পড়ন্ত বিকেলের মেয়ে
হেমন্তের হালকা রোদের পড়ন্ত বিকেল। পড়ন্ত
বেলার এই সময়টা পারমিতার অবসর সময়। পারমিতা ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
বারান্দার সামনের সবুজ মাঠের চত্বরে বাচ্চাদের ছোটাছুটি তার শৈশবের কথা মনে
করিয়ে দেয়।
মনে হয় শৈশবটাই ভাল ছিল, কোন জটিলতা ছিল না।
বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, সংসারটা যদি ধরে রাখতে পারত তাহলে হয়ত ওর
সন্তানও মাঠে খেলে বেড়াত। চোখ জলে ভরে ওঠে। মাগরিবের আজানে পারমিতা ঘরে
ফিরে যায়। নামাজ শেষে ব্যাগ গুছিয়ে নেয়, কারণ রাতের ট্রেন ধরতে হবে নতুন
কর্মস্থলে যোগদানের জন্য।
পারমিতার বাবা স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেন। ট্রেনে উঠে জানালার পাশে বসে পারমিতা। এই প্রথম লং জার্নিতে সম্পূর্ণ একা যাচ্ছে। কারণ পারমিতার মনে হয়েছে তার একা চলার শক্তি অর্জন করতে হবে। ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দে পারমিতর ঘুম এলো না, বরং চোখের সামনে তার জীবনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ছবির মতো মনে পড়ে যাচ্ছিল। পারমিতা তখন সবেমাত্র অনার্স ফাইনাল দিয়েছে। বরাবর ভাল ছাত্রী পারমিতা তাই খুব ভাল রেজাল্ট নিয়ে পাসও করে ফেলে। কিন্তু কিছুটা ঝোঁকের মাথায় এবং প্রেমিক রায়হানের চাপের মুখে মাত্র ছয় মাসের সম্পর্কের পর লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলে। এতে স্কুল শিক্ষক বাবা খুবই দুঃখ পান। তিন বোনের মধ্যে পারমিতা বড়। আর বড় বোনের অদূরদর্শী কাজে ছোট বোনদের কি হয় এ সমাজে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু বিয়ের ঠিক একমাসের মাথায় পারমিতা সে যে কি ভুল করেছে তা বুঝতে পারে। কারণ হঠাৎ একদিন পারমিতার বাসায় এসে হাজির হয় রায়হানের প্রথম স্ত্রী ও ৩-৪ বছর বয়সী ছেলে। পারমিতা কিংকর্তব্য বিমূঢ় আর রায়হান হতবাক। এত শীঘ্র যে তার প্রতারণা ধরা পড়ে যাবে তা বুঝতে পারেনি রায়হান। তারপর অনেক ঝগড়া, অনেক নাটকীয়তার পর পারমিতা বাবার কাছে ফিরে যায়। কিন্তু বাবা রায়হানকে ডিভোর্স দেয়ার শর্তে নিজের মেয়েকে কাছে টেনে নেন। অবশেষে এক সময় ওদের ডিভোর্সও হয়ে যায়।
পারমিতার আজ পরিচয় ডিভোর্সি মেয়ে বলে। বাবা মায়ের সংসারে নতুন করে জীবন শুরু হয় তার। এমএ পরীক্ষা দেয়। কিন্তু পারমিতা বুঝতে পারে আশপাশের প্রতিবেশীরা তাকে অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছে। সহজ, সরল ব্যবহার আর নেই। তার সমবয়সী মেয়েদের সাথে মেলামেশা করা বন্ধ হয়ে গেছে। আর এটা তাদের অভিভাবকদের কারণেই হয়েছে। কারণ তারা চান না পারমিতার সঙ্গে মিশে তাদের সন্তানও একই ভুল করুক। আত্মীয়রা আগের মতো আন্তরিকতা দেখায় না। এমন কি গর্ভধারিণী মাও অনেক সময় খোঁচা মেরে কথা বলেন। পারমিতার মনে হয় সে যেন জেলখানায় বন্দী। যেন সে খুনী। পারমিতা অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে। সে নিজেকে আস্তে আস্তে গুটিয়ে আনে। এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে বাবা পাশে এসে দাঁড়ান। বলেন, পড়ালেখা শিখে বসে না থেকে নিজের পায়ে দাঁড়াও। পারমিতা বিসিএসের জন্য তৈরি হয়। ফাঁকে ফাঁকে নানা জায়গায় চাকরির দরখাস্তও করে। ভাল রেজাল্ট বলে খুব শীঘ্রই চাকরিও হয়ে যায়।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, রায়হান কি করে খোঁজ পেয়ে পারমিতার অফিসেও হানা দেয়। ক্ষমা চেয়ে তাকে ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব করে। আর সে যে পারমিতার স্বামী তা বলে বেড়াতে থাকে। আর এও জানাজানি হয়ে যায়Ñপারমিতা ডিভোর্সি। তখন দেখা যায়, যে কলিগ পারমিতাকে আপনি বলে সম্বোধন করত সেও তুমি বলতে শুরু করেছে। বাইরে গিয়ে কফি খাওয়ার অফার দিচ্ছে কিংবা সন্ধ্যার পর পারমিতার বাসায় যাওয়ার এবং পারমিতাকে তাকে সময় দেয়ার অনুরোধ পর্যন্ত করছে। এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পারমিতা চাকরিটি ছেড়ে দেয়।
পারমিতা ভাবে সে না হয় ওই চাকরি ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেছে, কিন্তু এদেশে হাজারো নারী রয়েছে তারই মতো ডিভোর্সি। যাদের শিক্ষাদীক্ষা নেই কিংবা স্বল্প শিক্ষিত, তাদের কি অবস্থা? দেখা যায় উপযুক্ত কারণ ছাড়াই স্ত্রীকে পুরাতন আসবাবপত্র ভেবে ডিভোর্স দিয়ে নতুন সংসার শুরু করেছে। তখন সেই নারীটি এত বছরের সংসার ছেড়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? বাবা বেঁচে থাকলে হয় বাবা না হয় ভাই। তারা কি সেখানে সসম্মানে মাথা উঁচু করে থাকতে পারে? পারমিতা ভাবে প্রতিটি নারীকেই তার সম্মান রক্ষার্থে স্বাবলম্বী হতে হবে।
ডিভোর্সি বলে নারীকে বাঁকা চোখে দেখা, অসম্মান করা এ সমাজে ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সমাজের মানুষ ভাবে না যে, ডিভোর্স হলে একজন নারী যেমন ডিভোর্সি তেমনি একজন পুরুষও ডিভোর্সি। কিন্তু নারীকে এর খেসারত দিতে হচ্ছে অথচ কোন পুরুষের জন্য তা কিছুই নয়। এর কারণে পারমিতাকে যে বঞ্চনা সহ্য করতে হচ্ছে তা রায়হানের গায়ে আঁচড় পর্যন্ত কাটতে পারছে না। সে দিব্যি সুখে সংসার করছে। সুতরাং এ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হলে আসল শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা অর্জন করে নিতে হবে।
এতসব ভাবতে ভাবতে এক সময় ট্রেনের হুউসেলে পারমিতার ধ্যান ভাঙ্গে। নির্দিষ্ট স্টেশনে ট্রেন এসে পৌঁছেছে। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখে ঝকঝকে রোদ চারদিকে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। অবশেষে পারমিতা নামের পড়ন্ত বেলার মেয়েটি তার কালো তকমাটি (ডিভোর্সি) ছুড়ে ফেলে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় এক উজ্জ্বল জীবনের সন্ধানে।
ফেরদৌসী খানম লাকী
পারমিতার বাবা স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেন। ট্রেনে উঠে জানালার পাশে বসে পারমিতা। এই প্রথম লং জার্নিতে সম্পূর্ণ একা যাচ্ছে। কারণ পারমিতার মনে হয়েছে তার একা চলার শক্তি অর্জন করতে হবে। ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দে পারমিতর ঘুম এলো না, বরং চোখের সামনে তার জীবনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ছবির মতো মনে পড়ে যাচ্ছিল। পারমিতা তখন সবেমাত্র অনার্স ফাইনাল দিয়েছে। বরাবর ভাল ছাত্রী পারমিতা তাই খুব ভাল রেজাল্ট নিয়ে পাসও করে ফেলে। কিন্তু কিছুটা ঝোঁকের মাথায় এবং প্রেমিক রায়হানের চাপের মুখে মাত্র ছয় মাসের সম্পর্কের পর লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলে। এতে স্কুল শিক্ষক বাবা খুবই দুঃখ পান। তিন বোনের মধ্যে পারমিতা বড়। আর বড় বোনের অদূরদর্শী কাজে ছোট বোনদের কি হয় এ সমাজে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু বিয়ের ঠিক একমাসের মাথায় পারমিতা সে যে কি ভুল করেছে তা বুঝতে পারে। কারণ হঠাৎ একদিন পারমিতার বাসায় এসে হাজির হয় রায়হানের প্রথম স্ত্রী ও ৩-৪ বছর বয়সী ছেলে। পারমিতা কিংকর্তব্য বিমূঢ় আর রায়হান হতবাক। এত শীঘ্র যে তার প্রতারণা ধরা পড়ে যাবে তা বুঝতে পারেনি রায়হান। তারপর অনেক ঝগড়া, অনেক নাটকীয়তার পর পারমিতা বাবার কাছে ফিরে যায়। কিন্তু বাবা রায়হানকে ডিভোর্স দেয়ার শর্তে নিজের মেয়েকে কাছে টেনে নেন। অবশেষে এক সময় ওদের ডিভোর্সও হয়ে যায়।
পারমিতার আজ পরিচয় ডিভোর্সি মেয়ে বলে। বাবা মায়ের সংসারে নতুন করে জীবন শুরু হয় তার। এমএ পরীক্ষা দেয়। কিন্তু পারমিতা বুঝতে পারে আশপাশের প্রতিবেশীরা তাকে অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছে। সহজ, সরল ব্যবহার আর নেই। তার সমবয়সী মেয়েদের সাথে মেলামেশা করা বন্ধ হয়ে গেছে। আর এটা তাদের অভিভাবকদের কারণেই হয়েছে। কারণ তারা চান না পারমিতার সঙ্গে মিশে তাদের সন্তানও একই ভুল করুক। আত্মীয়রা আগের মতো আন্তরিকতা দেখায় না। এমন কি গর্ভধারিণী মাও অনেক সময় খোঁচা মেরে কথা বলেন। পারমিতার মনে হয় সে যেন জেলখানায় বন্দী। যেন সে খুনী। পারমিতা অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে। সে নিজেকে আস্তে আস্তে গুটিয়ে আনে। এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে বাবা পাশে এসে দাঁড়ান। বলেন, পড়ালেখা শিখে বসে না থেকে নিজের পায়ে দাঁড়াও। পারমিতা বিসিএসের জন্য তৈরি হয়। ফাঁকে ফাঁকে নানা জায়গায় চাকরির দরখাস্তও করে। ভাল রেজাল্ট বলে খুব শীঘ্রই চাকরিও হয়ে যায়।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, রায়হান কি করে খোঁজ পেয়ে পারমিতার অফিসেও হানা দেয়। ক্ষমা চেয়ে তাকে ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব করে। আর সে যে পারমিতার স্বামী তা বলে বেড়াতে থাকে। আর এও জানাজানি হয়ে যায়Ñপারমিতা ডিভোর্সি। তখন দেখা যায়, যে কলিগ পারমিতাকে আপনি বলে সম্বোধন করত সেও তুমি বলতে শুরু করেছে। বাইরে গিয়ে কফি খাওয়ার অফার দিচ্ছে কিংবা সন্ধ্যার পর পারমিতার বাসায় যাওয়ার এবং পারমিতাকে তাকে সময় দেয়ার অনুরোধ পর্যন্ত করছে। এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পারমিতা চাকরিটি ছেড়ে দেয়।
পারমিতা ভাবে সে না হয় ওই চাকরি ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেছে, কিন্তু এদেশে হাজারো নারী রয়েছে তারই মতো ডিভোর্সি। যাদের শিক্ষাদীক্ষা নেই কিংবা স্বল্প শিক্ষিত, তাদের কি অবস্থা? দেখা যায় উপযুক্ত কারণ ছাড়াই স্ত্রীকে পুরাতন আসবাবপত্র ভেবে ডিভোর্স দিয়ে নতুন সংসার শুরু করেছে। তখন সেই নারীটি এত বছরের সংসার ছেড়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? বাবা বেঁচে থাকলে হয় বাবা না হয় ভাই। তারা কি সেখানে সসম্মানে মাথা উঁচু করে থাকতে পারে? পারমিতা ভাবে প্রতিটি নারীকেই তার সম্মান রক্ষার্থে স্বাবলম্বী হতে হবে।
ডিভোর্সি বলে নারীকে বাঁকা চোখে দেখা, অসম্মান করা এ সমাজে ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সমাজের মানুষ ভাবে না যে, ডিভোর্স হলে একজন নারী যেমন ডিভোর্সি তেমনি একজন পুরুষও ডিভোর্সি। কিন্তু নারীকে এর খেসারত দিতে হচ্ছে অথচ কোন পুরুষের জন্য তা কিছুই নয়। এর কারণে পারমিতাকে যে বঞ্চনা সহ্য করতে হচ্ছে তা রায়হানের গায়ে আঁচড় পর্যন্ত কাটতে পারছে না। সে দিব্যি সুখে সংসার করছে। সুতরাং এ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হলে আসল শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা অর্জন করে নিতে হবে।
এতসব ভাবতে ভাবতে এক সময় ট্রেনের হুউসেলে পারমিতার ধ্যান ভাঙ্গে। নির্দিষ্ট স্টেশনে ট্রেন এসে পৌঁছেছে। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখে ঝকঝকে রোদ চারদিকে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। অবশেষে পারমিতা নামের পড়ন্ত বেলার মেয়েটি তার কালো তকমাটি (ডিভোর্সি) ছুড়ে ফেলে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় এক উজ্জ্বল জীবনের সন্ধানে।
ফেরদৌসী খানম লাকী
No comments