মোল্লার রায়ের প্রতিবাদ। চারুকলার শিক্ষার্থীরা রাস্তায় এঁকে যাচ্ছেন রাজাকারদের ব্যঙ্গচিত্র।
সমস্বরে দাবি জানানো হচ্ছে ‘ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ কর।’ সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’ রাতে ঢাকায় হাজারো মানুষ মশাল হাতে নিয়ে বিক্ষোভ করে। সন্ধ্যার পর শাহবাগের পুরো এলাকা জনসমূত্রে পরিণত হয়। মোমের প্রদীপের আলোতে অন্ধকার দূর করার শপথ নিয়েছেন সকলেই। আজ শুক্রবার শাহবাগে অনুষ্ঠিত হবে মহাসমাবেশ।
ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন থেকে শুরু করে সেবা সংস্থাগুলো স্বেচ্ছায় সেবা দিতে এগিয়ে এসেছে। শুকনো খাবার ছড়িয়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। ’৭১-এর ঘাতক ও জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে বৃহস্পতিবার রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, ফরিদপুর, যশোর, বরিশাল, কুমিল্লা, মুন্সীগজ্ঞ, গাইবান্ধা, সাতক্ষীরা, নোয়াখালী, রংপুর, সুনামগঞ্জ, বান্দরবান, মাগুরা, দোহার, নবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, খাগড়াছড়ি, নারায়ণগঞ্জ, নাটোর, নরসিংদী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, নড়াইল, মানিকগঞ্জ, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, শাবি, ঝিনাইদহ, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় অবস্থান কর্মসূচী, মানববন্ধন, বিক্ষাভ-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। মহাসড়ক অবরোধ করা হয়েছে সাভারে। বাস্তবতা হলো কাদের মোল্লাসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন শহর থেকে গ্রাম; টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে।
বিপ্লবী স্লোগানে মুখরিত ॥ স্বাধীনতাপ্রিয় প্রেশপ্রেমিক মানুষ যারাই শাহবাগে যাচ্ছেন তাদের সবাইকে মিছিল আর স্লোগানে উজ্জীবিত না হওয়ার কোন সুযোগ নেই। জয়বাংলা, জয় বাংলাদেশ বীর বাঙালীর হাতিয়ার-গর্জে ওঠ আরেকবার/জামায়াত মারার হাতিয়ার-শিবির মারার হাতিয়ার গর্জে ওঠ আরেকবার/ দালালদের আস্তানা-আপোসের আস্তানা-সমঝোতার আস্তানা ভেঙ্গে দাও গুঁড়িয়ে দাও/সাম্প্রদায়িকতার আস্তানা-রাজাকারের আস্তানা-জামায়াতের আস্তানা ভেঙ্গে দাও গুঁড়িয়ে দাও/ জ্বালো-জ্বালো আগুন জ্বালো/ আয় রে আয় ডাক দিয়েছে মায়, অস্তিত্বের সংগ্রামে আজ জোট বাঁধ সবাই/পাকিস্তানের প্রেতাত্মা পাকিস্তানেই ফিরে যা/লাখো শহীদ ডাক পাঠাল সারা বাংলায় খবর দে, সারা বাংলা ঘেরাও করে জামায়াত-শিবির কবর দে/কারা মোর ঘর ভেঙ্গেছে স্মরণ আছে/ জামায়াত-শিবির রাজাকার এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়, বাংলাদেশের মাটিতে জামায়াত-শিবিরের ঠাঁই নেই/আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত/ শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না, তোমার আমার ঠিকানা শাহবাগ-শাহবাগ/ ক-তে কাদের মোল্লা/তুই রাজাকার তুই রাজাকার/ ন-তে নিজামী/ তুই রাজাকার তুই রাজাকার/ ম-তে মুজাহিদ/ তুই রাজাকার তুই রাজাকার/ গ-তে গোলাম আযম/ তুই রাজাকার তুই রাজাকার। এ রকম শত শত স্লোগান আর গানে মুখরিত শাহবাগ।
কাদের মোল্লাকে খুন করে জেলে যেতে চাই ॥ ‘৩৫৫টি খুন ও ধর্ষণ মামলায় যদি ১৪ বছর করে জেল হয় তাহলে একটি খুনের মামলায় হয় প্রায় দুই মাস করে জেল। আমি কাদের মোল্লাকে খুন করে দুই মাস জেলে থাকতে চাই।’ ভিন্নধর্মী একটি ঐকিক নিয়মের পথ বের করে এভাবেই ফেস্টুন লিখে লাইনে দাঁড়িয়ে গেছেন তরুণ-তরুণীরা। নিজ আগ্রহে লেখা ব্যানার-ফেস্টুন হাতে লাইনে দাঁড়িয়ে ‘কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই, দিতে হবে দিয়ে দাও’ স্লোগান দেন তারা। কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়ায় প্রথমে বিষণ্ণ করলেও এ গণআন্দোলনে নামার পর প্রতিবাদে-প্রতিরোধে জ্বলে ওঠার আগুন ঝরছে সবার চোখে মুখে। শিহাব নামের এক তরুণ হাতে লেখা এমনি একটি ফেস্টুন নিয়ে বৃহস্পতিবার আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন।
মন্তব্য লেখার ঠাঁই নেই ॥ ‘ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই ছোট সে তরী’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতার বাস্তব চিত্র দেখা গেল শাহবাগের অবস্থান কর্মসূচীতে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড-এর পক্ষ থেকে একটি বিলাশ আকৃতির সাদা কাপড় রাখা হয় রাস্তায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জনস্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানের লক্ষ্যেই এই আয়োজন। কাপড়ের ওপর রাখা হয় কলমও। কে আগে লিখবেন? দীর্ঘ লাইন। অল্প সময়ের মধ্যে মন্তব্য লেখার আর জায়গা নেই। শত শত মন্তব্যে ভরে গেছে তরী। হতাশ হয়ে ফিরেছেন অনেকে। কাপড়ে বিপ্লবী মানুষের দাবি একটাই রাজাকারদের বিচার করা। কোন আপোস চলবে না। রাজাকারদের রক্ষায় যারা সহযোগিতা করবে আপোসের চেষ্টা চালাবে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে যুব সমাজ। এ ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে।
সংহতি প্রকাশ ॥ বৃহস্পতিবার আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তিনি বলেন, স্বাধীনতাবিরোধীরা ’৭১-এর পরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র সরকারের বিরুদ্ধে সরকার গড়ে তুলেছে। তারা দেশকে মৌলবাদের রাষ্ট্র বানাতে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে তরুণ প্রজন্ম যে গণজাগরণ গড়ে তুলেছে তার বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির চক্রও যে কোন আঘাত হানতে পারে। তাই এ আন্দোলনে আয়োজকদের আরও সতর্কভাবে এ আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে, আর শৃঙ্খলা আনতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে ’৭১-এ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবস্থান নিয়েছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে। আমাদের সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল রাশিয়া, ভারতসহ কয়েকটি রাষ্ট্র। তাই সেসব বিরোধী রাষ্ট্র ও তাদের মিডিয়ার অপপ্রচার চালানো খুবই স্বাভাবিক।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের প্রতিবাদী মঞ্চে সংহতি জানাতে এসে তোপের মুখে পড়েন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। প্রতিবাদী মঞ্চে সাহারা খাতুন কিছু বলতে ওঠেন। এ সময় উপস্থিত ছাত্র-জনতা স্লোগানে স্লোগনে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেন। স্লোগান ওঠে আপোসকারীদের মানি না, মানব না।’ একপর্যায়ে সাহারা খাতুন উপস্থিত ছাত্র-জনতাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শাহবাগ চত্বর থেকে বিদায় নেন। শাহবাগের এ প্রতিবাদ সমাবেশে সকালে আরও সংহতি জানান সংসদ সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, ভাস্কর রাসা, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী, ড. হোসেন মনসুরসহ আরও অনেকে। সংহতি প্রকাশ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মেডিক্যাল শিক্ষার্থীসহ আরও অনেকে।
এদিকে শাহবাগের আন্দোলনে বক্তব্য দেয়া হলো না আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তিনি শাহবাগে আসেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে। অস্থায়ী মঞ্চে তিনি বক্তব্য দিতে যান। এ সময় আন্দোলনকারীরা না না বলে চিৎকার করেন। এর পরও তিনি বক্তব্য দিতে উদ্যত হলে বিক্ষোভকারীরা পানির বোতল ছুড়ে মারেন ও তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক স্লোগান দিতে থাকেন। বুধবার রাতে সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীও আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে পড়েন। তবে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বৃহস্পতিবার বক্তব্য রাখলেও তাঁদের ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীরা বিরোধিতা করেননি।
রাজধানীজুড়ে আন্দোলন ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নিবন্ধ সমর্থন করায় দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও দেশদ্রোহী বললেন পরিবেশ মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, একজন আদর্শিক রাজনীতিক হিসেবে ফখরুল এই নিবন্ধ সমর্থন করতে পারেন না। আমরা আশা করেছিলাম তিনি জেল থেকে বের হয়ে নিবন্ধের বিপক্ষে বলবেন, অথচ করলেন উল্টোটা। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে তরুণ প্রজন্ম যে আন্দোলন শুরু করেছে আমরা তার প্রতি নৈতিক সমর্থন জানাচ্ছি।’ কাদের মোল্লাসহ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে বঙ্গবন্ধু মানবকল্যাণ পরিষদ ও ঘাতক-দালাল-যুদ্ধাপরাধী নির্মূল সংসদ এই মানববন্ধন আয়োজন করে। মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পৃথকভাবে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ শেষে শাহবাগে এসে মিলিত হয়।
খিচুড়িই ভরসা ॥ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে প্রতিবাদী সেøাগান-গণসঙ্গীত আর যুদ্ধাপরাধীর কুশপুতুলে জুতো নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে মুখরিত হয়ে ওঠে শাহবাগের সমাবেশস্থল। মঙ্গলবার বিকেল থেকে শুরু হওয়া এ জমায়েত বুধবারও রাত কাটিয়েছে শাহবাগ মোড়েই। বৃহস্পতিবার ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন নানা শ্রেণী-পেশার হাজারো মানুষ। আন্দোলনকারীদের খাবারের ভরসা বুধবার রাতের খিচুড়ি। রাতে লঙ্গরখানার মতো খিচুড়ি খাওয়ানো হয় আন্দোলনকারীদের। বৃহস্পতিবার সারাদিন ভাত জোটেনি। তবে শুকনো খাবার দিয়েছেন কেউ কেউ।
সকাল ৭টার দিকে প্রতিবাদী গান শুরু করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তীরন্দাজ’। ৮টার দিকে ঘোষণা মঞ্চ থেকে আহ্বান জানানো হয় চারদিকে গোল হয়ে অবস্থান নেয়ার জন্য। ১৫ মিনিটের মধ্যে মোড় ঘিরে চারদিকে গোল হয়ে অবস্থান নেন সমবেতরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদী মঞ্চ ঘিরে বাড়ে সংহতি জানাতে আসা মানুষের সংখ্যাও।
বিশেষ করে স্কুল-কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে আসতে থাকেন শাহবাগের দিকে। প্রায় সবার মাথা আর হাতে বাঁধা লাল-সবুজ পতাকা। আর মুখে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সেøাগান, কখনও বা দেশের গান, গুসঙ্গীত। সকাল ১০টার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ঢাক-ঢোলসহ মিছিল নিয়ে সংহতি জানাতে আসেন তরুণ-তরুণীরা। ঘোষণা মঞ্চ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভের খবর উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। ঘোষণা মঞ্চ থেকে জানানো হয়, যুক্তরাজ্যের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেছেন। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিক্ষোভ মঞ্চে রাজাকারদের কুশপুতুলে জুতো নিক্ষেপ চলে। এ ছাড়া সমাবেশস্থলে সারারাত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদসহ কয়েকটি সংগঠন। বুধবার রাতে দেখানো হয় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিএ হাঙর নদী গ্রেনেড। এদিকে শাহবাগ চত্বর প্রতিবাদকারীদের দখলে থাকায় কাঁটাবন, মৎস্যভবন ও রূপসী বাংলা মোড় থেকে শাহবাগ পর্যন্ত সড়কে ব্যারিকেড বসায় পুলিশ। ফলে যানবাহন চলছে বিকল্প পথে। ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের ডিসি সৈয়দ নূরুল ইসলাম বলেন, শাহবাগের সমাবেশে বাধা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। জাতীয় প্রেসক্লাবে সামনে অযৌক্তিক দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে মানুষ মিছিল-সমাবেশ করেছে। শাহবাগে জড়ো হওয়া মানুষের দাবি যৌক্তিক। দেশবাসীর প্রাণের কথা ধ্বনিত হচ্ছে এখানে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের ফাঁসি জনদাবিতে রূপ নিয়েছে। দেশের সকল মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণের বিষয় এই আন্দোলন। তবে আন্দোলনকারীরা পাশের সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে অবস্থান নিতে পারে। না নিলে যদি এখানেই অবস্থান করে তাহলেও পুলিশের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।
বিচারপতি মানিক হাসপাতালে ॥ কাদের মোল্লার রায় শোনার পর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আপীল বিভাগের সদস্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুল হুদা মানিক। তিনি ৩০৪ নম্বর কেবিনে অধ্যাপক ডা. মকসুবুল হকের তত্ত্বাবধানে আছেন। আরোগ্য কামনায় তিনি সকলের দোয়া প্রার্থী। তিনি জনকণ্ঠের কাছে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হত্যা মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-।
এখন দেশজুড়ে প্রতিবাদের নাম শাহবাগ। এখান থেকে নতুন করে দেশ রক্ষার ডাক দেয়া হচ্ছে। মুক্তিকামী মানুষের বিপ্লবী স্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছে রাজপথ। গোটা রাজধানীবাসীর একটাই ঠিকানা তা হলো শাহবাগ। এখানে আসছেন মুক্তিযোদ্ধা, কিশোরী থেকে শুরু করে অবুঝ শিশুও। নেমেছে নতুন প্রজন্মের বাধ ভাঙ্গা ঢল। তারুণ্যের জোয়ার। সৃষ্টি হয়েছে গণজাগরণের। সব মিলিয়ে পায়ে পায়ে মানুষের স্রোত এখন ‘শাহবাগ স্কয়ার’-এর দিকে। ’৭১-এর ঘাতক কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়ায় বুক ফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ মিরপুরের আলোকদী গ্রামের কেউ কেউ। এখানে গৃহিণীরা আসছেন সন্তানদের জন্য রান্না করা খাবার নিয়ে। শহীদ মিনার তৈরি করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন অনেকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচী পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন।
এখানে সংহতি জানাতে আসছেন সর্বস্তরের মানুষ। মুহূর্তের মধ্যে দীর্ঘ ব্যানার পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে প্রতিবাদী মানুষের রাজাকারদের প্রতি ঘৃণাভরা মন্তব্যে। আগুন দেয়া হচ্ছে রাজাকারদের কুশপুতুলে। থুতু আর জুতো ছুড়ে ধিক্কার জানানো হচ্ছে রাজাকারদের ঘৃণাস্তম্ভে। প্রজেক্টরে দেখানো হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। অবিরাম চলছে প্রতিবাদী স্লোগান, গান আর কবিতা। ঢাক, ঢোল, করতালসহ নানা সরঞ্জামের বাদ্যবাজনার তালে তালে চলছে কাদের মোল্লার রায়ের প্রতিবাদ। চারুকলার শিক্ষার্থীরা রাস্তায় এঁকে যাচ্ছেন রাজাকারদের ব্যঙ্গচিত্র।
সমস্বরে দাবি জানানো হচ্ছে ‘ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ কর।’ সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’ রাতে ঢাকায় হাজারো মানুষ মশাল হাতে নিয়ে বিক্ষোভ করে। সন্ধ্যার পর শাহবাগের পুরো এলাকা জনসমূত্রে পরিণত হয়। মোমের প্রদীপের আলোতে অন্ধকার দূর করার শপথ নিয়েছেন সকলেই। আজ শুক্রবার শাহবাগে অনুষ্ঠিত হবে মহাসমাবেশ।
ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন থেকে শুরু করে সেবা সংস্থাগুলো স্বেচ্ছায় সেবা দিতে এগিয়ে এসেছে। শুকনো খাবার ছড়িয়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। ’৭১-এর ঘাতক ও জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে বৃহস্পতিবার রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, ফরিদপুর, যশোর, বরিশাল, কুমিল্লা, মুন্সীগজ্ঞ, গাইবান্ধা, সাতক্ষীরা, নোয়াখালী, রংপুর, সুনামগঞ্জ, বান্দরবান, মাগুরা, দোহার, নবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, খাগড়াছড়ি, নারায়ণগঞ্জ, নাটোর, নরসিংদী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, নড়াইল, মানিকগঞ্জ, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, শাবি, ঝিনাইদহ, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় অবস্থান কর্মসূচী, মানববন্ধন, বিক্ষাভ-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। মহাসড়ক অবরোধ করা হয়েছে সাভারে। বাস্তবতা হলো কাদের মোল্লাসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন শহর থেকে গ্রাম; টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে।
বিপ্লবী স্লোগানে মুখরিত ॥ স্বাধীনতাপ্রিয় প্রেশপ্রেমিক মানুষ যারাই শাহবাগে যাচ্ছেন তাদের সবাইকে মিছিল আর স্লোগানে উজ্জীবিত না হওয়ার কোন সুযোগ নেই। জয়বাংলা, জয় বাংলাদেশ বীর বাঙালীর হাতিয়ার-গর্জে ওঠ আরেকবার/জামায়াত মারার হাতিয়ার-শিবির মারার হাতিয়ার গর্জে ওঠ আরেকবার/ দালালদের আস্তানা-আপোসের আস্তানা-সমঝোতার আস্তানা ভেঙ্গে দাও গুঁড়িয়ে দাও/সাম্প্রদায়িকতার আস্তানা-রাজাকারের আস্তানা-জামায়াতের আস্তানা ভেঙ্গে দাও গুঁড়িয়ে দাও/ জ্বালো-জ্বালো আগুন জ্বালো/ আয় রে আয় ডাক দিয়েছে মায়, অস্তিত্বের সংগ্রামে আজ জোট বাঁধ সবাই/পাকিস্তানের প্রেতাত্মা পাকিস্তানেই ফিরে যা/লাখো শহীদ ডাক পাঠাল সারা বাংলায় খবর দে, সারা বাংলা ঘেরাও করে জামায়াত-শিবির কবর দে/কারা মোর ঘর ভেঙ্গেছে স্মরণ আছে/ জামায়াত-শিবির রাজাকার এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়, বাংলাদেশের মাটিতে জামায়াত-শিবিরের ঠাঁই নেই/আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত/ শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না, তোমার আমার ঠিকানা শাহবাগ-শাহবাগ/ ক-তে কাদের মোল্লা/তুই রাজাকার তুই রাজাকার/ ন-তে নিজামী/ তুই রাজাকার তুই রাজাকার/ ম-তে মুজাহিদ/ তুই রাজাকার তুই রাজাকার/ গ-তে গোলাম আযম/ তুই রাজাকার তুই রাজাকার। এ রকম শত শত স্লোগান আর গানে মুখরিত শাহবাগ।
কাদের মোল্লাকে খুন করে জেলে যেতে চাই ॥ ‘৩৫৫টি খুন ও ধর্ষণ মামলায় যদি ১৪ বছর করে জেল হয় তাহলে একটি খুনের মামলায় হয় প্রায় দুই মাস করে জেল। আমি কাদের মোল্লাকে খুন করে দুই মাস জেলে থাকতে চাই।’ ভিন্নধর্মী একটি ঐকিক নিয়মের পথ বের করে এভাবেই ফেস্টুন লিখে লাইনে দাঁড়িয়ে গেছেন তরুণ-তরুণীরা। নিজ আগ্রহে লেখা ব্যানার-ফেস্টুন হাতে লাইনে দাঁড়িয়ে ‘কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই, দিতে হবে দিয়ে দাও’ স্লোগান দেন তারা। কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়ায় প্রথমে বিষণ্ণ করলেও এ গণআন্দোলনে নামার পর প্রতিবাদে-প্রতিরোধে জ্বলে ওঠার আগুন ঝরছে সবার চোখে মুখে। শিহাব নামের এক তরুণ হাতে লেখা এমনি একটি ফেস্টুন নিয়ে বৃহস্পতিবার আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন।
মন্তব্য লেখার ঠাঁই নেই ॥ ‘ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই ছোট সে তরী’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতার বাস্তব চিত্র দেখা গেল শাহবাগের অবস্থান কর্মসূচীতে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড-এর পক্ষ থেকে একটি বিলাশ আকৃতির সাদা কাপড় রাখা হয় রাস্তায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জনস্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানের লক্ষ্যেই এই আয়োজন। কাপড়ের ওপর রাখা হয় কলমও। কে আগে লিখবেন? দীর্ঘ লাইন। অল্প সময়ের মধ্যে মন্তব্য লেখার আর জায়গা নেই। শত শত মন্তব্যে ভরে গেছে তরী। হতাশ হয়ে ফিরেছেন অনেকে। কাপড়ে বিপ্লবী মানুষের দাবি একটাই রাজাকারদের বিচার করা। কোন আপোস চলবে না। রাজাকারদের রক্ষায় যারা সহযোগিতা করবে আপোসের চেষ্টা চালাবে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে যুব সমাজ। এ ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে।
সংহতি প্রকাশ ॥ বৃহস্পতিবার আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তিনি বলেন, স্বাধীনতাবিরোধীরা ’৭১-এর পরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র সরকারের বিরুদ্ধে সরকার গড়ে তুলেছে। তারা দেশকে মৌলবাদের রাষ্ট্র বানাতে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে তরুণ প্রজন্ম যে গণজাগরণ গড়ে তুলেছে তার বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির চক্রও যে কোন আঘাত হানতে পারে। তাই এ আন্দোলনে আয়োজকদের আরও সতর্কভাবে এ আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে, আর শৃঙ্খলা আনতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে ’৭১-এ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবস্থান নিয়েছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে। আমাদের সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল রাশিয়া, ভারতসহ কয়েকটি রাষ্ট্র। তাই সেসব বিরোধী রাষ্ট্র ও তাদের মিডিয়ার অপপ্রচার চালানো খুবই স্বাভাবিক।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের প্রতিবাদী মঞ্চে সংহতি জানাতে এসে তোপের মুখে পড়েন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। প্রতিবাদী মঞ্চে সাহারা খাতুন কিছু বলতে ওঠেন। এ সময় উপস্থিত ছাত্র-জনতা স্লোগানে স্লোগনে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেন। স্লোগান ওঠে আপোসকারীদের মানি না, মানব না।’ একপর্যায়ে সাহারা খাতুন উপস্থিত ছাত্র-জনতাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শাহবাগ চত্বর থেকে বিদায় নেন। শাহবাগের এ প্রতিবাদ সমাবেশে সকালে আরও সংহতি জানান সংসদ সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, ভাস্কর রাসা, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী, ড. হোসেন মনসুরসহ আরও অনেকে। সংহতি প্রকাশ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মেডিক্যাল শিক্ষার্থীসহ আরও অনেকে।
এদিকে শাহবাগের আন্দোলনে বক্তব্য দেয়া হলো না আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তিনি শাহবাগে আসেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে। অস্থায়ী মঞ্চে তিনি বক্তব্য দিতে যান। এ সময় আন্দোলনকারীরা না না বলে চিৎকার করেন। এর পরও তিনি বক্তব্য দিতে উদ্যত হলে বিক্ষোভকারীরা পানির বোতল ছুড়ে মারেন ও তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক স্লোগান দিতে থাকেন। বুধবার রাতে সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীও আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে পড়েন। তবে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বৃহস্পতিবার বক্তব্য রাখলেও তাঁদের ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীরা বিরোধিতা করেননি।
রাজধানীজুড়ে আন্দোলন ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নিবন্ধ সমর্থন করায় দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও দেশদ্রোহী বললেন পরিবেশ মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, একজন আদর্শিক রাজনীতিক হিসেবে ফখরুল এই নিবন্ধ সমর্থন করতে পারেন না। আমরা আশা করেছিলাম তিনি জেল থেকে বের হয়ে নিবন্ধের বিপক্ষে বলবেন, অথচ করলেন উল্টোটা। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে তরুণ প্রজন্ম যে আন্দোলন শুরু করেছে আমরা তার প্রতি নৈতিক সমর্থন জানাচ্ছি।’ কাদের মোল্লাসহ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে বঙ্গবন্ধু মানবকল্যাণ পরিষদ ও ঘাতক-দালাল-যুদ্ধাপরাধী নির্মূল সংসদ এই মানববন্ধন আয়োজন করে। মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পৃথকভাবে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ শেষে শাহবাগে এসে মিলিত হয়।
খিচুড়িই ভরসা ॥ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে প্রতিবাদী সেøাগান-গণসঙ্গীত আর যুদ্ধাপরাধীর কুশপুতুলে জুতো নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে মুখরিত হয়ে ওঠে শাহবাগের সমাবেশস্থল। মঙ্গলবার বিকেল থেকে শুরু হওয়া এ জমায়েত বুধবারও রাত কাটিয়েছে শাহবাগ মোড়েই। বৃহস্পতিবার ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন নানা শ্রেণী-পেশার হাজারো মানুষ। আন্দোলনকারীদের খাবারের ভরসা বুধবার রাতের খিচুড়ি। রাতে লঙ্গরখানার মতো খিচুড়ি খাওয়ানো হয় আন্দোলনকারীদের। বৃহস্পতিবার সারাদিন ভাত জোটেনি। তবে শুকনো খাবার দিয়েছেন কেউ কেউ।
সকাল ৭টার দিকে প্রতিবাদী গান শুরু করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তীরন্দাজ’। ৮টার দিকে ঘোষণা মঞ্চ থেকে আহ্বান জানানো হয় চারদিকে গোল হয়ে অবস্থান নেয়ার জন্য। ১৫ মিনিটের মধ্যে মোড় ঘিরে চারদিকে গোল হয়ে অবস্থান নেন সমবেতরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদী মঞ্চ ঘিরে বাড়ে সংহতি জানাতে আসা মানুষের সংখ্যাও।
বিশেষ করে স্কুল-কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে আসতে থাকেন শাহবাগের দিকে। প্রায় সবার মাথা আর হাতে বাঁধা লাল-সবুজ পতাকা। আর মুখে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সেøাগান, কখনও বা দেশের গান, গুসঙ্গীত। সকাল ১০টার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ঢাক-ঢোলসহ মিছিল নিয়ে সংহতি জানাতে আসেন তরুণ-তরুণীরা। ঘোষণা মঞ্চ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভের খবর উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। ঘোষণা মঞ্চ থেকে জানানো হয়, যুক্তরাজ্যের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেছেন। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিক্ষোভ মঞ্চে রাজাকারদের কুশপুতুলে জুতো নিক্ষেপ চলে। এ ছাড়া সমাবেশস্থলে সারারাত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদসহ কয়েকটি সংগঠন। বুধবার রাতে দেখানো হয় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিএ হাঙর নদী গ্রেনেড। এদিকে শাহবাগ চত্বর প্রতিবাদকারীদের দখলে থাকায় কাঁটাবন, মৎস্যভবন ও রূপসী বাংলা মোড় থেকে শাহবাগ পর্যন্ত সড়কে ব্যারিকেড বসায় পুলিশ। ফলে যানবাহন চলছে বিকল্প পথে। ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের ডিসি সৈয়দ নূরুল ইসলাম বলেন, শাহবাগের সমাবেশে বাধা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। জাতীয় প্রেসক্লাবে সামনে অযৌক্তিক দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে মানুষ মিছিল-সমাবেশ করেছে। শাহবাগে জড়ো হওয়া মানুষের দাবি যৌক্তিক। দেশবাসীর প্রাণের কথা ধ্বনিত হচ্ছে এখানে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের ফাঁসি জনদাবিতে রূপ নিয়েছে। দেশের সকল মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণের বিষয় এই আন্দোলন। তবে আন্দোলনকারীরা পাশের সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে অবস্থান নিতে পারে। না নিলে যদি এখানেই অবস্থান করে তাহলেও পুলিশের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।
বিচারপতি মানিক হাসপাতালে ॥ কাদের মোল্লার রায় শোনার পর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আপীল বিভাগের সদস্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুল হুদা মানিক। তিনি ৩০৪ নম্বর কেবিনে অধ্যাপক ডা. মকসুবুল হকের তত্ত্বাবধানে আছেন। আরোগ্য কামনায় তিনি সকলের দোয়া প্রার্থী। তিনি জনকণ্ঠের কাছে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হত্যা মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-।
No comments