খবর- চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী by আনোয়ারা স্নিগ্ধা

রাজধানীতে সরকারের জায়গা অবৈভাবে দখল করে যে কয়টি বড় বস্তি গড়ে উঠেছে, এরই একটি মহাখালীর কড়াইল বস্তি। বছরের পর বছর ধরে পরিত্যক্ত থাকা সরকারের ১০০ একর জমির পুরোটাই এখন বস্তি। স্থানীয় সূত্র মতে, এ বস্তিতে ২০ হাজারের মতো পরিবার আছে। লোকসংখ্যা দেড় লাখ। বস্তিবাসীর অধিকাংশই দরিদ্র। পুরুষদের প্রায় সবাই দিনমুজুর, হকার, ফেরিওয়ালা বা রিকশা-ভ্যানচালক। মেয়েরা বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ বা রাস্তায় ইট ভাঙার কাজ করেন, নয়তো বড়জোর গার্মেন্ট-কর্র্মী।
তবে ভালো নেই বস্তির বাসিন্দারা। তাঁরা স্থানীয় একটি সন্ত্রাসী চক্রের কাছে জিম্মি। দিনের পর দিন অপরাধ করে চলেছে এই সন্ত্রাসী চক্র। থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ কেউ বাধা দিলে তার অবস্থা বেহাল করে ছাড়ে সন্ত্রাসীরা। মারধর করে বের করে দেওয়া হয় বস্তি থেকে, অথবা মিত্যা মামলায় আটকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পুলিশ ঘরে। মানবাধিকার দিবস নিয়ে কথা হচ্ছিল এই বস্তির বাসিন্দা লাবণী, জুলেখা, মনোয়ারা, শহর আলী, আজমতসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁদের সবারই এক কথা, 'মানবাধিকার হচ্ছে মানুষের অধিকারের ব্যাপার-স্যাপার। বস্তির গরিবরা মানুষ নাকি? তারা তো শিয়াল-কুত্তার বাচ্চা। বড়লোক আর ক্ষমতাশালীদের দয়ায় উচ্ছিষ্ট খেয়ে চলতে হয়। এসব আলাপ বাদ দেন। আমরা রক্তচোষা মশার অত্যাচার থেকে বাঁচব কিভাবে সেই কথা বলেন।' বললাম, ঢাকা সিটি করপোরেশন কি মশা মারার ওষুধ দেয় না? আমার এই প্রশ্ন শুনে হেসে উঠলেন সবাই। জুলেখা বললেন, 'আফা, এইডা হেই মশা না। হুল ফুটায় না, গুলি করে, কথায় কথায় চাক্কু মারে। এইডা ব্যাডা মানুষ। সন্ত্রাসীদের রাজা। গডফাদার। এইডারে মারতে হইলে ওষুধ না, র‌্যাব বা পুলিশ লাগব।'
বস্তির একটু ভেতরে ঢুকতেই পরিচয় হলো পারুল বেগম নামে একজনের সঙ্গে। তাঁরও একই কথা। পারুল বেগমের মতে, শিশু বয়সে বাবার হাত ধরে এসেছিলেন। এখন মা ও নানি হয়েছেন। কিন্তু বস্তির সেই যে বেহাল অবস্থা, তার আর কোনো উন্নতি হয়নি। মাদক আর নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড গ্রাস করে ফেলেছে বস্তিবাসীর শান্তি।
তৃষা নামে এক তরুণী আর আজিমন নামে এক গৃহবধূ বললেন, তাঁদের যে জীবন তাকে মানুষের জীবন বলা চলে না। সন্ত্রাস আর অপরাধের কাছে তাঁরা জিম্মি। রাতের আঁধার নামার সঙ্গে সঙ্গেই বস্তি যেন হয়ে ওঠে একটা জ্বলন্ত অপরাধরাজ্য। ভয়ে তাদের কিছুই বলার থাকে না। এখানে মানবাধিকার বলে কিছু নেই।
বস্তিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি মাদক সেবনের ঘর। এ রকমই একটি ঘর চালায় এক দম্পতি। স্ত্রী জ্যোৎস্নাকে নিয়ে স্বামী জয়ের মিনি বার। জয় হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, আরো একটু ভেতরে গেলে নাম বলতে অনিচ্ছুক এমন একজন বললেন, এই মদের বারটি আগে চালাত যুবরাজ নামের এক সন্ত্রাসী। কিন্তু জয় ও জ্যোৎস্নার পুলিশি শক্তি বেশি থাকায় যুবরাজ আউট হয়ে গেছে।
বস্তির আরো একটু ভেতরে গিয়ে দেখা মিলল রোজি বেগম নামে একজনের সঙ্গে। কেমন আছেন জানতে চাইলে উত্তর দিতে গিয়ে অনেকটা কেঁদেই ফেললেন। এখানে এমন সব অপরাধ চলে, যা বলতে তার লজ্জা লাগে। ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ করে অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন। সুদের ওপর টাকা নিয়ে ছেলের চিকিৎসা করাচ্ছেন। অনেকে নেশা জাতীয় দ্রব্য বেচা-কেনা করে। তাঁকেও বলা হয়েছিল। তিনি না খেয়ে মরতে রাজি, কিন্তু অপরাধে জড়াবেন না।
রোজি বেগমের স্বামী ইউনুছ শরিফ তুলে ধরলেন বস্তির ভয়ংকর ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত বিভিন্ন সন্ত্রাসীর তৎপরতার কথা। বস্তিতে প্রতিটি লোককেই সালামি দিয়ে চলতে হয় মশা ভাইকে।
মশা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তার পুরো নাম মোশারফ হোসেন মশা। বস্তিতে মশা নামেই পরিচিত। বাবা খবিরউদ্দিন ভূঁইয়া একসময় টিঅ্যান্ডটিতে ছোট পদে চাকরি করতেন। এখন সপরিবারে রূপগঞ্জে থাকেন। তিনি ভালো লোক। তবে মশা তাঁর সঙ্গে থাকে না। কিশোর বয়স থেকে এই বস্তিতেই তার জীবনযাত্রা শুরু। আগে ছিল টোকাই মশা। এখন তার পরিচয় বড় ভাই মশা। বস্তির রাজা মশা। মশা গত সরকারের আমলে বিএনপির কর্মী ছিল। তখনই স্থানীয় নেতাদের ছত্রছায়ায় বস্তিতে জুয়ার ঘর, মাদক আর অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে বস্তিতে নিজের আধিপত্য গড়ে তোলে। সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। মশা এখন তাল মিলিয়ে চলছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ বস্তিতে কোনো রাজনৈতিক বিরোধ নেই। নেতারা সবাই মিলে-মিশে আছেন। প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকার ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে এই মশার মাধ্যমেই। মশা এখন স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে সোনার হাঁস।
মশা সম্পর্কে আরো জানা যায়, পুলিশ তালিকাভুক্ত দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী আক্তার এবং লম্বু সেলিমের (দুজনই কারারুদ্ধ) হাত ধরেই মশার যাত্রা শুরু। তার নেপথ্য আরেক শক্তি হচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী ফ্রিডম ইমাম গ্রুপ। মশা স্থানীয় সন্ত্রাসী জাকির, রিপন, দুলাল, শাহ আলম, জয়, জুয়েল, মন্টু, মোহাম্মদ হোসেন এবং জসিমকে সঙ্গে নিয়ে বস্তিতে গড়ে তুলেছে একটি বিশাল সন্ত্রাসী চক্র। গড়েছে একটি মার্কেট। এই মার্কেটটি বস্তিতে মশার মার্কেট বা মশার বাজার নামে পরিচিত।
রাশেদ নামে এক কিশোর বস্তির এই মাথা থেকে ওই মাথা ঘুরিয়ে দেখায়। সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, এ বস্তিতে হেরোইন, গাঁজা, মদ, ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন নেশার মালামাল বেচা-কেনা হচ্ছে অবাধে। ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনা করছে দুলাল। বস্তির ঘর ভাড়া তোলে জুয়েল। এই ভাড়া আদায় নিয়ন্ত্রণটাই তার দায়িত্ব। মশার নিজেরই দুই শতাধিক ঘর আছে এই বস্তিতে।
একাধিক সূত্র মতে, বস্তিতে মশা তার অপরাধ কর্মকাণ্ড ভাগ করে কয়েকটি উপকমিটি করেছে। তার রয়েছে কিলার গ্রুপ। এরা ভাড়াটে সন্ত্রাসী ও খুনি হিসেবেও কাজ করে। প্রায় সবার কাছেই আছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। বাইরের অনেকেই গাড়ি নিয়ে এসে বৈঠক করে মশার সঙ্গে। ভাড়াটে গ্রুপ পরিচালনা করে কিলার জাকির। চাঁদাবাজ গ্রুপ পরিচালনা করে মন্টু। মাদক গ্রুপ পরিচালনা করে দুলাল। জুয়া পরিচালনা করে ভান্ডারী হোসেন।
বস্তিরই একটি ঘরে বসবাস করে শাহ আলম। তার স্ত্রী গাঁজার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। বস্তির আরেক ঘরে থাকে লালচানের খালা বা পাগলী নামে পরিচিত এক মহিলা। তার ঘরে দেদার বিক্রি হয় গাঁজা। পরিমাণভেদে প্রতিপুরিয়ার দাম ২০, ৫০ ও ১০০ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বস্তিতে কোনো বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। তবে প্রতিঘরেই অবৈধ সংযোগ আছে। অনেক ঘরে টেলিভিশন-ফ্রিজও চলছে। সংযোগ পেতে পয়েন্টপ্রতি মাসে ১২০ টাকা দিতে হয় মশাকে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনাররা এখান থেকে নিয়মিত টাকা পান। তবে ওয়ার্ড কমিশনাররা এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
১৯ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার এবং স্থানীয় বিএনপি নেতা এ এফ এম আবদুল আলীম নকী জানান, মশা রাজনৈতিকভাবে তাঁর দলের কর্মী হলেও মূলত তাঁর সঙ্গে কোনো ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততা নেই। বিএনপি করলেও মশার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সম্পর্ক ভালো। আগে বস্তির অবস্থা ভালো ছিল। তবে এখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে বলে তিনি স্বীকার করেন।
আরেক প্রশ্নের জবাবে নকী বলেন, কোনো সন্ত্রাসী চক্র বা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই এবং তিনি কোনো মাসোহারাও পান না। তবে জনপ্রতিনিধি হিসেবে সন্ত্রাস দূর করতে স্থানীয় পুলিশের কাছ থেকে তিনি কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না।
মশার সঙ্গে সম্পৃক্তার কথা অস্বীকার করে ২০ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার এবং স্থানীয় বিএনপি নেতা আবুল কালাম আজাদ বলেন, তাঁর সঙ্গে মশার কোনো অর্থ লেনদেনের সম্পর্ক নেই। সে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকে।
এ এলাকার সংসদ সদস্য এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, তাঁর কাছে মশা সম্পর্কে কেউ কোনো লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ করেনি। কড়াইল বস্তির পুরোটাই সরকারি সম্পত্তি। তিনি এই বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন করার চেষ্টা করছেন বলে জানান।
তিনি আরো বলেন, 'মশার ব্যাপারে পুলিশের কাছে জানতে চেয়েছি। প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া গেলে এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
বস্তির প্রধান গডফাদার হিসেবে অভিযুক্ত এবং পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী মোশারফ ভূঁইয়া ওরফে মশা তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে জানায়, এগুলো প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র। কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদের কারণে হয়তো কেউ শত্রুতা করেছে।
ভিন্ন এক প্রশ্নের ব্যাপারে মশা জানায়, সে বস্তিসহ এ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবসা করে। এ ব্যাপারে তার কাছে কাগজপত্রও আছে বলে দাবি করে। তবে সে কোনো কাগজ দেখাতে পারেনি।
মশা স্থানীয় মোশারফ হোসেন মার্কেটের মালিক। অভিযোগ আছে, সরকারের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে সে এই মার্কেট গড়ে তুলেছে। তবে মশা জানায়, এ মার্কেট তার নয়। তবে তার বেশ কয়েকটি দোকান আছে। এ ছাড়া বস্তিতেও তার কয়েকটি ঘর আছে বলে মশা স্বীকার করে।
কথা প্রসঙ্গে মশা বলে, কয়েক দিন আগে তার বিরুদ্ধে একটি ছিনতাই মামলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তাঁর কাছে কেউ কখনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নিয়ে আসেননি। তবে সন্ত্রাসী যে দলেরই হোক না কেন, তার মূল পরিচয় অপরাধী। ফলে কোনো সন্ত্রাসী বা অপরাধীকে ছাড় দেওয়া হবে না। এই সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে তিনি পুলিশকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান।
=========================
উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল  এ মাটির মায়ায়  মধ্যবিত্তের উত্থান, না ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব  হিমালয়ের পায়ের কাছেঃ গোধূলির ছায়াপথে  পতিত স্বৈরাচারের আস্ফালন ও আওয়ামী লীগের নীরবতা  ৪০ বছর পড়ে থাকা লাশটার সৎকার করতে চাই  এই কি আমাদের মানবাধিকার?  ঐতিহ্যের মধ্যে সমকাল  কেমন দেখতে চাইঃ ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা  দ্রীপ প্রতিভার দ্যুতিময় স্মারক  গল্প- বৃষ্টি  শহীদুল্লা কায়সারঃ রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতা  আনোয়ার পাশাঃ জাতিরাষ্ট্রের অংশ ও প্রেরণা  মুনীর চৌধুরীঃ তাঁর নাটক  জেগে ওঠার গল্প  এখন শুনবেন বিশ্ব-সংবাদ  বাঘ  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১০  তাঁরা সমালোচিত, আমরা বিব্রত  মুজিবকে নিয়ে সিরাজের একমাত্র লেখা  ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির উদ্যোগ  মহাস্থানগড়ের ধ্বংস-পরিস্থিতিঃ পর্যবেক্ষণ  ওয়ান-ইলেভেনের চেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে!  ডিসেম্বরঃ গৌরব ও গর্বের মাস  উইকিলিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র  দুর্নীতি বেড়েছে দুনিয়াজুড়ে  উইকিলিকসঃ বাঘের ঘরে ঘোগ  আইন অপূর্ণাঙ্গঃ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার কঠিন  ১০০ কোটি ডলারে ঋণঃ ভারতের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত  ট্রেন দুর্ঘটনাঃ চালকের ভুল নাশকতারও গন্ধ!  ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা উইকিলিকস সমর্থকদের


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আনোয়ারা স্নিগ্ধা


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.