আমরা সবাই এক পরিবার: ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক

দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ও ধর্মীয় সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রাখার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছেন ধর্মীয় নেতারা। বলেছেন, বাংলাদেশে সবাই ভাই-ভাই। এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। পরাজিত শক্তি দেশের বাইরে বসে প্রোগাগান্ডা চালাচ্ছে। তাদের প্রোপাগান্ডায় কেউ পা দেবে না। এ দেশে সব ধর্ম সব মতের সমান অধিকার। দেশ সবার। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্বাধীনভাবে ধর্মীয় চর্চা করবেন। কেউ এতে বাধা দিতে পারবে না। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতে এসব কথা জানিয়েছেন ধর্মীয় নেতারা। সরকারপ্রধান ধর্ম ও পার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশের সব মানুষ একই পরিবারের সদস্য বলে মন্তব্য করেন। বলেন, আমাদের নানা মত, নানা ধর্ম থাকবে, নানা রীতিনীতি থাকবে কিন্তু আমরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। আমাদের সবার সমান অধিকার, বলার অধিকার, ধর্মের অধিকার, কাজকর্মের অধিকার। সেটা এসেছে সংবিধান থেকে। যেটা নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য, রাষ্ট্রের দায়িত্ব সেটা নিশ্চিত করা। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এ বৈঠক প্রধান উপদেষ্টার ধারাবাহিক বৈঠকের শেষ পর্ব। বৈঠকে হিন্দু- বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-মুসলমান, গারোসহ সব ধর্ম ও মতের লোক উপস্থিত ছিলেন। হিন্দু নেতারা যারা এ বৈঠকে উপস্থিত হননি সামনের দিনে তাদেরও নিয়ে আসার দাবি করেন। এছাড়াও দু’-একটি ঘটনা যে ঘটছে সে বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ দাবি করেন। হিন্দু নেতারা ইসকনের সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মাচারীর মুক্তি দাবি করেন। অন্যদিকে এক বৌদ্ধ নেতা একটি আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সম্মেলন করার প্রস্তাব দেন। মুসলিম নেতারাও সম্প্রীতির বার্তা দেন। তারা বলেন, পরাজিত শক্তি বিদেশে বসে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এদেশে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান বৌদ্ধ ভাই ভাই। সবার সমান অধিকার। মুসলমানরা দেশের শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে কোনো উস্কানিতে পা দেননি। আগামী দিনেও এটি বজায় রাখতে চান তারা। বৈঠকে ইসলামী বক্তা শায়েখ আহমদুল্লাহ, কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজেদুর রহমান, হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা মুহিউদ্দিন রাব্বানী, জুনায়েদ আল হাবিব ও মুনির হোসাইন কাসেমী, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) মহাসচিব মাহফুজুল হক, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব আবদুল মালেক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর ড. সুকমল বড়ুয়া, রমনা হরিচাঁদ মন্দিরের সহ-সম্পাদক অমিনাষ মিত্র, গারো সম্প্রদায় থেকে পুরোহিত জনসং ম্রি থমাল, বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়, রমনা সেন্ট ম্যারিজ ক্যাথেড্রালের প্রধান পুরোহিত আলবার্ট রোজারিও প্রমুখ। এছাড়া উপদেষ্টাদের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হাসান, মাহফুজ আলম, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন সাহা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, শুনলাম এখনো সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে। তাই আমি সবাইকে নিয়ে বসলাম এটা থেকে কীভাবে উদ্ধার হওয়া যায়। ভুল তথ্যের বিষয়ে সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, এখন আবার নতুন কথা হামলা হচ্ছে, অত্যাচার শুরু হচ্ছে। বিদেশি গণমাধ্যম বলবো না প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। আমি খোঁজ নিচ্ছি, কী হচ্ছে। সবদিকে দেখলাম এটা হচ্ছে না। তথ্যের মধ্যে বিশাল ফারাক আছে। এটা ঠিক না। এটার অবসান হতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা যে তথ্য পাচ্ছি তা ভুল হতে পারে। তথ্যের ওপর বসে থাকার কিছুই নেই, এটার অর্থ অন্ধের মতো বসে থাকা। ভেতরে গিয়ে দেখতে হবে। খোঁজ নিতে হবে তথ্যের গরমিল কেন? তাতে ওরা যা বলছে তা কি মিথ্যা প্রচার? না আমরা যা বলছি তা মিথ্যা প্রচার। সত্যটা কোথায়?

তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্যের কোনো ফারাক নেই। সঠিক তথ্য কীভাবে পাবো, সেটা আমাদের জানা প্রয়োজন। প্রকৃত তথ্যের ক্ষেত্রে অনেক সময় সরকারি তথ্যের ওপর ভরসা করে লাভ নেই। কারণ কর্তা যা চায়, তারা সেভাবে বলে। আসলটা মন খুলে বলতে চায় না। আমরা আসল খবরটা জানতে চাই। সেই প্রক্রিয়াটা প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। এত বড় দেশে যে কোনো ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু প্রকৃত তথ্য জানতে চাই। তাৎক্ষণিক খবর পেলে যাতে সমাধান করা যায়। যেদিক থেকেই হোক, দোষী দোষীই। তাকে বিচারের আওতায় আনা সরকারের দায়িত্ব।

ড. ইউনূস বলেন, প্রথম কথাটা হলো, এগুলো না হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা। আর হয়ে গেলে তাৎক্ষণিক প্রতিকারের ব্যবস্থা করা। আমি যা বলছি তা দেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে করে। আমরা এক পরিবারের মানুষ হিসেবে সামগ্রিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারি। সেখানে তথ্য ও প্রতিকার হলো বড় বিষয়।

তিনি বলেন, আমি পেলাম তথ্য কিন্তু প্রতিকার পেলাম না। সমস্যা হয়ে গেলে সমাধান করতে হবে। আজকের আলোচনা খোলাখুলি, আমরা সবাই আলোচনা করবো। আমাদের লক্ষ্যে কোনো বাধা নেই। তথ্যপ্রবাহ কীভাবে পাব, দোষীকে কীভাবে ধরবো। যাতে সবাই সঠিক তথ্যটা পেয়ে যায়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এমন বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলতে চাই। যার নাম দিয়েছি নতুন বাংলাদেশ। এটা আমাদের করতে হবে। আপনাদের কথা বলে সন্তুষ্ট করে আজকের মতো বিদায় দিলাম, তা নয়। এটা দ্রুত করতে হবে।

মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আপনাদের কথার মধ্যে যেগুলো এসেছে, একটা হলো ক্ষোভ। আমরা সবাই এমনিতে শান্তিতে আছি। কিছু একটা ঘটনা আমাদের একটা ক্ষোভ সৃষ্টি করে। পানিতে ঢিল ছোড়ার মতো ঢেউ শুরু হয়ে যায়। এই ক্ষোভ যদি আমরা সামাল দিতে না পারি তাহলে আমরা আবার আমাদের মাথায় যত কথাই থাকুক না কেন, এটা থেকে বিচ্যুতি হয়ে যাই। আর ঘটনা যদি ঘটেই যায় তাহলে ক্ষোভটা সংবরণ করা। এটার সঙ্গে সঙ্গে যদি আমরা উত্তেজিত হয়ে যাই তাহলে আমরা যত কিছুই করি, সে সমস্ত কিছু গোলমাল হয়ে গেল।

তিনি বলেন, ঘটনা ঘটবে, আমাদের দেশে কম ঘটবে। কিন্তু আমাদের ক্ষোভ সংবরণ করতে হবে। যাতে এই ক্ষোভের আরেকটা কারণ সৃষ্টি না হয়। ওই ক্ষোভ থেকে আমাদের আত্মসংবরণ করা। এটা আমাদের সবার অত্যন্ত জরুরি জিনিস। দ্বিতীয় হলো- একটা দল ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে আমরা এখান থেকে বিতাড়িত করেছি। তারা কিন্তু তাতে শেষ হয়ে যায়নি। সম্পূর্ণ সমাপ্ত মনে করে নাই। দেশে-বিদেশে তারা অবস্থান করছেন। তারা সুযোগ পেলেই উস্কানিমূলক কিছু একটা করবে। এই উস্কানিকে কীভাবে আমা নিশ্চিহ্ন করতে পারবো এবং উস্কানিতে সাড়া না দেয়া। এটা থেকে আমরা কীভাবে বাঁচবো। আমরা সবদিকেই ঠিক আছি। কিন্তু বাইরে থেকে আসছে। একটা ক্ষোভ ও উস্কানি সৃষ্টি করছে। উস্কানিটা এমনভাবে করে, বোঝা যায় না যে, এটা উস্কানি।

ড. ইউনূস বলেন, আবার বহির্বিশ্বে কেউ কেউ আছে, যারা আমাদের বিভিন্ন উস্কানির সূত্রপাত করে। তাদের দেশের যারা সংখ্যালঘু, তাদের ওপরে যে হয়রানি। সেটা আমাদের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করবে। এটা আমাদের কারণে হচ্ছে? হচ্ছে বাইরে কারণে। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিকভাবে প্রতিকারও সম্ভব হবে। আমরা ওদিকে চলে যেতে পারি কিনা? এই দু’টি জিনিসকে আমি গুরুত্ব দিচ্ছি। যাতে বারবার আমরা স্বীকার না হই।

তিনি বলেন, এখন আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলছি। আছে বলেই আমরা একমত হলাম যে, আমাদের সম্প্রীতি আছে। সম্প্রীতির সঙ্গে আমি আরেকটা জিনিস যোগ করতে চাই, সেটা হচ্ছে ভয়। সম্প্রীতি আছে। কিন্তু মনের মধ্যে ভয়ও আছে। এই ভয় থেকে কেমনে আমরা উত্তোলন করবো। আমরা নাগরিক, নির্ভয়ের নাগরিক। ভয়ের সঙ্গে নাগরিক না। এমন পরিস্থিতি আমরা করবো যে, আমরা কেউ কাউকে আর ভয় করছি না। ভয়মুক্ত নাগরিক হবো। নাগরিক অধিকারও থাকবে এবং নিজের মনের ভিতরে ভয়টা আর থাকবে না। এটা যদি আমরা করতে পারি তাহলে এটা হবে আমাদের আদর্শ। যেখানে আমরা যাওয়ার চেষ্টা করছি। আর আমরা সম্প্রীতির কথা বলি, সম্প্রীতির মধ্যেও কিন্তু একটা ভয় আছে। ভয় না থাকলে সম্প্রীতির কথাটা আসতো না।  

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ এখন নতুনভাবে জন্ম লাভ করছে। শুধু যে সামরিকভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেজন্য আমরা আলাপ করছি, শুধু তা না। আমরা এমন একটা বাংলাদেশ করবো, দুর্ঘটনা ঘটবেও না। আর ঘটলেও শান্তিপূর্ণভাবে এটাকে আমরা সামাল দিতে পারবো। এধরনের একটা রাষ্ট্র যাতে আমরা গঠন করতে পারি। একজন নাগিরক আরেকজন নাগরিককে ভয় পাবে না। আমরা নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারি, ভিন্নভাবে। বর্তমানে যা আছে তার কিছুটা রদবদল করে না। একেবারে কাঠামোগতভাবে পরিষ্কার করে। নতুন সূত্রে গাঁথা।

রমনা হরিচাঁদ মন্দিরের সহ-সম্পাদক অমিনাষ মিত্র বলেন, আমরা বাংলাদেশে সবাই ভালো আছি। এখানে সব ধর্মের লোক আছি। কোনো বিভেদ নেই। তাহলে যে বিভেদ হচ্ছে সেটা কোথায়, কারা করছে? যারা করছে তাদের লোক ওখানে (ভারতে) বসে এ বিভেদটা করছে। আমাদের মধ্যে বিভেদ নেই। সবার লক্ষ্য এক জায়গায়। কিন্তু আমাদের মধ্যে ঢুকে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে বিদেশে তাদের স্বার্থ হাসিল করতে চায় এটা আমরা চাই না। বাংলাদেশে আমরা সব জাতি সমানভাবে বাঁচতে চাই। সেইভাবেই বেঁচে আছি। এখানে কোনো সমস্যা নেই। যদি কেউ এ বিশৃঙ্খলা করে থাকে তাহলে তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। আমাদের এক ভাইকে মেরেছে কারা মেরেছে তাকেও খুঁজতে হবে।

ইসলামী বক্তা শায়খ আহমদুল্লাহ বলেন, আইনজীবী আলিফ হত্যাকাণ্ডের পরেও বাংলাদেশের মুসলমানরা ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দিয়েছে। বিগত সরকারের শেষের দিকে ফরিদপুরে মসজিদের দু’জন নির্মাণ শ্রমিককে নির্মমভাবে অন্য ধর্মাবলম্বীবা হত্যা করার পরেও গোটা দেশের মুসলমানরা সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। আমরা এটিকে যেমন সাধুবাদ জানিয়েছি, তেমন এটিকে ধরে রাখার জন্য সংগ্রাম করছি। আমরা সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই। বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতির উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরি করেছে এটা পৃথিবীতে আসলেই বিরল। কোনো প্রোপাগান্ডায় যেন কেউ কোনোভাবেই পা না দেই। আমরা যেন সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকি, সবাই এখানে কথা বলেছেন। মুসলিমরা ছাড়াও অন্য ধর্মের নেতৃবৃন্দরা কথা বলেছেন। আমরা আশা করছি, একটা সম্প্রীতির বাংলাদেশ যেটি ইতিমধ্যে আছে, তা আরও ভালো জায়গায় নিয়ে যেতে পারবো এবং পৃথিবীর কাছে উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করাতে পারবো। তিনি বলেন, ইসলাম আমাদের অন্য ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারে যথেষ্ট দায়িত্বশীল আচরণ করতে বলে। প্রিয় নবী (সা.) আমাদের মানুষ হিসেবে অন্য ধর্মাবলম্বীদের মর্যাদা দিতে শিখিয়েছেন। আমাদের দেশে সংখ্যালঘু ভাইয়েরা নিরাপদে আছেন। তাদের নিরাপদ রাখার জন্য সরকার যেমন কাজ করছে। ধর্মীয় নেতৃত্ববৃন্দরাও কাজ করছেন। আমরা এই বার্তা প্রধান উপদেষ্টাকে দেয়ার চেষ্টা করেছি। আমরা হিন্দু, মুসলিম, বোদ্ধ, খ্রিস্টান ভাই ভাই হয়ে এই দেশকে এগিয়ে নিতে চাই। আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। কোনো ফাটল নেই। বিভেদ এবং ফাটল যারা দেখানোর চেষ্টা করছে তাদের সেই মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় যাতে বিশ্ববাসী বিভ্রান্ত না হয়, দেশের মানুষ বিভ্রান্ত না হয় আমরা সেই বার্তা আজ দেয়ার চেষ্টা করেছি।

বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয় বলেন, আমাদের আজ প্রধান উপদেষ্টা ডেকেছেন। আমরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক সেখানে উপস্থিত ছিলাম। দীর্ঘক্ষণ আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমরা তার কাছে জানিয়েছি দেশের সম্প্রীতি যাতে বিরাজ থাকে। সকল সম্প্রদায়ের মানুষ যেন আমরা মিলেমিশে থাকতে পারি।

রমনা সেন্ট ম্যারিজ ক্যাথেড্রালের প্রধান পুরোহিত অলভার্ট রোজারিও বলেন, গতকাল রাজনৈতিক দলগুলো যে কথা বলেছে তার সঙ্গে আমরা একাত্মতা পোষণ করেছি। আমরা একটা স্পর্শকাতর সময় পার করছি। এই সময়ে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তিনি বলেন, ইসকনের ঘটনায় মানুষের মনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে হবে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যারা কষ্টে আছেন, যাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে তাদের অনেকেই আজ আসেন নাই। তাদেরকে নিয়ে যেন প্রধান উপদেষ্টা বসেন আমি এই কথা বলে এসেছি। পাশাপাশি বলেছি আমরা যেন এমন একটা আয়োজন করি যাতে সারা পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে বাংলাদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক সমপ্রীতির মধ্যে আছে, তারা মিলেমিশে থাকে, তারা একসঙ্গে পথ চলে। এডভোকেট মারা যাওয়ার ঘটনায় দেশের মানুষ অনেক ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। এরপরেও ভারতের কিছু মিডিয়া উস্কানিমূলক সংবাদ প্রচার করেছে যা বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই।
হেফাজত ইসলামের মহাসচিব সাজেদুর রহমান বলেন, আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। ভাই ভাই। কোরআন বলেছে, সব মানবজাতি আদম সন্তান। তাই সম্প্রীতি বজায় রাখা সবার দায়িত্ব। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে না বলে মত দিয়েছেন বেশ কয়েকজন হিন্দু ভাই। সাম্প্রদায়িক নির্যাতন হচ্ছে পাশের দেশে। এখানে বেশ কয়েকটি উস্কানি দেয়া হলেও কোনো দাঙ্গা হয়নি। আমরা অমুসলিম ভাইদের পাহারা দিই কোনো বিপদ আসলে। আমরা দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ আছি। যারা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে তাদের কঠোরহস্তে দমন করা হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া বলেন, আমরা একটা মানবিক রাষ্ট্র চেয়েছিলাম। আমরা শান্তি-সম্প্রীতিতে বসবাস করতে চাই। এজন্য আমি বলেছিলাম, আন্তর্জাতিক সম্প্রীতির সম্মেলন করার জন্য। যেখানে সকল ধর্ম-বর্ণ, জাতিগোষ্ঠী, নৃ-গোষ্ঠী আসবে। যাতে তারা দেখুক আমরা শান্তির মেলবন্ধনের মধ্যে অবস্থান করতে চাই।

গারো সম্প্রদায় থেকে পুরোহিত জনসং ম্রি থমাল বলেন, আমরা আলোচনা করেছি। সবাই আমরা ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু যেসব মিডিয়া অপপ্রচার চালাচ্ছে তাদের প্রতিরোধ করবো। আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি। এ সরকারকে সহযোগিতা করবো।

উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, আমাদের দেশের সংহতির শক্তি বৃদ্ধি করবো। বাইরে যতই ষড়যন্ত্র হোক না কেন, আমরা যদি এ দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামপ্রদায়িকভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকি। আরও অন্যান্য ক্ষেত্রবিশেষে ঐক্যবদ্ধ থাকি তাহলে বাইরে যতই অপপ্রচার চলুক বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। এটাই প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন।

মাহফুজ বলেন, এ দেশটা আমাদের সবার। প্রধান উপদেষ্টা শেষে বলেছেন, সমপ্রীতি দরকার। সেটার সঙ্গে ভয় যাতে জড়িয়ে না যায়; বরং নাগরিকেরা নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে, সবার মধ্যে মেলবন্ধন খুব স্বাভাবিকভাবে হয়। শুধু আমরা ঠেকায় পড়ছি তাই হিন্দু, বৌদ্ধদের ডাকতেছি তা যেন না হয়; বরং ঐক্য ও সমপ্রীতি বজায় থাকে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী যে পথে রওনা দিয়েছে এ পথে যাতে অনেক দূর যেতে পারি। বাংলাদেশের সকল দল, মত, পথ ও ধর্মের মানুষ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে দাঁড় করাতে পারি। এজন্য ধর্মীয় নেতাদের সমর্থন চেয়েছি। তারা অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন। আমরা আশাকরি বাংলাদেশ যে গতিতে আগাচ্ছে এবং বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য হচ্ছে এটা ভবিষ্যতে অনেক দূরে এগিয়ে যাবে।

তিনি বলেন, একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার যে গণহত্যা চালিয়েছে তার স্বীকৃতি ভারতকে দিতে হবে। এর স্বীকৃতি দেয়ার পর এখানে যত ধরনের নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে, আপনারা ফ্যাক্ট চেক করেছেন, তথ্য সরবরাহ করেছেন, আমরা আমাদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চটুকু করবো। তিনি বলেন, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের মিডিয়ার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। আমাদের যখনই কথা বলার সুযোগ হয়েছে আমরা বলেছি যে আপনাদের মিডিয়ার ভূমিকাকে কার্টেইল করতে হবে। এই অপতথ্য দুই দেশের বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ। আমরা এটা বলেছি। আমরা আশা করবো তাদের সুমতি হবে।

তিনি বলেন, সংলাপের মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে ও বিপক্ষে যেসব শক্তি রয়েছে তাদের একটা বার্তা সরকার দিতে চেয়েছে। সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ সমপ্রদায়গত দিক থেকে একটা পয়েন্টে আছে, এক জায়গায় মিলিত হয়েছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার যেকোনো মূল্যে, যেকোনো ষড়যন্ত্র রুখতে প্রো-অ্যাক্টিভ কাজ করবে। হঠকারী কাজ এ সরকার আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেবে না; বরং আমরা জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির দিকে আগাবো।

সামপ্রদায়িক ইস্যুতে গণমাধ্যমকে সঠিক তথ্য তুলে ধরার আহ্বান জানান মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, আমরা প্রেসনোট দিচ্ছি না; বরং বাংলাদেশের যেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে সত্যতা তুলে ধরুন। আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবো। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.