এক দশকে রাশিয়ার আভিজাত্যে বড় আঘাত

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার ফলে সিরিয়ার কতোটুকু লাভ বা ক্ষতি হয়েছে, তা সামনের দিনগুলোতেই প্রমাণ হয়ে যাবে। এখন আলোচনায় আবু মোহাম্মদ আল জোলানি। কিন্তু আল কায়েদা ও আইসিলের সঙ্গে তার অতীত সম্পর্ক নিশ্চয়ই পশ্চিমাদের কাছে স্বস্তির নয়। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আসাদ পালিয়ে যাওয়ার পরই সিরিয়ায় দেদারছে হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। তারা গোলান মালভূমির বড় একটি অংশ বাফার জোন নাম দিয়ে দখল করে নিয়েছে। হাসিমুখে টেলিভিশনে এ ঘোষণা দিয়েছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বা তার দেশ একবার যে ভূখণ্ড দখল করে তা ছেড়ে দেয়ার নজির খুব কমই। ফলে আসাদ থেকে মুক্তি পেলেও সিরিয়াবাসী ইসরাইল ও তার পশ্চিমা দোসরদের কব্জা থেকে সহজে মুক্তি পাবে বলে মনে হয় না। এরই মধ্যে আলোচনায় ফিরেছে আসাদকে উৎখাতের পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বদলে যাবে। বিশেষ করে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে যে হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি, ইরান বা ইরাক লড়াই করছে- তারা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়বে। এ অবস্থা আসাদকে সমর্থনকারী রাশিয়ার জন্যও তার আভিজাত্যের প্রতি একটি বড় আঘাত বলে মনে করছেন বিবিসি’র রাশিয়া বিষয়ক সম্পাদক স্টিভ রোজেনবার্গ। তিনি বলছেন, প্রায় এক দশক ধরে বিষয়টি ছিল রাশিয়ার ‘ফায়ারপাওয়ার’, যা প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষমতায় রেখেছিল। অবশেষে দামেস্কের পতন হয়েছে। বাশার আল আসাদ পালিয়ে মস্কো গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। রাশিয়া থেকে বলা হয়েছে, সেখানে আসাদ, তার পরিবারকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হয়েছিল। এর আগে তিনি শনিবার দিবাগত রাতে পালিয়ে কোথায় চলে যান, তার কি পরিণতি হয়েছে- তা নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ার ছিল সতর্ক দৃষ্টি। রাশিয়ার একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে রাশিয়ার নিউজ এজেন্সিগুলো এবং রাষ্ট্রীয় টিভি রিপোর্টে বলেছে, মানবিক কারণে আসাদ ও তার পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছে রাশিয়া। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে ক্রেমলিনের সিরিয়া-প্রজেক্ট সবচেয়ে নাটকীয় মোড় নেয়। সিরিয়াকে, আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে মস্কো ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে।

এক বিবৃতিতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে যে, গভীর উদ্বেগের সঙ্গে সিরিয়ার নাটকীয় পটপরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি রাখছে মক্কো। আসাদ শাসকগোষ্ঠীর পতন রাশিয়ার আভিজাত্যের জন্য বা ইমেজের ওপর এক বড় রকম আঘাত। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে টিকিয়ে রাখতে সেখানে ২০১৫ সালে হাজার হাজার সেনা পাঠায় রাশিয়া। এর মধ্যদিয়ে রাশিয়া বিশ্বে নিজেকে অন্যতম শক্তিধর হিসেবে দেখাতে চেয়েছে। পশ্চিমা শক্তি এবং তাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে এটাই ছিল ভ্লাদিমির পুতিনের বড় বড় চ্যালেঞ্জ। এর বড় সফলতা দেখা যায়। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিন সিরিয়ায় অবস্থিত রাশিয়ার হমেইমিম বিমান ঘাঁটি পরিদর্শন করেন এবং ঘোষণা দেন, মিশন সম্পন্ন হয়েছে। নিয়মিত রিপোর্টে বলা হচ্ছিল, রাশিয়ার বিমান হামলায় বিপুল পরিমাণ নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় খুব আত্মবিশ্বাসী ছিল। রাশিয়ার সামরিক অভিযান প্রত্যক্ষ করার জন্য তারা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সাংবাদিকদেরকে নিয়ে যায় সিরিয়ায়। এমন এক সফরে গিয়েছিলেন সাংবাদিক স্টিভ রোজেনবার্গ। তিনি বলেন, একজন কর্মকর্তা আমাকে তখন বলেন- সিরিয়ায় দীর্ঘ সময়ের জন্য অবস্থান করছে রাশিয়া। তবে এ বিষয়টি ছিল আভিজাত্যের চেয়ে অনেক বেশি কিছু।

সামরিক সহায়তা পাওয়ার বিনিময়ে রাশিয়াকে হমেইমিমে একটি বিমান ঘাঁটি ও তারতোউসে একটি নৌঘাঁটি স্থাপনের জন্য তা রাশিয়াকে ৪৯ বছরের জন্য লিজ দেয় সিরিয়া কর্তৃপক্ষ। ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে পা রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান পেয়ে যায় রাশিয়া। আফ্রিকার ভেতরে এবং বাইরে সামরিক কন্ট্রাক্টরদের স্থানান্তরের গুরুত্বপূর্ণ প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে এই ঘাঁটি দু’টি। স্টিভ রোজেনবার্গ লিখেছেন- এখন মস্কোর ওই ঘাঁটি দু’টির কী হবে? বাশার আল আসাদ মস্কো পৌঁছেছেন এই ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি রাশিয়ার কর্মকর্তারা এটাও উল্লেখ করেছে যে, তারা সিরিয়ার সশস্ত্র বিরোধী পক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। রাষ্ট্রীয় টিভির উপস্থাপক বলেন, রাশিয়ান সামরিক ঘাঁটির নিরাপত্তা এবং সিরিয়ায় কূটনৈতিক মিশনগুলোর নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিরোধী নেতারা। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সিরিয়ায় এই ঘাঁটিগুলোকে উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। আর বলা হয়েছে, বর্তমানে এগুলোর জন্য গুরুতর কোনো হুমকি নেই।

মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার কট্টর মিত্র ছিলেন বাশার আল আসাদ। তার ওপর অসীম আস্থা রেখেছে ক্রেমলিন। রাশিয়ার কর্মকর্তারা তাকে উৎখাতের বিষয়ে কিছু চেষ্টা করেও তা মস্কোর জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। রোববার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সাপ্তাহিক খবরের সময় রাশিয়া থেকে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করা হয়। বলা হয়, বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করেনি। উপস্থাপক ইয়েভগেনি কিসেলেভ বলেন, যে কেউ দেখতে পাবেন যে, সিরিয়ার কর্তৃপক্ষের জন্য পরিস্থিতি ক্রমশ নাটকীয় থেকে আরও নাটকীয় হয়ে উঠছে। তিনি আরও বলেন, রাশিয়া সব সময়ই সিরিয়ার বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে পুনরেকত্রীকরণ প্রত্যাশা করে। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.