টুঙ্গিপাড়ার খোকা যেভাবে জাতির পিতা

 ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা সাহারা খাতুনের ৪ কন্যা ও ২ ছেলের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তৃতীয়।
বাবা-মা আদর করে তাঁকে ডাকতেন খোকা বলে। বঙ্গবন্ধুর পুরো ছেলেবেলাই কাটে টুঙ্গিপাড়ায়। ১৯২৭ সালে মাত্র ৭ বছর বয়সে গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরম্ন। ৯ বছর বয়সে তিনি গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তেন। প্রায় একই সময়ে আগের স্কুল থেকে বদলি হয়ে তিনি ভর্তি হন স্থানীয় মিশনারি স্কুলে।
১৯৩৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে। ২ মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং ৩ ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেলকে নিয়ে ছিল তাঁদের সুখের সংসার। ৩ ছেলেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাবা-মায়ের সঙ্গে নিহত হন।
১৯৩৯ সালে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হয়। যখন তিনি ছিলেন গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলের ছাত্র; সে সময় স্কুল পরিদর্শনে আসেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক আর হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়াদর্ী। এ সময় বঙ্গবন্ধু স্কুলের ফাটল ধরা ছাদ মেরামতের দাবি জোরের সঙ্গে তুলে ধরতে ছাত্রদের নেতৃত্ব দেন।
১৯৪০ সালে বঙ্গবন্ধু নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। তিনি সে সময় এক বছর মেয়াদে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪২ সালে তিনি এন্ট্রান্স পরীৰা পাস করেন। পরে তিনি ভর্তি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক মানবিক বিভাগে। থাকতেন বেকার হোস্টেলে। সে বছরই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৬ সালে তিনি ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বঙ্গবন্ধু বিএ পাস করেন। ভারত-পাকিস্তান নামে আলাদা দু'টি দেশের জন্মলগ্নে সৃষ্ট দেশব্যপী ছড়িয়ে পড়া দাঙ্গা ও আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু মুসলিমদের রৰায় সহিংসতা বন্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ৪ জানুয়ারি মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। 'উদর্ুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের এ বক্তব্য দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন বঙ্গবন্ধু। খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যে দেশব্যপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শেখ মুজিব তখন এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্রনেতাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এক সভায় অল পার্টি স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ বা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের প্রস্তাব তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। পরিষদ ১১ মার্চ বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ধর্মঘটের ডাক দেয়। সেদিনই বঙ্গবন্ধু সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভ করার অভিযোগে আরও কয়েকজনসহ গ্রেফতার হন। ছাত্ররা এ গ্রেফতারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। মূলত এখান থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন বাঙালী জাতিকে।
ছাত্র আন্দোলনের মুখে ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু জেল থেকে মুক্তি পান। এরপর বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে অযৌক্তিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে জরিমানা করে। বঙ্গবন্ধু এ অন্যায্য নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু ভাইস চ্যান্সেলরের বাসার সামনে অবস্থান ধর্মঘট করার জন্য গ্রেফতার হন। ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন হয়_ বঙ্গবন্ধু সে সময় যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন জেলে থাকা অবস্থাতেই। জুনের শেষে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। একই বছরের সেপ্টেম্বরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জেলে যান এবং পরে মুক্তি পান। অক্টোবরে আওয়ামী মুসলিম লীগের এক সভায় তিনি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। মন্ত্রী লিয়াকত আলীর আগমন ঠেকানোর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় গ্রেফতার হয়ে বঙ্গবন্ধু ২ বছর ৫ মাস কারাভোগ করেন।
১৯৫২ সালের ২০ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। জেলে থাকা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু এ ঘোষণার বিরুদ্ধে বিৰোভ গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। জেল থেকে তিনি পরিষদের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানাতে আহ্বান জানান। ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি কারাগারে অনশন শুরু করেন, চলে টানা ১৩ দিন। ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টির মধ্যে ২২৩টি আসনে জয়ী হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৪৩টি।
গোপালগঞ্জের আসন থেকে বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে মাত্র ১৩ ভোটে পরাজিত করেন। ১৫ মে প্রাদেশিক সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধু বন ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২৯ মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয়। ৩০ মে করাচী থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। ২৩ ডিসেম্বর মুক্ত হন। ১৯৫৫ সালের ৫ জুন এ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন। আদর্শগত দিক দিয়ে দলকে যুগোপযোগী ও ধর্মনিরপেৰ হিসেবে দাঁড় করাতে ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে বিশেষ সভায় মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু আবারও দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান মার্শাল ল জারির পর শেখ মুজিব আবারও গ্রেফতার হন। সে সময় তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। ১৪ মাস জেলে থাকার পর তিনি জেল থেকে ১৯৬২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে মুক্তি পান। তবে মুক্ত হয়ে জেলগেটে আসামাত্রই আবারও গ্রেফতার হন। দেশের জন্য আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা রাখার জন্য এভাবে যুবক বয়সের বেশিরভাগ সময়টাই বঙ্গবন্ধুকে জেলে কাটাতে হয়। ১৯৬৬ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু আবারও কারারম্নদ্ধ হন।
'৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতা তাঁকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি দেয়। '৭০-এর নির্বাচনে বাঙালী বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। ফলে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট লাভ করে। তবে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালীর এ নির্বাচনী বিজয়কে মেনে নেয়নি।
এরপর বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ দেন। সব আয়োজন শেষ। আর অপেক্ষা নয়। '৭১-এর মার্চে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরম্ন হয় নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' তাঁর এ ঐতিহাসিক ভাষণ সেদিন নিরস্ত্র বাঙালী জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করেছিল; ঐক্যবদ্ধ করেছিল বাঙালী জাতিকে। সেদিনই স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধু সংগ্রামের দিকনির্দেশনা দেন জাতিকে।
'৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী হিংস্র হায়নার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন থেকে ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শুরম্ন হয় তাঁর গোপন বিচার। নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বীর বাঙালী '৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে। জন্ম হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।
১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু। দেশে এসেই মনোনিবেশ করেন দেশকে পুনর্গঠন করার কাজে। কিন্তু সে সুযোগ তিনি বেশিদিন পাননি। ১৯৭৫ সালে তিনি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে জাতীয় কর্মসূচী ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার কিছুদিনের মধ্যে '৭৫-এর ১৫ আগস্ট নিজ বাসভবনে ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নিহত হন তিনি। পাকিস্তানী জল্লাদরা কবর খুঁড়েও জাতির জনকের গায়ে হাত দেয়ার সাহস পায়নি। কিন্তু স্বাধীন দেশে একাত্তরের পরাজিত ঘৃণ্য শত্রুরা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার মিছিল থামিয়ে দেয়। রক্তাক্ত হয় বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ড।

No comments

Powered by Blogger.