লিবিয়ায় ৩ মাস ধরে খোঁজ নেই অপহৃত আলীর by ওয়েছ খছরু

তিন মাস আগের কথা। একদিন জগন্নাথের বাড়িতে থাকা মাকে ভিডিও কলে বার্তা দেন লিবিয়ায় অপহরণকারীদের হাতে বন্দি আলী হোসেন। এ বার্তায় দেখা গেছে, আলী হোসেনের পাশে বসে আছে এক অপহরণকারী যুবক। আর পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল আলী হোসেন। বলছিল; ‘মা টাকা পাঠাও, নতুবা ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ এই ভিডিও বার্তায় দেশে থাকা স্বজনরা আতঙ্কিত হয়ে উঠেন। কিছু টাকা দিয়েছিলেন সিলেটে থাকা অপহরণকারীদের এজেন্ট ফয়সলের হাতে। তবুও ৩ মাস ধরে খোঁজ নেই আলী হোসেনের। কোথায় আছে- কেমন আছে- জানে না পরিবারও। অন্যদিকে দেশে থাকা এজেন্ট ফয়সল মিয়াও গা-ঢাকা দিয়েছেন। সন্তানের কোনো খোঁজ না পেয়ে কয়েক দিন আগে সিলেটের আদালতে মানব পাচার আইনে ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন আলী হোসেনের পিতা আবুল হক। পরে আদালতের নির্দেশে বুধবার এ মামলাটি রেকর্ড করেছে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। লিবিয়ায় থাকা আলী হোসেনের বাড়ি জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীধরপাশা গ্রামে। ৫ বছর আগে স্পেনে নেয়ার কথা বলে তাকে দুবাই হয়ে লিবিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তাকে অজ্ঞাত স্থানে রেখে দফায় দফায় দেশে থাকা পরিবারের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অপহরণকারীরা। ঘটনার মূল হোতা ফয়সল মিয়া। তাকে মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে। তার বাড়িও শ্রীধরপাশা গ্রামে। বিগত ১৫ বছর সাবেক মন্ত্রী এম এ মান্নানের নিকটজন পরিচয় দিয়ে ঘটিয়ে গেছেন অপরাধ কর্মকাণ্ড। তার বিরুদ্ধে রয়েছে মানব পাচারের গুরুতর অভিযোগ। ফয়ছলের এ সাম্রাজ্য বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তার কাছে টাকা দিয়ে সিলেট বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক যুবক আজ নিঃস্ব। এ ছাড়া লিবিয়ায় অনেককে আটকে রেখে পরিবারের কাছ থেকে বার বার টাকা নেয়ারও অনেক অভিযোগ আছে ফয়ছলের বিরুদ্ধে। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে- আবুল হকের ছেলে আলী হোসেনকে লিবিয়ায় নিয়ে গিয়ে মাফিয়া চক্র দিয়ে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করে ভিডিও চিত্র ধারণ করে সেই ভিডিও মা-বাবার কাছে পাঠিয়ে ফয়ছল ও তার সহযোগী মকবুল হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ২৫ লাখ টাকা। টাকা নিয়েও ফয়ছল তার লিবিয়ার এজেন্টদের কাছ থেকে আলী হোসেনকে ছাড়িয়ে আনেননি, বরং আরও ১০ লাখ টাকা দাবি করে আলী হোসেনের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অবশেষে ছেলেকে জীবিত ফিরে পেতে ২৭শে নভেম্বর সিলেট মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে ফয়ছল ও  মকবুলসহ মানব পাচারকারী চক্রের নাম উল্লেখ করে মামলার আবেদন করেন আবুল হক। আভিযোগটি আমলে নিয়ে বুধবার সিলেট কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশকে এফআইআরের নির্দেশনা দেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. সাইফুর রহমান। পরে সেটি কোতোয়ালি থানায় রেকর্ড হয়। মামলার আসামিরা হচ্ছে ফয়সলের বাড়ির মকবুল মিয়া, হাসান নুর, সাইফুল ইসলাম, ছালাতুর রহমান, সিরাজুল ইসলাম শিরু, সামছুল ইসলাম, এনাম আহমদ, নজরুল ইসলাম, সালেহ, শাহীন ও জিলু মিয়া। সবার বাড়ি জগন্নাথপুর উপজেলায় বলে জানান মামলার বাদী আবুল হক। তিনি জানিয়েছেন- ফয়ছল ও মকবুল এবং তাদের সহযোগীরা শুধু আমার ছেলেই নয়- সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৭০-৮০ জন যুবককে  ইতালি নেয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিজস্ব মাফিয়া এজেন্টদের কাছে আটক রেখে ফয়ছল ও মকবুল ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক কোটি টাকা। বাধ্য হয়ে আমি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি, আমার ছেলেকে জীবিত ফেরত পেতে সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে জোর দাবি জানাচ্ছি। সিলেটের কোতোয়ালি থানা পুলিশ জানিয়েছে- মানব পাচার আইনে দায়ের করা এ মামলাটি এসআই মুকিত মিয়াকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আদালত আগামী ২রা মার্চের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে; মামলার প্রধান আসামি ফয়সল সহ অন্যরা পলাতক থাকায় তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না। মামলা দায়েরের পর থেকে আসামিরা মোবাইল ফোনও বন্ধ রেখেছেন। এ ব্যাপারে প্রধান অভিযুক্ত ফয়সলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, সিলেটে ফয়সল ও লিবিয়ায় এনাম মিলে মানব পাচার সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এনামের নেতৃত্বে তাদের এলাকার কয়েকজন যুবক লিবিয়ায় টাকার বিনিময়ে যুবকদের নিয়ে ইউরোপে পাঠিয়ে বন্দি করে রাখছে। এরপর তাদের পরিবারের কাছ থেকে লুটে নিচ্ছে টাকা। এই অবস্থায় সাড়ে তিন মাস ধরে আলী হোসেনের খোঁজ না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। আলীর পিতা-মাতা জানান, ছেলেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আমরা দফায় দফায় টাকা দিয়েছি।  স্পেনে পাঠানোর জন্য মোট ১৫ লাখ টাকার চুক্তি হয়। সেই টাকা দেয়ার পরও ছেলেকে ফেরত পেতে আরও অতিরিক্ত টাকা দেয়া হয়েছে। এরপর টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে দেশে থাকা ফয়সলের নেতৃত্বে মানব পাচার সিন্ডিকেট তাদের কাছ থেকে  চেক বইয়ের পাতা ও ব্ল্যাংক স্ট্যাম্পে দস্তখত নিয়ে রেখেছে। এরপরও আলী হোসেনকে তারা ফিরিয়ে দেয়নি। ওই চেক ও স্ট্যাম্প দিয়ে তাদের হয়রানি করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করেন পরিবারের সদস্যরা।
mzamin
আলীর পাশে বসে আছে অপহরণকারী

No comments

Powered by Blogger.