লাঠ্যৌষধি ও তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া by আনিসুল হক
সরকার কি সব বিক্ষোভের দাওয়াই হিসেবে বেছে নিয়েছে লাঠ্যৌষধিকে? কিছুদিন আগে বিরোধী দল মানববন্ধনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল; পরের দিন সংবাদপত্রগুলোয় শিরোনাম হলো, বিএনপি দাঁড়াতেই পারেনি। পুলিশ তাদের দাঁড়াতেই দেয়নি। অবশ্য তার আগে বিএনপির একটা পদযাত্রা ছিল, নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি ছিল, সেটায় পুলিশ বাধা দেয়নি, তাতে বিক্ষোভকারীরা হতোদ্যম হয়ে পড়ে। তারা ভেবেছিল, পুলিশ বাধা দেবে মৎস্য ভবনের কাছে, কিন্তু সেখানে এসে তারা দেখল কোনো ব্যারিকেড নেই, তারা হেঁটে হেঁটে এল শাহবাগের মোড় পর্যন্ত, ততক্ষণে একজন একজন করে নেতা-কর্মী কেটে পড়ছে, এই গরমের মধ্যে কেই বা হাঁটতে চায়! শাহবাগের মোড়েও কোনো বাধা না পেয়ে তাদের কর্মসূচির নটে গাছটি আপনাআপনিই মুড়িয়ে গেল। এ থেকে একটা শিক্ষা সরকারি নীতিনির্ধারকেরা লাভ করতে পারেন, বিক্ষোভ কর্মসূচিতে বাধা দিলে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, বাধা না দিলে আন্দোলন আপনাআপনিই মন্দীভূত হয়। অবশ্য সেই আন্দোলন বা বিক্ষোভের পেছনের কারণটা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত হতে হয়। অযৌক্তিক আন্দোলনকে বেগবান করা খুব মুশকিল।
কিন্তু সরকারে যাঁরা থাকেন, তাঁদের কাছে ব্যবস্থা গ্রহণ মানেই পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণ। আজকে কোথাও ছাত্র বা শ্রমিক বিক্ষোভ হতে পারে, প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে, এই কথার মানে হলো, পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে, এই কথার মানে হলো, পুলিশের লোকবল আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
কিন্তু পুলিশ দিয়েই কি সব বিক্ষোভ দূর করা যায়? পুলিশি ব্যবস্থাই কি সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা? আর সব ওষুধের সেরা কি লাঠ্যৌষধি?
সম্প্রতি বেশ কিছু ঘটনায় পুলিশ বেধড়ক পিটিয়েছে বিক্ষোভকারীদের। পোশাককর্মীদের আন্দোলন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধিবিরোধী আন্দোলন দমনে পুলিশের লাঠি ছিল খুবই সক্রিয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর পুলিশ চড়াও হচ্ছে, সেসব ছবি কেবল বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি, ফেসবুকসমেত ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইটে ছাত্রছাত্রীরা সেসব ছড়িয়ে দিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া হলে তার কিছু সুবিধা ক্ষমতার বাইরে থাকা মানুষও যে পাবে, এটা হলো তার প্রমাণ। শুধু যে বিক্ষোভ কর্মসূচি দমনে পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণের দৃষ্টান্ত দেখা যাচ্ছে তা-ই নয়, বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মামলা দেওয়া, তাঁদের রিমান্ডে নেওয়া, একযোগে বিভিন্ন স্থান থেকে মামলা দিয়ে হেনস্তা করা—নানা রকমের ওষুধই সরকার বা তার দল প্রয়োগ করে চলেছে।
বিক্ষোভ দমনের এই ধন্বন্তরি প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্রটা এই সরকার সম্ভবত গত জোট সরকারের প্রেসক্রিপশন থেকেই নকল করছে। ওই সময়ে আওয়ামী লীগকে জোট সরকার রাজপথে নামতেই দিতে চায়নি। আমাদের মনে আছে, সাবের হোসেন চৌধুরী, আসাদুজ্জামান নূরের মতো নেতারা ওই সময়ে পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে হাসপাতালে নীত হয়েছিলেন। সাবের হোসেন চৌধুরীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। খুবই হাস্যকর যে ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা বিস্ফোরণের পর অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবিরের মতো মানুষদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। দুঃখজনক ঘটনাটাকে হাস্যকর বললাম, কারণ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার এই দুজন লেখককে আটক করেছিল তারাই, যাদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এখন বেশ পাকাপোক্তভাবেই উঠে আসছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল বিএনপি সরকারের শুরুর দিকেই হঠাৎ একবার করে দিনক্ষণ ঘোষণা করে দিয়ে বলেছিলেন, অমুক দিনের মধ্যেই সরকারের পতন ঘটবে। সেই সরকার পতনের লক্ষ্যে তাঁরা রাজপথে নামার যে চেষ্টা করেছিলেন, পুলিশের লাঠির বাড়িতে তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
এখন বিএনপি তথা জোট সরকারের আচরিত, প্রদর্শিত ও শেখানো পথেই আওয়ামী লীগ সরকার পা বাড়িয়েছে। কঠোরভাবে সব আন্দোলন গোড়াতেই দমনের তারা চেষ্টা করছে। কিন্তু এত কিছু করেও কি বিএনপি-জামায়াতের শেষ রক্ষা হয়েছে? ভোটটাও তো তারা পুরোটাই হাইজ্যাক করার চক্রান্ত করেছিল, কিন্তু শেষে আম ও ছালা দুটোই তারা হারিয়েছে।
আসলে বিক্ষোভ দমন করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো বিক্ষোভের কারণটা দূর করা। যেমন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বেতনের ওপর করারোপ করার ফলে তাদের মনে ক্ষোভ দেখা দেয়। অর্থমন্ত্রী দ্রুত ঘোষণা দেন, এই ভ্যাটটা তাঁরা আসলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর আরোপ করতে চেয়েছিলেন, ছাত্রদের ওপরে নয়; ঠিক আছে, ওটা প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো। ওই বিষয় নিয়ে বিক্ষোভ আর ছাত্ররা দেখাবে না বলেই এরপর আশা করা যায়।
কিন্তু এখানে দুটো কথা বলার আছে। যেকোনো বিক্ষোভের কারণ সৃষ্টি হলেই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভকারীদের প্রধান ও প্রথম কাজ হয় গাড়ি ভাঙচুর ও আশপাশের কাচের ভবনগুলোয় ঢিলপাটকেল নিক্ষেপ। কোনো বিক্ষোভই শান্তিপূর্ণ থাকে না। এমনকি স্কুলের বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও এ দেশে রাস্তায় নেমে বাস ভাঙচুর করে থাকে! এখন মানুষের জানমাল রক্ষা করা, জনজীবন স্বাভাবিক রাখার দায়িত্বও তো সরকার ও প্রশাসনকে পালন করতে হবে। তারা সেটা করার জন্য পুলিশ নামায়। পুলিশ নেমেই রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য লাঠিপেটা করা শুরু করে দেয়। পুলিশের মৃদু লাঠির ছোঁয়াও যাঁর পিঠে একবার পড়েছে, তিনি তাঁর জীবদ্দশায় সেটা আর ভুলতে পারবেন না। প্রতি পূর্ণিমা-অমাবস্যায় ৬০ বছর পরও তার পিঠে ব্যথা অনুভূত হবে। শুধু ব্যথা নয়, বেদনাও তিনি অনুভব করবেন। আমাদের মরহুম সহকর্মী লতিফ সিদ্দিকী কিছুতেই আওয়ামী লীগ বা বিএনপির জোটে এরশাদের জাতীয় পার্টির অন্তর্ভুক্তি মেনে নিতে পারতেন না; বলতেন, ভাই রে, পিঠে তো এরশাদের (পুলিশের) লাঠির বাড়ির দাগ এখনো আছে।
বলার কথা হলো, সব সমস্যার সমাধান যেমন ভাঙচুর-অবরোধ নয়, তেমনি বিক্ষোভের দাওয়াই পুলিশের লাঠি নয়। সেটা ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালে এই দেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রচণ্ড আন্দোলন হয়েছিল। সেই আন্দোলন কিছুদিনের মধ্যেই শ্লথ হয়ে পড়েছিল, কারণ তখন প্রাদেশিক সরকার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছিল, দাবিগুলো মেনে নেওয়ার কথা বলেছিল। আর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সারা বাংলায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ তাতে পুলিশ বাধা দিয়েছিল, গুলি করেছিল, রক্ত ঝরিয়েছিল।
কোথাও কোনো বিক্ষোভ দেখা দিলে, সেই বিক্ষোভের কারণটি যদি বাস্তব ও খাঁটি হয়, পুলিশি ব্যবস্থা নিয়ে সেই বিক্ষোভ দূর করা যায় না। বরং যত বেশি বাধা আসে, আন্দোলন ততই বেগবান হয়। হরতালে, মিছিলে, জনসভায় বাধা এলেই আন্দোলনটা জমে ওঠে, ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি আসতে থাকে। বাধা না দিলে বিএনপির ওই পদযাত্রার মতোই সেটা আপনাআপনিই স্তিমিত হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিক্ষোভের কারণ দূর করা।
এটা ক্ষমতাসীনেরা আর ক্ষমতাবানেরা বুঝতে চান না। ফিলিস্তিনের মানুষের মনে কেন এত বিক্ষোভ, এটা যদি আমেরিকা বুঝত আর তা নিরসনে কাজ করত, তাদের এত কষ্ট করে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ পরিচালনা করতে হতো না, যে যুদ্ধে এখন দেখা যাচ্ছে, আমেরিকানরা জয়লাভ করতে পারছে না।
আওয়ামী লীগ তার দীর্ঘ ইতিহাসে বেশির ভাগ সময়ই বিরোধী দলে ছিল। তারা খুব ভালো করে জানে, সব সমস্যার সমাধান শক্তি প্রয়োগে নিহিত নয়। বহু সমস্যার সমাধান করতে হবে রাজনৈতিকভাবে। উল্টোপাল্টা শক্তি প্রয়োগ করতে গিয়ে বিএনপি জোট জন্ম দিয়েছিল কানসাট বিদ্রোহ, সায়েদাবাদ এলাকায় মানুষের আন্দোলন, যার পরিণতি হলো ‘দৌড়’ সালাহ উদ্দিনের সেই ঐতিহাসিক পৃষ্ঠ প্রদর্শন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটা রাজনৈতিক সরকারের হাতে অনেক রকমের কৌশল থাকে। রাজনৈতিক সমাধানের সঙ্গে তুলনা করে দেখলে লাঠিপেটা, মামলা, রিমান্ড—এসব কোনো ওষুধই নয়; বরং ক্ষমতার নিষ্ঠুর প্রয়োগ নামের ওষুধটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বড় বেশি। একটা মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পরিণামে আসে অনেক মিছিল। তারপর হরতাল-ধর্মঘট। তারপর লাঠি-গুলি-টিয়ারগ্যাস। তারপর আবার হরতাল। এ এক দুষ্টচক্র। এই দুষ্টচক্রে পড়ে আমরা বহু বছর পিছিয়ে গেছি। ১৯৪৭ সালে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীন ছিল আমাদের চেয়েও পশ্চাৎপদ, অনুন্নত, মালয়েশিয়া তো সেদিনও ছিল পিছিয়ে পড়া, আর আজকে তারা কোথায় আর আমরাই বা কোথায়। আমরা আর হরতাল-ভাঙচুরের যুগে ফিরে যেতে চাই না। তাই বলি, কেবল সব বুদ্ধি লাঠিতে নামিয়ে না এনে বুদ্ধির বিকল্প চর্চাও করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী যে বিরোধী দলের নেত্রীকে ইফতারের দাওয়াত দিয়েছেন, এটা একটা শুভ লক্ষণ। আর গতকালের বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচিটা যে নির্বিঘ্নে হতে পেরেছে, এটাও সরকারের পরিপক্বতার প্রমাণ। দেশটা আমাদের সবার, আমরা সবাই দেশটাকে ভালোবাসি। আসুন, সবাই মিলে দেশটাকে একটু এগিয়ে নিই। আমাদের প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে নিয়ে যাই, দেশটাকে মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত করি। আর ঢাকা শহরটা এমনিতেই চলছে না, মানুষ আর যানবাহনের চাপে এটা অচলই হয়ে আছে, ঘন ঘন কর্মসূচি দিয়ে এটাকে পুরোটাই পরিত্যক্ত করার বিলাসিতা এখন বর্জনই করা উচিত।
তবে বিরোধী দলকে শ্বাস নিতে দিতে হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তারা বাধ্য হবে পথে নামতে। তাদের যেন সরকার বাধ্য না করে। অন্যদিকে ‘ভারত সব নিয়ে গেল, হায় হায় দেশ বিক্রি হয়ে গেল’-জাতীয় বস্তাপচা স্লোগানের রাজনীতি থেকে কি বিএনপি বেরোবে না? অকারণ বিরোধিতার জন্য রাজপথে নেমে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করলে বিএনপির জনপ্রিয়তা বাড়বে না।
মনে রাখতে হবে, যে যা-ই করুন না কেন, জনগণ হিসাব রাখছে। ভোটের দিনে পর্দাঘেরা ঘরে ঢুকে জনগণ এই দুই দলকে তাদের কৃতকর্মের ফল স্বাধীনভাবে ও নির্ভুলভাবে দেবে। সেই সময় কে কত আন্দোলন করেছে, সে কথা কেউ খেয়াল রাখে না। জনগণকে কে কতটা অপমান করেছে, সেটা কিন্তু মানুষ ভোলে না।
বাড়াবাড়ি কারও জন্য শুভ হয় না এবং শেষ পর্যন্ত মধ্যপন্থাই শ্রেষ্ঠ পন্থা বলে এ দেশের মানুষের কাছে সমাদৃত ও বিবেচিত হয়ে আসছে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
কিন্তু সরকারে যাঁরা থাকেন, তাঁদের কাছে ব্যবস্থা গ্রহণ মানেই পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণ। আজকে কোথাও ছাত্র বা শ্রমিক বিক্ষোভ হতে পারে, প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে, এই কথার মানে হলো, পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে, এই কথার মানে হলো, পুলিশের লোকবল আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
কিন্তু পুলিশ দিয়েই কি সব বিক্ষোভ দূর করা যায়? পুলিশি ব্যবস্থাই কি সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা? আর সব ওষুধের সেরা কি লাঠ্যৌষধি?
সম্প্রতি বেশ কিছু ঘটনায় পুলিশ বেধড়ক পিটিয়েছে বিক্ষোভকারীদের। পোশাককর্মীদের আন্দোলন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধিবিরোধী আন্দোলন দমনে পুলিশের লাঠি ছিল খুবই সক্রিয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর পুলিশ চড়াও হচ্ছে, সেসব ছবি কেবল বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি, ফেসবুকসমেত ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইটে ছাত্রছাত্রীরা সেসব ছড়িয়ে দিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া হলে তার কিছু সুবিধা ক্ষমতার বাইরে থাকা মানুষও যে পাবে, এটা হলো তার প্রমাণ। শুধু যে বিক্ষোভ কর্মসূচি দমনে পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণের দৃষ্টান্ত দেখা যাচ্ছে তা-ই নয়, বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মামলা দেওয়া, তাঁদের রিমান্ডে নেওয়া, একযোগে বিভিন্ন স্থান থেকে মামলা দিয়ে হেনস্তা করা—নানা রকমের ওষুধই সরকার বা তার দল প্রয়োগ করে চলেছে।
বিক্ষোভ দমনের এই ধন্বন্তরি প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্রটা এই সরকার সম্ভবত গত জোট সরকারের প্রেসক্রিপশন থেকেই নকল করছে। ওই সময়ে আওয়ামী লীগকে জোট সরকার রাজপথে নামতেই দিতে চায়নি। আমাদের মনে আছে, সাবের হোসেন চৌধুরী, আসাদুজ্জামান নূরের মতো নেতারা ওই সময়ে পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে হাসপাতালে নীত হয়েছিলেন। সাবের হোসেন চৌধুরীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। খুবই হাস্যকর যে ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা বিস্ফোরণের পর অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবিরের মতো মানুষদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। দুঃখজনক ঘটনাটাকে হাস্যকর বললাম, কারণ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার এই দুজন লেখককে আটক করেছিল তারাই, যাদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এখন বেশ পাকাপোক্তভাবেই উঠে আসছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল বিএনপি সরকারের শুরুর দিকেই হঠাৎ একবার করে দিনক্ষণ ঘোষণা করে দিয়ে বলেছিলেন, অমুক দিনের মধ্যেই সরকারের পতন ঘটবে। সেই সরকার পতনের লক্ষ্যে তাঁরা রাজপথে নামার যে চেষ্টা করেছিলেন, পুলিশের লাঠির বাড়িতে তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
এখন বিএনপি তথা জোট সরকারের আচরিত, প্রদর্শিত ও শেখানো পথেই আওয়ামী লীগ সরকার পা বাড়িয়েছে। কঠোরভাবে সব আন্দোলন গোড়াতেই দমনের তারা চেষ্টা করছে। কিন্তু এত কিছু করেও কি বিএনপি-জামায়াতের শেষ রক্ষা হয়েছে? ভোটটাও তো তারা পুরোটাই হাইজ্যাক করার চক্রান্ত করেছিল, কিন্তু শেষে আম ও ছালা দুটোই তারা হারিয়েছে।
আসলে বিক্ষোভ দমন করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো বিক্ষোভের কারণটা দূর করা। যেমন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বেতনের ওপর করারোপ করার ফলে তাদের মনে ক্ষোভ দেখা দেয়। অর্থমন্ত্রী দ্রুত ঘোষণা দেন, এই ভ্যাটটা তাঁরা আসলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর আরোপ করতে চেয়েছিলেন, ছাত্রদের ওপরে নয়; ঠিক আছে, ওটা প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো। ওই বিষয় নিয়ে বিক্ষোভ আর ছাত্ররা দেখাবে না বলেই এরপর আশা করা যায়।
কিন্তু এখানে দুটো কথা বলার আছে। যেকোনো বিক্ষোভের কারণ সৃষ্টি হলেই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভকারীদের প্রধান ও প্রথম কাজ হয় গাড়ি ভাঙচুর ও আশপাশের কাচের ভবনগুলোয় ঢিলপাটকেল নিক্ষেপ। কোনো বিক্ষোভই শান্তিপূর্ণ থাকে না। এমনকি স্কুলের বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও এ দেশে রাস্তায় নেমে বাস ভাঙচুর করে থাকে! এখন মানুষের জানমাল রক্ষা করা, জনজীবন স্বাভাবিক রাখার দায়িত্বও তো সরকার ও প্রশাসনকে পালন করতে হবে। তারা সেটা করার জন্য পুলিশ নামায়। পুলিশ নেমেই রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য লাঠিপেটা করা শুরু করে দেয়। পুলিশের মৃদু লাঠির ছোঁয়াও যাঁর পিঠে একবার পড়েছে, তিনি তাঁর জীবদ্দশায় সেটা আর ভুলতে পারবেন না। প্রতি পূর্ণিমা-অমাবস্যায় ৬০ বছর পরও তার পিঠে ব্যথা অনুভূত হবে। শুধু ব্যথা নয়, বেদনাও তিনি অনুভব করবেন। আমাদের মরহুম সহকর্মী লতিফ সিদ্দিকী কিছুতেই আওয়ামী লীগ বা বিএনপির জোটে এরশাদের জাতীয় পার্টির অন্তর্ভুক্তি মেনে নিতে পারতেন না; বলতেন, ভাই রে, পিঠে তো এরশাদের (পুলিশের) লাঠির বাড়ির দাগ এখনো আছে।
বলার কথা হলো, সব সমস্যার সমাধান যেমন ভাঙচুর-অবরোধ নয়, তেমনি বিক্ষোভের দাওয়াই পুলিশের লাঠি নয়। সেটা ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালে এই দেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রচণ্ড আন্দোলন হয়েছিল। সেই আন্দোলন কিছুদিনের মধ্যেই শ্লথ হয়ে পড়েছিল, কারণ তখন প্রাদেশিক সরকার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছিল, দাবিগুলো মেনে নেওয়ার কথা বলেছিল। আর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সারা বাংলায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ তাতে পুলিশ বাধা দিয়েছিল, গুলি করেছিল, রক্ত ঝরিয়েছিল।
কোথাও কোনো বিক্ষোভ দেখা দিলে, সেই বিক্ষোভের কারণটি যদি বাস্তব ও খাঁটি হয়, পুলিশি ব্যবস্থা নিয়ে সেই বিক্ষোভ দূর করা যায় না। বরং যত বেশি বাধা আসে, আন্দোলন ততই বেগবান হয়। হরতালে, মিছিলে, জনসভায় বাধা এলেই আন্দোলনটা জমে ওঠে, ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি আসতে থাকে। বাধা না দিলে বিএনপির ওই পদযাত্রার মতোই সেটা আপনাআপনিই স্তিমিত হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিক্ষোভের কারণ দূর করা।
এটা ক্ষমতাসীনেরা আর ক্ষমতাবানেরা বুঝতে চান না। ফিলিস্তিনের মানুষের মনে কেন এত বিক্ষোভ, এটা যদি আমেরিকা বুঝত আর তা নিরসনে কাজ করত, তাদের এত কষ্ট করে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ পরিচালনা করতে হতো না, যে যুদ্ধে এখন দেখা যাচ্ছে, আমেরিকানরা জয়লাভ করতে পারছে না।
আওয়ামী লীগ তার দীর্ঘ ইতিহাসে বেশির ভাগ সময়ই বিরোধী দলে ছিল। তারা খুব ভালো করে জানে, সব সমস্যার সমাধান শক্তি প্রয়োগে নিহিত নয়। বহু সমস্যার সমাধান করতে হবে রাজনৈতিকভাবে। উল্টোপাল্টা শক্তি প্রয়োগ করতে গিয়ে বিএনপি জোট জন্ম দিয়েছিল কানসাট বিদ্রোহ, সায়েদাবাদ এলাকায় মানুষের আন্দোলন, যার পরিণতি হলো ‘দৌড়’ সালাহ উদ্দিনের সেই ঐতিহাসিক পৃষ্ঠ প্রদর্শন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটা রাজনৈতিক সরকারের হাতে অনেক রকমের কৌশল থাকে। রাজনৈতিক সমাধানের সঙ্গে তুলনা করে দেখলে লাঠিপেটা, মামলা, রিমান্ড—এসব কোনো ওষুধই নয়; বরং ক্ষমতার নিষ্ঠুর প্রয়োগ নামের ওষুধটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বড় বেশি। একটা মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পরিণামে আসে অনেক মিছিল। তারপর হরতাল-ধর্মঘট। তারপর লাঠি-গুলি-টিয়ারগ্যাস। তারপর আবার হরতাল। এ এক দুষ্টচক্র। এই দুষ্টচক্রে পড়ে আমরা বহু বছর পিছিয়ে গেছি। ১৯৪৭ সালে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীন ছিল আমাদের চেয়েও পশ্চাৎপদ, অনুন্নত, মালয়েশিয়া তো সেদিনও ছিল পিছিয়ে পড়া, আর আজকে তারা কোথায় আর আমরাই বা কোথায়। আমরা আর হরতাল-ভাঙচুরের যুগে ফিরে যেতে চাই না। তাই বলি, কেবল সব বুদ্ধি লাঠিতে নামিয়ে না এনে বুদ্ধির বিকল্প চর্চাও করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী যে বিরোধী দলের নেত্রীকে ইফতারের দাওয়াত দিয়েছেন, এটা একটা শুভ লক্ষণ। আর গতকালের বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচিটা যে নির্বিঘ্নে হতে পেরেছে, এটাও সরকারের পরিপক্বতার প্রমাণ। দেশটা আমাদের সবার, আমরা সবাই দেশটাকে ভালোবাসি। আসুন, সবাই মিলে দেশটাকে একটু এগিয়ে নিই। আমাদের প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে নিয়ে যাই, দেশটাকে মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত করি। আর ঢাকা শহরটা এমনিতেই চলছে না, মানুষ আর যানবাহনের চাপে এটা অচলই হয়ে আছে, ঘন ঘন কর্মসূচি দিয়ে এটাকে পুরোটাই পরিত্যক্ত করার বিলাসিতা এখন বর্জনই করা উচিত।
তবে বিরোধী দলকে শ্বাস নিতে দিতে হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তারা বাধ্য হবে পথে নামতে। তাদের যেন সরকার বাধ্য না করে। অন্যদিকে ‘ভারত সব নিয়ে গেল, হায় হায় দেশ বিক্রি হয়ে গেল’-জাতীয় বস্তাপচা স্লোগানের রাজনীতি থেকে কি বিএনপি বেরোবে না? অকারণ বিরোধিতার জন্য রাজপথে নেমে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করলে বিএনপির জনপ্রিয়তা বাড়বে না।
মনে রাখতে হবে, যে যা-ই করুন না কেন, জনগণ হিসাব রাখছে। ভোটের দিনে পর্দাঘেরা ঘরে ঢুকে জনগণ এই দুই দলকে তাদের কৃতকর্মের ফল স্বাধীনভাবে ও নির্ভুলভাবে দেবে। সেই সময় কে কত আন্দোলন করেছে, সে কথা কেউ খেয়াল রাখে না। জনগণকে কে কতটা অপমান করেছে, সেটা কিন্তু মানুষ ভোলে না।
বাড়াবাড়ি কারও জন্য শুভ হয় না এবং শেষ পর্যন্ত মধ্যপন্থাই শ্রেষ্ঠ পন্থা বলে এ দেশের মানুষের কাছে সমাদৃত ও বিবেচিত হয়ে আসছে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments