২০১৫: জনমনে আতঙ্ক উদ্বেগ আর জঙ্গিবাদের নতুন উত্থানের বছর by আমীর খসরু
বছরটি
শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার মধ্য দিয়ে। এর আগের বছরের ৫ই
জানুয়ারি ভোটারবিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে ওই
সহিংসতা শুরু হয়। আর বছরটি শেষ হচ্ছে প্রথমবারের মতো দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয়
সরকার ব্যবস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠান পৌর নির্বাচনকে ঘিরে উত্থাপিত নানা
অনিয়ম, আচরণবিধি লঙ্ঘন এবং ছোট-বড় নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার মধ্য দিয়ে।
বছরটি জুড়ে ছিল আগে থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক ভারসাম্যহীনতার কারণে সৃষ্ট
নানা বিপদ। আর ওই ভারসাম্যহীনতার কারণে রাজনৈতিক শূন্যতা গাঢ় হয়ে বড় সংকটের
দৃশ্যমান উপস্থিতি লক্ষ্য করা
যায়। ওই কারণে বছরটিতে জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের নতুন উত্থান ঘটে। আগের চেয়ে শক্তিমান হিসেবে আবির্ভূত হয় তারা এবং নতুন মাত্রায়। পুরো বছরটি জুড়ে রাজনৈতিক শূন্যতার যে ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে তা আগামীতে কমবে এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, ক্রমবর্ধমান গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতি ও কর্তৃত্ববাদিতার কারণে।
গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি এবং ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার বিপদটিই বিস্তারিত হয়েছে সর্বত্র- তা শাসনে হোক, রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় কিংবা মানুষের বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রেই হোক। এ কারণে গেল বছরটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতার উপরে যেমন বড় মাত্রার বাধা এসেছে, তেমনি বিরোধী দল, মত, পক্ষ ও পথ বিনাশী কার্যক্রমের অবাধ কার্যক্রম ছিল ব্যাপকমাত্রায় লক্ষ্যণীয়। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, এ সমস্ত বিষয়াদি শাসকদের মনোজগতে এবং মনের গহীন ভেতর বাসা বেঁধেছে গাঢ়তর হয়ে। জঙ্গিবাদ দমনের নামে যেখানে প্রয়োজন ছিল জাতীয় ঐক্যের, তা বাদ দিয়ে এক এবং এককের প্রচেষ্টাটিই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছে। হাত পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপরেও। ২২ দিন বন্ধ ছিল ফেসবুক। ভাইবারসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমও এ থেকে বাদ পড়েনি।
২০১৪-এর ৫ই জানুয়ারিতে বিতর্কিত এবং নজিরবিহীন নির্বাচনের মধ্যদিয়ে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা যে মানুষের নাগালের অনেক দূরে যেতে থাকে- তা আর থামানো হয়নি। যার প্রতিফলন দেখা গেছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে।
গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণে যেসব বাধা-বিঘ্নসমূহ তৈরি করা হয় তা থেকে সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতার কারণেই নতুন করে উত্থান ঘটেছে জঙ্গিবাদের। এ কথা অনেকদিন ধরে বার বার বলা হচ্ছিল, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির কারণে ভারসাম্যহীন পরিস্থিতিতে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা থেকেই জন্ম নেয় জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদ-চরমপন্থার। ২০১৫-তে চারজন ব্লগার ও একজন প্রকাশককে হত্যা, প্রকাশক-ব্লগারদের হত্যার উদ্দেশে হামলার ঘটনা ঘটে। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র-বহির্ভূত দুই শক্তিই স্বাধীন মতামত প্রকাশের উপরে বাধার সৃষ্টি করে। এছাড়া দু’জন বিদেশী নাগরিককে হত্যা করা হয়। একজন বিদেশী নাগরিকের উপর হামলাসহ শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মিছিলে হামলায় দু’জন নিহত হওয়া, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদ ও হিন্দু মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। হামলা এবং হুমকির ঘটনা ঘটে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের যাজকদের উপরে। এসব ঘটনা বাংলাদেশে একেবারেই নতুন। বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস, আল-কায়েদা ভারতীয় শাখা, আনসার আল-ইসলামের উপস্থিতির কথা ইতিপূর্বে এদেশে আর শোনা যায়নি। কিন্তু সরকার বরাবরের মতোই এসব ক্ষেত্রেও উল্টো পথ বেছে নিয়েছে। সবকিছুকে না বলা এবং অস্বীকারের সংস্কৃতি আরও জোরদার হয়েছে এ বছরটিতে। আইএস-এর উপস্থিতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন- ‘আইএস’-এর উপস্থিতি আছে এমনটা বললে তারা ‘হামলে’ পড়তে পারে’। এ কথার মধ্যদিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কথাটিই বললেন। পরে অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, এ পর্যন্ত যতো সব জঙ্গি ঘটনা ঘটেছে তা সবই আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। এ কথাগুলোর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চক্রান্ত হচ্ছে তাও প্রথমবার শোনা গেল।
একদিকে, জঙ্গিবাদের নতুন উত্থান অন্যদিকে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে সামগ্রিকভাবে একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যদিয়েই কেটেছে বছরটি। আপাত: শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে বলে বলা হলেও পুরো সমাজের অন্তর্গত অবস্থাটি ছিল ভিন্ন। ভেতরে রক্তক্ষরণ রেখে বাইরে দৃশ্যমান শান্তির অবস্থাই ছিল সর্বত্র।
এতে জন্ম নিয়েছে নানা সংকট। রাজনৈতিক সংকট থেকে অর্থনীতি, বাদ যায়নি সাধারণ মানুষও। এ বছরটিতে দলে দলে মানুষ দেশান্তরী হতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে পড়েছেন সাগরে, থাইল্যান্ডের গহীন জঙ্গলে, মালয়েশিয়ার বিরানভূমিতে। এটি অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার নমুনা। আর এই অস্থিতিশীলতার কারণে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আরও কমেছে। বেড়েছে জনদুর্ভোগ। সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে সামাজিক বৈষম্য। আবার উল্টো পথে অর্থনৈতিক খাতের নৈরাজ্যও বজায় ছিল। ব্যাংক থেকে টাকা লোপাট কিংবা দুর্নীতির দায়ে অভিযোগ উঠলেও তা অচিরেই হাওয়ায় মিলিয়ে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে ক্ষমতা আর বিত্তশালীদের পক্ষ নিয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও এই দুর্ভাগা দেশে তা কমেনি।
বাংলাদেশের মতো শেকড়ে প্রোথিত গণতন্ত্রপ্রিয় ও মনোভাবাপন্ন জনমানুষের দেশে প্রথমবার শুনতে হয়েছে ‘অল্প-স্বল্প গণতন্ত্র এবং বেশি উন্নয়নে’র স্লোগান। কিন্তু গণতন্ত্রবিহীন উন্নয়ন যে আমাদের মতো দেশে সম্ভব নয়- সে কথাটিও শাসকরা ভুলিয়ে দিতে চেয়েছেন। এটাও কর্তৃত্ববাদিতার কারণে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার উদাহরণ দেয়া হয়েছে বার বার। কিন্তু সে কথাটি বলা হয়নি যে, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় গণতন্ত্রের অভাব থাকলেও ওই সব দেশে প্রশাসনে দলীয়করণ নেই, দলের নেতা-কর্মীরা রাজত্ব করে না, দুর্নীতি আর অনিয়ম হলে কঠিন শাস্তি। এটাও বলা হয়নি যে, সেখানে আইনের শাসন আছে, আইনকে শাসন করা হয় না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি সেখানে নেই।
এতো সবের মধ্যে ন্যায্যতাবিহীন, বৈষম্যপূর্ণ বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ড মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার প্রচারণায় সাধারণ মানুষকে শুনতে হয়েছে জয়গান আর জয়ধ্বনি।
২০১৫-র সামগ্রিক পরিস্থিতিটি ছিল এমন যে, নানাবিধ সন্ত্রাস সমাজকে গ্রাস করেছে। এই সন্ত্রাসের হাত থেকে নারীরাও রেহাই পাননি। বেড়ে গেছে যৌন সন্ত্রাস। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে এতো বড় যৌন সন্ত্রাসের ঘটনা বেমালুম চেপে যাওয়ার ইতিহাস আর নেই। এখানে বলতেই হবে, সন্ত্রাসীদের যেহেতু দলীয় পরিচয় আছে তাই কখনোই তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। আগেও হয়নি। এটা টেন্ডারবাজি থেকে হল দখল, শিক্ষকদের মারধর আর যৌন সন্ত্রাস যাই হোক না কেন।
দলীয়করণ প্রশাসনসহ সর্বত্র বিস্তৃত হয়েছে। সার্বিকভাবে ক্ষমতাশ্রয়ী, ক্ষমতাবান ও শক্তিমান একটি শ্রেণির উত্থান ঘটেছে বছরটিতে। সামগ্রিকভাবে কর্তৃত্বপরায়ণতার সৃষ্টির পথে বেড়েছে গুম, অপহরণ, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, কথিত গণপিটুনিসহ নির্যাতন-নিপীড়নের নানা পন্থা। মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশে-বিদেশে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা চরমে উঠলেও না বলার সংস্কৃতিটি ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বছর জুড়েই জারি ছিল।
২০১৫-তে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতেও কোনো স্থিরতা ছিল না। এরও কারণ গণতন্ত্রহীনতার কারণে বহির্বিশ্বে যে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে তার দাওয়াই খোজার কারণে। পশ্চিমি দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক তেমন ভালো যায়নি। ভারতের সাথে সম্পর্কের মাত্রাটি ছিল ভিন্ন। পশ্চিমি দুনিয়ার বিকল্প হিসেবে চীন-রাশিয়াকে দিয়ে স্থান দখলের চেষ্টা করা হয়।
সব মিলিয়ে ২০১৫ ছিল বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্রহীনতা আরও প্রকট হওয়ার কারণে সৃষ্ট নানাবিধ অনিবার্য সমস্যা ও সংকটের বছর। আর এ কারণে আইনের শাসনের অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতির উত্থানের সাথে সাথে জনমনে জন্ম নিয়েছে অধিকতর হতাশা, উদ্বেগ, আতঙ্ক আর শঙ্কা। মানুষ আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন তার বর্তমান নিয়ে এবং ভবিষ্যৎ চিন্তা করে।
এ কথাটি মনে রাখতে হবে, একটি বছরের হিসাব-নিকাশ শুধু ওই বছরটির ঘটনাবলীর নিরিখেই বিচার-বিশ্লেষণ করা যায় না। বছরটিকে বিচার করতে হলে, এর হিসাব-নিকাশ মিলাতে হলে অতীতকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক অতীত। গণতন্ত্রবিহীনতার কারণে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, সে প্রক্রিয়াটি এ বছরই শুরু হয়েছে তা নয়, এটি অনেকদিনের সংকটের অনিবার্য পরিণতি। বিদ্যমান পরিস্থিতি জারি থাকলে আগামী বছরটিতেও কোনো সুসংবাদ থাকবে কিনা তা বলা এখনই সম্ভব নয়। তবে আগামী বছরটি সবার জন্য শুভ হোক, প্রতিটি সকাল হোক প্রত্যাশিত আনন্দের। আমীন।
যায়। ওই কারণে বছরটিতে জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের নতুন উত্থান ঘটে। আগের চেয়ে শক্তিমান হিসেবে আবির্ভূত হয় তারা এবং নতুন মাত্রায়। পুরো বছরটি জুড়ে রাজনৈতিক শূন্যতার যে ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে তা আগামীতে কমবে এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, ক্রমবর্ধমান গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতি ও কর্তৃত্ববাদিতার কারণে।
গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি এবং ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার বিপদটিই বিস্তারিত হয়েছে সর্বত্র- তা শাসনে হোক, রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় কিংবা মানুষের বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রেই হোক। এ কারণে গেল বছরটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতার উপরে যেমন বড় মাত্রার বাধা এসেছে, তেমনি বিরোধী দল, মত, পক্ষ ও পথ বিনাশী কার্যক্রমের অবাধ কার্যক্রম ছিল ব্যাপকমাত্রায় লক্ষ্যণীয়। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, এ সমস্ত বিষয়াদি শাসকদের মনোজগতে এবং মনের গহীন ভেতর বাসা বেঁধেছে গাঢ়তর হয়ে। জঙ্গিবাদ দমনের নামে যেখানে প্রয়োজন ছিল জাতীয় ঐক্যের, তা বাদ দিয়ে এক এবং এককের প্রচেষ্টাটিই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছে। হাত পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপরেও। ২২ দিন বন্ধ ছিল ফেসবুক। ভাইবারসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমও এ থেকে বাদ পড়েনি।
২০১৪-এর ৫ই জানুয়ারিতে বিতর্কিত এবং নজিরবিহীন নির্বাচনের মধ্যদিয়ে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা যে মানুষের নাগালের অনেক দূরে যেতে থাকে- তা আর থামানো হয়নি। যার প্রতিফলন দেখা গেছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে।
গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণে যেসব বাধা-বিঘ্নসমূহ তৈরি করা হয় তা থেকে সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতার কারণেই নতুন করে উত্থান ঘটেছে জঙ্গিবাদের। এ কথা অনেকদিন ধরে বার বার বলা হচ্ছিল, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির কারণে ভারসাম্যহীন পরিস্থিতিতে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা থেকেই জন্ম নেয় জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদ-চরমপন্থার। ২০১৫-তে চারজন ব্লগার ও একজন প্রকাশককে হত্যা, প্রকাশক-ব্লগারদের হত্যার উদ্দেশে হামলার ঘটনা ঘটে। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র-বহির্ভূত দুই শক্তিই স্বাধীন মতামত প্রকাশের উপরে বাধার সৃষ্টি করে। এছাড়া দু’জন বিদেশী নাগরিককে হত্যা করা হয়। একজন বিদেশী নাগরিকের উপর হামলাসহ শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মিছিলে হামলায় দু’জন নিহত হওয়া, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদ ও হিন্দু মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। হামলা এবং হুমকির ঘটনা ঘটে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের যাজকদের উপরে। এসব ঘটনা বাংলাদেশে একেবারেই নতুন। বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস, আল-কায়েদা ভারতীয় শাখা, আনসার আল-ইসলামের উপস্থিতির কথা ইতিপূর্বে এদেশে আর শোনা যায়নি। কিন্তু সরকার বরাবরের মতোই এসব ক্ষেত্রেও উল্টো পথ বেছে নিয়েছে। সবকিছুকে না বলা এবং অস্বীকারের সংস্কৃতি আরও জোরদার হয়েছে এ বছরটিতে। আইএস-এর উপস্থিতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন- ‘আইএস’-এর উপস্থিতি আছে এমনটা বললে তারা ‘হামলে’ পড়তে পারে’। এ কথার মধ্যদিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কথাটিই বললেন। পরে অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, এ পর্যন্ত যতো সব জঙ্গি ঘটনা ঘটেছে তা সবই আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। এ কথাগুলোর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চক্রান্ত হচ্ছে তাও প্রথমবার শোনা গেল।
একদিকে, জঙ্গিবাদের নতুন উত্থান অন্যদিকে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে সামগ্রিকভাবে একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যদিয়েই কেটেছে বছরটি। আপাত: শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে বলে বলা হলেও পুরো সমাজের অন্তর্গত অবস্থাটি ছিল ভিন্ন। ভেতরে রক্তক্ষরণ রেখে বাইরে দৃশ্যমান শান্তির অবস্থাই ছিল সর্বত্র।
এতে জন্ম নিয়েছে নানা সংকট। রাজনৈতিক সংকট থেকে অর্থনীতি, বাদ যায়নি সাধারণ মানুষও। এ বছরটিতে দলে দলে মানুষ দেশান্তরী হতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে পড়েছেন সাগরে, থাইল্যান্ডের গহীন জঙ্গলে, মালয়েশিয়ার বিরানভূমিতে। এটি অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার নমুনা। আর এই অস্থিতিশীলতার কারণে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আরও কমেছে। বেড়েছে জনদুর্ভোগ। সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে সামাজিক বৈষম্য। আবার উল্টো পথে অর্থনৈতিক খাতের নৈরাজ্যও বজায় ছিল। ব্যাংক থেকে টাকা লোপাট কিংবা দুর্নীতির দায়ে অভিযোগ উঠলেও তা অচিরেই হাওয়ায় মিলিয়ে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে ক্ষমতা আর বিত্তশালীদের পক্ষ নিয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও এই দুর্ভাগা দেশে তা কমেনি।
বাংলাদেশের মতো শেকড়ে প্রোথিত গণতন্ত্রপ্রিয় ও মনোভাবাপন্ন জনমানুষের দেশে প্রথমবার শুনতে হয়েছে ‘অল্প-স্বল্প গণতন্ত্র এবং বেশি উন্নয়নে’র স্লোগান। কিন্তু গণতন্ত্রবিহীন উন্নয়ন যে আমাদের মতো দেশে সম্ভব নয়- সে কথাটিও শাসকরা ভুলিয়ে দিতে চেয়েছেন। এটাও কর্তৃত্ববাদিতার কারণে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার উদাহরণ দেয়া হয়েছে বার বার। কিন্তু সে কথাটি বলা হয়নি যে, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় গণতন্ত্রের অভাব থাকলেও ওই সব দেশে প্রশাসনে দলীয়করণ নেই, দলের নেতা-কর্মীরা রাজত্ব করে না, দুর্নীতি আর অনিয়ম হলে কঠিন শাস্তি। এটাও বলা হয়নি যে, সেখানে আইনের শাসন আছে, আইনকে শাসন করা হয় না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি সেখানে নেই।
এতো সবের মধ্যে ন্যায্যতাবিহীন, বৈষম্যপূর্ণ বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ড মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার প্রচারণায় সাধারণ মানুষকে শুনতে হয়েছে জয়গান আর জয়ধ্বনি।
২০১৫-র সামগ্রিক পরিস্থিতিটি ছিল এমন যে, নানাবিধ সন্ত্রাস সমাজকে গ্রাস করেছে। এই সন্ত্রাসের হাত থেকে নারীরাও রেহাই পাননি। বেড়ে গেছে যৌন সন্ত্রাস। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে এতো বড় যৌন সন্ত্রাসের ঘটনা বেমালুম চেপে যাওয়ার ইতিহাস আর নেই। এখানে বলতেই হবে, সন্ত্রাসীদের যেহেতু দলীয় পরিচয় আছে তাই কখনোই তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। আগেও হয়নি। এটা টেন্ডারবাজি থেকে হল দখল, শিক্ষকদের মারধর আর যৌন সন্ত্রাস যাই হোক না কেন।
দলীয়করণ প্রশাসনসহ সর্বত্র বিস্তৃত হয়েছে। সার্বিকভাবে ক্ষমতাশ্রয়ী, ক্ষমতাবান ও শক্তিমান একটি শ্রেণির উত্থান ঘটেছে বছরটিতে। সামগ্রিকভাবে কর্তৃত্বপরায়ণতার সৃষ্টির পথে বেড়েছে গুম, অপহরণ, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, কথিত গণপিটুনিসহ নির্যাতন-নিপীড়নের নানা পন্থা। মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশে-বিদেশে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা চরমে উঠলেও না বলার সংস্কৃতিটি ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বছর জুড়েই জারি ছিল।
২০১৫-তে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতেও কোনো স্থিরতা ছিল না। এরও কারণ গণতন্ত্রহীনতার কারণে বহির্বিশ্বে যে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে তার দাওয়াই খোজার কারণে। পশ্চিমি দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক তেমন ভালো যায়নি। ভারতের সাথে সম্পর্কের মাত্রাটি ছিল ভিন্ন। পশ্চিমি দুনিয়ার বিকল্প হিসেবে চীন-রাশিয়াকে দিয়ে স্থান দখলের চেষ্টা করা হয়।
সব মিলিয়ে ২০১৫ ছিল বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্রহীনতা আরও প্রকট হওয়ার কারণে সৃষ্ট নানাবিধ অনিবার্য সমস্যা ও সংকটের বছর। আর এ কারণে আইনের শাসনের অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতির উত্থানের সাথে সাথে জনমনে জন্ম নিয়েছে অধিকতর হতাশা, উদ্বেগ, আতঙ্ক আর শঙ্কা। মানুষ আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন তার বর্তমান নিয়ে এবং ভবিষ্যৎ চিন্তা করে।
এ কথাটি মনে রাখতে হবে, একটি বছরের হিসাব-নিকাশ শুধু ওই বছরটির ঘটনাবলীর নিরিখেই বিচার-বিশ্লেষণ করা যায় না। বছরটিকে বিচার করতে হলে, এর হিসাব-নিকাশ মিলাতে হলে অতীতকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক অতীত। গণতন্ত্রবিহীনতার কারণে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, সে প্রক্রিয়াটি এ বছরই শুরু হয়েছে তা নয়, এটি অনেকদিনের সংকটের অনিবার্য পরিণতি। বিদ্যমান পরিস্থিতি জারি থাকলে আগামী বছরটিতেও কোনো সুসংবাদ থাকবে কিনা তা বলা এখনই সম্ভব নয়। তবে আগামী বছরটি সবার জন্য শুভ হোক, প্রতিটি সকাল হোক প্রত্যাশিত আনন্দের। আমীন।
No comments