‘হাসিনাকে বলুন আমরা তার বক্তব্য পছন্দ করছি না’
হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে যা বললেন পররাষ্ট্র সচিব: জুলাই-আগস্টের গণহত্যা এবং দেশে ১৫ বছরের দুঃশাসনের জন্য শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে তাকে ফেরানোর কোনো অনুরোধ দিল্লির কাছে বাংলাদেশ করেছে কিনা? এমন প্রশ্ন ছিল সংবাদ ব্রিফিংয়ে। জবাবে সচিব বলেন, ফেরানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে এখনো কোনো অনুরোধ না আসায় তা তারা সরাসরি করেননি। এটাকে ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ আখ্যা দিয়ে সচিব বলেন, সিদ্ধান্ত যখন হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন ব্যবস্থা নেবে। এটা এফওসিতে বা যে কোনো পর্যায়ে হতে পারে। সেটা কূটনৈতিক পত্রের মাধ্যমেও হতে পারে। দিল্লিতে আমাদের যে মিশন আছে তার মাধ্যমেও অনুরোধ করা যেতে পারে।
অন্যান্য প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যা বলেছেন: বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান এবং অভ্যুত্থানের পর সংখ্যালঘুদের প্রতি কথিত বৈরী আচরণ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তিকর বয়ানের বিষয়ে ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, এ বিষয়ে ভারত সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। সচিব বলেন, আমরা জোর দিয়ে বলেছি যে বাংলাদেশে বসবাসরত সবাই স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করে আসছে। এ বিষয়ে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি ও অপপ্রচারের সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার সরজমিন বাস্তব অবস্থা দেখা ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিদেশি সাংবাদিকদেরও আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করাটা যে ঠিক হচ্ছে না, সেটা ভারতকে জানানো হয়েছে, এমনটা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা বলেছি, এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের মন্তব্য সমীচীন নয়। বাংলাদেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে এবং অন্যান্য দেশেরও একই ধরনের শ্রদ্ধাবোধ আমাদের প্রতি দেখানো উচিত। সীমান্তে হত্যার প্রসঙ্গটি আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা আমাদের অগ্রাধিকার। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি জীবন মূল্যবান। এ লক্ষ্যে ভারত সরকারকে দৃশ্যমান কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা অনুরোধ করেছি। তাছাড়া, আন্তঃসীমান্ত অপরাধ, মাদক পাচারসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যক্রম নির্মূল করতে ভারতের সহযোগিতাসহ সীমান্তসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সমাধানে ভারত সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছি।
ইতিবাচক সম্পর্কের প্রত্যয়, সংখ্যালঘু ইস্যুতে উদ্বেগ পুনর্ব্যক্ত ভারতের: ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে ও ইতিবাচকভাবে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায় তার দেশ। এজন্য দুই দেশের জনগণের স্বার্থে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে আগ্রহী। সোমবার বিকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর বিক্রম মিশ্রি বলেন, আমাদের মধ্যে অত্যন্ত খোলামেলা, গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। আমি জোর দিয়ে বলেছি যে, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ইতিবাচক, গঠনমূলক এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক চায়। আমরা সবসময়, অতীতেও দেখেছি এবং আমরা ভবিষ্যতে এই সম্পর্কটিকে একটি জনকেন্দ্রিক ও জনমুখী সম্পর্ক হিসেবে দেখতে থাকবো। যেই সম্পর্কের কেন্দ্রে থাকবে সকল মানুষের কল্যাণ। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, পরস্পরের জন্য সহায়ক এই সহযোগিতা আমাদের উভয় দেশের জনগণের স্বার্থে কেন অব্যাহত থাকবে না এটা ভাবার কারণ নেই। আমি আজ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য ভারতের আগ্রহের কথা তুলে ধরেছি। একই সময়ে, আমরা কিছু সামপ্রতিক পরিস্থিতি এবং সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছি। আমি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কিত আমাদের উদ্বেগগুলোকে জানিয়েছি। আমরা সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও কূটনৈতিক সম্পত্তির ওপর হামলার কিছু দুঃখজনক ঘটনা নিয়েও আলোচনা করেছি।
টানাপড়েনের মধ্যেই হলো দিল্লি বিদেশ সফর: দুই দেশের সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যেই সোমবার ঢাকায় এলেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব। দুই নিকট প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই অনুষ্ঠিত হলো পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠক। গত সপ্তাহে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগে আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে নজিরবিহীন হামলা করে স্থানীয় হিন্দুত্ববাদী কয়েকটি সংগঠন। এর প্রতিবাদে পরদিন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। শেষ মুহূর্তে দুই পররাষ্ট্র সচিবের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক নিয়ে কিছুটা হলেও সংশয় তৈরি হয়েছিল। কিন্তু না। শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত পজিটিভ মুডেই সফরটি হলো। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এটিই ছিল ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রথম বৈঠক। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে এটি ছিল বিক্রম মিশ্রির প্রথম বাংলাদেশ সফর।
ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে চায় দিল্লি, প্রধান উপদেষ্টাকে বিদেশ সচিব
ভারত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চায় বলে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জানিয়েছেন ঢাকায় সফররত দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। তিনি বলেন, আমরা দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে সমন্বিত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে চাই। গতকাল বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধান উপদেষ্টার মিডিয়া সেল এ তথ্য জানায়।
প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের নৃশংসতা ও দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরতন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশের জনগণ উদ্বিগ্ন কারণ তিনি সেখানে বসে নানা ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। এটা উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। প্রফেসর ইউনূস ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে শেখ হাসিনার দুর্নীতিগ্রস্ত দুঃশাসনের ইতি টেনেছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের কাজ হচ্ছে- তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। এটি নতুন বাংলাদেশ। মিশ্রি প্রধান উপদেষ্টাকে বলেন, আপনার দায়িত্ব গ্রহণের পর আপনাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রথম বিশ্বনেতা হিসেবে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আমরা আপনার সফলতা কামনা করছি। তিনি বলেন, ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রচারণা আমাদের সরকারের ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এটা ভুল ধারণা যে, ভারত বাংলাদেশে নির্দিষ্ট কোনো একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে। বরং সম্পর্ক সবার সঙ্গে রাখছে। প্রফেসর ইউনূস বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনায় ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে তার উদ্যোগে যোগ দিতে বলেন। আমরা সবার জন্য সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়তে চাই। মিশ্রি বলেন, ভারত সার্কের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে। যদিও এখানে কিছু বাধা রয়েছে। সংখ্যালঘু ইস্যুতে ড. ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার সব নাগরিকের সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বিবেচনা না করে সবার অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করছে। আমরা একটি পরিবার। আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টাকে বিক্রম মিশ্রি গত মাসের থেকে ভিসা দ্বিগুণ করার কথা জানান। বলেন, পর্যায়ক্রমে এটি বাড়ানো হবে। আমরা আমাদের সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে চাই। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে যমুনায় পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা ড. সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ও আরও জোরদার করতে আগ্রহী। বাংলাদেশে হাইকমিশনে আক্রমণের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে রিজওয়ানা হাসান বলেন, সহিংস আক্রমণের বিষয়ে আগেই বলা হয়েছে। তারা দুঃখ প্রকাশ করছে। তারা যেহেতু সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে এসেছে। তাই সেটি বলা হয়নি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রোপাগান্ডার জবাব লিখিত-মৌখিক আগেই জানিয়েছি। এগুলো বেশির ভাগই রাজনীতির অংশ। সরকার এটি ধারণ করে না বলে জানিয়েছে। তিনি বলেন, সম্পর্কের মেঘ দূর করতে হবে। পারস্পরিক স্বার্থ নিয়ে কাজ করার অনেক কিছু রয়েছে। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, সুনির্ধারিত বিষয়গুলো পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে।
No comments