স্বীকৃতি পাননি নারী মুক্তিযোদ্ধারা
এপ্রিলের শেষ থেকে শুরু করে নবেম্বরের শেষ
পর্যন্ত চার দফায় ইন্ডিয়া গিয়েছি নৌকা নিয়ে অস্ত্র আনার জন্য। নদীতে
গানবোট নিয়ে পাকিস্তানী আর্মি টহল দিত।
এরই মধ্যে জীবনের
ঝুঁকি নিয়ে নৌকা করে ভারতে যেতাম অস্ত্র আনতে। লিস্ট থাকত আমার কাছে। একবার
ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। যেহেতু অস্ত্রের লিস্ট আমার কাছে ছিল, মাথায়
শুধু এটাই ছিল যে কোনমতেই ওদের কাছে লিস্ট যাওয়া চলবে না। নৌকা থেকে নেমে
গ্রামের ভেতর দৌড়েছি। কতক্ষণ দৌড়েছিলাম মনে নেই। যখন মনে হলো ওরা
(পাকিস্তানী আর্মি) আর নাগাল পাবে না তখন মনে পড়ল নৌকার পাশে ফেলে রেখে
এসেছি আমার স্বামীকে (সহযোদ্ধা), ওদের ঠেকানোর জন্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও
সত্যি, যুদ্ধের পরে যখন অস্ত্র জমা দেয়ার সময় এলো তখন আমার মুক্তিযোদ্ধা
স্বামী যিনি আমার সহযোদ্ধা ছিলেন তিনি আমাকে বললেন, ‘তোমার অস্ত্র জমা দিতে
যাওয়ার দরকার নেই, তোমার অস্ত্র আমি জমা দিয়ে দিচ্ছি।’ কারণ তিনি ও তাঁর
পরিবার চায়নি, আমার যুদ্ধে যাওয়ার কথা জানাজানি হয়ে যাক। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে
যুদ্ধ করেছি, স্বামীর এমন কথা মেনে নিতে পারিনি; তার কথা অগ্রাহ্য করেই
আমার অস্ত্র আমি জমা দিয়েছি। আর তাই নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার নাম
মুক্তিযোদ্ধা লিস্টে উঠেছে। আমার এই পরিচিতি পাওয়ার জন্য আমাকে যুদ্ধ করতে
হয়েছে আমার পরিবারের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে। কিন্তু এমন অসংখ্য নারী
মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন যাঁরা আজও আড়ালে রয়ে গেছেন। এভাবেই মুক্তিযোদ্ধা নারীর
প্রতি পরিবার, সহযোদ্ধা, বন্ধুর মনোভাবের বর্ণনা দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা
আমিনা বেগম।
২. সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে পায়ে গুলি খেয়ে পড়ে যাই। যখন বুঝতে পেরেছি ধরা পড়ে যাব, শেষ গ্রেনেডটা ছুড়ে মারি পাকিস্তানীদের দিকে। দুই পাকিস্তানী আর্মি মারা যায় সেই মুহূর্তে। কিন্তু নারী বলে ওরা আমাকে মেরে ফেলেনি। নিয়ে যায় ক্যাম্পে। চার মাস অমানুষিক নির্যাতন করে ক্যাম্পে রেখে। হঠাৎ একদিন শুনলাম দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু যখন বাড়ি ফিরি আমার পরিবার আমাকে গ্রহণ করেনি। সমাজ থেকে শুনতে হয়েছে নানা ধরনের কটাক্ষ। তখন থেকে সংগ্রাম করে যাচ্ছি, আজও সংগ্রাম করছি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও শুধু নারী হওয়ার কারণে পাইনি মুক্তিযোদ্ধার সম্মান বরং পদে পদে হয়েছি বঞ্চিত, লাঞ্ছিত। এভাবেই সমাজ কিভাবে নারী মুক্তিযোদ্ধাকে বঞ্চিত করেছে তার বর্ণনা করেন মুক্তিযোদ্ধা হালিমা বেগম।
এ তো মাত্র দু’জন নারী মুক্তিযোদ্ধার কথা; এ রকম আরো নারী মুক্তিযোদ্ধা ৪০ বছর ধরে বঞ্চিত হয়ে আসছেন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে। যে কোন দেশের জন্য এটা খুবই দুঃখজনক যে, সেই দেশের স্বাধীনতা অর্জনকারী মুক্তিযোদ্ধারা বছরের পর বছর বঞ্চিত হয়ে আসছেন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ছিল লাখো নারীর নানামুখী অংশগ্রহণ। যে নারী অন্ধকারে ভাত রেঁধে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছে কিংবা যে নারী ওষুধ সরবরাহ করে, নার্সিং করে তাদের সুস্থ করেছে, যে নারী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তথ্য সরবরাহ করেছে, অস্ত্র সরবরাহ করেছে; এদের কারও অবদানই কি সম্মুখযুদ্ধের তুলনায় কম? তাদের এই অংশগ্রহণ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা বা সম্মুখযুদ্ধ কিভাবে সম্ভব হতো? কিন্তু সেই নারীর অংশগ্রহণের কোন স্বীকৃতিই কি আমরা আমাদের ইতিহাসে দেখতে পাই? একটি জাতির স্বাধীনতাযুদ্ধের আংশিক বা বিকৃত ইতিহাস দিয়ে কোন জাতির সমৃদ্ধি আদৌ সম্ভব কি?
এবার একটু পাঠ্যবইয়ের দিকে ফেরা যাক। আমাদের ন্যাশনাল কারিকুলাম বইয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত রয়েছে পর্যায়ক্রমে ৭ বীরশ্রেষ্ঠের ইতিহাস। আবার পঞ্চম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নামে একটি অধ্যায় রয়েছে। ক্লাস ফোরের বাংলা বইয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নামে রয়েছে একটি ছোটগল্প। কিন্তু এখানে কোথাও মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ তো নেই-ই বরং যে ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে সেটাতেও রয়েছে রাজনীতিকরণ।
প্রতি ৫ বছর পর পর পরিবর্তন হয় আমাদের পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে পাঁচ বছর পর পর শুরু হয় দুই বড় দলের কাড়াকাড়ি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ থেকে শুরু করে স্বাধীনতার ঘোষক এবং যুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা আলোচনা হয় প্রায় দুই পৃষ্ঠাজুড়ে। বাকি এক-দেড় পৃষ্ঠায় অন্যান্য ইতিহাস। আবার বিএনপি ক্ষমতায় এলে পাঠ্যপুস্তকে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের বক্তব্য ছাড়া অন্য সকল অংশ বাদ হয়ে যায় এবং একই সঙ্গে স্বাধীনতার ঘোষক হয়ে যান মেজর জিয়াউর রহমান, সে সময় যিনি একজন উর্ধতন সৈনিক ছিলেন মাত্র।
সুতরাং একই শিশু দুই সরকারের আমলে দুই ধরনের ইতিহাস পড়ছে। ফলে তারা বিভ্রান্ত হচ্ছে। অন্যদিকে পাঠ্যবইয়ে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা এবং যুদ্ধে নারীর অবদানের কথা উল্লিখিত নেই বলে ছোটবেলা থেকেই তার ধারণা তৈরি হচ্ছে নারী দুর্বল, মুক্তিযুদ্ধে তাদের কোন অংশগ্রহণ নেই, শুধু নির্যাতিত হওয়া ছাড়া; সেটাও বর্ণিত হয়েছে খুবই অসম্মানজনকভাবে।
ইতিহাস বিভাগের অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে পুরো একটি সাবজেক্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থাকলেও সেখানে কোথাও মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ এবং অবদানের কথা উল্লেখ নেই। যেসব রেফারেন্স বই দেয়া হয়েছে তাতেও নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নয়। সুতরাং আমাদের শিক্ষাজীবনে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান সম্পর্কে জানার কোন ব্যবস্থাই নেই। কেবল যদি কোন শিক্ষার্থী বা কোন ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে জানতে চায় তাহলে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কিছু লেখকের লেখা বই থেকে জানতে পারে। সেসব বইও সহজলভ্য নয়।
একজন নারী মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে এই লেখা শেষ করতে চাই। মুক্তিযোদ্ধা রাবেয়া। তাঁর বাড়ির সামনেই ছিল ব্রিজ। কাজ করতেন পাকিস্তানী আর্মি ক্যাম্পে। ক্যাম্পের বিভিন্ন তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাচার করতেন। বাড়ির সামনের ব্রিজটি নিজের হাতে বোমা পেতে ভেঙ্গে ফেলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক হিসেবে তাঁকে তখন দেখে ফেলে রাজাকাররা। এরপর তাঁর বাড়িতে আসে পাকিস্তানী আর্মি। দৌড়ে পালাতে গিয়ে পায়ে গুলি খান। তারপর স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানী ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন। আজও তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটেন। ভারতের ক্যাম্পে গিয়ে নাম লেখাননি বলে মুক্তিযোদ্ধার খাতায় তাঁর নাম নেই, নাম হয়েছে বীরাঙ্গনা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পাতা কুড়ান। তা হাটে বিক্রি করে দিনযাপন করেন। আর মাঝে মধ্যেই লোকমুখে শুনতে পান ‘পাকিস্তানীর বউ’ সম্বোধন। এই তাঁর স্বীকৃতি।
স্বাধীনতার ৪১ বছর পেরিয়ে গেল, আজও অধিকাংশ নারী মুক্তিযোদ্ধার অবস্থা রাবেয়ার মতো। কেউবা দিন গুনছেন শেষ যাত্রার। কেউ কেউ চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। বর্তমান সরকার নির্বাচিত হওয়ার পর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়। পূর্বে যাঁরা সরাসরি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছেন তাঁদেরই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির কথা উল্লিখিত। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর ‘যেসব নারী সরাসরি, স্পাইং, নার্সিং’ করেছেন তাঁদের নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কথা ঘোষণা দেন। তাঁদের নাম লিপিবদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন পত্রিকায় এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে ঘোষণা দেয়, যেসব নারী যুদ্ধের সময় সরাসরি বা নার্সিং বা স্পাইং বা রান্না করে যুদ্ধে সাহায্য করেছেন তাঁদের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদে যোগাযোগ করতে হবে এবং তাঁরা যে যুদ্ধ করেছেন তার সাক্ষীসহ সেটা তাঁকে প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু গরিব মুক্তিযোদ্ধার বাসায় টেলিভিশন নেই বা তাঁরা পত্রিকা পড়েন না; তাঁদের কাছে এই ঘোষণা পৌঁছানোর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তাহলে তিনি কিভাবে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দরখাস্ত করবেন। আবার যিনি এক স্থানে যুদ্ধ করেছেন, পরবর্তী সময়ে অন্য স্থানে চলে এসেছেন বা তাঁর সহযোদ্ধারা মারা গেছেন বা তিনি জানেন না তাঁর সহযোদ্ধারা কোথায় তিনি কিভাবে প্রমাণ করবেন যে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা? তাই শুধু উদ্যোগ গ্রহণ করলেই চলবে না, তার বাস্তবায়নের দিকটি নিয়েও ভাবতে হবে সরকারকে।
মোশফেক আরা
২. সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে পায়ে গুলি খেয়ে পড়ে যাই। যখন বুঝতে পেরেছি ধরা পড়ে যাব, শেষ গ্রেনেডটা ছুড়ে মারি পাকিস্তানীদের দিকে। দুই পাকিস্তানী আর্মি মারা যায় সেই মুহূর্তে। কিন্তু নারী বলে ওরা আমাকে মেরে ফেলেনি। নিয়ে যায় ক্যাম্পে। চার মাস অমানুষিক নির্যাতন করে ক্যাম্পে রেখে। হঠাৎ একদিন শুনলাম দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু যখন বাড়ি ফিরি আমার পরিবার আমাকে গ্রহণ করেনি। সমাজ থেকে শুনতে হয়েছে নানা ধরনের কটাক্ষ। তখন থেকে সংগ্রাম করে যাচ্ছি, আজও সংগ্রাম করছি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও শুধু নারী হওয়ার কারণে পাইনি মুক্তিযোদ্ধার সম্মান বরং পদে পদে হয়েছি বঞ্চিত, লাঞ্ছিত। এভাবেই সমাজ কিভাবে নারী মুক্তিযোদ্ধাকে বঞ্চিত করেছে তার বর্ণনা করেন মুক্তিযোদ্ধা হালিমা বেগম।
এ তো মাত্র দু’জন নারী মুক্তিযোদ্ধার কথা; এ রকম আরো নারী মুক্তিযোদ্ধা ৪০ বছর ধরে বঞ্চিত হয়ে আসছেন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে। যে কোন দেশের জন্য এটা খুবই দুঃখজনক যে, সেই দেশের স্বাধীনতা অর্জনকারী মুক্তিযোদ্ধারা বছরের পর বছর বঞ্চিত হয়ে আসছেন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ছিল লাখো নারীর নানামুখী অংশগ্রহণ। যে নারী অন্ধকারে ভাত রেঁধে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছে কিংবা যে নারী ওষুধ সরবরাহ করে, নার্সিং করে তাদের সুস্থ করেছে, যে নারী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তথ্য সরবরাহ করেছে, অস্ত্র সরবরাহ করেছে; এদের কারও অবদানই কি সম্মুখযুদ্ধের তুলনায় কম? তাদের এই অংশগ্রহণ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা বা সম্মুখযুদ্ধ কিভাবে সম্ভব হতো? কিন্তু সেই নারীর অংশগ্রহণের কোন স্বীকৃতিই কি আমরা আমাদের ইতিহাসে দেখতে পাই? একটি জাতির স্বাধীনতাযুদ্ধের আংশিক বা বিকৃত ইতিহাস দিয়ে কোন জাতির সমৃদ্ধি আদৌ সম্ভব কি?
এবার একটু পাঠ্যবইয়ের দিকে ফেরা যাক। আমাদের ন্যাশনাল কারিকুলাম বইয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত রয়েছে পর্যায়ক্রমে ৭ বীরশ্রেষ্ঠের ইতিহাস। আবার পঞ্চম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নামে একটি অধ্যায় রয়েছে। ক্লাস ফোরের বাংলা বইয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নামে রয়েছে একটি ছোটগল্প। কিন্তু এখানে কোথাও মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ তো নেই-ই বরং যে ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে সেটাতেও রয়েছে রাজনীতিকরণ।
প্রতি ৫ বছর পর পর পরিবর্তন হয় আমাদের পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে পাঁচ বছর পর পর শুরু হয় দুই বড় দলের কাড়াকাড়ি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ থেকে শুরু করে স্বাধীনতার ঘোষক এবং যুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা আলোচনা হয় প্রায় দুই পৃষ্ঠাজুড়ে। বাকি এক-দেড় পৃষ্ঠায় অন্যান্য ইতিহাস। আবার বিএনপি ক্ষমতায় এলে পাঠ্যপুস্তকে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের বক্তব্য ছাড়া অন্য সকল অংশ বাদ হয়ে যায় এবং একই সঙ্গে স্বাধীনতার ঘোষক হয়ে যান মেজর জিয়াউর রহমান, সে সময় যিনি একজন উর্ধতন সৈনিক ছিলেন মাত্র।
সুতরাং একই শিশু দুই সরকারের আমলে দুই ধরনের ইতিহাস পড়ছে। ফলে তারা বিভ্রান্ত হচ্ছে। অন্যদিকে পাঠ্যবইয়ে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা এবং যুদ্ধে নারীর অবদানের কথা উল্লিখিত নেই বলে ছোটবেলা থেকেই তার ধারণা তৈরি হচ্ছে নারী দুর্বল, মুক্তিযুদ্ধে তাদের কোন অংশগ্রহণ নেই, শুধু নির্যাতিত হওয়া ছাড়া; সেটাও বর্ণিত হয়েছে খুবই অসম্মানজনকভাবে।
ইতিহাস বিভাগের অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে পুরো একটি সাবজেক্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থাকলেও সেখানে কোথাও মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ এবং অবদানের কথা উল্লেখ নেই। যেসব রেফারেন্স বই দেয়া হয়েছে তাতেও নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নয়। সুতরাং আমাদের শিক্ষাজীবনে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান সম্পর্কে জানার কোন ব্যবস্থাই নেই। কেবল যদি কোন শিক্ষার্থী বা কোন ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে জানতে চায় তাহলে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কিছু লেখকের লেখা বই থেকে জানতে পারে। সেসব বইও সহজলভ্য নয়।
একজন নারী মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে এই লেখা শেষ করতে চাই। মুক্তিযোদ্ধা রাবেয়া। তাঁর বাড়ির সামনেই ছিল ব্রিজ। কাজ করতেন পাকিস্তানী আর্মি ক্যাম্পে। ক্যাম্পের বিভিন্ন তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাচার করতেন। বাড়ির সামনের ব্রিজটি নিজের হাতে বোমা পেতে ভেঙ্গে ফেলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক হিসেবে তাঁকে তখন দেখে ফেলে রাজাকাররা। এরপর তাঁর বাড়িতে আসে পাকিস্তানী আর্মি। দৌড়ে পালাতে গিয়ে পায়ে গুলি খান। তারপর স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানী ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন। আজও তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটেন। ভারতের ক্যাম্পে গিয়ে নাম লেখাননি বলে মুক্তিযোদ্ধার খাতায় তাঁর নাম নেই, নাম হয়েছে বীরাঙ্গনা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পাতা কুড়ান। তা হাটে বিক্রি করে দিনযাপন করেন। আর মাঝে মধ্যেই লোকমুখে শুনতে পান ‘পাকিস্তানীর বউ’ সম্বোধন। এই তাঁর স্বীকৃতি।
স্বাধীনতার ৪১ বছর পেরিয়ে গেল, আজও অধিকাংশ নারী মুক্তিযোদ্ধার অবস্থা রাবেয়ার মতো। কেউবা দিন গুনছেন শেষ যাত্রার। কেউ কেউ চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। বর্তমান সরকার নির্বাচিত হওয়ার পর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়। পূর্বে যাঁরা সরাসরি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছেন তাঁদেরই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির কথা উল্লিখিত। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর ‘যেসব নারী সরাসরি, স্পাইং, নার্সিং’ করেছেন তাঁদের নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কথা ঘোষণা দেন। তাঁদের নাম লিপিবদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন পত্রিকায় এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে ঘোষণা দেয়, যেসব নারী যুদ্ধের সময় সরাসরি বা নার্সিং বা স্পাইং বা রান্না করে যুদ্ধে সাহায্য করেছেন তাঁদের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদে যোগাযোগ করতে হবে এবং তাঁরা যে যুদ্ধ করেছেন তার সাক্ষীসহ সেটা তাঁকে প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু গরিব মুক্তিযোদ্ধার বাসায় টেলিভিশন নেই বা তাঁরা পত্রিকা পড়েন না; তাঁদের কাছে এই ঘোষণা পৌঁছানোর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তাহলে তিনি কিভাবে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দরখাস্ত করবেন। আবার যিনি এক স্থানে যুদ্ধ করেছেন, পরবর্তী সময়ে অন্য স্থানে চলে এসেছেন বা তাঁর সহযোদ্ধারা মারা গেছেন বা তিনি জানেন না তাঁর সহযোদ্ধারা কোথায় তিনি কিভাবে প্রমাণ করবেন যে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা? তাই শুধু উদ্যোগ গ্রহণ করলেই চলবে না, তার বাস্তবায়নের দিকটি নিয়েও ভাবতে হবে সরকারকে।
মোশফেক আরা
No comments